তৃনা হাসিমুখে বাবাকে বললো, ‘বাবা, আজ কী আমার রুমে ঘুমাচ্ছ ?’
আজ রাতে বাবা তার রুমে ঘুমাবে নাকি আম্মুর সাথে বেড রুমে ঘুমাবে তা নিয়ে তৃনা আসলে খানিকটা দ্বিধায় পড়েছে। আম্মু বাবার সাথে রাতে ঝগড়া করলে বাবা সাধারণত তার রুমেই ঘুমায়। এই কিছুক্ষন আগে আম্মুর সাথে বাবার এক চোট হয়ে গেল।

তৃনা তার বাবা – মায়ের ঝগড়ার একটি প্যাটার্ন খেয়াল করেছে। প্রথমটি হচ্ছে “এ” ক্যাটাগরির ঝগড়া বা ভদ্র ঝগড়া । এক্ষেত্রে, তার আম্মু বাবার সাথে বইয়ের ভাষায় কথা বলে, অর্থাৎ করেছো, খেয়েছো এই টাইপের সম্বোধন। ঝগড়ার বিষয়বস্তু হয় অতি সাধারণ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, হয়তো বাবা রান্না করেছেন কিন্তু রান্না ঘর নোংরা করে রেখেছেন। সিঙ্কের ট্যাপের হাতলে, ক্যাবিনেটের, ফ্রিজের হ্যান্ডেলে মরিচের গুঁড়া, মসলা মেখে ফেলেছেন ইত্যাদি। তৃনা খেয়াল করেছে এই ক্যাটাগরির ঝগড়া হালকা মাপের হয়, বাবাকে মৌখিক ওয়ার্নিং দেয়া হয় এবং হালকা মাপের কথা শোনানো হয়: ‘বেকার মানুষ ঘরে একটু কাজ / টাজ করবে তাও গুছিয়ে করতে পারো না ? রান্না ঘরে একেবারে বস্তির মতো যা তা অবস্থা করে রেখেছো, এভাবে কেউ রান্না করে?’ এসব ক্ষেত্রে বাবা কোনো উচ্চবাচ্য করেন না, আম্মুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন। সেই হাসির মধ্যে মেশানো থাকে অনুশোচনা, লজ্জা আবার একই সঙ্গে আম্মুর সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা। বাবার জন্যে তখন তৃনার বেশ মায়া হয়।

আম্মুদের ‘বি ক্যাটেগরির ঝগড়া হচ্ছে অনেকটা এরকম : যেমন ধরা যাক, বাবাকে বাজারের লিস্ট দিয়ে বাজারে পাঠানো হলো , বাবা ভুলে এমন কিছু কিছু আইটেম ছেড়ে এলেন যা আম্মুর চোখে ভীষণ দরকারি । দেখা গেলো তিনি গরুর গোস্ত কিনি এনেছেন কিন্তু আদা কেনা হয়নি। পায়েসের জন্য আতপ চাল কেনার কথা, বাবা কিনে এনেছেন সেদ্ধ চাল, অথবা বাজারের লিষ্টে সব কেনা হয়েছে কিন্তু লবন কেনা হয়নি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আম্মু প্রচন্ড রেগে যান। আম্মুর মুখ লালচে হয়ে ওঠে। অনেক সময়ে বাজারের ব্যাগ ছুড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বাবাকে বলে, ‘শিগ্রী আবার বাজারে যাও।’ তখন বাবাকে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হন্তদন্ত হয়ে আবার বাজারে যেতে হয়।

এ বাসায় ভয়ঙ্কর টাইপের ঝগড়া হচ্ছে “সি” ক্যাটেগরির ঝগড়া। এসব ঝগড়ায় তুই -তোকারি-তে কথাবার্তা চলে। মাঝে মাজে অশ্লীল ভাষা ব্যাবহৃত হয়। এমনকি চিৎকার ও চেঁচামেচির এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়, তৃনা তখন নিজের ঘরে ঢুকে কাঁদতে থাকে। তবে, আজকের ঝগড়াকে এ ক্যাটেগরি না বি ক্যাটেগরিতে ফেলবে তৃনা ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে । কারণ, ঝগড়ার এক পর্যায়ে বাবাকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখা গিয়েছে।

তৃনা যে ব্যাপারটি নিয়ে ধাঁধায় পড়েছে সেটির বিস্তারিত বর্ণনা শোনা যাক । টুটুলের এক ফুপু রেবেকা (টুটুলের বাবার চাচাতো বোন) শ্যামলীতে থাকেন। রেবেকার স্বামী ডক্টর হাবিবুর রহমান সাহেব এপ্লাইড ক্যেমেস্ট্রিতে জার্মানি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি নিয়ে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার হিসাবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন অফিসে চাকরি করেন। গবেষণা এবং ধর্মকর্ম নিয়েই হাবিবুর রহমান সাহেবের সময় কাটে। ওনার স্ত্রী অর্থাৎ টুটুলের রেবেকা ফুপু অসম্ভব বড়োলোকের মেয়ে। মাঝে মাঝে বড়োলোকের রূপবতী কন্যাদের আচরণ অদ্ভুত ধরণের হয়ে থাকে। সময় সময় তিনি এমন সব কান্ড করেন যা অন্য মানুষকে বিব্রত করে । যেমন, গতকাল রেবেকা ড্রাইভার দিয়ে টুটুলের বাসায় ব্যাগভর্তি মুরগির কলিজা, গীলা, মাথা, চামড়া পাঠিয়েছেন। সঙ্গে একটি চিরকুটে লিখেছেন:

টুটুল, আমাদের বাসায় কোলেস্টরল জনিত কারণে আমরা এসব খাই না, আমি যত্ন করে ফ্রিজে এসব জমা করে তোমাদের পাঠালাম। তোমার বউ যেন আবার কিছু মনে টোনে না করে। ভুনা ভুনা করে এসব রান্না করে সকালে পড়াটা দিয়ে খাবে, ভালো লাগবে। ইতি – রেবেকা ফুপু ; পুনশ্চ: তোমার চাকরি কিছু হলো নাকি এখনো সংসারে হাউজ হাজব্যান্ড হিসাবে আছো?

রেবেকা ফুপুর এই চিঠি টুটুলের হাতে সরাসরি পৌঁছায়নি। টুটুলের কাছে চিঠিটি এসেছে স্ত্রী ত্রপার হাত ঘুরে। সমস্যাটি  হয়েছে এই যায়গায়। ত্রপা মাছের মতো স্থির চোখে টুটুলের দিকে তাকিয়ে চিঠি এবং সেই ব্যাগ টুটুলের হাতে দিয়ে বললো, ‘এসব কী ধরণের অপমান ? বোরো লোক হয়েছেন দেখে আত্মীয়স্বজনদের অপমান করতে হবে ? এক্ষুনি ওনাকে এসব ফিরিয়ে দিয়ে আসো। যেসব জিনিস নিজেরা খেতে পারেন না উনি কী করে ভাবলেন আমরা এসব খাবো ? উনি কী আমাদের রাস্তার ফকির মিসকিন ভেবেছে? তুমি না হয় বেকার, গায়ের চামড়া গুই সাপের মতো, আমি বিদেশী অফিসে চাকরি করি, আমারতো দুটা মান-সম্মান আছে , না কী ?

টুটুল প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। পরে, ঘটনাটি বুঝতে পেরে থতমত খেয়ে পরিস্থিতির সম্ভাব্য ভয়াবহতা আন্দাজ করে দ্রুত ব্যাগটি নিয়ে সটকে পড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কথা বাড়ালে ফলাফল শুভ হয় না। মহিলাদের আত্মসম্ভ্রম বোধ মারাত্মক। কান্না -কাটি পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই এসব ক্ষেত্রে কোনোরকম তর্কে না যেয়ে সবকিছু মেনে নিতে হয়।

রেবেকা ফুপু এই কাজ যে আজকেই প্রথম করেছে তা না, এর আগেও কয়েকবার করেছিলেন। সেক্ষেত্রে ত্রপা বাসায় ছিল না। আজ ত্রপা বাসায় থাকায় বিপত্তিটি ঘটেছে। টুটুল সেই মুরগির মাথা, চামড়া, গীলা ও কলিজার ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে রেবেকা ফুপুর বাড়ির উল্টা দিকে রওনা দিলো। উদ্দেশ্য রাস্তায় ফকির মিসকিন পেলে ব্যগটি দিয়ে দিবে। কিন্তু, দিন অনেক বদলিয়েছে। আধুনিক বাংলাদেশে রাস্তাঘাটে বিশেষকরে ঢাকা শহরে ফকির মিসকিন দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

টুটুল একবার চিন্তা করলো ফার্মগেটের দিকে যাবে, পরে মত পাল্টে একটি রেস্টুরেন্টে যেয়ে বললো, ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না, আমার বাসায় আমরা তো এসব মেডিক্যাল জনিত কারণে খাই না, এখানে মুরগির গীলা কলিজা, মাথা ইত্যাদি আছে আপনি কাস্টমারের জন্য রান্না করতে পারেন । হোটেলের ম্যানেজের মুনির হোসেন তার জীবনে এরকম কোন ও ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। পাশে কেউ সিগারেট ধরিয়ে ভদ্রতা করে যখন সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ভাই সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে ? তখন হাত বাড়িয়ে যেমন ভঙ্গিতে মানুষ বাড়িয়ে দেয়া সেই সিগারেট নেয় অনেকটা সেরকম ভঙ্গিতে মুনির হোসেন ব্যাগটি হাতে নিয়ে টুটুলের দিকে দুটি একশো টাকার নোট বের করে দিতেই টুটুল বললো, ‘না না আমাকে টাকা দিতে হবে না’ বলেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। মুনির হোসেন অবাক হয়ে অদ্ভুত এই লোকের গমন পথের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হোটেলের হেড বাবুর্চি হেলাল মুন্সিকে টুটুলের দেয়া সেই ব্যগটি হস্তান্তর করে বললো, ‘কাল সকালের জন্য লটপটি রান্না করো মুন্সি।’ এভাবেই টুটুলের রেবেকা ফুপুর সেই মুরগির মাংসের উচ্ছিষ্ট অংশাবলীর নাটকের সমাপ্তি হলো। শুধু টুটুলকে বাসায় ফেরার পথে মনে মনে আফসোস করতে দেখা গেল, ‘ আহা! ম্যানেজারের থেকে একশো টাকার নোট দুটি সে নিতেই পারতো, পরিচিত কেউ তো আর আশেপাশে ছিল না।

টুটুল বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেতেই তৃনার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তৃনা জানতে চাচ্ছে আজ রাতে সে তৃনার রুমে ঘুমাবে কি না। টুটুল অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়ে-কে বললো, ‘ না মা, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। টুটুল ভাবলো, ছোটোখাটো ঝামেলা পুষিয়ে রাখতে নেই। বাসার আলাদা ঘরে রাত কাটানের চেয়ে নিজ স্ত্রীর সাথেই রাত কাটানো অনেক ভালো অপশন । ঝামেলা মেটানের সুযোগ থাকে।

সারা দেশে তীব্র তাপদাহ চলছে। অনলাইন ভিত্তিক একটি পত্রিকায় খবর ছেপেছে , “তীব্র গরমে ‘হিট স্ট্রোক’ একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যা উল্লেখ করে দুর্যোগ ফোরাম সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বরাতে জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ‘হিট স্ট্রোকে’ মারা গেছেন ২০ জন। তাদের মধ্যে একজন শিশু, পাঁচজন নারী এবং ১৪ জন পুরুষ। তাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।” (https://www.banglanews24.com/health/news/bd/1130608.deta )

টুটুল- ত্রপা’রা ঠিক নিম্ন আয়ের ক্যাটেগরিতে না পড়লেও বাসায় এ সি রাখার সামর্থ্য নেই। এর মাঝে তাদের ফ্ল্যাটটি টপ ফ্লোরে। ঢাকা শহরে টপ ফ্লোরে থাকার যন্ত্রনা যে কত ভয়াবহ তা শুধু ভুক্তভুগীরাই জানেন। তীব্র গরম মানুষের শরীর ও মনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। আজ এই জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমের রাতে গরম ছাড়াও আরেকটি ব্যাপারে ত্রপার ঘুম আসছে না। বিছানায় ছটফট করছে। আজ টুটুলের ফুপু তাদের সাথে অপমানসুলভ ঘটনা ঘটিয়েছে।

পাশেই টুটুল সুখী মানুষের মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকার শব্দ বর্ষা কালের কোলা ব্যাঙের ডাককেও হার মানাবে । মানুষটার জন্য ত্রপার খানিকটা মায়া হলো। কেউ অপমান করলেও মানুষটা গায়ে মাখে না অথবা সেই সুক্ষ অপমান ধরতেই পারে না। একবার ঈদের দিন ত্রপা’রা এই রেবেকা ফুপুর বাসায় ঈদের নামাজ শেষে বেড়াতে গিয়েছিলো। ফুপা বাসায় ছিলেন না। ফুপু তাদেরকে বিস্কুট আর চা দিয়ে আপ্যায়ন করে বিদায় করলেন।

ত্রপা কোথায় যেন পড়েছিল, ফ্যানের কাছে ভেজা কাপড়, ঠান্ডা বস্তু অথবা ঠান্ডা পানির বোতল রাখলে ঠান্ডা বাতাস ছড়ায় এবং ঘর ঠান্ডা থাকে। ত্রপা বিছানা থেকে উঠে ডিপ ফ্রিজ খুলে কিছু আইসের টুকরা গামলায় নিয়ে আরেকটি চেয়ার ফ্যানের পেছনে টেনে এনে সেই চেয়ারের ওপর গামলাটি রাখলো। পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখা গ্লাসে আরও কয়েক টুকরা আইসের টুকরা ফেলে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে আবারো ঘুমোতো গেল। গরমের বিপক্ষে এই আইস থেরাপিতে সম্ভবত কাজ হয়েছে । ত্রপা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো এবং এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখলো।

ত্রপা স্বপ্নে দেখলো বগুড়া ভি এম স্কুলে সে ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। আজ চলছে অংক পরীক্ষা। ত্রপা প্রতি অংক চেষ্টা করছে কিন্তু একটিও হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বড়ো ভাইয়ার কথামতো ত্রপা প্রশ্নের উল্টাপিঠে সকল প্রশ্নের উত্তর লিখে এনেছে। ত্রপার ধারণা, ভাইয়া উত্তরগুলো মিলিয়ে দেখে যখন দেখবে একটিও হয়নি, তখন তার মাথার চুল সত্যিই ছিঁড়ে ফেলবেন। দুরু দুরু আশংকা নিয়ে ত্রপা বাসায় এসে দেখলো উঠোনে বেশ জটলা। সুইডেন থেকে মিনু খালা এসেছেন। মিনু খালা সুটকেস খুলে একেকজনকে নতুন নতুন জামাকাপড়, খেলনা ইত্যাদি দিচ্ছেন, আর সবার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। ত্রপাকে দেখে মিনু খালা একটি ব্যাবহার করা সালোয়ার কামিজ দিয়ে বললেন, ‘আমার মেয়ে এটি বেশিদিন গায়ে দেয়নি, তোকে কিন্তু এটা বেশ মানাবে। যা, চট করে পরে আয় তো। পুরাতন কাপড় পেয়ে ত্রপার মন কিছুটা খারাপ হলেও খালা কে খুশি করার জন্য কামিজ পড়তে যেয়ে দেখলো জামাটির বগলের দিকে খানিকটা অংশ ছেঁড়া। ত্রপা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর তখনি টুটুলের ধাক্কায় ত্রপার ঘুম ভেঙে গেল।

গরমের দিনে শেষ রাতের দিকে বায়ুমণ্ডলে কিছুটা পরিবর্তণ দেখা যায়। সারাদিনের সূর্যের ত্যাজি রোদের শোষিত তাপশক্তি ইলেক্ট্রম্যগনেটিক ওয়েভের মাধ্যমে বিকিরণ ঘটিয়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে দিয়ে ধরণীকে খানিকটা সুশীতল করে থাকে। আজ এই শেষ রাতে বেডরুমের জানালা দিয়ে সেই সুশীতল বায়ুমণ্ডলের হালকা ঠান্ডা কিছু মুক্ত বাতাস টুটল ত্রপাদের বেড অবধি পৌছিয়ে পরিশ্রান্ত ত্রপা টুটুলদের আবেশিত করলো। বাইরের শুক্লপক্ষের থালার মতো চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে ওদেরকে আরও মোহাচ্ছন্ন করে রাখলো। গল্প ও ভালোবাসায় ওরা ঘুমহীন একরাত কাটালো।

ভোরের আলো ফোটার আগে টুটুলের চওড়া লোমশ বুকে মাথা রেখে আদুরী গলায় ত্রপা বললো, ‘টুটুল, মাঝে মাঝে বাইরের লোকজন এমনকি সময় সময় আমিও তোমাকে হাউজ হাজবেন্ড বলে উপহাস করি। আমি জানি, তুমি একদিন ঠিকই অনেক ভালো চাকরি পাবে, আমার চাকরি, তোমার চাকরি, সব মিলে আমাদের তখন অনেক অনেক টাকা পয়সা হবে। আমরা এই টপ ফ্লোরের ফ্লাট ছেড়ে দিয়ে শহর থেকে কিছুটা দূরে একতালা একটি বাসা বানাবো। বাসার সাথে লাগোয়া লম্বা বারান্দায় টিনের শেড থাকবে। সেই বারান্দায় দুজনে বসে বৃষ্টি দেখবো, টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ শুনবো। বাসার সামনে অনেক জায়গা থাকবে। সেখানে শিউলি গাছ, কদম গাছ লাগাবো । নানান জাতের গোলাপের বাগান করবো। টুটুল, আমাকে একটি জিনিস প্রমিজ করবে ? আমরা যত বড়োলোকই হই না কেন, একটা জিনিস সবসময় মেনে চলবো, আমরা কখনো কোনো গরিব আত্মীয় স্বজনকে অপমান করবো না, মনে কষ্ট পাবে এমন কাজ করবো না ।

—–

পুনশ্চ: আজ থেকে এই ধারাবাহিক অফিসিয়ালি শেষ করলেও , আমি আমার নিজের ডায়রীতে লিখতে থাকবো। তাই সঙ্গত কারণেই শিরোনামে শুধু পর্ব ৫ লিখেছি, শেষ পর্ব লেখিনি । এ পর্যন্ত এই পাঁচটি পর্বে যেসব বিষয়াবলী আমি ফোকাস করে চেষ্টা করেছি,
পর্ব ১: ডাল রান্না করার পরে চুলা অফ করা নিয়ে আতঙ্ক, স্ত্রীর বন্ধু /কলিগদের দাওয়াত পার্টিতে স্বামীর বিড়ম্বনা
পর্ব ২ : হাউজ হাজব্যান্ড টুটুলের সংসারে অতিথি বন্ধুর উপস্থিতি
পর্ব ৩: বন্ধু ও বন্ধুপত্নী’র আগমনে স্বামী স্ত্রীতে কুৎসিত ঝগড়া
পর্ব ৪: স্ত্রীর শাড়ির কুচি ঠিক করা, ছোট্ট বাচ্চাকে স্ট্রোলারে রেখে বাবার বাথরুমে যাওয়া
পর্ব ৫: বাবা মায়ের বিভিন্ন ক্যাটেগরির ঝগড়া নিয়ে গ্রেড সিক্স এর ছাত্রী তৃনার উপলদ্ধি, দরিদ্র আত্মীয়স্বজনদের অবহেলা/অপমান করা ইত্যাদি
আমার এই ধারাবাহিক আজ অফিসিয়ালি শেষ হলেও এভাবে প্রাত্যহিক জীবনে সংসারের প্র্যাকটিক্যাল ঘটনাপ্রবাহ  আরও ক্রমাগত লিখতে খাবো, লিখতে থাকবো। লিখে লিখে মোটামুটি দশ/এগারো ফর্মা হলে, আরও ঘষা মাজা করে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের অবয়বে প্রকাশ করার চেষ্টা করবো, যেখানে আমাদের, আপনাদের পরিবারের জীবন্ত কথা, ঘটনা থরে থরে সাজানো থাকবে। বইমেলার বিখ্যত সব লেখকদের হাজার হাজার বইয়ের ভিড়ে আশাকরি আমার এই ‘হাউজ হাজব্যান্ড’ উপন্যাসটি আগামী বইমেলায় আপনাদের হাতে উঠে আসবে।

জগতের সকল হাউজ হাজব্যান্ড ও সকল পরিবারের সুখ কামনা করছি। টুটুল-ত্রপাদের নিজহাতে লাগানো গাছ থেকে শরৎ ও হেমন্ত কালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা কমলা বোঁটার শ্বেতশুভ্র একগুচ্ছু শেউলী ফুল , বর্ষার বৃষ্টিস্নাত কদম ফুল দিয়ে আপনাদের আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ।
—— সমাপ্ত
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, টরেন্ট, জুন ২০২৩

আগের পর্বগুলির লিংক:

পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের প্রভাব
পরবর্তী নিবন্ধ“Raising The Hope Community Services” এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন