মহাবিশ্বের বিশাল সৃষ্টির মধ্যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। অনেকটা মহাসাগরের ফেনিল জলরাশিতে সৃষ্ট বুদ্বুদের মতোই। পৃথিবীতে আমাদের আগমন, অবস্থান, প্রস্থান কোনো কিছুই বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না যদি না আমাদের এই  ক্ষনস্থায়ী জীবন স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির কোনো কাজে না লাগে। অকিঞ্চিৎকর এই জীবনেও আমরা অনেক অসাধারণ মানুষের দেখা পাই, এমন অনেক মানুষের সাহচর্যে আসি, সাধারণ দৃষ্টিতে যাদেরকে বুঝার উপায় নেই। সাধারণ হয়েও নিজ গুনেই এরা অসাধারণ । মেঘে ঢাকা তাঁরার মতোই সহজে তাদের দেখা মেলে না । আপাত বাহ্যিক রূপ দেখে বুঝার উপায় থাকে না যে মানবিক সত্তায় বা মানবিক গুণাবলীতে এসব মানুষের অবস্থান আসলে কোন স্তরে । এমনি একজন মানুষ ‘সায়মন’ । সঙ্গত কারণেই ছদ্ম নামের ব্যবহার ।

সেন্টার ফর এডিকশন এন্ড মেন্টাল হেলথ (CAMH) এর কুইন স্ট্রিটের অফিস থেকে এক ক্লায়েন্ট কে নিয়ে সমন্বিত সেবা পরিকল্পনা (Coordinated Care Planning) বিষয়ক একটি মিটিং শেষে ফিরছি। ভবন থেকে বের হয়ে কুইন স্ট্রিটের দিকে এগুতে গেলেই গাছ গাছালিতে ভরা সবুজ এক চত্বরের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় । CAMH তাদের নিজস্ব এই জায়গাটিকে  “Patient Recovery Zone” নাম দিয়ে ধূমপান মুক্ত করে রেখেছে । রোগীরা কেউ একাই বসে আছে , আবার কেউ জটলা বেঁধে গল্প গুজবে ব্যস্ত। চত্বরের মাঝামাঝি আসতেই আমার নাম ধরে কারো ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি সায়মন। সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাসছে মিটি মিটি। কাছে যেয়ে কুশল জিজ্ঞেস করতেই উঠে দাঁড়ালো। বললো কোনো এক বিশেষ কারণে এখানে ভর্তি হয়েছে একসপ্তাহ আগে, এখন একটি গ্রুপ কাউন্সেলিংএ নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। সায়মনের সাথে আমার পরিচয় এক হাসপাতালে । হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গুরুতর অসুস্থ আমার এক ক্লায়েন্টকে দেখার জন্য যখনি আসি, তখনই দেখি সাইমনকে। ভাবলেশহীন, নির্লিপ্ত এক চেহারা নিয়ে বসে থাকে আমার ক্লায়েন্টের পাশে । সুযোগ পেলেই এক ঘন্টার পাস নিয়ে হুইল চেয়ার এ বসিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে হাসপাতাল সংলগ্ন ফুলের বাগান, ক্যাফেটেরিয়া অথবা প্রার্থনার হল। নার্সিং স্টেশন থেকে নার্সকে ডেকে নিয়ে আসে খাবার, ঔষধ বা স্যালাইনের প্রয়োজনে । ভাবে মনে হয় যে আমার ক্লায়েন্টের ব্যক্তিগত সহকারী। একদিন নিজে থেকেই জানালো যে একই subsidized হাউসিংএ পাশাপাশি দুই রুমে তারা থাকতো, সম্পর্ক স্রেফ বন্ধুত্বের। বন্ধুর জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সে প্রস্তুত। অবস্থা অবনতির সাথে সাথে সাধারণ ইউনিট থেকে একসময় আমার ক্লায়েন্ট কে স্থানান্তর করা হয় পালিয়াটিভ কেয়ার এ। প্রশ্ন উঠে কে হবে বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী (সাবস্টিটিউট ডিসিশন মেকার)। বন্ধুর সম্মতিতে নির্ধিধায় এগিয়ে আসে সায়মন। কাঁধে তুলে নেয় আর এক গুরু দায়িত্ব। না ফেরার দেশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পালিয়াটিভ কেয়ার এ আমার ক্লায়েন্টের অবস্থান ছিল প্রায় তিন মাস। বন্ধুর মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একই রকম নিষ্টা ও সততা নিয়ে ক্লান্তিহীন, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছে সায়মন। কোনোদিন বিরক্তির লেশমাত্র ও দেখিনি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ফিউনারেল হোমে বন্ধুর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করার কাগজপত্রেও স্বাক্ষর করেছে সায়মন। নিতান্তই একজন বন্ধুর জন্য কেন এতো কিছু করছে জিজ্ঞেস করলে বলতো, “Perhaps this is an eternal rent I must pay for the space I occupy in this planet”. অবাক হয়ে ভাবতাম স্বার্থকেন্দ্রিক এই দুনিয়ায় এখনো এতো নিঃস্বার্থ মানুষ আছে। যারা প্রতিদানের আশায় নয়, শুধু হৃদয়ের তাগিদেই এগিয়ে আসে অন্য মানুষের সেবায়।

সমাজ সেবার বিভিন্ন শাখায় কাজের সুবাদে মাঝে মাঝেই আমরা এরখম মেঘে ঢাকা তাঁরার সন্ধান পাই। নিভৃতচারী এসব মানুষের সংস্পর্শে এসে সম্মৃদ্ধ হয় আমাদের নিজেদের মানবিক সত্তার ভীত, অনুপ্রাণিত হই নুতন প্রেরণায়। আমার নিজের আত্মউপলব্দি এবং জীবনবোধ আরো প্রখর হয়ে উঠে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্দব, অনেকেই মাঝে মাঝে  জানতে চান অন্য পেশায় না গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য এবং আসক্তি নিয়ে কাজ করার যৌক্তিকতা। উত্তরে Edith Wharton এর একটি উক্তি ধার করে বলি, “There are two ways of spreading the light in the darkness. Be the candle that generate the light or be the mirror to reflect that light”। প্রদীপ হয়ে মানুষের জীবনে আলো জ্বালানোর ক্ষমতা আমাদের নেই, কিন্তু আয়না হয়ে সেই আলোর প্রতিফলনের সামর্থ্য নিশ্চয় আমাদের আছে। সমাজের আশাহীন, স্বপ্নহীন মানুষদের জন্য না হয় আমরা ক্ষুদ্র সেই চেষ্টাই করে গেলাম। কে জানে, এই চেষ্টায় আমাদের নিজেদের জীবনও হয়তো একদিন আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারে, সার্থক হয়ে উঠতে পারে “purpose of life ” ।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

2 মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন