“ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্,আসমানী তাগিদ ।”

নজরুল ইসলামের এই গানটি আজ ও শুনলে  দু’চোখ জলে সিক্ত হয়ে উঠে । ১৯৩১ সালে নজরুলের শিষ্য প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের অনুরোধে গানটি রচিত ও সুর দেয়া হয়।  সে থেকেই এ গানটি বিশেষত রমজান মাসের শেষের দিকে  ঈদের সময়  বাংলাদেশী রেডিও এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে  শুনা যায়। যখনই শুনি মনে হয় যেন এই প্রথম শুনলাম, এতই সুমধুর যা হৃদয় স্পর্শ করে এবং ভুলে যাওয়ার মতো নয়।  

ঈদুল ফিতর কে রোজা ভাঙার উৎসব বলা হয়, সারা মাসের সিয়াম সাধনার পর  বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের রোজা ভাঙার উৎসব  পালিত হয়।  এ দিনে প্রতিটি মানুষ  গরিব ধনী যার যা সমর্থ অনুযায়ী নতুন , পুরনো  যার যা সমর্থ, সুন্দর  কাপড় পড়ে উৎসব  মুখর পরিবেশে  ঈদগাহ মাঠ বা মসজিদে জমায়েত হয়ে নামাজ আদায়ের পর  একে অপরের  সঙ্গে হাসিমুখে আলিঙ্গন করা -যা অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে আসে।      

রমজানের রোজা রাখার মাধ্যমে আমরা কিছু  শিক্ষা অন্বেষণ করি যেমন :

কর্তব্য ও নিষ্ঠা:

রমজান মুসলমানদের আত্ম-শৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ত্যাগ এবং কম ভাগ্যবানদের প্রতি সহানুভূতি অনুশীলন করতে শেখায়।মুসলমান পবিত্র রমজান মাসে  ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজা রাখা , নামাজ পড়া, কোরান তেলাওয়াত করা এবং ইবাদতের মাধ্যমে এক মাস সমাপ্তির মধ্য দিয়ে ঈদুল ফিতর উদযাপিত করে । এটি একটি ধর্মীয় কর্তব্য, প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর  জন্য অবশ্য পালনীয়  যা কোরান ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এবং ধর্মের পাঁচটি  স্তম্ভের একটি।  

রমজান একটি আত্মচেতনা, উপলব্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাস যা পবিত্র রমজান মাসে সফল ভাবে রোজা সমাপ্তির মধ্য দিয়ে  ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। 

এই উৎসব আমাদের শিক্ষা দেয়  একের প্রতি অন্যের ভালোবাসা,অসহায়কে সাহায্য করা এবং ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একের প্রতি অন্যের কর্তব্য সম্পাদন ও  ত্যাগ স্বীকার করা এবং  এর  মধ্যেই আসে প্রকৃত সুখ। রমজানে রোজা, নেক আমল ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে হেদায়েত দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। 

দাতব্য সংস্থা এবং সম্প্রদায়:

ব্যক্তিগত এবং সাম্প্রদায়িক ভাবে যাকাত এবং ফিতরার মাধ্যমে দুঃস্থ প্রিতিবেশীদের খাবার এবং আর্থিক সাহায্য করা হয় যা  ঈদের  আগে, রমজানের শেষ দিনগুলিতে, প্রতিটি মুসলিম পরিবার দরিদ্রদের ফিতরা, জাকাত,কাপড়  ও বিভিন্নভাবে নিজের স্বার্থমতো  সাহায্য করে থাকে।  

সাদাকাহ আল-ফিতর বা যাকাত আল-ফিতর নামে পরিচিত -সাধারণত খাদ্য আকারে (যেমন চাল, বার্লি এবং খেজুর)  অভাবীরা যাতে পুষ্টিকর  খাবার উপভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে এই বিধান দেয়া হয়েছে । এই দিনটিতে ছোট- বড় এবং গরিব -ধনী ভুলে গিয়ে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে -এক মহৎ দৃষ্টান্ত ।    

ক্ষমা : 

ক্ষমা প্রার্থনা একটি  মহৎ গুন্  যা এই মাসে  প্রতিটি মুসলিম নর-নারী   আল্লাহর নিকট চেয়ে নিতে পারে   ।   প্রতিটি মুসলিম দেশে ঈদের দিনে  এবং পরবর্তী আরও কয়েকটি দিন  সরকারি ছুটি দেয়া হয় ;  যার জন্য প্রায় সবাই শহর ছেড়ে গ্রামে মাবাবা এবং আত্মীয়স্বজনদের সাথে ঈদের ছুটি উপভোগ করার সুযোগ পায়। এই উদযাপন তিন দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে , এই সময়ে লোকেরা একে অপরকে “ঈদ মোবারক” (যার অর্থ “ধন্য ঈদ”) এবং আনুষ্ঠানিক আলিঙ্গন দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।

বাড়িতে মিষ্টি খাবার প্রস্তুত করা , নিজেরা, আত্ময়স্বজন, প্রতিবেশী  এবং শিশু এবং অভাবীদের নিয়ে বিশেষ ভাবে উপভোগ করে থাকে ।  

 ঈদুল ফিতর  আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার দিন : 

মহান পুরস্কার ঈদুল ফিতরের দিনটি তাদের জন্য একটি বরকতময় দিন যারা রমজানের রোজা পালন করে এবং বিধিবিধান মেনে চলে।   আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা ঈদুল ফিতর এর একটি বিশেষ সময় ।  এ সময় প্রতিটি  মুসলমান তাদের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে  এবং  মনের কপটতা ভুলে গিয়ে একে অপরের প্রতি স্নেহ ও মায়াবন্ধনে জড়িয়ে পরে  । 

আল্লাহ আমাদের ওপর কোনো বোঝা চাপাতে চান না। তিনি আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য রোজা রাখার নিয়ম দিয়েছেন। ব্যক্তি ও সমাজের জন্য রোজা রাখার অনেক উপকারিতা রয়েছে।  মুসলমান এই রমজানের শেষের দিনগুলিতে “ইতেকাফ” বসে আল্লাহর নিকট কৃত অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করে।  

২  

১৯৮২ সনের পর বাংলাদেশে আত্মীস্বজন্দের সঙ্গে ঈদের উৎসব পালন করার মতো আমি বা আমার পরিবারের সুযোগ হয় নি।  বিদেশে পরিবার ও  বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঈদের উৎসব পালন করেছি বা করি ; কিন্তু দেশের আনন্দ সম্পূর্ণ ভিন্নধরনের যা থেকে বঞ্চিত।  গ্রামের সে পরিবেশে ঈদের আনন্দ জীবনে  আর কোনো দিন ও ফিরে আসবে না।  রমজানের রোজা শুরু হতেই  ঈদের কেনাকাটার জল্পনা কল্পনা  শুরু হতো ।  ঈদের বাজার জমজমাট; বিশেষ করে  ঢাকার বাজারে প্রচন্ড ভিড়, প্রতিটি পরিবার প্রধানকে তার স্ত্রী,ছেলেমেয়ে ,কাজের বুয়া থেকে আরম্ভ করে মাবাবা ও ভাইবোনকে খুশি করার জন্য কেনা কাটা করতে হবে । যারা সরকারি  বা প্রাইভেট মালিকানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে , এ মাসে বাড়তি বোনাস ভাতা দেয়া হবে যা দিয়ে বাড়তি খরচ করা যাবে।   বাড়তি এক মাসের বেতন পাবে এই নিয়ে কত কি জল্পনা কল্পনা।  ঢাকা শহরের মতো বড়ো বড়ো শহর গুলি প্রায়ই জনশূন্য হয়ে পড়ে।  আগে থেকে বাস ট্রেন ও লঞ্চের টিকেট না কেনা হলে যাত্রীদের বিশেষ ভোগান্তিতে  পড়তে হয়।  তাই সবাই আগে থেকে টিকেট কাউন্টারে গিয়ে ভিড় জমায়।  এমন ও দেখা গেছে যে সারারাত ট্রেন স্টেশনে  টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে  ও অনেকে টিকেট পায় নি।  

ঈদের এক সপ্তাহ পূর্বে ও এক সপ্তাহ পরে  অফিসে তেমন কোনো কাজের চাপ থাকে না ।  কর্মকর্তা -কর্মচারী সবাই ঈদের শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত।     

ফেসবুকে দেয়া আমাদের “এনায়েতপুর ছোট্ট গ্রাম ” এর  রোজার  ইফতারির দৃশ্য অবাক  হয়ে দেখলাম এবং পুরোনো স্মৃতিকে স্বরণ করিয়ে দিলো ।  গ্রামের বহু লোক একত্রে ইফতারির দৃশ্য আকৃষ্ট করেছে। সে যুগে   জমিরউদ্দিন প্রধানিয়া সাহেব  গ্রামের সব মুসল্লি ও ছেলেমেয়েদের  ঈদের নামাজের পর খাওয়াতেন ; আজকাল তাঁর  সুযোগ্য  নাতি-নাতনিরা সে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।  

১৯৬০ এর দিকে এই গ্রামে আমাদের বাড়িতে একটি মাত্র মসজিদ ছিল। সারা গ্রামে ৭-৮ টি বাড়ির লোক একত্রে জমায়েত হতো এই মসজিদে।  নামাজের পর  সিন্নি বিতরণ করা হতো।  সবাই একত্রে বসে খেয়ে আনন্দ করতাম। ওই সিন্নির স্বাধ ভিন্ন রকম ছিল, অনেক করে নারিকেল  অগ্রহায়ণ-পৌষে খেজুরের রস দিয়ে রান্না করে মুসল্লিদের বিতরণ করা হতো।  খাবার পর গ্রামের মুরুব্বিরা দেশের সমস্যাদি নিয়ে আলোচনায় বসতেন, বাদী-বিবাদীর  কৈফিয়ত শুনতেন, ৪-৫ জন মাতবর শ্রেণীর লোক আলোচনা করে  সমস্যা  মীমাংসা করে দিতেন, আইন-আদালতে যেতে হতো না । 

 এই গ্রামের আমজাদ হোসেন মুন্সি সাহেব মসজিদের মুয়াজজিন, একজন হক্কানী  আলেম ,ওনার আজান অতি চমৎকার, সে যুগে মাইকের ব্যবস্থা ছিল না, উনি আজান দিলে মাইকের প্রয়োজন হতো না, মসজিদ কাঁপিয়ে তুলতেন এবং গ্রামের সবাই আজান শুনে মসজিদে জমায়েত হতেন।  

সারা গ্রামে একটি মাত্র ঈদগাহ, নামাজের পর  জমিরউদ্দিন প্রধানিয়া সাহেব মুসল্লিদের দাওয়াত দিতেন  খাওয়ার জন্য।  সব মুসল্লিরা গিয়ে উঠানে হোগলা বা পাটিতে বসে খেয়ে গল্পের আসরে যোগ দিতেন  । গ্রামের ছেলেমেয়েরা  সুন্দর পোশাকে সেজে এই ঘর সে ঘর গিয়ে ঈদের খাওয়া, বকশিস আদায় করে আনন্দে মেতে উঠতো ।  দুপুরের পর থেকেই শুরু হতো  এ গ্রাম সে গ্রাম আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি যাওয়া। আমাদের প্রধানিয়া বাড়ির ‘সিরাজ কাকা ‘ তার দল নিয়ে তাস খেলায় বসতেন, সে কি হইচই, আনন্দ ? রাত জেগে গ্রামের জারিগান এবং পুঁথি পড়ার আসরে যোগ দেয়া সে আর এক দৃশ্য ভুলে যাওয়ার মতো না।  

স্থানীয় রঘুনাথপুর বাজারে বিরাট ঈদের জামাত, চারিদিকের গ্রাম থেকে মুসল্লিরা এই জমাতে উপস্থিত হতো।  মওলানা আব্দুর রব সাহেব,  গলার আওয়াজ অতি সুন্দর ও   প্রকট,  মাইকের প্রয়োজন হতো না।ঈদের নামাজ পড়ে পাশে  নানাবাড়ি গিয়ে মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে ঈদের খাওয়া ও আনন্দে মেতে হইচই, খেলাধুলা করে দিন শেষ হয়ে যেত। বাড়ি ফিরতে রাত হতো, মা বলতো সারাদিন বাহিরে বাহিরে,ঘরে কখন খাবে ?  

   ৩

তবে গ্রামে মসজিদ এবং ঈদের জমাতে কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য  দুর্ঘটনা ও হয়ে যেত যা আজ ও স্মৃতিতে রয়েছে । ১৯৭৭ সনে ঢাকা থেকে  বাড়িতে মাবাবা ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করতে গিয়েছিলাম ।  গ্রামে এক বিবাহ-বিচ্ছেদ নিয়ে অনেকদিন থেকেই দুই দল। সে বৎসর  এই দুই দলের বিবাদের কারণে ঈদের নামাজ এবং ঈদের মিলন হয় নি।আমরা নিরপেক্ষ কিছু লোক নামাজ পড়তে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিনা নামাজে ঘরে ফিরে গেলাম ; সে অনেক না বলা কথা … ।  

আমাদের বরণ্য কবি নজরুল ইসলাম এর সেই কবিতার দুটি লাইন দিয়ে শেষ করছি -” বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন ও পিছে, বিবি তালাকের ফতুয়া খুঁজি হাদিস ফেকা চষে। ” সমাপ্ত

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅমোঘ
পরবর্তী নিবন্ধসন্দেহ
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন