(ডায়রির পাতা ও আমার লেখা গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত)

০১. প্রাককথনঃ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য ২৫ মে ১৯৭১, তৃতীয়বারের মতো কুমিল্লা জেলার দেবিদ্ধার উপজেলার রাজামেহার গ্রাম থেকে ত্রিপুরা রওনা হই। এ যাত্রাও শুরু করি মা-বাবার সম্পুর্ন অগোচরে, তাদেরকে না বলে।
বাড়ি ছাড়ার পূর্বে ভিত্তিফৌজের কাছ থেকে সংগৃহীত তাজা হ্যান্ডগ্র্যানেড দুটি বৈঠক ঘরে মাটির নিচে পুঁতে রাখি।

০২. প্রশিক্ষণঃ ২৬ মে ১৯৭১ আগরতলা ক্র্যাফ্টস হোস্টেলে পৌঁছি এবং প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহনের জন্য নির্বাচিত হই। নির্বাচিত হওয়ার জন্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্যারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই।
২৭ মে ১৯৭১ ভারতের আগরতলা থেকে আসামের তেজপুর যাই। ২৮ মে তারিখে তেজপুরে ট্রেনিং শুরু। আমরা ছিলাম ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচের সদস্য। প্রথম ব্যাচের ২০০ জন গেরিলাকে ১০টি স্কোয়াডে বিভক্ত করা হয়। আমি ছিলাম ০৩ নম্বর স্কোয়াডের গেরিলা। আমার চেষ্ট নম্বর ৪৯। জীবনে-মরণে এটাই ছিল আমার পরিচয়। ০৩ নম্বর স্কোয়াডের লীডার ছিলেন টংগীর ডাঃ খলিলুল্লাহ। ১৭ জুন পর্যন্ত আমরা আসামের তেজপুরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।

০৩. নেফাঃ ১৭ জুন ১৯৭১-এর পর আমরা নেফা (North East Frontier Area – NEFA) যাই। ২০০ জন গেরিলার মধ্যে ৪৫ জনকে নেফার বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য সিলেক্ট করা হয়। তাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। সেখানে ১৮ জুন ১৯৭১ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত উচ্চতর বিশেষ ট্রেনিং গ্রহন করি।

০৪. দেশে প্রবেশঃ আসামের তেজপুর ও নেফা থেকে আর্মস ট্রেনিং এবং বিশেষ ট্রেনিং শেষে আগড়তলার বায়কোড়া এস. এস. বি. (Special Security Branch – SSB) ক্যাম্পে সমবেত হই।
পরে হাই কমান্ডের নির্দেশনা মতে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ইন্ডাকশন ( প্রবেশ)। দেশে ফেরার পর বিভিন্ন অপারেশনে অংশ গ্রহন করি।
আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো সিকুরিটির কথা। আমরা যেন আমাদের পরিচয় ফলাও না করি। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের কথাও যেন গোপন রাখি। সিক্রসি বা গোপনীয়তা হচ্ছে একজন গেরিলার বড় অস্ত্র। আর লীডার নিজ থেকে না জানালে কোন কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করা যাবে না। এ কথা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো।

০৫. ডিসেম্বরঃ ১৯৭১ সনের ডিসেম্বরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধা দলের অবস্হান ছিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্ধার উপজেলার পুর্ব পাশে। আমাদের দেবিদ্ধার অন্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ইন্জিনিয়ার মোস্তাফিজ, রেহান, কাশেম, সামাদ সিকদার (বাঙ্গাল) , হালিম ভাই, আওলাদ ভাইসহ অনেক সহযোদ্ধা তখন একসাথে মুভ করি। (তালিকা লম্বা হয়ে যাবে বিধায় সকলের নাম দেয়া হলো না। আর অনেকের নাম মনেও নেই)। এলাহাবাদের ফুলমিয়া ভাই ও রনজিতদা (রন্জিত মাস্টার) আমাদের গাইড হিসেবে সহায়তা করেন। তারা আমাদের খাবার- দাবারেরও ব্যবস্হা করেন।

ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে দেবিদ্ধার, বুড়িচং, ময়নামতি এবং চান্দিনা এলাকায় আমরা বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। অপারেশনের প্ল্যান করি, রেকী ও রিভিউ করি এবং পাকিস্তানী হানাদার খতমের জন্য শিকারী বিড়ালের মতো ওৎ পেতে থাকি।
জাফরগন্জ বাজারের পশ্চিম-উত্তরে মেইনরোডের ওপর ফাঁদ পাতি (বুবিট্র্যাপের আশ্রয় নেই)। তাতে কখনও কাজ হয়,কখনও ওরা (হানাদারেরা) টের পেয়ে বিকল্প পথের আশ্রয় নেয়। কখনো কখনো আমাদের টার্গেটে অন্য দলের বা গ্রুপের মুক্তিযুদ্ধারাও আঘাত হানে। কখনো বা যৌথ অপারেশন। বড় বড় অপারেশনগুলো ছিল যৌথ আক্রমণেরই সুফল। যেমন, মাধাইয়া বাজারের পশ্চিম দিকের ব্রীজ উড়ানোর অপারেশন। জাফরগঞ্জ বাজারের পশ্চিম দিকের কালভার্ট অপারেশন ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকটায় এভাবেই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যস্ততম দিন-রাত কাটাতে থাকি। সময় কাটে তখন চরম উৎকন্ঠার সাথে। কখনো শুনি, দেশ সহসাই স্বাধীন হচ্ছে আবার শুনি দীর্ঘায়িত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের অবশ্য দীর্ঘ সময়ের লড়াইয়ের সার্বিক প্রস্তুতিই ছিল। আমাদের ওরিয়েন্টাশন ছিল সেরকমই।

০৬. বিজয় দিবসঃ অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের বিজয় দিবস। এর আগে, ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন এলাকা, অঞ্চল ও জেলা হানাদার মুক্ত হয়। দেবিদ্বার থানাও হানাদারমুক্ত হয় ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকেই (০৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)।
১৬ ডিসেম্বর হলো আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকহানাদারের আত্মসমর্পনের দিন ও আমাদের বিজয়ের দিন।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সুবহে সাদেকের সময়। ফজরের নামাজের বেশ পূর্বেই আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধা ঘুম থেকে উঠলাম। কেউ কেউ আবার কাটিয়েছে নির্ঘুম রাত। ইতোমধ্যে জেনে গেছি যে, আমাদের প্রিয় স্বদেশ হানাদার মুক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন। সে যে কী অনুভুতি! সেটি কাউকে বলে বা লিখে বুঝানো যাবে না। অন্যরকম দিন, ভিন্ন স্বাদের অনুভুতি। এক আনন্দ-বেদনার দিন। আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধাই তখন আনন্দিত ও উত্তেজিত।

আপনা আপনা (যার যার) হাতিয়ার ( আগ্নেয়াস্ত্র) হাতে নিলাম। সেল্টার ( আশ্রয়স্হল) থেকে বের হলাম। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার ভিরাল্লা প্রধান সড়কে এসে সকলে সমবেত হলাম। এটিকে কুমিল্লা-সিলেট রোডও বলা হয়। কমান্ডারের নির্দ্দেশে সাথে থাকা যারযার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ফায়ার করলাম। ফাঁকা গুলি করে আনন্দ প্রকাশ করলাম। সকলে মিলে একসাথে আওয়াজ তুলি সেই প্রাণের স্লোগান, জয় বাংলা।

এভাবে আমরা প্রথমে দেবিদ্বার ও পরে মার্চ করতে করতে চান্দিনা পৌঁছলাম। পথিমধ্যে জনতার ঢল। ছেলে বুড়ু, সুস্হ অসুস্হ সকলেই রাস্তায় নেমে এসেছে। যেন ঘরে আর মন টেকে না। কেউ হাত মিলাচ্ছে। কেউ বুকে বুক মিলাচ্ছে। কেউ ফুলের মালা দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে বাংলাদেশ খচিত ছোট্ট একটি পতাকা। কেউ মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছে। চিড়া মুড়ি, যে যা পারছে দিচ্ছে। এভাবেই আপামর জনগণ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের আপ্যায়ণ, অভিনন্দন ও স্বাগত জানাচ্ছে এবং নিজেরাও বিভিন্ন ভাবে উল্লাস প্রকাশ করছে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে, জয় বাংলা। তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব।

এর মধ্যেও অনেকের চোখে স্বজন হারানোর অশ্রু। চোখেমুখে দুঃখ-কষ্টের হাজারো প্রশ্ন! বিজয় দিবস যেন এক আনন্দ বেদনার মহাকাব্য।

আমরা চান্দিনা পৌঁছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সৈনিকদের দেখলাম গরুবাজারে বন্দি। তারা সারেন্ডার (আত্মসমর্পণকারী) করেছে । এদের সংখ্যা প্রায় ১৫০ / ২০০ হবে। চান্দিনা বাজারে, যেখানে গরু রাখা হয়, সেখানেই তাদের হাতে- পায়ে রশি দিয়ে গরুর খোয়ারে বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধা।

চান্দিনায় কমান্ডারের নির্দ্দেশ মতো, যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হলো, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করলাম। আমরা তখন খুব ক্ষুধার্থ। এরমধ্যে কমান্ডারের হুকুম হলো, কুমিল্লা চলো। মার্চ শুরু হলো কুমিল্লার পথে।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল নাগাদ আমরা কুমিল্লা টাউনহলে প্রবেশ করি। কুমিল্লা টাউনহলের পশ্চিম-দক্ষিনের টিনশেড ঘরটিতে প্রবেশ করে আমরা হতবাক। সেখানে হানাদার বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারের অনেক নির্মম চিহ্ন দেখতে পাই।

কুমিল্লা টাউনহলে তখনও অনেক কিছুর সাথে মাথার খুলি, বুলেটপ্রুফ হেলমেট এবং হেভিওয়েট গ্লাভস ইত্যাদি দেখতে পাই। অনেকের মাঝে ঐ ঘরে উপস্হিত ছিলেন সহযোদ্ধা ইন্জিনিয়ার মোস্তাফিজ, জাকির হোসেন ভাই, ফারুক ভাই, জুয়েল, এহসান, খসরু, সামাদ, রেহান, আলী হোসেন চৌধুরী, সেলিম, হুমায়ুন মজুমদার, আবু আইউব হামিদ, আওলাদ, হালিম, হেদায়েত, হেলাল, নাজির, আলী হোসেন, খবীর এবং ওয়ালীসহ অন্যান্য সহযোদ্ধারা।

আরও অনেকেই তখন উপস্থিত ছিলেন। যাদের নাম সংযুক্ত করতে পারিনি সে সকল সহযোদ্ধার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। স্মরণ করিয়ে দিলে পরবর্তীসময়ে, যদি বেঁচে থাকি, সংযোজিত হবে ইনশাআল্লাহ।

ট্রেনিং ও যুদ্ধ শেষে, বরাবরের মতো, সেদিনও সকল মুক্তিযোদ্ধার হাতেই ছিল স্বয়ংক্রিয় লোডেড আগ্নেয়াস্ত্র। সকলের চোখে-মুখেই ছিল বিজয়ের আনন্দ। ছিল আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত অশ্রু। এমন শুভক্ষণ অনেক জীবনেই আসে না। এক জীবনে বারবার আসে না। সেই অর্থে আমরা সত্যি সৌভাগ্যবান।
এখানে, কুমিল্লা টাউন হলেও আমরা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে উল্লাস প্রকাশ করি। স্হানীয় এবং আশেপাশের সহকর্মী ও সহযোদ্ধারা টাউন হলে এসে আমাদের সাথে মিলিত হয়। একাত্নতা ঘোষণা করে। একে অপরকে অভিনন্দন জানায়। আমরা একে অপরের সাথে কোলাকোলি করি এবং আবেগ-আপ্লুত হয়ে উল্লাস প্রকাশ করি। এ যেন হারিয়ে যাওয়া ভাইকে ফিরে পাবার মহা আনন্দ! মৃত মানুষকে জীবন্ত দেখার এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য ; তৃপ্তি ও আনন্দ!

কুমিল্লা টাউন হলের সেই ঐতিহাসিক মূহুর্তকে ধরে রাখার জন্য ছবি তুলে রাখার প্রয়োজন অনুভুত হলো। হাফিজ ভাই (কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন কুমিল্লা জেলার সম্পাদক মরহুম হাফিজ ভাই) ঐ সময়ে অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সে সময়ে আমাদের সকলের খাবারেরও ব্যবস্হা করেছেন। হাফিজ ভাইই একজন ক্যামেরাম্যান ডেকে আমাদের গ্রুপছবি তোলার ব্যবস্হা করলেন। এখানে কুমিল্লা অন্চলের আমরা প্রায় শ’ খানেক মুক্তিযোদ্ধা উপস্হিত ছিলাম। এখনও অনেকের কাছে ঐ ছবিগুলো আছে কিন্তু চিনতে পারিনা একে অপরকে। কতগুলো দিন, কতগুলো বছর! চেহারায় কত পরিবর্তন?

আমাদের দলে, আমরা বেশ কিছু কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। তখন আমরা কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলাম বেশ উত্তেজিত। আজ শহীদ সহযোদ্ধা ও যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের কথা বেশ মনে পরছে। সে মুখগুলো আর দেখছি না, দেখা যাবেওনা কোনদিন। আল্লাহ পাক ঐ সকল সহযোদ্ধাদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

০৭. পরিশেষেঃ সেদিনের কথা মনে হলে আজও শিহরিত হই। বেঁচে থাকা যেন এক অলৌকিক ব্যাপার বলেই মনে হয়। হায়রে মুক্তিযুদ্ধ! হায়রে জীবন! হায়রে স্বদেশ!
১৬ ডিসেম্বর বা বিজয় দিবস হঠাৎ করে পাওয়া কোন জিনিস নয়। অনেক ত্যাগতিতিক্ষার ও লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই মহান বিজয়। তাই ডিসেম্বর মাস এলে আজও কেমন যেন হয়ে যাই। মনে পড়ে শহীদ সহযোদ্ধাদের কথা। বেতিয়ারার শহীদ নিজামুদ্দিন আজাদসহ ৯ শহীদ সহযোদ্ধার কথা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা। মনে পড়ে কতো কথা, কতো স্মৃতি! বেঁচে থাকা যেন একটি বাড়তি পাওনা – স্পেশাল বোনাস।
মনে হয় এইতো সেদিন কিন্তু কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।

পূনঃলিখনঃ ০৭-১২-২০২০ খ্রিস্টাব্দ।
@ডক্টর মুহম্মদ আব্দুস সামাদ সিকদার (সামাদ সিকদার), বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য। সুকান্ত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যাঃ ১৩।।
০১. “মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি”
০২. “মুক্তিযুদ্ধঃ কিছু কথা কিছু স্মৃতি” সামাদ সিকদার রচিত মুক্তিযুদ্ধের উপর উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন