মা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি, দেশকে মুক্ত করে ঘরে ফিরব। আমি জানি তোমাকে বলে যেতে পারব না, তুমি যেতে দিবে না আমাকে। আমি তাই ছোট্ট চিঠিটা লিখে গেলাম, দোয়া করো। এই চিঠি যখন হাতে পেলেন মা, ছেলে তার চলে গিয়েছে এলাকার অন্য ছেলেদের সাথে কোন ক্যাম্পে প্রশিক্ষন নিতে, দেশকে স্বাধীন করতে ।
পুরো বাড়ীতে গোপনে কান্না চললেও মায়ের কান্না ছিল সরবে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এভাবেই দেশের জন্য বাড়ী থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন যে ছেলে, তার নাম ইউনুস মোল্লা। চর ভদ্রাসন কলেজের (বি এ) পড়তেন তখন। আমার বাবার ৭ ভাইয়ের ৬ নাম্বার ভাইয়ের ছেলে। আমাদের ৫ কাকা ছিলেন চরভদ্রাসন, ২ জন চর মাধবদিয়ায়।
যুদ্ধের সময় আমার বয়স ৫ বছর, খুব বেশী মনে নেই তেমন। তবে কিছু কথা মনে আছে, বাড়ির সবার, আমার মা,বাবার মুখে শুনে শুনে মনের ভিতর গেথে গিয়েছে।
একদিন মধ্য রাতে অনেক লোকের কথা ও অট্টোহাসিতে ভয়ে ঘুম থেকে উঠে যাই। আমরা তখন ৪ ভাইবোন, আব্বা আমাদের ফরিদপুরের ভাংগা থেকে বাড়ীতে রেখে গেছেন। মা আর আমার নানী বোঝাচ্ছেন শান্ত হ, ভাত দেই সবাই খা তোরা । আমার মনে আছে এই ভাত তরকারীতে সবার হবেনা দেখে নানী গেলেন আমার মেজো চাচীর ঘরে, ধলা চাচীর ঘরে। ইতিমধ্যে আমার মেজো কাকা,ধলা কাকা আরোও চাচাত ভাইয়েরা আসলেন আমাদের ঘরে।
মেজো কাকা ছিলেন গ্রামের তথা পুরো এলাকার খুব সন্মানিত একজন। তাকেই প্রথম শাসানো হলো “এই বাড়ীতে যেন পাকিস্তানের কোন পতাকা না উড়ে ” মুক্তি যোদ্ধাদের যেন সহায়তা করা হয়। আমার কাকারা শান্ত হতে বলে কথা দেন তুই যুদ্ধে গেছিস সাবধানে থাকিস।
আমার মনে আছে, চাদরের নীচ থেকে রাইফেল না কি যেন বের করে নাড়াচাড়া করছিলেন, প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম।
আমার মা ছিল সবার কুটি চাচী, আমাদের নতুন ঘরেই থাকতেন চাচাতো ভাইয়েরা,রেডিও শোনা, গল্প করা সব চাচীর সাথে। বাড়ীর কাচারী ঘরে জায়গা হতোনা সবার । আব্বা সেজন্য এই ঘর করছিলেন। মা বলছিলেন ইউনুস মাথা ঠান্ডা রাখ, তোর কুটি কাকাও তোর জন্য খুব গর্বিত। চলে গেলেন যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার মেজো কাকা এক সময় সিদ্ধান্ত নিলেন আমার মা, চাচাত বোন ও বাড়ীর বউদের চর ঝাউকান্দা পাঠিয়ে দিবেন। আমরা খুব খুশী নৌকায় করে যাব, সবাই খেলব। যুদ্ধ দিয়ে কি হবে!
কিন্তু তার মাত্র ২/৩ পরেই দেখি আমাদের বাড়ীতে অনেক হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিতে এসেছে,সেখানে বড় বড় মেয়েরা ছিল। সেদিন আমাদের এলাকার কয়েকটি হিন্দু বাড়ী পোড়ানো হয়েছিল, তার মধ্যে প্রফুল্ল ডাক্তারের বাড়ী ছিল।
ধলা কাকা (৫ নাম্বার) রেডিওতে খবর শুনতেন আমাদের ঘরে,আব্বা মাঝে মাঝে বাড়ী আসেন। আমার নানী রাতে সুর করে কান্না করেন , সবাই তাকে আস্তে কাদতে বলেন যদি কেউ শুনে ফেলে।
আমার ছোট মামা ফজল মোল্লা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, ওনাদের দল প্রধান জালাল কমান্ডার। তারপর আরোও শুনি আমার ফুফাতো বোনের ছেলে হালিম মৃধাও( উনি জীবিত) ভারতে চলে গেছেন মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। আমার সেই বোন এসে কান্না করেন তার ছেলের জন্য। সব মিলিয়ে যুদ্ধ যে আনন্দের কিছু না বুঝতে পারছি তখন।
১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো, সবাই রেডিওতে শুনছে। আমরাও পাটখড়িতে কাপড় বেধে পতাকা উড়াচ্ছি সারাদিন।
বেলা তখন প্রায় পরে গেছে, ছালাম ভাই আসছেন চরমাধবদিয়া থেকে উনি ইউনুস ভাইয়ের বড় ভাই। বাড়ীতে কান্নার রোল পরে গেল “ইউনুস আর নাই ” ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল বেলা ফরিদপুরের সি এন্ড বি ও শ্রামদি ঘাটের মাঝে বিহাড়ীদের গুলিতে উনি শহীদ হন।
জায়গা টা বাড়ী থেকে মাত্র ২/৩ কিলোমিটার।
স্বাধীনতার সুর্যটা দেখা দেখা হলো না আর!
তারপর থেকে আমার চাচার পুরো পরিবার প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাবার মতো। আমার চাচী পাগল প্রায়, কাকাও আস্তে আস্তে স্তব্দ হয়ে গেলেন। ছোট ছোট ভাইবোন সবার লেখা পড়া বন্ধ। এই অবস্থায় কাকা মারা গেলেন ১৯৭৯ সালে।
বহু কষ্টে সবাই দাড়ানোর চেষ্টা কিন্তু আমার চাচী আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। একটা মুরগী জবাই করাও সহ্য করতে পারতেন না। বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতেন তার ছেলেকে খুজতে। বাংলাদেশ বিশেষ দিন গুলোতে সারাদিন আহাজারি করতেন, ছেলেকে খুঁজে ফিরতেন। চাচী চলে গিয়েছেন ২০০৬ সালে।
আপনারা জানেন কিনা জানিনা, অবিবাহিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার কোন সরকারী সন্মানী পাবার যোগ্যতা রাখেনা বা পায়না।
কিন্তু একজন শহীদের মাকে দেখতে কোন দিন কোন মুক্তিযোদ্ধা বা রাস্ট্রীয় পর্যায় থেকে কেউ যাবে না এটা মেনে নিতে পারিনা।
যার সন্তানের রক্তে এই দেশ তার মাকে সন্মান দেয়া হয় না, এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি হতে পারে।
আমার মুক্তিযোদ্ধা মামাও বেচে নেই, অনেক কষ্টেই জীবন কাটিয়েছেন কিন্তু তার পরিবারের খবর কে রাখে!?
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জানা অজানা সব মুক্তি সেনাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
আমার আরাধ্য স্বাধীনতা আমার পতাকা কারোও দয়ার দানে প্রাপ্ত নয়, আমার এ স্বাধীনতা সব মুক্তিকামী মানুষের হ্নদয়ের কান্না।