টুটুল ড্রইংরুমের এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। স্ত্রী ত্রপা তাকে লালমাটিয়াতে এক কলিগ ফরহাদ সাহেবের বাসায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে। আজ এ বাসায় ফরহাদ সাহেবদের পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীর উৎসব চলছে। ড্রয়িংরুমে ত্রপাদের আরেক কলিগ মিনহাজুল সাহেব চুটকি-র ঝুলি নিয়ে যেন বসেছেন। একেকটি চুটকি বলেছেন আর সবাই হেসে গড়াগড়ি করছে। দুই একজন মহিলা আবার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছেন। হাসতে যেয়ে চোখে পানি- টানি ফেলে যা তা অবস্থা । ফরহাদ সাহেব ঘোষণা দিয়েছেন, চুটকির পরপরেই ম্যাজিক দেখানো পর্ব শুরু হবে । শাকিল নামে ফরহাদ সাহেবের এক ভাগ্নে সম্প্রতি সিডনি থেকে বেড়াতে এসেছেন। ম্যাজিক দেখাবে শাকিল। শাকিলের জাদু ছাড়া সিডনিতে বগুড়া সমিতির কোনো অনুষ্ঠানই হয় না। শাকিল হন্তন্দ হয়ে ছুটাছুটি করছে কারণ ম্যাজিক দেখানোর জন্য এক খন্ড কালো কাপড় তার বিশেষ দরকার, কিন্তু কাল কাপড়ের খন্ড এখনও জোগাড় হয়নি। তাড়াহুড়া করে আসার সময় শাকিল এটি সাথে করে আনতে পারিনি, রাগে শাকিলের নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা হচ্ছে। এতো বড়ো একটি বাসায় এক খন্ড কালো কাপড় পাওয়া যাবে না এটা একটি কথা হলো !

টুটুলের জন্য বিশেষ আনন্দের বিষয় হচ্ছে তার ব্যাপারে কারো খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না । সাধারণতঃ ত্রপার সাথে কোথাও বেড়াতে গেলে শুরুতে হ্যান্ডশেক করতে যেয়ে পরিচিতি পর্বে ছোটোখাটো ঝামেলা বেঁধে যায়। একবার টুটুল ত্রপার এক বান্ধবীর মেয়ের জন্মদিনে গেলে সেই মেয়ের বাবা বললেন , ভাই আপনি কোথায় আছেন ? মানে, ব্যাবসাপাতি না কোনো জবে আছেন ? এ ধরণের পরিস্থিতিতে কি করতে হয় এবং বলতে হয় তা টুটুলের মোটামুটি মুখস্ত। টুটুল এধরণের পরিস্থিতিতে কাচুমাচু করে হাসিমুখে বলতে থাকে, ‘ ওর চাকরিটা সেই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত, বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা, তার মধ্যে বাচ্চারাও ছোট, ঢাকাশহরে আমাদের তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই বাচ্চাদের রেখে কাজে যাবো , আমি তাই বাসায়ই থাকি, ঘরে বসে কিছু করার চেষ্টা করছি।’ টুটুল সেদিনও মুখে হালকা হাসি টেনে এনে সেই একই ডায়ালগ দিলো। ভদ্রলোক টুটুলের কথায় হোহো করে হেসে বললেন, তাহলে তো মশায় আপনি খুব সুখে আছেন, এ তো দেখছি ‘হাউজ হাজবেন্ড ‘ !! কথাটি বলে ভদ্রলোক নিজের কথায় নিজেই মজা পেয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলেন। ভদ্রলোকের কথা শুনে আরেক ভদ্রলোক খানিকটা আরো জোরে হেসে বললেন , ভাই সাহেব বাংলা সাহিত্যে এতদিন বিদেশি এডজেক্টিভ হাউজ ওয়াইফ একতরফা রাজত্ব করে গেছে, আজ থেকে সেই দিন শেষ , নর -নারী সমঅধিকার, এখন শুরু হবে হাউজ হাজব্যান্ডের যুগ, কি বলেন সবাই।’ সবাই বেশ মজা পেয়ে হাসলেন , এমনকি টুটুলও খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে হাসলো, শুধু হাসতে দেখা গেলো না ত্রপাকে।

মিনহাজুল সাহেব এই মাত্র যে চুটকিটি বললেন তা হচ্ছে: এক লোকের বউ চলে গিয়েছে বা হারিয়ে গিয়েছে, লোকটা ব্যাস্ত হয়ে পোস্ট অফিসে এসে পোস্টমাস্টার সাহেবকে বললেন , ‘ভাইজান, আমার বৌ হারিয়ে গিয়েছে” । গল্পের এই পর্যায়ে সবটা না শুনেই ইতিমধ্যে অনেকেই হাসাহাসির পর্ব শুরু করে দিয়েছে। টুটুল মোবাইল ফোনে আজকের খবরের কাগজের খেলার পাতা পড়ছিলো। সাধারণতঃ চুটকির আসরে টুটুল কিছুটা অস্বস্তিতে থাকে। অধিকাংশ চুটকি তার কাছে চিত্রকর্ম অথবা আধুনিক কবিতার মতো দুর্বোধ্য মনে হয়ে। তবুও তাকে পরিস্থিতিতে পরে সবার সাথে হাসতে হয়। তবে, আজ হঠাৎ করে এই বউ হারানোর চুটকির ব্যাপারে টুটুলকে বেশ উৎসাহিত দেখা গেলো। টুটুল তার মোবাইল ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিনহাজুল সাহেবের দিক ঔৎসুক্য চোখে দিকে তাকিয়ে আছে। মিনহাজুল সাহেব একটু দম নিয়ে আবারও শুরু করলেন, ‘ পোস্ট মাস্টার সাহেব চোখ সরু করে লোকটির দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, বউ হারিয়েছে তো থানায় যাবেন, পোস্ট অফিসে এসেছেন কেন?’ এবার লোকটি বললো, ‘ভাইজান কিছু মনে করবেন না, খুশির চোটে মাথার ঠিক নাই।’

চুটিকির আসরে চুটকিবাজরা পরিস্থিতি বুঝে কখনো ডার্টি জোকস, কখনো হালকা সুড়সুড়ি, আবার অনেক সময় নারী -পুরুষ অথবা স্বামী -স্ত্রী-র মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক চুটকি বলে আসর গরম রাখেন। এক পক্ষ খেপে আরেক পক্ষকে নিয়ে নতুন নতুন চুটকি বলতে থাকে, আসর জমে যায়। আজ এই পোস্ট অফিসের চুটকি শুনে সবার হাসি ছাপিয়ে টুটুলকে বেশ শব্দ করে হাসতে দেখা গেল। কেউ তেমন একটি টের না পেলেও ত্রপার চোখে তা ঠিকই ধরা পড়লো । বউ হারিয়েছে শুনে নতুন বিয়ে করার আনন্দে আর সবাই হাসতে পারে, টুটুল এত খুশি হবে কেন ? সেতো তার সংসারে হাউজ হাসব্যান্ড হয়ে মহাসুখেই আছে।

হাউজ হাসব্যান্ড টুটুল কতখানি সুখে আছেন তা বুঝতে ধারাবাহিক এই গল্পের অন্তত আরও কিছু পর্ব পর্যন্ত পাঠকদের অপেক্ষা করতে হবে । আপাতত আবারও ফরহাদ সাহেবের সিলভার জুবিলী বিবাহবার্ষিকীর উৎসবের দিকে মন দেয়া যাক। এই মাত্র বাসার একটি কাজের ছেলে বাসার ভিতর থেকে একটি কালো কাপড়ের খন্ড নিয়ে এসে আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’ স্টাইলে চিৎকার করে বলে উঠলো ‘পেয়েছি’। সবাই আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। শাকিল ছোঁ মেরে কাপড়টি হাতে নিয়ে দেখলো একটি কালো জর্জেটের পাতলা ওড়না। এটি দিয়ে জাদু দেখলে ক্যালেঙ্কারির মধ্যে পড়তে হবে। শাকিল হতাশ হয়ে অন্য আইটেমের জাদু খেলার কথা ভাবতে লাগলেন। আজ আর শূন্যে মানুষকে ভাসিয়ে রাখার জাদু দেখানো যাবে না । বরং, কাটা দড়ি জোড়া লাগানো অথবা রুমালে পয়সা রেখে পায়রা বানিয়ে উড়িয়ে দেয়া এই জাতীয় কিছু দেখাতে হবে।

টুটুলের হঠাৎ করে বুক ধক করে উঠলো। বাসায় থেকে আসার সময় চুলায় ডাল বসিয়েছিলো। চুলাটি কী সে অফ করেছে? যদি অফ না করে থাকে তবে সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। এতক্ষনে বাসায় আগুন টাগুন ধরে যায়নি তো ! অজানা আশংকায় টুটুলের মন দুলে উঠলো। কেন যে বেড়াতে বের হওয়ার আগদিয়ে ডাল রান্নার দায়িত্ব নিয়েছিল ! এমন না যে ত্রপা থাকে ডাল চড়াতে বলেছিলো। সে ডাল চড়িয়েছিলো তৃনা এবং ত্রপাকে খুশি করার জন্য। ওদের বড়ো মেয়ে তৃনার প্রিয় খাবার ডাল। সাদা ভাত ডাল দিয়ে মেখে কয়েক পিস টমেটো টুকরা দিলেই মেয়েটির আর কিছুই লাগে না। গত দুদিন বাসায় ডাল ছিল না। ত্রপা সকালে অফিস যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলো , ‘মেয়েটা ডাল পছন্দ করে বাসায় যে এক দানা ডাল নেই, মনে আছে ? সারাদিন তো বাসায় বসেই থাকো দোকান থেকে দুটা ডাল আনা যায় না?’

টুটুল কথা রেখেছে। সে শুধু ডাল কিনেই আনেনি, রান্নাও বসিয়েছিলো। সাধারণতঃ ডাল খুব দ্রুত সেদ্ধ হয়। ডাল রান্নার নিয়ম হচ্ছে ডাল ধুয়ে সামান্য তেল দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হয়। এই সিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটা একটু ঝামেলার। শুরুতে তক্কে তক্কে থাকতে হয়। ডাল একটু আধা সেদ্ধ হওয়ার আগেই পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে রাখতে হয় নচেৎ উতাল উঠে ফেনা সমেত পানি উঠে আসে । অনেকে আবার সাবধানী হয়ে শুরু থেকেই পাতিলের ঢাকনা ছাড়া ডাল সেদ্ধ করতে থাকে । আজ সবকিছুই ঠিক চলছিল। টুটুল ডাল সেদ্ধ করে পরে আবার আলাদা ফ্রাইপ্যানে পিঁয়াজ রসুনের কুঁচি ভেজে, খানিকটা ডাল মসলা দিয়ে সিদ্ধ ডাল বাগার দিয়েছে। কিন্তু চুলাটি বন্ধ করা হয়েছে কি না টুটুল নিশ্চিত হতে পাচ্ছে না। হাউজ হাজব্যান্ড হওয়ার অনেক যন্ত্রনা !! সংসারের সব মানুষের মন যুগিয়ে চলতে হয়, রান্নাবান্না, বাচ্চা পালন আরও কত কী ! ওদিকে ফরহাদ সাহেবদের ড্রইং রুমে যখন সবাই সিডনি প্রবাসী শাকিল সাহেবের ম্যাজিক দেখছেন , রুমালের পয়সা থেকে পায়রা উড়ে যেতে দেখে হাত তালি দিচ্ছেন তখন টুটুল সন্তর্পনে ট্যাক্সি নিয়ে চিন্তিত মুখে অজানা আশংকায় কলাবাগানে তাদের বাসার দিকে রওনা হলো।
——–
(চলবে)

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের ছোট্ট গ্রাম-পর্ব ৬
পরবর্তী নিবন্ধকিভাবে আপনার বাগানের জন্য সেরা চারা নির্বাচন করবেন?
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন