১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স (সারওয়ার্দী উদ্যানময়দানের সে বিজয়  দেখা আমার   সৌভাগ্য হয় নি। পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল  কে নিয়াজী আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর এবং নব- বাংলাদেশের পক্ষে লিবারেশন ফোর্সের জয়েন্ট কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এই স্বাক্ষরকৃত অনুষ্ঠানটি প্রতিবারই টেলিভশন পত্রপত্রিকায়  দেখানো হয়।  এটা সত্যিই বাংলাদেশের জন্য একটা গৌরবময় মুহূর্ত   ; পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে  এই স্মৃতি  ইতিহাসের পাতায় ছবি সহ লেখা থাকবে, এমন কি প্রচার মাধ্যমে বারবার আসবে, আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখে আনন্দে শিহরিয়া উঠবে, ভাববে যদি ওই বিশেষ মুহূর্তটি দেখতে পেতাম ! 

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী  যুদ্ধে ৩০ লক্ষ জনতা  রক্ত দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। পৃথিবীতে  অনেক ধ্বংস্বাত্মক বড়ো বড়ো  যুদ্ধ হয়েছে এবং আজ ও হচ্ছে- যেমন -প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৮), রাশিয়ান গৃহযুদ্ধ (১৯১৮-২০), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫), পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯০–৯১), আফগানিস্তান যুদ্ধ (২০০১–১৪), সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ (২০১২–),আরও কত কি ? কিন্তু বাংলাদেশ-পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ মূলত  গেরিলা যুদ্ধ ;  বাংলার দামাল ছেলেরা  যে ভাবে নিজের যা কিছু সম্বল ছিল  তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছে ,তা ইতিহাসে বিরল।   বঙ্গবন্ধুর ডাকে  শহর বা গ্রাম সর্বত্রই অভূতপূর্ব সাড়া দিয়ে যুদ্ধে  অংশ নিয়েছে । গ্রামের কৃষাণ ছেলেরা প্রতিবেশী ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে লুঙ্গি, গেঞ্জি পড়ে একদিকে গ্রামকে পাহারা ও  পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত এবং পাল্টা আক্রমণ করেছে ;অপর পক্ষে মাবোন ও বৃদ্ধরা  মুক্তি যোদ্ধাদের থাকা খাবার নিরাপত্তা দিয়েছে ।   এ দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কম -বেশি প্রতিটি পরিবার-ই  দেশের স্বাধীনতায় অবদান রেখেছে । এই যে এক কোটি  শরণার্থী বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে যাওয়ার  পথে জনগণ থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে,আহতদের সেবা দিয়েছে, ওদের অবদান কি ভুলে যাওয়ার ?  

১৯৪৭ সালে  ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে  পাকিস্তান, ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে ১২০০ মেইল দূরত্বে  দুইটি  অসংলগ্ন আঞ্চলিক সত্তা নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত  হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ ধর্মের দিক থেকে  মুসলমান /ইসলামী হওয়া সত্ত্বেও, জাতিগত, সংস্কৃতি  এবং ভাষাগত ভিত্তিতে বিভক্ত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একমাত্র ভাষা  বাংলায়;পশ্চিম পাকিস্তানে আঞ্চলিক ভিত্তিক   -পাঞ্জাবি,সিন্দি,বেলুচি ও পশতু ভাষায় কথা বলে ।    উর্দু ছিল ভারত থেকে আগত মুষ্টিমেয়  শিক্ষিত (এলিট), যাদের হাতে ছিল রাষ্ট্রের  ক্ষমতা ;ওরা উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে জনগণের  ইচ্ছার বিরুদ্ধে  চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়েছে । 

বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ,  ত্রিপুরা ও আসাম  রাজ্যের সাথে সংযুক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র ও অনেক সাহিত্যিকদের প্রভাব রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট সীমানা অতিক্রম করে বাঙ্গালী  জনগণের সাধারণ ভাষাগত ঐতিহ্য হিসাবে দেখা দেয়, পূর্ব বাংলার  জনগণ    ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথেই  পশ্চিমা উর্দু ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে মেনে নিতে পারে নি।  

জাতি যত বড় বা ছোট আকারের হোক না কেন,কেউ নিজের মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা করে না। কানাডার  জনসংখ্যার ৭% লোক কুইবেক ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে; এ দেশে ফ্রেঞ্চ কে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে সরকারিভাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কুইবেক  প্রদেশের প্রধান সার্বভৌমত্ববাদী রাজনৈতিক দল, “পার্টি কুইবেকোইস,” দেশকে কানাডা থেকে আলাদা করার জন্য দুইবার ভোটাভোটিতে হেরে যায়।  কিন্তু তাদের মুখের ভাষা(ফ্রেঞ্চ) দেশের গঠনতন্ত্রে দ্বিতীয় ভাষা, প্রতিটি স্কুল এবং অফিস আদালতে চালু রয়েছে।   

অখণ্ড ভারতীয় মুসলিম লীগ গোড়া থেকেই পাকিস্তানের ভাষা উর্দু হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।  

দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,লিয়াকত আলী খান,আয়ুব খাঁন আর ও  অনেকেই ছলেবলে পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষা চালু করার   চেষ্টা চালিয়ে বার্থ হয়।  ১৯৫২র  ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাংলার গভর্নর নুরুল আমিন ঢাকার ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়ার ফলে – সালাম , বারকাত , রফিক , জব্বার এবং শাফিউর শহীদ হয়।  

পাকিস্তানী চক্র উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র বন্ধ করে নি। ১৯৫৮ সনে  আয়ুব খান ক্ষমতায় এসে পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলে উর্দু ভাষা চালু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এ দেশের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণ তা মেনে নেয় নি।   

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান জাতীয় সংসদে  সদস্য হিসাবে তার নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লা থেকে প্রতিনিধিত্ব করে ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে  বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা করার আহ্বান জানিয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশীদের কাছে সর্বাধিক স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বক্তব্য নিয়ে জাতীয় সংসদে দত্ত সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও কর্তৃত্ববাদের প্রতি দত্তের জোরালো যুক্তির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের তিন দিন পর, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ দত্তকে কুমিল্লায় তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে  তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে সহ  ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

এ সময়  আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পবেলপুর কর্মরত ছিলাম।  ১৯৭০ সনের অক্টোবর কি নভেম্বরের দিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভোট  প্রচার অভিযানে ক্যাম্পবেলপুর জনসভা করেছিলেন।  আমরা অফিস থেকে অনেকে ওর বক্তব্য শুনার জন্য ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলাম।  ভুট্টো বক্তৃতার প্রায় পুরো সময় পূর্ব পাকিস্তান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানী জনগণের মধ্যে এ নিয়ে সর্বদাই আলোচনা হতো এবং অফিসে অনেকে এ নিয়ে আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন ।

সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকাতে, পূর্ব পাকিস্তানে কোথায় কি হচ্ছে সীমিত আকারে পত্র -পত্রিকায় আসতো।   এই ছোট্ট শহরে আমরা সবাই মেস করে থাকতাম এবং আর্মি অফিসার্স মেসে দুবেলা খাওয়া হতো।  রুটি, মাংস, ডাল ও সপ্তাহে একদিন একটু ভালো খাওয়া । খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে মাঝে মধ্যে নিজেরা রান্না করে ডাল ভাত খেতাম।  অফিস হালকা কাজ, বিকেলে পায়ে হেটে শহরে ঘোরাঘুরি করে রাতে খেয়েদেয়ে কেউ কেউ তাস  খেলা এবং আমি লাইব্রেরি থেকে কিছু বই এনে সময় পার করতাম।  

কয়েক মাসের মধ্যেই আমি ক্লান্ত হয়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ইসলামাবাদ  কৃষি মন্ত্রলায়ে নুতন চাকুরী নিয়ে চলে গেলাম।  জি ৬-২ আপপাড়া কয়েকজন মিলে এক বাসায় থাকি ।  রাত  হলেই ট্রান্সিস্টর নিয়ে নাড়াচাড়া করি মুক্তিযুদ্ধের খোঁজখবর নেয়ার জন্য।  কিন্তু কোনো ক্রমেই ১২ ০০ মাইল দূরে কোথায় কি হচ্ছে, কিছুই জানতাম  না।   নভেম্বর ১৯৭১ এর দিকে অফিস থেকে আমাদের চাকুরী থেকে ছাঁটাই করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।  ঢাকা চলে আসতে চাই, এয়ারপ্লানের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না, তাছাড়া এরোপ্লেন ভর্তি সেনাবাহিনীর লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।    আব্দুস সাত্তার (সিএসপি) কাবুল বর্ডার দিয়ে পার হতে গিয়ে ধরা খেয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন।  আমাদের আর এক অফিসার, দেশে স্ত্রী ও মাবাবা কে কোথায় আছে,খবর না পেয়ে অস্থির। সে  একটা চিঠি লিখে  রেখে আত্বহত্যা করেছে।  এ নিয়ে পুরা ইসলামাবাদে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।     

ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম দিকে ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির আকাশে ভারতীয় আক্রমণ শুরু হলো।  প্রতিরাতেই ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি শহরে ব্ল্যাক আউট এবং এয়ার সাইরেন শুনা যাচ্ছে।  সারা শহর অন্ধকার ; এক রাতে আমাদের বাসার দরোজায় কড়ানাড়ার আওয়াজ হচ্ছে।  আমরা ৪ জন বাংলাদেশী যুবক ভয় পেয়ে ভিতর থেকে বলছি কে কে ? উর্দুতে বলে আমরা তোমাদের প্রতিবেশী; ভয়ে দরজা খুলছি না।  ওরা বলে  তোমরা আকাশে টর্চ মেরে  শত্রুকে বোম্বিং করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছো ।  আমরা হতবম্ব  হয়ে যত বলি এটা হতেই পারে না। কোনো অবস্থাতেই দরজা খুলছি না , শেষে আমাদের শাসিয়ে চলে যায়।  

দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো ।  পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুই সংসদ সদস্য নুরুল আমিন(মুসলিম লীগ ) ও রাজা ত্রিদিব রায় (স্বতন্ত্র) ইসলামাবাদ ছিলেন;  নুরুল আমিন সাহেব কে  ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রাজা ত্রিদিব রায়কে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবে  নিয়োগ দিলেন।   পাকিস্তান /আফগানিস্তান বর্ডার কিছুটা শিথিল হলে আমরা কয়েকজন মিলে দালালের স্বরণাপন্য হয়ে পায়ে হেটে কাবুল,  আফগানিস্তান পৌঁছি।  কাবুল থেকে দিল্লি হয়ে দেশে পৌঁছতে প্রায় তিন সপ্তাহ লেগেছিলো।  

সমাপ্ত 

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতি থেকে
পরবর্তী নিবন্ধআমরা কি করতে পারি, না বলে বলুন আমি কি করতে পারি !
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন