আজ সারারাত প্রচন্ড গরম ছিল, রুবিনা দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। খুব সকালে উঠে ফজর নামাজ পড়ে সে রাস্তায় এসে দাড়ালো। লাল সবুজের কাগজ আর রং দিয়ে চারিদিক সাজানো। রুবিনার বুকের মধ্যে প্রচন্ড এক ঝড় খেলে যাচ্ছে, দেখছে ৫১ বছর আগের সেই দিনের সব কিছু স্পষ্ট চোখে ভাসছে। এই দিন সে আগেও দেখেছে প্রতিবারই কেন ওলট পালট করে দেয় তার মন!
চারিদিকে কেমন গুমোটভাব,মন খুলে কেউ কথা বলেনা। তাদের এক রকম বদ্ধ হয়েই থাকতে হয়, চাপা অস্বস্তি সবার মাঝেই। পাশের বাসার রেবেকা,জুই, নতুন চাচী তারাও মেপে কথা বলে।
কিছুতেই আর থাকা যাবেনা এখানে বাবা,মেজ চাচা বলে। এই দেশে থাকা তাদের জন্য আর নিরাপদ না, তারাই হবে বাংগালীদের প্রথম টার্গেট। কারন পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে, বিনা অপরাধে নিরীহ নিরস্ত্র বাংগালীদের হত্যা করেছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাড়াতাড়ি।
রুবিনাদের আমগাছ, নারিকেল গাছে ঘেরা দোতলা বাড়ী ছিল মোহাম্মদপুরে। সেখানে তার পুরো পরিবার থাকতো। সেখানে আরোও অনেক বিহারীদের বাড়ী ছিল, আরা এসেছিল ১৯৪৭ এ দেশভাগের সময় ইন্ডিয়া থেকে। বিহার রাজ্য থেকে আসার কারনে সবাই তাদের বিহারী অবাঙালী বলে। তাদের ভাষা হিন্দি আর উর্দু। কিন্তু জন্মসূত্রে তাদের কোন পাকিস্তানী শেকড় নেই। অথচ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তাদের পাকিস্তানি আখ্যা দেয়া হয় ভাষার কারনে।
২৬ শে মার্চ ঢাকায় প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়েছে, ঠিকমতো খবর না পাওয়া গেলেও বোঝা যাচ্ছে অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, মানুষ পালিয়ে যাবার বিভিন্ন পথ খুঁজছে। রুবিনার বাবা আফসার উদ্দীন রাতে পুরো পরিবারকে একত্রে ডেকে বললেন শোন আমাদের ৫/১০ দিনের মধ্যেই পালাতে হবে, এখানে আমাদের থাকা নিরাপদ না। যেভাবে নিরিহ মানুষকে মেরেছে তার প্রতিশোধ নিবে আমাদের উপর।
রুবিনা তার চাচাতো বোন জোবায়দাকে বললো আমি যাবনা রে। জোবায়দা তাকে বোঝালো, দেখ বুবু এখন পাগলামী করিসনা, দেখিস না সব ফেলে শুধু পরনের কাপড় নিয়েই সবাই পথে বের হয়ে যাচ্ছে। রুবিনা ওকে আর কিছু বলেনা। ছোট ভাইটাকে আদর করে কোলে নিয়ে। মনে মনে ভাবে এ জীবনে তোদের সাথে আর দেখা হবে না। সে সিদ্ধান্ত নেয় ও হাসিবের সাথে পালিয়ে থেকে যাবে এদেশেই।
হাসিব রুবিনার বড় ভাই শোয়েবের বন্ধু। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বাবার বেকারীর ব্যবসা দেখে। তারাও এই মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা, ওর ভাইয়ের সাথে সেই ক্লাস ৬ থেকে বন্ধুত্ব। রুবিনার ভাই সোয়েব এর কাঠ ভাংগানোর কারখানা আছে। পড়াশুনা আর হয়নি তবে অসুবিধা নেই ব্যবসা ভালোই বুঝে।
এই দেশেই ওদের জন্ম, এদেশকে জেনেছে নিজের জন্মভূমি হিসেবে। গল্প শুনেছে দাদার কাছে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবার সময়, ধর্মের মিল থাকায় ভারত বর্ষের মুসলমানদের দু’দিকে ঠেলে দেয় অনেকে চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে আর অনেকে চলে আসে পূর্ব পাকিস্তানে। রুবিনার দাদা ও তার আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন ভারতের বিহার থেকে। রুবিনা বাংলা ঊর্দূ সবই পারে। স্কুলে ওদের বাংলায় লেখাপড়া শিখতে হয়েছে। তাই ওর সব ধরনের বন্ধুই আছে। হাসিবের সাথে রুবিনার কিভাবে যে প্রেম হয়ে যায়!!
রুবিনা আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে? অবশ্যই, রুবিনা পানি এনে দিতেই টেবিলে গ্লাসটা রেখে হাসিব চিঠিটা রুবিনার হাতে দিয়েই পালিয়ে যায়। বুক ধূক করে ওঠে রুবিনার। কিভাবে সম্ভব! একটা অবাংগলী ছেলের সাথে প্রেম!! দু’ফ্যামিলির কেউ যদি মেনে না নেয়!? অনেক দোলাচালের মাঝে সারাদিন সারারাত কেটে যায়। একটা লাইন বার বার মনে পরে ওর ” সোনার মেয়ে তোমার জন্যই জন্ম আমার”। চিঠির উত্তর না দিয়ে পারেনা সে। কিভাবে যে একটা বছর চলে যায়!! শুধু চিঠি লিখে আর সামান্য দেখায়! তবে ওরা একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। এর মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
সেদিন সারাদিন সবাই গোছগাছ করছে, পালাবে রাতে। রুবিনাও গুছিয়ে নিয়েছে সব,কেউ জানেনা কি যুদ্ধ চলছে তার ভিতর। রাত দশটায় সবাই যখন এক সাথে বেড়িয়ে পরে সে পালিয়ে যায় পেছন থেকে, গলির মাথায় দাঁড়িয়ে সবার চলে যাওয়া দেখে। নিজের আত্মার সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলো!? হু হু করে কেঁদে ওঠে। এক দৌড়ে চলে যায় চৌ রাস্তার মাথায় যেখান থেকে হাসিবদের বাড়ী দেখা যায়। সব যখন ছেড়েছে তখন আর ভয় কিসের। টিনের দরজায় কড়া নাড়তেই ভয়ে ভয়ে হাসিব দরজা খুলে দেয়। ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, তুমি কেন আমার বাসায় এসছো?আমি এখন কি করব?
রুবিনা কান্নায় ভেংগে পরে, তার সবাই ওপাড়ে চলে যাচ্ছে সে পিছন থেকে পালিয়েছে শুধু হাসিবের জন্যই।
হাসিবের মা মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকিয়ে সব জানতে চায়। সে রাতটা কাটিয়ে সকালেই ওর মা হাসিব ও রুবিনাকে পাঠিয়ে দেয় তার বোনের বাড়ী শ্রীনগর। সেখানেই ওরা বিয়ের ব্যবস্থা করবে। ভোর রাতে হেটে রওয়ানা হয়, শ্যামলী আসার পরে একটা রিক্সায় কিছু দূর এলে মেলেটারীর গাড়ী দেখে রিক্সাওয়ালা তাদের গলির মুখে নামিয়ে দেয়। একবার হেটে, রিক্সায়,নৌকায় বুড়িগংগা পার হয়ে যখন তারা মুন্সীগঞ্জ শ্রীনগরে পৌছায় তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। খালা, খালুকে সব বলার পরে পরের দিন সকালে মসজিদের হুজুরকে ডেকে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দেন খালু। বিয়ের মাত্র ১০ দিন পরে হাসিব ফিরে আসে ঢাকায়। রুবিনার সেদিন মনে হলো এ পৃথিবীতে আর কেউ রইলোনা। অনেক কেঁদে ছিল সেদিন ওরা দুজনেই। হাসিব বলে দেশের পরিস্থিতি ঠিক হলেই তাকে ঢাকায় নিয়ে যাবে।
বন্ধুরা হাসিবকে খুঁজে না পেয়ে ধরে নিয়েছে সে পালিয়েছে সেই বিহারী মেয়েকে নিয়ে। সেটা যে অসত্য আর নিজের পরিবার,দেশকে বাঁচাতে ঢাকায় ফিরেই হাসিব মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। রুবিনা কোন খোঁজ জানেনা আর। খালা,খালু থাকেন গ্রামে সেখানেও মিলিটারি ঢুকে পরেছে, সেখান থেকে নদীর ওপাড়ে চলে যায় তারা, সাথে রুবিনা। ততোদিনে বুঝতে পারে তার শরীরের ভিতর জন্ম নিয়েছে আরেকটা শরীর। যুদ্ধের তেমন কোন খবরই জানেনা তারা, শুধু জানে প্রতিদিন হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, হয়ত এক দিন স্বাধীন হবে দেশ। রুবিনার ভাংগা ভাংগা বাংলা বলা দেখে অনেকেই প্রশ্ন করে খালাকে এ কিভাবে আপনার ভাগ্নে বউ হয়,খালা এড়িয়ে যান আর রুবিনাও খুব কম কথা বলে। এর মধ্যেই মানুষ বুঝতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে চারিদিক থেকে আক্রমণ করছে সাথে ভারতের সহযোগিতা পাকিস্তানিরা পিছু হটছে। খুব শীঘ্রই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। সেই স্বাধীন দেশে বা তার আগেই কি জন্ম হবে তার সন্তানের?
শীতকাল এসে গেছে, দেশ প্রায় স্বাধীন। যেকোন দিন সারা দেশ উল্লাসে মেতে উঠবে। সেদিন রুবিনা কি করবে? সেতো সব হারিয়েছে, যার জন্য সে এদেশে ফেরারী হলো,নিজের আত্মাদের হারিয়ে ফেলেছে সে কি ফিরে আসবে? তাকে কি গ্রহণ করবে?
ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। এখন যেকোন সময় রুবিনার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, ডিসেম্বরের শেষ দিজে খালু রুবিনাকে নিয়ে ঢাকায় যান। হাসিব যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে। রুবিনাকে দেখে হাসিব ও তার পুরো পরিবার আতকে উঠে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সবার হাতেই অস্ত্র। কেউ যদি প্রচার করে দেয় এক বিহারি মেয়েকে সে আশ্রয় দিয়েছে বা বিয়ে করেছে, তাদের বাড়ী ঘর সব জ্বালিয়ে দিবে এমন কি তাকেও প্রানে মেরে ফেলবে।
১৭ বছরের রুবিনার সারাপৃথিবী উলটে গেল, চোখে সে কিচ্ছু দেখতে পারছে না। আস্তে আস্তে নিজের জন্ম ভিটায় আসে। সেখানে এখন অন্য মানুষ দখল করে আছে। তার জায়গা কোথায়!!?
সে আর হাটতে পারছে না, কখন যে জ্ঞান হারিয়েছে জানে না। নিজেকে যখন খুঁজে পেল তখন সে মোহাম্মদপুর কালশী বিহারী কলোনীতে। আশ্রয় দিয়েছেন এক বৃদ্ধ চাচা চাচী। মাত্র ৮ দিন পরেই তার কোল জুড়ে আসে এক পুত্র সন্তান। সেই থেকেই জীবনে আরেক যুদ্ধে জড়ায় রুবিনা।
কতবার ছেলেকে গল্প শুনিয়েছে তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, এদেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু বাবার খোঁজ কোনদিন দিতে চায়নি,গল্পের ছলে ছেলে জেনেছে তার বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এটা বিজয়ের ভীষন গর্বের তবুও সেটা কখন ও বলতে পারেনি কাওকে। মা তাকে তার বাবার নাম বলেনি কখনো।
রুবিনার বয়স প্রায় ৭০ বছর এখন চোখেও কম দেখে হাটতেও পারেনা, তবুও থেকে গেছে সেই কালশীতে। ছেলে চায় সে তার কাছে থাকুক বউ, নাতী নাত্নীদের নিয়ে। নিয়ে যাস বাবা যখন আমার আর উঠে দাড়ানোর শক্তি থাকবে না। যেতে চায় না এখান থেকে দূরে, এই কলোনীতে তার মতো আরোও মায়েরা আছে, যারা সব হারিয়েছে।।
রুবিনা আর কোনদিন হাসিবের সামনে দাঁড়ায়নি, চায়নি তার সন্তানের অধিকার। দেখেছে টিভিতে সে এখন দেশের অনেক বড় পদে আছে, তার সন্তানেরাও আছে অনেক ভালো।
এই স্বাধীন দেশে তার মাত্র একটা চাওয়া আছে, যারা এদেশকে ভালোবেসে বা যেভাবেই হোক এখানে থেকে গেছে তাদের যেন মানবেতর জীবন থেকে রক্ষা করে। কিন্তু কাকে বলবে সে কথা!?
বিজয় আমি মারা যাবার পরে এই বেড়ীবাঁধের পাশে আমাকে কবর দিস। হয়ত কেউ বাজাঁবে বাশী মায়াবী সন্ধ্যায়, আমি প্রাণ ভরে নিব আমার মুক্তির স্বাদ।
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ওই আকশে”।