আজকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রথমেই সকল বুদ্ধিজীবিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে কিছু কথা লিখছি। তবে আমি মনে করি শুধু মাত্র মাঝে মাঝে তাদেরকে স্মরণ করা এবং কিছু লেখালেখি বা অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে তাদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান করা হয় না। হানাদার বাহিনীরা আমাদের বুদ্ধিজীবিদের হত্যার মাধ্যমে আমাদের বুদ্ধিকেই হত্যা করতে চেয়েছিলো।
এখন কথা হলো তারা কতখানি সফল হয়েছে। কথায় বলে মানুষকে হত্যা করতে পারো কিন্তু তার দর্শন, আদর্শ বা চেতনাকে হত্যা করতে পারবে না। আমি মনে করি কথাটি ঠিক আবার বেঠিকও। একটি মানুষকে এবং তার দর্শন, আদর্শ বা চেতনাকে হত্যা করতে হলে আসলে দুইটি পক্ষ লাগে। এর একটি পক্ষ হলো যে স্বয়ং মানুষটিকে হত্যা করছে সে, এবং মৃত মানুষটির রেখে যাওয়া আশেপাশের মানুষগুলি।
হত্যাকারী মানুষটাকে হত্যা করে চলে গেলে মানুষটির আসে পাশের মানুষ যদি তার বুদ্ধিদীপ্ত আদর্শ বা চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে এবং বাস্তবে পরিনিত করে সামনে এগিয়ে না নিতে পারে তখনই মানুষটির সবদিক থেকেই মৃত্যু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে খুন হওয়া মানুষটির হত্যাকারীর সাথে তার রেখে যাওয়া আসে পাশের লোকগুলিও হত্যাকারীর মতো অনেকাংশে দায়ী, কারণ তারা মানুষটির আদর্শ বা চেতনাকে অবহেলা করে তার হত্যাকারীর উদেশ্য সফল করতে সহায়তা করেছে। হত্যাকারী, এক্ষেত্রে হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ শুধু আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা ছিল না, বরং তাদের বুদ্ধি, আদর্শ, চেতনা বা দর্শনকে ধ্বংস করা, যাতে করে তাদের রেখে যাওয়া লোকগুলি, অর্থাৎ আমরা বাঙালিরা যেন বোকা থেকে যাই। এখন তারা কতখানি সফল হয়েছে সেটা বোঝা যাবে আমাদের সে সমস্ত বুদ্ধিজীবিদের আদর্শ, দর্শন বা চেতনাকে বাস্তবে কার্যকরী করার মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা চেষ্টা করে জাসছি তাদের সেই আদর্শ, দর্শন বা চেতনাকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীর মূল উদ্দেশকে পরাহত করতে, কত দূর পেরেছি ? এ প্রশ্ন সবার কাছে।
আমি মুক্তি যুদ্ধ করিনি বা তখন অতটা বুঝতামও না, তবে আমার বাবা যুদ্ধ করছেন পুরা ৯টি মাস এবং আহতও হয়েছেন। তার কাছ থেকে এবং পরবর্তীতে অসংখ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে শুনেছি যে তারা দল-মত নির্বিশেষে যুদ্ধ করেছিলেন শুধু মাত্র যুদ্ধকালীন সময়ে দল-মত নির্বিশেষে এক সাথে থাকার জন্য নয়, বরং তারা চেয়েছিলেন শোষণহীন, নিপীড়িত, মৌলবাদী এবং নির্যাতিত একটি সমাজ বেবস্থা থেকে বেরিয়ে আগামী দিনগুলিতে দল-মত নির্বিশেষে মান সম্মানের সাথে একটি সমাজে বাশ করতে, হয়তোবা সে সমাজ খুব বিত্তবান নাইবা হলো। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী বছরগুলির কর্মকান্ড দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তোবা আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা দল-মত নির্বিশেষে থাকতে চেয়েছিলেন শুধু মাত্র ৯ মাসের জন্য। শুধুমাত্র ভৌগোলিকভাবে একটি দেশ এবং একটি ভাষা পেলে কি সব হয়ে গেলো। দেশ অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি হস্ছে তবে, মনুষত্বের বা মূল্যবোধের উন্নতিটার গতি খুবই শ্লথ।
তবে আমি একজন অত্তান্ত আশাবাদী লোক তাই আশা ছাড়তে রাজি নোই। তাই আসুন আমরা সবাই আমাদের সমস্ত শহীদদের আত্মার প্রতি দোয়া রেখে শপথ নেই, যাতে করে আমরা যেন আমাদের মনুষত্বের বা মূল্যবোধের উন্নতির মাধ্যমে তাদের আশা, আকাঙ্খা, আদর্শ বা চেতনাকে জীবিত রাখি, এবং সেই হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেই যে তারা আমাদের বুদ্ধিজীবিদেরকে হত্যা করলেও তাদের বুদ্ধিকে হত্যা করতে পারেনি। বুদ্ধিজিবি না থাকলেও তাদের বুদ্ধিদীপ্ত আদর্শ, দর্শন, চেতনা এবং মূল্যবোধ থাকবে আমাদের হৃদয়ে এবং কর্মকান্ডে, এই কামনাই শেষ করছি।
সবাই ভালো থাকবেন।
বি. মুকুল
টরন্টো