জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের  ৬৪ হাজার গ্রামের সাড়ে সাত কোটি জনতা ১৯৭১ সনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যার যা কিছু ছিল তা নিয়েই রুখে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের ছোট্ট গ্রাম এনায়েতপুরের জনগণ ও আবু তাহেরের নেতৃত্বে  এ ডাকে সাড়া দিয়েছিলো।  এই গ্রামে জন্ম আবু তাহের,  আব্দুর রাজ্জাক,দেলোয়ার হোসাইন , আব্দুর রাশিদ ও আরও কয়েক জন স্বক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে । আবু তাহের ও  আব্দুর রাজ্জাক আজ আমাদের মাঝে নেই, আল্লাহ তাদের জান্নাত বাসি করুন।

আমাদের এই বীর ছেলেরা কুমিল্লা থেকে  অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে  বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়াতে গিয়ে পুরা ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এতে পুরা গ্রাম আর্মি, রাজাকার ও আল-বদরের  নজরে পড়ে এবং কয়েকবার এই গ্রামে  আর্মি  হানা দেয় আবু তাহের তার সঙ্গী এবং কচুয়া থানার  মুক্তিযোদ্ধা  এবং কৃষক  মজদুর সাহসের সঙ্গে  কচুয়া  থানায়  রাজাকার এবং পাকিস্তানী  সৈন্যদের আগ্রাসন প্রতিহত করে মুক্তি যুদ্ধারা মতলব থানায় যে অপারেশন চালিয়ে ছিল, তাতে এক দিনের যুদ্ধে ৭-৮  জন পাকিস্তানী আর্মি হত্যা করেএতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যাম্প থেকে বের হতেই সাহস হারিয়ে পেলে

গ্রামের কৃষক, মা বোনেরা নিজে না খেয়ে  মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়ে পাকিস্তানী এবং রাজাকারদের হাত থেকে রক্ষা করেছে আমাদের বৃদ্ধ জনতা যারা যুদ্ধ করতে অক্ষম, তারা মুক্তি যোদ্ধাদের সাহস জুগিয়ে তাদের থাকা খাওয়ায় সহযোগিতা করেছে 

পাকিস্তানী সামরিক শাসক ভাবতেও পারে নি যে বাঙ্গালীরা এক যোগে এ ভাবে যুদ্ধ করবে মূলত পূর্ব পাকিস্তানের ৬৪ হাজার গ্রামে মুক্তিবাহিনী দুর্গ গড়ে ছিল যেখান থেকে প্রতিটি মানুষ যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছে এ জাতীয় যুদ্ধ পৃথিবীতে বিরল এবং মাত্র ৯ মাসের  যুদ্ধে পাকিস্তানিরা ৯০ হাজার সৈন্য এবং গোলাবারুদ  থাকা শর্তেও হেরে যায়পাকিস্তানিরা সুসজ্জিত সৈন্য,রাজাকার,আল বদর, আল শামস সহ ও মুক্তি যোদ্ধাদের কাছে হেরে যায় মুক্তি যোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণের সামনে রাজাকার বা তাদের সংগঠন  গ্রামে গঞ্জে কোথায় ও কোনো রকম সহযোগিতা পায়নি এবং টিকে থাকতে পারেনি

আমার এক স্কুল বন্ধু নজরুল ইসলাম সবে মাত্র পাকিস্তানে করাচী ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা শেষ করে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে সে তার বাবার সঙ্গে স্থানীয় রঘুনাথপুর বাজার নৌকা করে গিয়েছে সে নৌকাতে বসে রয়েছে এবং রাজাকার এসে তাকে জোর করে নৌকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গুলি করে শহীদ করে তার বাবা রাজাকারদের হাতে পায়ে ধরে আর্তনাদ করে “আপনারা আমার ছেলেকে জীবন ভিক্ষা দিয়ে আমাকে মারেন ” কিন্তু এই পশু রাজাকার তার বাবার সামনে নজরুল ইসলামকে শহীদ করে 

আমাদের লক্ষ লক্ষ মা বোনেরা মুক্তিযুদ্ধ চলা কালীন সময় নির্যাতিত ও শহীদ হয়েছে, তাদের আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণ করি  

পূর্ব পাকিস্তানের  স্বাধিকার আন্দোলন মূলত  পাকিস্তান জন্মের পর পরই শুরু হয়েছিল  

১৯৪৮ সনে করাচিতে জাতীয় অধিবেশন ডাকা হলে জিন্নাহ সাহেব প্রস্তাব করেছিলেন দেশের জাতীয় ভাষা হবে এক মাত্র উর্দু সে অধিবেশনে একমাত্র ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত উদাত্ত ভাষায় বলেছিলেন বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে হবে কিন্তু কেউ তার সমর্থন করেন নি ২৫ সে মার্চ ,১৯৭১ বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে পাকিস্তান আর্মি গ্রেফতার করে, এর তিন দিন পর  এই মহান ব্যক্তিকে ২৯ সে মার্চ,১৯৭১ তাঁর কুমিল্লা শহরের বাসা থেকে আর্মি উঠিয়ে নিয়ে অত্যাচার করে মেরে ফেলে এবং তাঁর মৃত দেহ পয্যন্ত ফেরত পাওয়া যায় নি  

১৯৪৮ সনে যখন জিন্নাহ সাহেব পূর্ব পাকিস্তান এসে পল্টন ময়দানে ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দু, জনগণ সঙ্গে সঙ্গে না না ধ্বনি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে জিন্নাহ সাহেব  এমন ও   বলেছিলেন যারা এর বিরুধিতা করবে, তারা দেশের শত্রু পর দিন ঢাকা ইউনিভার্সিটি কার্জন হলে ভাষণে ছাত্র জনতা প্রশ্ন করেছিলেন দেশের জাতীয় ভাষা কি হবে?

জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন এক মাত্র উর্দু সে দিন ছাত্র জনতা না না ধ্বনিতে হল কাঁপিয়ে তোলে 

১৯৫২ সনে ভাষা আন্দোলন এবং  জব্বার, সালাম, বরকত, রফিক ও আরও  অনেকে যারা শহীদ হয়ে ছিল এবং ১৯৫৪ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ইলেক্শনে কৃষক শ্রমিক লীগের নিরংকুশ জয় এবং পরবর্তীতে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কে প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করতে না দেয়ার মধ্যে এটাই প্রমান করে যে পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের ভালো কিছু  চায় নি 

১৯৬৯ সনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার (স্টেট ভার্সেস শেখ মুজিবুর রহমান ) মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানী   নেতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের  ফাঁসি দিতে বা  কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণকরতে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের  অভ্যত্থানের মাধ্যমে তা সম্ভব হয় নি  

১৯৭০ সনের ইলেকশন , আওয়ামী লীগের নিরংকুশ জয় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলে দেয় এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক দিকে ক্ষমতা হস্তান্তর আলোচনা  ও গোপনে নিরীহ জনতাকে অক্রোকমন করার নীল নকশা তৈরী করে ছিল   

২৫সে মার্চ, ১৯৭১কালো রাত্রি ঢাকা রাজারবাগ  পুলিশ ফাঁড়ি, ইউনিভার্সিটি আবাসিক এলাকা পাকিস্তানী আর্মি আক্রমণ করে হাজার হাজার নিরীহ ছাত্র জনতাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ এর যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ জনতা যখন পাকিস্তানী সৈন্য রাজাকারদের অত্যাচারে জীবন দিচ্ছে এবং দেশ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, সে সময় পাকিস্তানী নেতা মেজর জেনারেলগন বলেছেন  “মিট্টি চাহিয়ে, আদমী নেহি। অর্থাৎ আমরা ভূমি চাই, লোকজন নয়।তার মানে পাকিস্তানিরা, পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি চেয়েছিলো , সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি চায় নি।

আর একটু গোড়ার দিকে গেলে (১৯৫৬– ১৯৫৮) হোসেন শহীদ সারওয়ার্দী সাহেব পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন।  জেনারেল আয়ুব খান সবে মাত্র মার্শিয়াল এডমিনিস্ট্রেটর হয়েছেন। হোসেন শহীদ সারওয়ার্দী সাহেবকে যেভাবে চাকুরিচ্যুত করে বৈরুত , লেবানন নির্বাসন  দিলেন এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। সারওয়ার্দী সাহেব  মৃত্যুর পূর্ব পয্যন্ত  বৈরুত  হোটেলে থাকতেন। ১৯৬৩ সনে মৃত্যুর আগে পয্যন্ত তাঁকে দেশে ফিরিয়ে  আনা হয় নি । 

পাকিস্তানিরা ২৩ বৎসর ভুল নীতি নিয়ে দেশ পরিচালনা করেছে । পশ্চিম পাকিস্তানের লোক সংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটি এবং পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি  মেজরিটি লোকের দাবি দাওয়াকে অবজ্ঞা করে কি ভাবে একটা দেশ টিকে থাকে ?

পূর্ব পাকিস্তানী লোক সংখ্যা হারে সেনা বাহিনী, চাকুরী সর্ব ক্ষেত্রে ছিল বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা  দিয়ে  ইসলামাবাদ পাহাড় কেটে রাজধানী করা ছিল পাকিস্তানী শাসকদের মোটা বুদ্ধির পরিচয় বাঙ্গালীরা পশ্চিম পাকিস্তানের যেখানেই গিয়েছে, অবহেলার শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানী মেয়েরা শাড়ি পড়ে,কপালে টিপ্ দেয় (বিউটি স্পট) ওটা ও সমালোচনার বিষয় ছিল বাঙ্গালীরা মাছ খায় যা থেকে দুর্গন্ধ হয় (মুসলি খানেওয়ালে বাঙ্গালি  , মুসলিছে বদবু হোতা হায়) অর্থাৎ মাছ খাওয়া বাঙ্গালি, মাছে দুর্গন্ধ হয় । সর্ব ক্ষেত্রেই বাঙ্গালি ছিল  অবহেলিত  ভাতৃত্ব  না থাকলে একটা পরিবার ও টিকে থাকে না, একটা জাতি অনেক বড়ো ব্যাপার     

বাংলাদেশ ৫০ বৎসরের সুবর্ণ জয়ন্তী পূর্তি জাতির জন্য একটা মাইল ফলক  জাতীয় সমস্যাদি কাটিয়ে এ জাতি উত্তর উত্তর উন্নতির শিখরে এগিয়ে যাবে এই আসা করছি   আমি একজন বাঙ্গালী, আমার দেশে কি গরিব,কি ধনী, কি কৃষক,  কি মজুর, কি হিন্দু,কি মুসলিম, কি বৈদ্ধ,কি খ্রিষ্টান   আমরা সবাই এক মায়ের সন্তান আমার দেশের প্রতিটি মানুষ হিংসা,বিদ্বেষ, হানা হানি, নিজের স্বার্থ  ভুলে গিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে দেশের উন্নতি সাধন করবে, এটাই জনগণের  প্রত্যাশা

সমাপ্ত 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন