আসলে চাকরি মানে “কিছু কাজ যা করতে হবে”, বাধ্যবাধকতা থাকে। চাকরিজীবী ব্যাক্তি আয় রোজগার ইচ্ছেস্বাধীন মতো করতে পারে না। যেহেতু চাকরি মানে একজন ব্যাক্তি অন্য কারোর কর্মচারী হয়ে কাজ করে তার কাছ থেকে বেতন পায়। ফলে চাকরিরত প্রতিষ্ঠানটির বিস্তৃতি- প্রভাব ও অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীদের মান ইজ্জতও মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। চাকরি নির্ভর জীবিকার চাইতে উদ্যোগ নির্ভর জীবিকা অধিক সম্মানের। যে চাকরি করে আর যে চাকরি দেয় দুজন কখনোই সমান নয়। যে যাই বলুক ছাত্রজীবনে ভাল মেধা ও রেজাল্টের গুরুত্ব থাকলেও কর্মজীবনে যেয়ে আয়রোজগারের পরিমাণটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। ভাল ছাত্র হলেই ভাল পাত্র হওয়া যায় না। আমি সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্যক্রমে এক পরিচিত সাংবাদিক ভাইয়ের বিয়ের জন্যে ঘটকালি করতে যেয়ে মেয়ে পক্ষের অভিভাবকদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম যে-পেশায় সাংবাদিক বুঝলাম কিন্তু আর কি করেন? ফলে সব পরিচয় সব জায়গায় একই রকম গ্রহণীয় হয় না।

আরেকটি ব্যাপার চাকরি খন্ডকালীন নাকি পূর্ণকালীন ? খন্ডকালীন চাকরি প্রথাটি ইউরোপ, আমেরিকায় প্রচলিত হলেও এশিয়ায় তেমন একটা প্রচলিত নয়। বাংলাদেশে যেখানে পূর্ণকালীন চাকরি জোটাতে ডজন ডজন জুতা ক্ষয় করতে হয় সেখানে আবার খন্ডকালীন চাকরী! অবশ্য এখন যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে তৈরি হচ্ছে চাকরির নতুন নতুন ক্ষেত্র। যাদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা আছে, তারাই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি খন্ডকালীন চাকরির মধ্য দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছে।

২/৩দিন আগে এক আড্ডায় নতুন সরকারি চাকরি পেয়েছেন এমন একজনকে কয়েকজনের প্রশ্নে বেশ বিব্রতই দেখলাম। জিজ্ঞাসা ও কৌতুহল- দোস্ত কতো টাকা লেগেছে? চুপ করে থাকতে দেখে আরেকজন বলে উঠলো- আরে আজকালতো টাকার জোর কিংবা মামার জোর না থাকলে চাকরি নামের সোনার হরিণ জুটেনা। এটা সবাই জানে। সবার আগ্রহে সে বলেই ফেললো- আমার সাথে ৮লাখ/১০লাখ করেও দিছে, আমার এক পরিচিত…….থাকায় ৫ লাখেই হয়েছে। তারপরও সরকারি চাকরি অনেকেরই পছন্দ এর নিশ্চয়তার কারণে। একবার পেলে তা সহজে যায় না, চাকরি নিরাপদ। আর রাষ্ট্র যেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে ফলে সরকারি চাকরিজীবীরা অবস্থানভেদে ক্ষমতাবান হয়ে উঠে। অনেক সময় দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে পেনশনের আশায় শুধু বসে না থেকে উপরি অর্জনের মাধ্যমে অতিরিক্ত সঞ্চয়ের পথ ধরে।

বাস্তবতা হচ্ছে চাকরি যিনি করেন তার জন্মই যেন হয়েছে উর্ধ্বতনের হুকুম তামিল করার জন্য। অধস্তনদের হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা উর্ধ্বতনদের। ফলে যে যতো নীচে থাকে তাকে তত বেশি হুকুম তামিল করতে হয়। অনেকক্ষেত্রেতো প্রত্যেক মানুষের থাকা মৌলিক সৃষ্টিশীলতা হারিয়েই যায়। অনেকে সোশ্যাল স্টাটাস বাড়াতে আয়রোজগারের সুযোগ সুবিধা গ্রামে বেশি থাকলেও শহরে বসবাস করেন কিংবা দেশে উপার্জনের সুব্যবস্থা থাকলেও বিদেশমুখী হন। সব সময় অর্থনৈতিক চাহিদাগত কারণ ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানান কারণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বিদেশে প্রবাসীরা চাকরি এবং প্রকৃত বাস্তবতার কথাও অনেক সময় সংকীর্ণতায় ভূগে অথবা আত্বীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবদেরকে আশাবাদী রাখতে স্পষ্ট তুলে ধরেন না। রুঢ় বাস্তব হলো দেশ থেকে বড় ডিগ্রি এবং বড় কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে উন্নত অনেক দেশে যেয়ে দ্রুত প্রফেশনাল চাকরি পান না। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশে এদেশের অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , দেশের ভূত পূর্ব বড় সরকারী চাকরিজীবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/শিক্ষিকা, বড় প্রতিষ্ঠানের ভূতপূর্ব কর্মকর্তা আছেন যারা খাবার হোটেলে বয় বেয়ারার, চায়ের দোকানে ক্যাশিয়ার, ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরে বা ফ্যাক্টরীতে চাকরি করছেন। এদের কেউ কেউ এ কাজ করে বাড়ি গাড়ি করছেন এবং মানসিকভাবে ভালই আছেন। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা এভাবে আছেন কিন্তু মন থেকে কখনোই এ জীবন মেনে নিতে পারেন না।

পত্রিকায় দেখলাম- ভারতে উত্তরপ্রদেশে ৩৬৮টি পিওন পদের এক সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ২৩ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনকারীদের মধ্যে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৪ পিইচডিধারীও রয়েছেন। সেখানকার সচিবালয়ের ওই চাকরিতে মাস্টার্স পাস আবেদনকারীর সংখ্যা ২০ হাজার। আর হাইস্কুল পর্যন্ত পড়েছেন, এমন চাকরি প্রত্যাশী রয়েছেন প্রায় ৫ লাখ। বেকারত্ব কোন জায়গায় পৌঁছেছে, উত্তরপ্রদেশের এই পরিসংখ্যানই তা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশে চাকরিটা কতো গুরুত্বপূর্ণ যে চাকরি চলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রেম ভালবাসা সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে ভাবা হচ্ছে। তাইতো অনুমতি ছাড়া বিদেশি নাগরিকদের বিয়ে করার ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত বিল সংসদে উত্থাপিত হয়। ‘শাস্তি স্বরূপ’ চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধানও থাকে। অর্থাৎ চাকরিটােই আগে, চাকরিটাই বড়; তারপর অন্যকিছু।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সোথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। রোবট এবং এ্যালগরিদমগুলো বেশ কার্যক্ষম হয়ে উঠছে গাড়ি বানাতে, প্রবন্ধ লিখতে, ভাষা রুপান্তর করতে – সেই কাজগুলো করতে যা এক সময় করতে মানুষের দরকার পড়ত। আসলে নতুন প্রযুক্তি আসে, নতুন ধরনের কর্মক্ষেত্রও তৈরি হয়। ফলে মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে, টিকে থাকতে পারে। চাকরি মানে শুধু বেঁচে থাকার উপায়

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন