আজ শনিবারের ভোরবেলা থেকে তমাল রেডি হয়ে বসে আছে। প্ল্যান অনুযায়ী, ঠিক পৌনে দশটার সময় বাল্যবন্ধু পরাগ তমালকে নিয়ে ইগলিন্টন রাস্তার উপরে স্কারবোরো ফ্লি মার্কেটে (Flea market) যাওয়ার কথা। ওখানে সস্তায় তমালের জন্য সেফটি বুট কেনা হবে। নিউ ইমিগ্রান্ট বলে কথা। দেশের মধবিত্ত পরিবার থেকে আসা নিউ ইমিগ্রান্টদের আবার অন্তত সেট না হওয়া পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই কীভাবে দুটি টাকা পয়সা সেভ করা যায় সেটি ভাবতে হয়। তমালের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। পরাগ যে ফ্যাক্টারিতে কাজ করে আগামীকাল থেকে তমালের সেখানে জয়েন করার কথা। তাই, পরাগ সস্তায় সেফটি বুট কেনার প্রস্তাব দিতেই তমাল সে প্রস্তাব লুফে নিয়েছে।

কানাডাতে প্রথম চাকরি। তাই আজ প্রায় কয়েকদিন ধরেই তমাল বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে। বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটু পর পর তমাল সেলফোনে সময় দেখছে। কেন যেন ভিতর থেকে কু-ডাক দিচ্ছে। এমনতো হতে পারে, তমাল একটু পরে এসে বলল, দোস্ত কিছু মনে করিস না, ওঁরা আমাকে ফোন করে বলেছে, ওদের ফ্যাক্টরি ঠিক ভালোভাবে এগুচ্ছে না, তাই নতুন লোকজন এমুহুর্তে নিচ্ছে না।’

আসলে, তমালের এসব কথা ভাবার পিছনে কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম চেষ্টায় যেকোনো কাজেই তমালের জীবনে তেমন সফলতা নিয়ে আসেনি। তাই, প্রবাসে বন্ধুর কল্যাণে এতো দ্রুত চাকরি পেয়ে যাবে এতখানি ভাগ্য যে সে করে আসেনি তমাল এটি প্রায় নিশ্চিত। তমাল দুরু দুরু মনে বন্ধুর জন্য সকাল থেকে যখন অপেক্ষা করছে, তখন ছেলেবেলার অনেক ছিটেফোঁটা ঘটনার কথা স্বরণ করে তমালকে আরও বিচলিত দেখাচ্ছে।

বগুড়া জিলা স্কুলের ক্লাস সিক্সের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে বন্ধুদের নাম থাকলেও তমালের নাম উইথেল। পরীক্ষার খাতায় রেজিস্ট্রেসন নাম্বার ভুল লেখা ছিল। পরে, হেডমাস্টার স্যারের রুমে আলাপ আলোচনা করে, খাতাপত্র, হাতের লেখা সব মিলিয়ে তারপরে তমালের ভর্তির ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তমালের অসফলতার আরেকটি ঘটনা শোনা যাক, তমালের সব বন্ধুরা সাইকেল চালানো জানলেও তমাল তখনও সাইকেল চালাতে পারত না । ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার পরে নানার বাড়িতে যেয়ে বাড়ির পিছনের মাঠে সাইকেল চালানো শিখতে যেয়ে তমাল চিৎপটাং হয়ে পড়ে যেয়ে লুঙ্গি খুলে একেবারে কেলেঙ্কারি অবস্থা। এর জের হিসাবে লজ্জায় প্রায় বছর দুই /তিনেক তমালের নানা বাড়ি যাওয়া বন্ধ। তবে, সেই থেকে নানাবাড়িতে তমালের নাম হয়ে গেলো ‘লুঙ্গি তমাল’। তমালের একবারের চেষ্টায় অসফলতার আরো দুটি উদাহরণ না দিলেই না। ইউনিভার্সিটি শেষ করে তমালের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ, পরীক্ষার স্থান মিরপুর ২, প্রশিকার হেড অফিস। তমালের সারারাত টান টান উত্তেজনায় কাটল। ভিড়ের মধ্যে মিনিবাসে উঠে শরীর কিছুটা গুলিয়ে গেল। মিনিবাস থেকে নেমে রিকশায় প্রশিকার হেড অফিসে যেয়ে রিসেপ্টানিষ্টের সাথে কথা বলতেই হরহর করে বমি করে ফেলল। পরে ওয়াস রুমে যেয়ে খালি গা হয়ে হাত ধোয়ার সাবান দিয়ে পুরা শার্ট ধুয়ে ভেজা শার্ট গায়ে দিয়ে ওয়েটিং রুমে ঘন্টাখানিক সময় বসে থাকার পর পিয়ন এসে বলল, আজকের মতো ইন্টারভিউ নেওয়া শেষ, পরের সিরিয়াল থেকে আগামীকাল ইন্টারভিউ নেয়া হবে। রাগ করে তমাল পরের দিন আর প্রশিকায় ইন্টারভিউ দিতে যায়নি। মাস খানিক পরে একটি মাল্টিন্যাশনাল পেস্টিসাইড কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়ে তমাল থানা লেভেলে একটি চাকরি ম্যানেজ করে ফেলল। কিন্তু সমস্যা হলো চাকরিতে জয়েন করার সময় বলে দেওয়া হলো মোটর সাইকেলের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। তমাল মোটর সাইকেল চালানো জানলেও লাইসেন্স ছিল না। তাই শর্ত সাপেক্ষে তমালকে জয়েন করানো হলো। বন্ধুদের অনেক তালিম নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রথম রোড টেস্টে তমাল ফ্ল্যাগের উপর দিয়ে মটরসাইকেল নিয়ে গেল, ফলাফল ফেল। পরে, অবশ্য কয়েকবারের চেষ্টায় পাশ করে লাইসেন্স পেয়েছে। এভাবেই অনেক ঘোল খেয়ে তমালের চাকরি জীবন শুরু হয়েছে। এমনকি, কানাডা ইমিগ্রেশনের সময়ও তমালকে অনেক বাধা উৎরিয়ে আসতে হয়েছে। সব ঠিকঠাক কিন্তু মেডিক্যাল চেকআপ এর সময় ঝামেলা হয়ে গেল। পরে অবশ্য, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে সমস্যার সমাধান হলো। এভাবেই, সফলতার সোনার হরিণ তমালের জীবনে কখনো একবারের চেষ্টায় আসেনি। একমাত্র বিয়ে ছাড়া তমালের জীবনে প্রায় প্রতিটি বড়ো বড়ো ইভেন্টের সফলতা সরল পথে না এসে, এসেছে এঁকেবেঁকে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে।

তাই, সঙ্গত কারণেই, আগামীকালের চাকরিতে জয়েন করা নিয়ে তমাল কিছুটা চিন্তিত। তমাল যখন নিজ জীবনের সফলতা অসফলতা নিয়ে এসব আকাশপাতাল ভাবছে, হটাৎ করে বন্ধু পরাগের গাড়ির হর্ণের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পরাগের পাশের সীটে বসে সেফটি বুট কেনার উদ্দেশ্যে ফ্লি মার্কেটের দিকে রওনা দিল। গাড়িতে উঠেই পরাগ বলল, ‘দোস্ত, কিছু মনে করিস না, একটু দেরি করে ফেললাম, আজ রাতের বাসায় পার্টির ব্যাপারে বৌকে রান্নার সবকিছু যোগারপাতি করে তারপরে আসতে একটু লেট হয়ে গেল।’

যেহেতু জীবনে কোনোদিন সেফটি বুট পায়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, তাই পাছে পায়ের আঙ্গুলে ব্যাথা না পায়, এই ভয়ে তমাল ইচ্ছাকরেই পা এর মাপের চেয়ে সামান্য কিছুটা বড়ো সাইজের সেফটি বুট কিনে বাড়ি ফিরল। বুট পায়ে দেওয়ার পরে পায়ের আঙ্গুল ও বুটের ভিতরের দিকের কিনারার মধ্যে প্রায় আধা ইঞ্চি খানিক গ্যাপ। বাড়িতে এসে তমাল বুট জোড়া পায়ে দিয়ে হাঁটাহাঁটির প্রাকটিস করছে। থপ থপ করে বাচ্চাদের হাঁটা শেখার মতো করে হাঁটতে যেয়ে তমাল নিজেকে অনেকটা শিশুর মতো মনে হতে থাকে । একেকটি নিউ ইমিগ্রান্ট যেন একেকটি শিশুর মতো, নতুন এক ভিন্ন সংস্কৃতির দেশে এসে প্রবাসে হাজার হাজার সমস্যার মধ্যে থেকে বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রামে টিকে থেকে আবার নতুন করে শিক্ষা দীক্ষা, অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে শিশুর মতো হাঁটিহাঁটি পায়ে এগুতে হয়।

সন্ধ্যা থেকেই পরাগের সদ্য কেনা কোনডোমেনিয়ামে ‘হাউস-ওয়ার্মিং’ পার্টি বেশ জমে উঠেছে। বিকালের দিকে অর্ধেকের বেশি গেস্ট চলে এসেছে। বিল্ডিং-এর নিচতলায় পার্টি রুমে গেস্টদের বসার আয়োজন। পরাগ পরিচিত বন্ধুদের তালিকার মধ্যে প্রায় সবাইকেই দাওয়াত করে ছিল। কিন্তু, কনফার্ম করেছিল মাত্র সতেরো জন।একেবারে, শেষমুহূর্তে আরেক বন্ধু রবিন ফোন করে বলল, ‘দোস্ত, দাঁতে প্রচণ্ড ব্যাথা, যেতে পারব না।’ পরাগ পরে রবিনের বাসায় যেয়ে ভাবি ও ওর দুই বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। তমাল, তিথি ওদের ছেলে তিতাসকে নিয়ে আগেভাগে চলে এসেছে। দুই একজন ছাড়া অধিকাংশই অপরিচিত মুখ, তাই ওরা পার্টি রুমের একসাইডে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। অন্যান্য বাচ্চারা যখন দল বেঁধে হৈচৈ করে হাইড এন্ড সিক খেলছে, তিথি-তমালদের একমাত্র ছেলে তিতাস মায়ের পাশে কোনার দিকে একটি চেয়ারে বসে মায়ের সেলফোনে হাতে নিয়ে বসে বসে একা একা আপনমনে খেলছে। অটিস্টিক বাচ্চাদের এই এক সমস্যা, এরা অন্যান্য বাচ্চাদের মতো দ্রুত বন্ধুত্ব তৈরী করতে পারে না বিধায় এদের শৈশবে খেলার সাথী হিসাবে বাবা মা ছাড়া তেমন কেউ থাকে না।

সন্ধ্যার দিকে, শ্রীলংকান দোকান থেকে নিয়ে আসা গরম গরম সমুচা, পাকোড়া, ডালপুরি পরাগের হাউস ওয়ার্মিং পার্টিতে সার্ভ করা হচ্ছে। তমাল পরাগকে চা পরিবেশনে হেল্প করার জন্য উঠে যাওয়ায় তিথিকে পার্টিতে গেস্ট ভাবীদের আড্ডার কথাগুলি মনোযোগী শ্রোতার মতো নিরুত্তাপ ভাবে শুনতে হচ্ছে। তিথি বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করল, ভাবীদের বেশিভাগ গল্পই হচ্ছে মোটামুটি তিন ক্যাটাগরির মধ্যে সীমাবদ্ধ: ১. নিজ নিজ স্বামীকে নিয়ে বদনাম করা, ২. একেকজন যারা অনুপস্থিত তাদের নেগেটিভ কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা, ৩. অন্য ভাবীদের বাচ্চা /কাচ্চাদের ছোট করে নিজ নিজ ছেলে মেয়ের প্রশংসায় একেবারে আকাশে তোলা । যেমন, এক ভাবি বলছে, ‘আমার স্বামী কাজ থেকে এসে ওই যে সেলফোন নিয়ে পোরে থাকে, আমাকে কাজ থেকে এসে একহাতে রান্না করা, ঘরদোর পরিষ্কার করা সব করতে হয়।’ আরেক ভাবি বলছে,’ কেন যে স্বামীর সাথে জয়েন্ট একাউন্ট করেছিলাম, নিজের মতো করে যে দুটি পয়সা খরচ করবো, তার উপায় নেই। একটু ভালো মন্দ কিছু খরচ করলেই স্বামী অনলাইনে চেক করে বলে, ‘ টাকা পয়সা একটু বুঝেশুনে খরচ করা উচিত, মেয়েটা বড় হচ্ছে ওর একটা ভবিষ্যত আছে না! বলেনতো ভাবী, মেয়ের চিন্তা কি শুধু ওনার একার, আমার চিন্তা নাই।’ আরেক ভাবী তাৎক্ষনক ভাবে বললেন, ‘ স্বামীদের কথা আর কি বলবেন ভাবী, বিয়ের পর থেকে দেখে আসছি স্বামী বাবার বাড়িতে কোরবানির টাকা পাঠাচ্ছে, আমাদের কী বাপ ভাই নাই! আমার কী বানের জলে ভেসে এসেছি! চাকরি কী সে একাই করে!’ তিথির প্রায় গা ঘেঁষে কয়েকজন মহিলা রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছে। এক ভাবি বললেন, ‘টুনি ভাবীকে দেখছি না, উনাকে বুঝি দাওয়াত দেয়নি, না দিয়ে ভালোই করেছে, উনার যা স্বভাব খালি একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগায়।’ একজন একটু বয়স্ক টাইপের মহিলা কিছুটা গম্ভীর হয়ে বাকিদের কথা শুনছিলেন। হঠাৎ করে উনি কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে গলা নামিয়ে ফিসফিস কোরে বললেন, ‘এই শিউলি ভাবীদের খবর শুনেছেন? ওনাদের মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে এক গাইনিজ হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে মন্ট্রিয়লে চোলে গেছে।’

তিথি যে দিকটায় বসে আছে তার বাম পাশের দিকে একটু অদূরে আরও কয়েকজন মহিলা কী কথায় যেন বেশ উচ্চস্বরে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কে জানে কার নামে আবার কী কথা নিয়ে ওখানে হাসাহাসি হচ্ছে। একটু পরে, হাসি থামিয়ে এক ভাবি আরেকজনকে বলছে, ‘এই ভাবী, শুনলাম, আপনার মেঝো ছেলে ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে, মন খারাপ করেন না ভাবী, এটাতো আর বাংলাদেশ না, এখানে কলেজই কী বা ভার্সিটিই কী, এখানকার ছেলেপেলেরা পাশ করলেই চাকরি, অবশ্য আমার ছেলে ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটিতে কম্পেউটার ইঞ্জিনিরিং পড়ছে। ওর কথা অবশ্য আলাদা ওতো আবার স্কুলে প্রিন্সিপ্যাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল।’ তিথি অদূরে বসেই স্পষ্ট দেখতে পেল, যে মহিলাটি মনোযোগ দিয়ে ভাবীটির কথাগুলি শুনছিলো নিজের ছেলের পড়াশুনা নিয়ে খোঁচা খেয়ে ভদ্রমহিলার মুখ সহসাই মলিন হয়ে গেল। কিন্তু, তিথি তখনো জানে না এই মলিনতা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে তার দিকেও ধাবিত হয়ে আসছে।

তিথি বাংলাদেশে থাকতে এধরনোর দাওয়াত/পার্টির সাথে তেমন পরিচিত ছিল না। দাওয়াত বলতে কেবল আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা করা হতো। খুব কাছের বান্ধবীরা বা অফিসের কোনো কলিগ এলে বাড়িতে এলে বাসায় মাঝে মাঝে গল্পগুজব করা হতো, ভালোমন্দ রান্নাবান্না হতো কিন্তু এরকম আয়োজন করে দাওয়াত পার্টিতে কখনোই এটেন্ড করা হয়নি। আর তাছাড়া, ইউনিভার্সিটিতে মাষ্টারি করতে যেয়ে এধরণের পার্টিতে এটেন্ড করে মহিলাদের সাথে সুর মিলিয়ে এধরণের খোশগল্প শোনার সময়ই বা কোথায় ছিল!

তমাল আজকের পার্টির হোস্ট, বাল্যবন্ধু পরাগকে হেল্প করার জন্যে সারাক্ষন একেবারে ওর সাথে লেপ্টে আছে। একটু আগে ক্যাটারিং করে অর্ডার দেওয়া খাবারের ডেলিভারি চলে এসেছে। তমালসহ পরাগের আরোও দুই একজন বন্ধু গাড়ি থেকে খাবারের ট্রেগুলি হাতে করে ধরে পার্টি রুমের এককোনায় রাখা টেবিলয়ের উপর সারি করে গুছিয়ে রাখছে। তিথি দূরে বসে খেয়াল করল তমাল কিছুক্ষন আগে গরুর গোস্তের ট্রে হাতে করে নিয়ে আসার সময় দাওয়াত উপলক্ষে সদ্য দেশ থেকে আনা যে দামি গ্যাঞ্জি পড়েছিল, সেটির পেটের দিকে গোস্তের ঝোল দিয়ে কিছুটা মেখে ফেলল। তারপরেও, তমালের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এদিকে, তিথির বাথরুমে যাওয়া দরকার। তমালকে যে একটু বলবে ছেলেকে দেখে রাখতে সে সুযোগ নেই। অগত্যা, তিথি তিতাসকে একা রেখে বাথরুমে গেল। যাওয়ার আগে শুধু তিতাসকে বলে গেল, ‘বাবা সোনা, আমি বাথরুমে যাচ্ছি, যাব আর আসব, কোথাও যাবে না কিন্তু।’

বাথরুম থেকে ফিরতে না ফিরতেই এক ভাবী কাছে এসে তিথিকে বললো ,’ভাবী’ কিছু মনে করবেন না, আপনার ছেলে নাকি পাগল!’ তিথি প্রচন্ড ধরণের ধাক্কা খেল, দেশ ছেড়ে আসার পরে এই সভ্য দেশে এসে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না, তবে দেশে এধরণের পরিস্থিতি তিথিকে অনেকবার সামলাতে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই চারিপাশের সুস্থ মানুষদের মনের অসুস্থতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোয়াল শক্ত করে তিথি জবাব দিল, ভাবী অটিজম মানে পাগল না, এটি একধরণের ডেভেলপমেন্টাল ডিসর্ডার, এটি অনেক অনেক ধরণের হয় তাই এটিকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসর্ডার বা এ এস ডি (Autism Spectrum Disorder/ASD) বলে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ অটিস্টিক ছিলেন, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন অটিস্টিক ছিলেন, বিখ্যাত কমেডি অভিনেতা Dan Aykroyd অটিস্টিক ছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটির এনিমেল সায়েন্সের বিখ্যাত প্রফেসর বহু বই এর প্রণেতা Temple Grandin অটিস্টিক ছিলেন। আমার ছেলেকে প্লিজ পাগল বলবেন না।’

এই রহস্য ঘেরা পৃথিবীতে মানুষ অত্যন্ত রহস্যজনক এক প্রাণী, এদের একেকজনের মধ্যে দৈহিকভাবে যেমনতেমন মানসিক ধ্যানধারণা ও চালচলনের মধ্যে এতবেশি বৈচিত্রতা থাকে যে একদিকে যেমন একেক মানুষ পাওয়া যায় যাঁরা আরেকজনের বিপদে নিজের জীবন দিয়ে যায় আবার, কেউ কেউ আছে যারা আরেকজনের সেনসেটিভ বিষয়ে আঘাত করে কথা বলে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে। তিথির ভাগ্য খারাপ বলতে হবে, এইমাত্র তিথির সাথে যা ঘটল তা সেই দ্বিতীয় ক্যাটাগরির এক মানবরূপী প্রাণীর যিনি একজন মা- কে কষ্ট দিয়ে বিকৃত আনন্দে আনন্দিত হয়ে হাসছেন।

দুঃখ, কষ্ট, বেদনা এসব শব্দের মালা বুঝি কেবল নিউকামার ইমিগ্রান্টদের জন্যই তোলা থাকে। পরের দিন তমাল, বন্ধু পরাগের ফ্যাক্টারিতে কাজে জয়েন করতে গিয়েছিলো। মূলত এটি একটি গাড়ীর পার্টস তৈরির কারখানা, মেশিনের তালে তালে কাজ করতে হয়। পরাগ যেহেতু অনেকদিন থেকে এখানে কাজ করে তাই, সুপারভাইজারের সাথে ওর খানিকটা খাতির থাকায় তমালের সাথে পরিচয় করে দিল। সুপারভাইজার তমালকে আলাদা করে অফিসে নিয়ে যেয়ে আরো দুই একজনসহ তমালের সাথে আলাপ আলোচনা শেষে তমালকে দিয়ে কিছু কাগজপত্রে সই করিয়ে তমালকে একটি টিমে ঢুকিয়ে দিল।

তমালের এই টিমের অধিকাংশই প্রায় বিশ/ বাইশ বছরের তরুণ। সকলেই কাজ নিয়ে প্রচুর ব্যাস্ত। তমালকে ‘হাই ‘ বলে যে যার মতো কাজ করছে । পরাগের আর কোনো পাত্তাই নেই । বেচারা তমাল ঠিক মেশিনের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারছিলো না । কাজের ধরণ ঠিকভাবে ধরতে না পেরে খানিকটা স্লো হওয়ায় তমাল যে লাইনে কাজ করছিলো সেখানে মেশিনের পাইপ লাইনে অনেক প্রোডাক্ট জমা হয়ে গেল।তমালের সাথে কাজ করা অল্প বয়সী পাঞ্জাবি তরুণেরা , তমালের অবস্থা দেখে একেকজন হেসে অস্থির। সুপারভাইজার দ্রুত কাছে চোলে এসে বিদ্যুৎ বেগে কাজ করে জমে থাকা লাইন আপ প্রোডাক্টগুলি সব ক্লিয়ার করে চলে গেল। লাঞ্চের বেশ খানিক আগে পনেরো মিনিটের একটি স্ন্যাক ব্রেক দিতেই পরাগ হন্তদন্ত হয়ে বললো, ‘ কিরে দোস্ত, সব ঠিকঠাক?’

ঠিকঠাকের সংজ্ঞা যে কী সেটা ভালোভাবে বুঝতে না পারলেও তমালের মোটেই বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি যে তার কাজের ব্যাপারে তার সুপারভাইজার তার উপর একেবারেই সন্তুষ্টি না। তবে, বন্ধুকে তা বুঝতে না দিয়ে শুধু মুচকি হেসে জবাব দিয়ে তমাল ব্রেকের পরে আবার পরম উদ্দমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিকাল সাড়ে তিনটার সময় কাজ শেষ হওয়ার কথা। লাঞ্চের ঠিক আধাঘন্টা খানিকের মধ্যেই সুপারভাইজার তমালের কাছে এসে বলল, ‘প্লিজ ডোন্ট কাম টুমোরো, মে বি দিস জব নোট সুইট্যাবলে ফর ইউ, টেক ইওর অল স্টাফ এন্ড ইউ মে গো নাও, আই এম সরি, নো ওরি, আই উইল ফুল পে ইউ ফর টুডে।

কথাটি শুনে তমালের মাথায় যেন অকাল ভেঙ্গে পড়ল। এতোবছরের জীবনে তমাল কোনোদিন চাকরির কোনো জায়গা থেকে ফায়ার হয়েছে এমন উদাহরণ একেবারেই নেই। লজ্জায় অপমানে পরাগের সাথে না দেখা করে, ড্রেস চেঞ্জ করে ভারী সেফটি বুট, লাঞ্চব্যাগ, আর ময়লা ড্রেস দুটি আলাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে দ্রুত ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে সামনে যে বাস পেল, কোন দিকে যাচ্ছে সেটা না ভেবে তমাল বাসে উঠে পড়ল। এতো আগে বাসায় যেতে তমালের ইচ্ছা হচ্ছে না। তার চেয়ে বাসে করে খানিকটা ঘুরে বাসায় গেলে কেমন হয় !!

তমাল বাসের পিছিনের দিকে গুটিশুটি মেরে জানালার পাশে বসে থেকে বাসে দুলোনি খেতে খেতে বাসের সাথে সাথে এগুচ্ছে। বাস যে কোনদিকে যাচ্ছে তমাল নিশ্চিত না। আকাশ হটাৎ কালো করে একেবারে দেশীয় কায়দায় ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। কে বলবে বাড়ি থেকে আসার সময় ঝঝকে রোদ ছিল। তোমালের জন্ম হয়েছিল খোদ আষাঢ় মাসে। সেই কারণেই কিনা মুষলধারে বৃষ্টি হতে দেখলে তমাল বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করে। বিশেষকরে টিনের কালে বৃষ্টির শব্দ তমালকে কেমন জেনো মাদকতা এনে দেয়। কিন্তু, জীবনের প্রথম আজকের বৃষ্টিকে তমালের পছন্দ হচ্ছে না। টিটিসি বাসের জানালা দিয়ে দেখা আজ বৃষ্টির একেকটি ফোটা তমালের কাছে জেনো মনে হচ্ছে তমালকে নিয়ে বিদ্রুপ করছে। প্রবাসে আসার পরে বন্ধু পরাগ একবার হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বুঝলি দোস্ত, এখানে তিনটি ডব্লিই এর কোনো বিশ্বাসঃ নেই,১. ওয়েদার, ২. ওয়ার্ক এন্ড ৩. ওয়াইফ, হাহাহা’ । তমাল এই তিন ডব্লিই -এর দুইটির সাথেই আজ পরিচিত হলো, কিন্তু তৃতীয় নাম্বার ডব্লিউ -এর প্রমান দেখার আগে তমাল ভাবতে থাকে দেশে ফিরে গেলে কেমন হয়!!!!!

(চলবে)

————————————–
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোস্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো

আগের পর্বগুলির জন্য ক্লিক করুনঃ-
স্বপ্নের ইমিগ্রেশন-পর্ব ১
স্বপ্নের ইমিগ্রেশন-পর্ব ২

স্বপ্নের ইমিগ্রেশন-পর্ব ৩

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়িয়ে দাও হাত-পর্ব ৯
পরবর্তী নিবন্ধসবজি উৎপাদনে পরাগায়নের গুরুত্ব
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন