মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। প্রযুক্তির সফলতা ফুলে ফেঁপে একাকার অবস্থা। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো সভ্যতা তেড়ে এলো। আমাদের বাবারা তাঁদের বাবার জায়গায় থাকলেও এই আমরা বাবা থেকে আব্বু, ড্যাডি, পাপ্পা প্রভৃতি রকমারি বাহারি শব্দের মাঝে উজাড় হতে থাকলাম।

আমাদের সেই বাবাদেরকে হটাৎ করে একদিন তড়িঘড়ি করে 35 / 65 লংক্লথের আতপ চালের মতো সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি পড়িয়ে বাবার গলা জুড়ে কতরকম রং ঢং করে ছবি তুলে মাস মিডিয়াতে পোষ্ট দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললাম, ‘হ্যাপি বাবা দিবস, বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল বাবাদের শুভেচ্ছা।’

আমাদের সেই বাবারাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। ঠোঁটে মুখে হাসি হাসি ভাব করে ভালো থাকার, সুখে থাকার আপ্রাণ অভিনয় করে আমাদের খুশি করার কত চেষ্টা করে গেলেন, সেই অবিকল খুশি মাখা হাসি- যেদিন প্রথম হাঁটা শিখলাম, মা মা করে প্রথম শব্দ উচ্চারণ করলাম, স্কুল থেকে দৌড়ে এসে বললাম বাবা বৃত্তি পেয়েছি!! অথবা স্কুলে বাবার ছাতা হারিয়ে ভয় পেয়ে মুখ শুকনা করে বাবাকে বললাম, ‘বাবা ছাতা হারিয়ে ফেলেছি ‘, বাবা হটাৎ করে ফিক করে হেসে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘দূর পাগল, ছাতা হারিয়েছিস তো কি হয়েছে তুই তো আর ইচ্ছা করে হারাসনি, আমি বাবার বুকে মাথা গুঁজে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম।

ভাদ্রের তাল পাকা গরমের রাতে লোডশেডিং। আমরা সব ভাইবোনেরা উঠোনে চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে বাবার সাথে আকাশের তারা চেনা শিখতাম, ধ্রুব তারা, সপ্তর্ষিমণ্ডল ইত্যাদি। আজও রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকালে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকা তারাগুলির দিকে তাকিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে। আমার বাবা ছিলেন আমার শক্তি, আমার মাইটোকন্ড্রিয়া।

ক্লাস নাইনের কেমিস্ট্রি ক্লাসে হুদা স্যার প্রকান্ড ধর্য্যের সাথে আমাদের বুঝাচ্ছিলেন শক্তির রূপান্তর সূত্র / শক্তির নিত্যতা সূত্র। শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শক্তি অবিনশ্বর। আমার হারিয়ে যাওয়া বাবা ঠিক হারিয়ে যাননি। বাবার সেই অবিকল হাসি, সেই মায়া মমতা, হালকা বকুনি আকাশে বাতাসে ইথারে মিশে যেয়ে ভাসতে ভাসতে মেঘমালার মতো আমাদের মাথার উপর ছায়া দিয়ে আড়াল করে রাখে আমাদের বুকের জমে থাকা কষ্টগুলিকে।

অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমরা বাবা -ছেলে মোড়া পেতে বসে মাটিতে ছক এঁকে ষোলো গুটি, বাগ-বকরী ইত্যাদি খেলতাম। বাবা নিজে হেরে আমাকে জিতিয়ে দিতেন, আর আমার চোখে মুখে কী যে আনন্দ!! বাবাকে হারিয়েছি বাবাকে হারিয়েছো বলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলতাম। আমার মা রান্না ঘর থেকে উঁকি মেরে সবকিছু বুঝতে পেরে এই বোকা আমার খুশি উপভোগ করতেন।

এনজিও তে কাজ করি। বিদেশী ভিজিটরদের সাথে ফিল্ড ভিজিট করতে যেয়ে সেবার আমার ঈদে আর বাড়ি যাওয়া হলো না। বাবার সাথে শেষ ঈদ আমার আর করা হলো না। বাবাকে যখন দেখলাম, বাতাসে আগরবাতির গন্ধ, জলন্ত আগরবাতির ছাইগুলি নিচে গড়িয়ে পরছে। মাদ্রাসার ছেলেরা মাথা দুলে দুলে সুর করে সূরা ‘আর রহমান’ পড়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের দিকের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম পশ্চিমাকাশে রাঙা করে সারাদিনের ত্যাজি দাপুটে সূর্য টুপ্ করে ডুবে গেল।

চক্রাকারে সব ঘুরে ফিরে আসে। আমার বাবার অতি প্রিয় ‘বাপজান’ এই আমি, একদিন বাবা তথা পাপ্পা হলাম। আমার বাবু একদিন বাবা হবে অথবা পাপ্পা হবে। এভাবে বাবা, বাপজান, আব্বু, আব্বা, পাপ্পা চরিত্রগুলি শক্তির রূপান্তর সূত্র মেনে চলে রপান্তরিত হয়ে চক্রাকারে এই রহস্যময় পৃথিবীতে ঘুরে ফিরে যাবে আসবে। আমার মতো কিছু পিতৃহারা বাবারা ভাদ্রের ভরা পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে অথবা মিটিমিটি তারার দিকে তাকিয়ে নিজ নিজ বাবার কথা মনে করে নীরবে ও স্বরবে কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে সন্তানদের জড়িয়ে ধরে আদর করবে।

এই নশ্বর পৃথিবীতে বাবারা অবিনশ্বর শক্তি। এই শক্তির কোনো বিনাশ নেই শুধু বাবা থেকে বাপি, পাপ্পা প্রভৃতি শব্দে রূপান্তর হয় মাত্র।

“সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা…….”

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“আমার শহর কবিতায় জেগে থাকে”-কন্ঠচিত্রণ
পরবর্তী নিবন্ধবাচনিকের নবীন বরণ
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন