নিলা, মিলা, বিনা তিন বোনের নামের যেমন মিল রয়েছে এই পরিবারের চতুর্থ কন্যা ত্রপা’ র নামের কোন মিল নেই। এমনকি ত্রপার নামেরে সাথে বাবা আনিস হোসেন অথবা মা লিলি আক্তার এর নামেরও কোনো মিল নেই। নামের এই মিল অমিল নিয়ে এই পরিবারের কারো তেমন মাথা ব্যাথা নেই। তবে লিলি’র কিছুটা মাথা ব্যাথা অতিসম্প্রতি হয়েছে । লিলি যেমন মেয়ে, তার এই মাথা ব্যাথা নিজ থেকেই শুরু হওয়ার কথা না । এই মাথা ব্যাথাকে উসকে দিয়েছে বান্ধবী ইরা । আজ আমরা সেই গল্পই শুনবো ।

লিলি’র মগজে ঢুকে দেওয়া হয়েছে তার মেয়েদের নামকরণের ব্যাপারে কলেজে পড়ার সময় আনিসের ক্লাসমেট নাবিলা আপার সাথে একটি যোগাযোগ রয়েছে। না-বি -লা লিখতে যেয়ে প্রথম তিন মেয়ের নাম চলে আসে। তবে, ত্রপা’র ক্ষেত্রে আনিস বোকার মতো আরেকটা কাজ করতে যেয়ে ধরা পড়ে গেছে। নাবিলা আপার বড়ো মেয়ের নাম হচ্ছে ‘তিথি’ যা শুরু হয়েছে ‘ত’ অক্ষর দিয়ে। এই ‘ত’ এর সাথে মিল রেখে আনিস তার সর্বকনিষ্ঠ মেয়ের নাম ত্রপা রেখেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে লিলির পরিবারের এই নাম রহস্য ভেদ করতে ইরা বান্ধবী এই যে বিশেষ সাহায্য যেচে পড়ে কেন করেছে সেটি সহজ সরল লিলি কখনো ভাবার অবকাশ ও প্রয়োজনীয়তা  অনুভব করেননি ।

ঘটনার আরো গোড়া থেকে শোনা যাক। ইরা, লিলি , পলা, নাসরিন সবাই বগুড়া ভিএম স্কুলে পড়ে। সরকারি আযিযুল হক কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া সুদর্শন মেধাবী আনিস ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ইরা’র তখন পাগল প্রায় অবস্থা। আনিস ভাই পলার বড়ো ভাই। ইরা ছুতো পেলেই ঘন ঘন পলাদের বাসায় যেত। ইরা অতি গোপনে আনিস ভাইকে সাহস করে প্রেম পত্র দিয়ে বসলো। বেরসিক আনিস ভাই সেই প্রেম পত্রের কোনো সাড়া দেননি। আনিস ভাই সাড়া দিলেন সহপাঠিনী নাবিলা আপার ডাকে। পরবর্তীকালে আনিস ভাই ভর্তি হলেন পাবলিক এডমিনেস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টে আর নাবিলা আপা ভর্তি হলেন একই ইউনিভার্সিটিতে সোসোলজি ডিপার্টমেন্টে। বগুড়া থেকে ঢাকায় পড়তে এসে ঢাকা’র বাতাস পেয়ে আনিস-নাবিলার প্রেমের নৌকা নির্বিগ্নে এগিয়ে চলতে থাকল। প্রেমের অতল গহব্বরে প্রায় তলিয়ে গেলেন আনিস।

ঠিক এরকম সময়ে হঠাৎ করে রূপবতী নাবিলার বিয়ে হয়ে গেল জনৈক কানাডা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার হানিফ সাহেবের সাথে। প্রেমিকার এই হঠাৎ বিয়ের ব্যাপারটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী নিরিহ সন্তান আনিসকে এতটাই আলোড়িত করলো যে, তিনি সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারের পরীক্ষায় দু’বছরের চেষ্টাতেও কৃতকার্য হতে পারলেন না। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির অনার্স ডিগ্রী নিতে মহাঝামেলায় পড়ে গেলেন। কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসাতে না পেরে লেখা পড়ায় ইস্তফা দিয়ে তিনি দেশের বাড়ি বগুড়ায় ফিরে এলেন । এসব খবরে ইরা-কে তেমন একটা প্রভাবিত করতে দেখা গেল না, কারণ ততক্ষনে ইরার বিয়ে হয়ে গেছে বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক মুহাম্মদ লুৎফর রহমান সাহেবের সাথে।

প্রেমের জগতের নিয়ম হচ্ছে, বিশেষ করে গরীব ঘরের উঠতি বয়সের ছেলে ছোকড়া যখন ছ্যাঁকামাইসিন খেয়ে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পড়ালেখার বারোটা বাজিয়ে হয় নেশার জগতে ঢুকে যায়, বা আরও নেশাখোর হয়ে ছিঁচকে চোর বাটপার হয়ে ওঠে অথবা বাবা মায়ের চেয়ে চিন্তে যোগাড় করা টাকা পয়সা দিয়ে পাড়ায় ডিশের লাইনের ব্যাবসা করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এক আধটু চালাকচতুর হলে দু’এক বছর পরে প্রেমের ছ্যাঁকার কথা ভুলেটুলে সরকারি রাজনীতিতে জড়িয়ে কন্ট্রাক্টরী জাতীয় পেশায় নিয়োজিত থেকে বিয়ে থা করে সংসারী হয়ে ওঠে। আনিসের ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কিছু দেখা গেল না।

ছেঁকামাইসিন খেয়ে বাংলা সিনেমার নায়কদের মত খোচাখোচা দাড়ি রেখে আনিস যখন স্থানীয় কমিউনিস্টপন্থী একটি পার্টির একজন একনিষ্ঠ কর্মী হওয়ার চেষ্টা করছেন তখন কিছু বন্ধুদের পরামর্শ নিয়ে আনিস বগুড়া শাহ সুলতান কলেজে পাশ কোর্সে বি.এ’তে ভর্তি হলেন এবং সেকেন্ড ক্লাসে বি.এ পাস করে  বিসিএস পরীক্ষায় সব স্তরের পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হয়ে একেবারে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে বগুড়াবাসিদের তাক লাগিয়ে দিলেন । একেই বলে কপাল।

সেই আনিস ভাইয়ের সাথে লিলির বিয়ে হয়ে যাওয়ার গল্পটা আরও একটা কপাল জনিত ব্যাপার। লিলি তখন বেশ বিপদের মধ্যে আছে। একে একে সব বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার বিয়ের নামগন্ধও নেই। পলা, শিরিন, রিমি, শিরিন, নাসরিন এমনকি ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ইরা’রও বিয়ে হয়ে গেল কিন্তু লিলির কিছুতেই বিয়ে হচ্ছে না। রহস্যময় এই পৃথিবীতে কত যে রহস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কুল কিনারা নেই। বগুড়ার গাবতলী থানার নতুন পোস্টিং নিয়ে আসা ম্যাজিস্ট্রেট আনিস সাহেব যার জন্য কি না শত শত গার্জিয়ানগন তাদের সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য লাইন দিয়ে আছেন সেই আনিস সাহেব এক বন্ধুর বোনের বিয়ে বাড়িতে লিলিকে দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। বন্ধুর বোনের বিয়ের ছয় দিনের মাথায় লিলি আক্তার-কে বিয়ে করে ফেললেন ।

মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। আনিস সাহেবের মেজিস্ট্রেট থেকে পদোন্নতি হতে হতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন । লিলি স্বামীর সংসার আলো করে একে একে চারটি কন্যাসন্তান প্রসব করেও লেকসার্কাস কলাবাগানে একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রীকে নিয়ে মহাসুখে সুখে স্বাচ্ছন্দে দিন যাপন করছেন । ঠিক তখন ঢাকা শহরে ইরা’র আবির্ভাব হলো । ইরা’র স্বামী লুৎফর বহমান সাহেবের প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি নিয়ে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে বদলি হয়ে এলেন। প্রেমে সাড়া না পেয়ে রাগে ও অপমানে ইরা এমনিতেই আনিস ভাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল । সেই আনিস ভাই  কিনা বিয়ে করেছে তারই আরেক বান্ধবীকে। আর তাই, এবার ঢাকায় এসে ইরাদের সংসারের সুখ দেখে ইরা’র ভেতরে জ্বলতে থাকা তুষের আগুন ধক করে জলে উঠলো। সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ইরা লিলিদের বাসায় যাতায়াত শুরু করলেন।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে  সন্দেহের বীজ একবার ঢুকে গেলে তা যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। ভয়ংকর কোভিড ভাইরাস, এরও ভ্যাক্সিন প্রতিষেধক রয়েছে, কিন্তু এই সন্দেহ ভাইরাসের তো কোন প্রতিষেধক নেই। এই ভাইরাস অতি দ্রুতার সাথে বংশ বৃদ্ধি করে সাজানো-গোছানো অনেক সংসার জ্বলে পুড়ে ছারখার করে ফেলে। লিলিদের সংসারেও সেরকম কিছু একটা ঘটার আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে । ইরা একেকদিন লিলিদের বাড়িতে এসে আনিস-কে নিয়ে এমন এমন একেকটা কথা বলে ইরা’র সাদা মনে সন্দেহের বীজ বপন করতে লাগলেন যে বীজ থেকে চারা বের হয়ে তর তর করে দ্রুততার সাথে বেড়ে উঠতে থাকল।

যেমন, একদিন ইরা এসে বললেন, ‘এই যে আমি গত কয়েকদিন তোর বাসায় ইফতার করলাম তোর বরকে তো একদিনও দেখলাম না।’ লিলি সহজ সরলভাবে বললেন , ‘ অফিসের কাজের ঝামেলা , তা ছাড়া ঈদের আগে ব্যাস্ততা আরও বেশি, জরুরি ফাইল-পত্র সাইন করতে হয় , অফিসেই ইফতারি সেরে বাসায় আসে। আমি আমার মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’ ইরা বললেন, ‘ এটাকি ক্যারাণীর চাকরি, নাকি অফিসের ক্যাশিয়ার যে ঈদের আগে কর্মচারীদের বোনাসের ফাইল রেডি করতে ব্যাস্ত,আনিস ভাই হচ্ছে উপ সচিব, ওনার তো এতো ঝামেলায় থাকার কথা না, তুই আগেও ছিলি গাধা, এখনও গাধাই থেকে গেলি, তোকে বোকা বেয়ে আনিস ভাই তোকে যা বুঝান তুই তাই বিশ্বাস করে বসে আছিস।  তলে তলে দেখ উনি কোথায় কি করে বেড়াচ্ছেন ! আচ্ছা বল তো আনিস ভাই বাসায় যখন আসেন তখন তোকে বেশি সময় দেন না কি ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকেন ? লিলি বললেন , হাঁ , সেতো আজকাল সবাই ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে ।’ ইরা বললেন, ‘তুই ওনার প্রোফাইলে যেয়ে ফ্রেন্ডলিস্ট ভালো করে চেক করবি। পুলিশ আর পুরুষ মানুষদের বিশ্বাস করতে নেই। লিলি শব্দ করে হেসে বললেন ‘আরে যা, ও এসবের মধ্যে নেই। ‘

বান্ধবীর কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও ইরা চলে যাওয়ার পরে লিলির মনে খুঁত খুঁত করতে লাগল। আনিস ইদানিং দামি সেন্টার প্রতি বেশ আসক্ত হয়েছে। দু একদিন বাদেই দামি দামি সেন্ট কিনে বাসায় নিয়ে আসে। এসব কেনা সেন্ট না গিফট আল্লায় জানে। ইদানিং বেশভূষাতেও আনিসের মধ্যে লিলি সুক্ষ একটু পরিবর্তন খেয়াল করেছে । এক সময়ে সেলফোনে স্বামীর প্রোফাইলে যেয়ে লিলি চমকে উঠল। ওর ফ্রেন্ড লিস্টে বেশ কিছু অপরিচিত মহিলা। বোকা লিলি ইরার ফাঁদে পা দিলেন।

সেদিন লিলি তার বড়ো দুই মেয়ে নিলা, মিলাকে নিয়ে আয়োজন করে ইফতারির জন্য পিয়াজু ভাজছিলেন। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠায় মেয়েদের সময়মতো পিয়াজু উল্টে দিতে বলে  কল রিসিভ করতে লিলি উঠে পড়লেন। ফোন করেছে ইরা। ইরা-কে বান্ধবীর সাথে কি এক নতুন একটি পরিকল্পনা নিয়ে টেলিফোনে অনেক্ষন ধরে কথা বলতে দেখা গেল। ইরা চাপাস্বরে হাত নেড়ে নেড়ে বান্ধীর সাথে কোনো এক মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করছেন। লিলি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেসব কথা শুনছেন । ওদিকে নিলা-মিলা সময় মতো পিয়াজু উল্টাতে ভুলে গেলে পিয়াজু সমূহ নীরবে ও সরবে পুড়ে যাচ্ছে, কারো খেয়াল নেই। স্মোক অ্যালার্ম বেজে উঠে কেলেঙ্কারি অবস্থা ।

ইরা- লিলিদের ফোনের সেই গুরুত্বপূর্ণ কী কথাপকথন হচ্ছিলো তা একটু শোনা যাক।  ইরা বললেন, ‘শোন, এই শুক্রবারের বিকেলে উবারের গাড়ি নিয়ে তোদের বাসায় আসবো। আমি বাসার ভিতরে ঢুকবো না। তোদের বাসার পাশে গাড়ির ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকবো। তোর জামাই বের হওয়ার সাথে সাথে তুইও বের হবি, মুখে বলবি এক বান্ধবীর বাসায় যাবো, জরুরি কাজে বান্ধবী গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে যেতে বলেছে। ব্যাস, তারপরে আমরা আনিস ভাইয়ের গাড়ির পেছন পেছন যাবো দেখি কত ধানে কত চাল। ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি ! আল্লাহও সহ্য করবে না ।’

শুক্রবারের বিকেলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হলো। আনিস সাহেব ফিরতে দেরি হবে বলে গাড়ি বেরিয়ে যেতেই ইরা- লিলি পেছন পেছন গোয়েন্দার মতো গাড়ি হাকিয়ে ছুঁটছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ড্রাইভার ইমতিয়াজ হোসেন আনিস সাহেববের গাড়িকে নিপুণভাবে অনুসরণ করে যাচ্ছে। সারা রাস্তায় ইরা ঢাকা শহরে সরকারি -বেসরকারি হোমরাচোমড়া লোকদের চরিত্রের বিচিত্র বিবরণ দিতে দিতে লিলির কান ঝালাপালা করে ফেললেন। কেন লিলি আরও  আগে থেকে সাবধান হল না তা নিয়ে বান্ধবীকে দায়ী করে কথা শোনাতে থাকলেন । একপর্যায়ে লিলি তো কেঁদেই ফেললেন।

ইরা এবং লিলি-কে সম্পূর্ণ অবাক করে আনিস সাহেবের গাড়ি এসে থামলো বড়ো মগবাজারে নয়াটোলা দারুস সালাম এতিম খানার সামনে। আনিস গাড়ি থেকে নেমে এতিম খানার ভেতরে ঢুকে গেলেন। ইরা তখনও সমানে বলে যাচ্ছেন, তুই কি ভেবেছি আনিস ভাই এতিম খানায় দেন-খয়রাত করতে এসেছে ? পত্রিকায় আমলাদের নিয়ে নানান বিকৃত রুচির খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছে দেখিস না ? এসব আমলাদের অনেক অনেক চারিত্রিক সমস্যা থাকে। কাচা টাকাপয়সা পেয়ে বিশ্রী সব কান্ডকারখানা করে, নানান বিকৃতরুচির যৌনাচারে লিপ্ত হয়। তাদের হাত থেকে ভদ্রঘরের বউঝি, কর্মজীবী হোস্টেলের মেয়েরা, এমনকি এতিমখানার অনাথ অনাথিনী কেউ বাদ থাকে না। ইরা হাতেনাতে চোর ধরতে পেরেছে ভেবে মহা উৎসাহে লিলি-কে গাড়িতে বসে এসব কথাবার্তা বলছেন। একসময়ে লিলি শব্দ করে কেঁদে ফেললেন।

লিলি হঠাৎ কী মনে করে গাড়ি থেকে নেমে এতিম খানার ভিতরে ঢুকলেন । ইরাও গাড়ি থেকে ঝটপট নেমে এসে বান্ধবীকে অনুসরণ করে করে ভেতরে অফিসের দিকে এগিয়ে গেলেন। এতিম খানার প্রিন্সিপ্যাল লিলি’র পরিচয় পেয়ে বেশ খাতির যত্ন করলেন। ইরা-লিলি জানালা দিয়ে ভিতরের হলঘরের দিকে তাকাতেই দেখলেন আনিস ভাই হাসিমুখে এতিম খানার অনাথ-অনাথিনী বাচ্চাদের নিয়ে ইফতারি করছেন। প্রিন্সিপ্যাল বললেন, ‘আনিস স্যারদের মতো লোক দেশে এখনো আছে বলে এখনো আমরা এতিমখানা ভালোভাবে চালাতে পারছি, শুধু সরকারি অনুদান নিয়েই কি এতিম খানা চালানো যায় ? শুনেছি আজ আবার স্যার বাচ্চাদের জন্যে ঈদের জামাকাপড় নিয়ে এসেছেন। নামাজের পরে রাতের খাবারের শেষে সেসব কাপড়চোপড় বন্টন করা হবে।’

লোডশেডিং এর কারণে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। এতিমখানায়ও হ্যাজাক লাইট জালানা হয়েছে। আনিস সাহেব তখনও জানেন না তার স্ত্রী ও স্ত্রীর বান্ধবী তাকে অনুসরণ করে এখানে এসেছেন। লিলি ইরা-কে খাতির করে প্রিন্সিপ্যালের রুমে বসিয়ে ইফতার দেয়া হয়েছে। ইফতার শেষে নামাজ পড়ে প্রিন্সিপ্যাল লিলিদের আনিস সাহেব সম্পর্কে আরও নানান গল্প করতে থাকলেন। আনিস সাহেব অফিস শেষে মাঝে মাঝেই এখানে আসেন, এতিম খানার ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলেন, পড়ালেখার খবর নেন , ওনার মতো মানুষ হয় না , ইত্যাদি। লিলি -ইরা সেসব কথা কতখানি শুনছেন তা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে দুই বান্ধবী তাকিয়ে দেখছেন আনিস ভাই গভীর মমতায় ব্যাগ খুলে অনাথ অনাথিনী ছেলে মেয়েদের মাঝে  ঈদের নতুন কাপড় বিতরণ করছেন । ছেলেমেয়েরা অনন্দে আত্তহারা হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। ইরা ও লিলি হতো-বিহ্ববল হয়ে মূর্তির মতো বসে আছেন ।

পরিশিষ্ট :
আকাশে ক্ষয়িষ্ণু রোজার চাঁদ । এই চাঁদ এই কয়েক দিনে এক সময়ে  আরও  ক্ষয় হতে হতে অমাবস্যার আধারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। বিশ্ববিধাতা আধারের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখবেন পৃথিবী নামক গ্রহের কিছু মানুষের লোভ লালসা, হিংসা-,প্রতিহিংসাকে। তবুও রমজান মাস উপলক্ষে মুনাফা কামানো অসাধু কিছু নির্লজ্জ ব্যাবসায়ীদের ধূর্ত চোখ ঈদ বাজারের আরও মুনাফার আশায় শিয়ালের মত চকচক করতে থাকবে। দলে দলে হত দরিদ্র কিছু নারী পুরুষ অদক্ষ ও ত্রুটিপূর্ণ মানেজমেন্টের কারনে যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করার সময় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরবে, লাইসেন্সবিহীন আনফিট লঞ্চ আইন না মেনে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হবে। প্যালেস্টাইনে মসজিদে সেজদারত নামাজীদের দিকে তাক করে গুলিবর্ষণ করা হবে।

এমন যদি হতো :
ভুস করে ঝলমলে নতুন ঈদের চাঁদ আকাশে উদিত হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে । দলে দলে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন ঈদের আনন্দে মেতে উঠেছে। ধর্ম, বর্ণ, ক্ষমতা, বিত্ত সবকিছুর উর্ধে পৃথিবীর সব মানুষ এই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পৃথিবী থেকে লোভ- লালসা, হিংসা প্রতিহিংসা, ক্ষমতার দম্ভ উধাও হয়ে গেছে। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে ইসরাইলসহ আরও বহু দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে, রাশিয়া -ইউক্রেন,  সমস্যা মিটে গেছে, কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলগুলো মিলেমিশে সোনার বাংলাদেশ গড়ছে। লিলিদের সংসার থেকে সন্দেহ উধাও হয়ে সেখানে অনাবিল সুখ ও শান্তি বিরাজ করছে । লিলি, ইরা, পলা, শিরিন, রিমি, শিরিন, নাসরিন সবাই আনিস ভাইয়ের বাসার ছাদে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আনিস ভাইয়ের একেকটি কথায় সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আমি আজও জেগে জেগে এসব স্বপ্ন দেখি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদুল ফিতর ও রোজা সমাপ্তির উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধতৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের রূপ-পর্ব  ১৭
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন