রুহি ঘন ঘন সময় দেখছিলো, দেশে মায়ের সাথে ফোন করা বেশ জরুরী। এখন  টরেন্টোর সময় রাত সাড়ে নয়টা, বাংলাদেশ সময় হচ্ছে সকাল সাড়ে সাত টা। সাগরের ফুপু সাগরদের বাড়িতে কালকেই ফোন করে বিস্তারিত বলেছে। শশুর বাড়ির লোকদের সাথে রুহির বাবার বাড়ির লোকজনের যোগাযোগ তেমন নেই বললেই চলে, তাই হয়তো শশুর বাড়ি থেকে রুহিদের বাড়িতে এখনো সাগরের মৃত্যু সংবাদ বিষয়ক কথাবার্তা বলার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। রিফাত ও তিথি আজ একটু তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল রাত থেকে বাচ্চাদের উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। রুহি আরো আধা ঘন্টা খানিক অপেক্ষা করে মা কে ফোন করলো:

‘হ্যালো মা, কেমন আছো ?’  ‘আর বলিস না মা, ভোরে ফজর নামাজ এর পর একটু চোখ বন্ধ করেছি, অমনি তোর বাবা চ্যাঁচামেচি শুরু করেছে, আদা থেঁতলে করে লেবু চা খাবে, অরে বাবা, চা খাবি খা, তার জন্য মন্টুর বৌ আছে ওকে বললেই হয়, আমি কি সারা জীবন খেটেই মরবো ! আর মন্টুর বৌ এর আক্কেল দেখ, এতো বেলা হয়েছে, এখনো ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে।’ রুহির মা গলার স্বর খানিকটা নিচু করে অনেকটা ফিস ফিস করে বললেন, ‘মন্টুর বৌ এর কথা কিছু শুনেছিস মা? ওতো তিন মাসের প্রেগনেন্ট। আমাকেতো কিছু বলে টলে না, সেদিন রান্না ঘর থেকে হুট করে তারাহুড়া করে বাথরুমে যেয়ে হর হর করে বমি করে ফেললো। আমি মন্টুকে বলতেই, হারামজাদা দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বললো, মা, বাড়িতে নতুন মেহমান আসছে। মেহমান না ছাই, ওকে পিটিয়ে তক্তা বানানো দরকার। হারামজাদাটার বুদ্ধিশুদ্ধি আর কোনোদিনই হবে না, দোকানপাট এসময় বন্ধ, আয় রোজগার নেই, বাপের পেনশনের টাকা আর বোনের পাঠানো টাকায় কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালাচ্ছি, এরইমধ্যে এসব কান্ড করার কোনো দরকার ছিল, তুই বল মা?’

রুহি এত দুঃখেও হাসি চেপে রেখে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মাকে বললো, ‘মা,আমি এখন যা বলবো ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনবে, আমার কথা শুনে কোনোরকম চ্যাঁচামেচি বা কান্নাকাটি করবে না, গতকাল তোমাদের জামাই মারাত্মক গাড়ি একসিডেন্ট করে হাসপাতালে ছিল, গতকালই শেষ রাতের দিকে মারা গেছে।’ রুহির মা এবার হাউমাউ করে মরা কান্না শুরু করে দিলেন। এতো বড় একটি ঘটনা ঘটে গেল কাল শেষ রাতে, সারা দিন গেল কিছুই বললি না মা, এখন তোর কি হবে মা, বাচ্চাদের নিয়ে বিদেশ  বিভূঁইয়ে কিভাবে সামাল দিবি?’

-‘মা, শুরুতেই তোমাকে বলেছিলাম, চ্যাঁচামেচি করবে না, এটাতো আর বাংলাদেশ না, মানুষ ধুম করে মরে গেল, ঘন্টাখানিকের মধ্যে কাফনের কাপড়, জোগাড় করে লাস গোসল টোসল করে মসজিদ থেকে খাটিয়ে নিয়ে এসে দাফন শেষ করে কবর দিয়ে ফেললে, এসব দেশে মানুষ মরে গেলে অনেক ঝামেলা হয়, তাছাড়া অনেক খরচপাতি ব্যাপার আছে, তুমি এসব বুঝবে না মা, আর শোনো, তুমি এমন ভাবে কাঁদছো যেন তোমারই স্বামী মারা গেছে, ও মারা যেয়ে এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে মা, আমাকে ও যে কি নির্যাতন করতো ওসব তোমাদের কোনোদিন বলিনি মা, তোমরাতো জানতে তোমাদের মেয়ে বিদেশে মহা সুখে আছে। ও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আমাকে প্রায়ই বাচ্চাদের সামনে মারধর করতো। আমি ইচ্ছা করলেই ওকে পুলিশে ধরে দিতে পারতাম, মান সম্মানের ভয়ে আর বাচ্চাদের কথা ভেবে এতদিন পুলিশি ঝামেলায় যায় নি। প্রায় মাস খানিক হলো আমি বাচ্চাদের নিয়ে ওর ফুপুর বাসায় উঠেছি, ভদ্র মহিলা এই সময়ে হেল্প না করলে খুবই বিপদ হয়ে যেত মা।
-‘এতো সব ব্যাপার আমাদেরতো কিছুই বলিসনি মা!’
-বললে কি করতে, প্লেনে করে এখানে এসে আমাকে উদ্ধার করতে ?
-মা রে, ওভাবে কথা বলিস না, দেখি, তোর বাবার সাথে কথা বলি, মন্টুর সাথে কথা বলি, তুই মনে সাহস রাখিস মা, এসময় সাহস হারালে বিপদ আরো বাড়বেই।’

রুহি ফোন রেখে কিছুক্ষন ফোন হাতে নিয়ে মায়ের কথা ভাবছে, মায়ের সাথে অভাবে কঠিন কঠিন কথা বলা ঠিক হয়নি, মা এমনিতেই নরম প্রকৃতির, হয়তো এতক্ষনে মা সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে, মন্টু হয়তো একটু পরেই মেসেঞ্জারে ফোন করবে। টেলিফোন রেখে, অনলাইন অফ করে, রুহি বিছানায় শুয়ে পড়লো। রুহি শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষন ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কিছুতেই ঘুম আসছেনা। এখন থেকে তার জীবনের বাকি দিনগুলি একাই লড়তে হবে। সবার আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা খুব জরুরী, স্বামী, গাড়ি ও চাকরিবিহীন রুহি এই বিদেশের মাটিতে আরো ভয়ঙ্কর আগামী দিনের কথা ভাবতে থাকে। ই আই (Employment Insurance) এর সামান্য কয়টি টাকা ও বাচ্চাদের বেনিফিটের টাকার উপর সংসার, দেশেও টাকা পাঠাতে হয়। স্কারবোরো বাঙ্গালী এলাকায় থাকার সময় রুহির সাথে কিছু মহিলার পরিচয় হয়েছিল, উনারা বাসায় রুটি, পড়াটা, মিষ্টি ইত্যাদি বানিয়ে বাংলাদেশী গ্রোসারিগুলিতে সাপ্লাই দেয়, আইডিয়াটা একেবারে মন্দ না, রুহি তো এখন বাসায়ই বসে থাকে। ক্যাশ টাকায় এসব করলে দুটো বাড়তি পয়সা আসবে। প্রায় সতেরো -আঠারো ঘন্টা আগেও সাগর বেঁচে ছিল, মরার আগে মানুষটা কি একবারও ভেবেছিলো রুহিকে কিভাবে এক হাতে এই বিদেশের মাটিতে সংসার সামাল দিতে হবে!

বিছানায় শুয়ে এসব আকাশ পাতাল ভাবতে যেয়ে হটাৎ করে রুহির রাজু ভাইয়ের কথা মনে হলো। সাগরের সাথে যখন বিয়ের কথা বার্তা পাকাপাকি, ঢাকা মেডিকেল কলেজের থার্ড এয়ারের ছাত্র রাজুভাই ঈদের ছুটিতে বাসায় এসেছে। রুহি একদিন খাড়া দুপুরবেলা রাজু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলো। রুহি নির্লজ্জভাবে রাজুভাইয়ের হাত ধরে বললো ‘ রাজু ভাই আমাকে বিয়ে করবেন?’ মুহূর্তেই ভয় পেয়ে রাজু ভাইয়ের মুখ একেবারে সাদা কাগজের মতো হয়ে গেলো। কি করছিস, হাত ছাড়, বেকুবের মতো কান্ড করবি না। আমার পক্ষে বিয়ে টিয়ে করা এখন সম্ভব না, পার্টির নিষেধ আছে। তুই তো আবার মার্ক্স্, লেলিন, চেগুয়েভা এনাদের নামই শুনিস নি। এক কাজ করিস, ডঃ নীহার কুমার সরকার সাহেবের লেখা মাত্র এক শত ছেষট্টি পৃষ্ঠার ‘ছোটদের রাজনীতি’ নামে একটি বই আছে পড়ে দেখতে পারিস। আচ্ছা বাদ দে ওসব কথা, তুই এসব বুঝবি না, শুনেছি সাগর ভাই কানাডা থেকে এসেছে তোকে বিয়ে করার জন্য। কানাডা, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এসব দেশ তো আর সৌদিআরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া না, এইসব দেশ হচ্ছে শান্তির দেশ, একটু আধটু ঠান্ডা এই যা, আর তাছাড়া উনি যেখানে থাকেন, শুনেছি সেই টরেন্টো শহরে এতটা ঠান্ডা নাই, উনাকে বিয়ে করে টুপ করে কানাডা চলে যা, দেখবি অনেক সুখে থাকবি, গাছ থেকে পেরে টাটকা আপেল, চেরি, স্ট্রবেরি এসব ফলমূল খাবি, সুন্দর সুন্দর জায়গায় নির্মল বাতাসে লেক টেকের ধরে ঘুরে ফিরে বেড়াবি, নায়াগ্রা ফলেসে পিকনিক করবি, এক গাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফেলবি, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সাদা বরফের উপর দিয়ে স্কেটিং করবি, দেখবি কত সুখে থাকবি। একনাগাড়ে কথাগুলি বলে রাজু খানিকটা দম নিলো। রুহি রাজু ভাইয়ের সব আজগবি কথাবার্তা তেমন বুঝতে না পেয়ে ফ্যাল করে রাজু ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললো, ‘তাহলে, এটাই আপনার শেষ কথা, আমাকে বিয়ে করবেন না?’ রাজু ভাই হা বা না বলে রুহির দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললো, ‘তুই আসলেই পাগল হয়েছিস, আমার পক্ষে বিয়ে করা সত্যিই সম্ভব না।’ চোখ মুছতে মুছতে রুহি রাজু ভাইয়ের ঘর থেকে বের হলো।

রুহি রাজু ভাই এর কথামতো সাগর ভাইকে বিয়ে করে কানাডায় এলো, তবে মাতাল স্বামীর পাল্লায় পোরে সুখ অধরাই থেকে গেলো।

রুহির রাজু ভাই এর কথা আরো খানিকটা শোনা যাক। রাজু ভাই হচ্ছে রুহির প্রিয় বান্ধবী যুথির মেঝো ভাই। রংপুরের আলম নগর এলাকায় রবার্টসন গঞ্জ হাইস্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এলাকার সব সুন্দরী মেয়েরা ও তাদের গার্জেনরা রাজুর একটু সান্নিধ্যের জন্য মুখিয়ে থাকতো। আর সেই রাজু ভাই কাউকে পাত্তা না দিয়ে কোনো এক অদ্ভুত কারণে রুহিকে পছন্দ করতেন, নানান অজুহাতে রুহিদের বাসায় এসে পড়াশুনা দেখিয়ে দিতেন। রুহি তখন ক্লাস নাইনে সায়েন্স নিয়ে পড়ে। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। আগামীকাল বায়োলজি প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা। রুহির চাপাচাপিতে রাজু ভাই বিকাল বেলা তার ক্ষুদে দলবাহিনী নিয়ে বাড়ির পিছনের ঝোপ ঝড় থেকে ২/৩ টি কুনো ব্যাঙ ধরে নিয়ে মহা উৎসাহে রুহিদের বৈঠক ঘরের চকির নিচে লাল বালতির মধ্যে লবন পানি মেশানো পানির মধ্যে রেখে ঢাকনার উপর ইট দিয়ে চেপে রাখলো। সন্ধ্যা নাগাদ ব্যাঙগুলি যখন আধমরা হলো, সেগুলিকে রাজু ভাই কায়দা করে চার হাত পায়ে আলপিন বসিয়ে প্রবল উৎসাহে যুথি ও রুহিকে কুনো ব্যাঙ এর রক্ত সগবহন তন্ত্র, স্নায়তন্ত্র, প্রজনন তন্ত্র ইত্যাদি বুঝাতে লাগলো। রুহি কতখানি ব্যাঙ নিয়ে জ্ঞান চর্চা করে লাভবান হলো সেটা বুঝা না গেলেও বান্ধবী যুথির মোটেই বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হলোনা না রুহি তার মেঝো ভাইয়ের প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে।

সে রাতে রাজু ভাই নিয়ে পুরান কথা ভাবতে যেয়ে রুহি অদ্ভুত একটি লম্বা চওড়া স্বপ্ন দেখলো। কাক ভোরে দরজায় কে যেন রুহির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে প্রবল বেগে দরজার কড়া নাড়ছে। রুহি দরজার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে চাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই ছিটকিনি খুলতে পাচ্ছে না । ওপাশ থেকে রাজু সমানে বলেই যাচ্ছে, ‘রুহি, এই রুহি দরজা খোল, তোর জন্য বিরাট সারপ্রাইজ আছে। অগত্যা অনেক কসরত করে রুহি দরজা খুলে দেখে তার সামনে হাসি হাসি মুখ করে রাজু ভাই দাঁড়িয়ে আছে, গালের দিকে খানিকটা কাটা শুকিয়ে যাওয়া খানিকটা রক্ত জমাট হয়ে আছে, রুহি উত্তেজিত হয়ে বললো, গালে কি হয়েছে রাজু ভাই? ‘আর বলিসনা, তোর সাথে দেখা করতে আসবো তাই ভাবলাম একটু সেভ টেভ করি, তাড়াহুড়া করতেই ফচ করে কেটে গেলো, ঘরে কোনো এন্টি সেপ্টিকতো দূরের কথা, কোনো তুলা ফুলাও নেই, গরিবের রক্ত, বুঝলি, আঙ্গুল দিয়ে ঠেসে ধরতেও বন্ধ হয়ে গেলো ।

রুহি রাজু ভাই এর পিছনে তাকাতেই দেখে পিছনে এক বিশাল ট্রাক ভর্তি নানান রং এর গোলাপ ফুল, রজনী গন্ধ, টকটকে লাল জবা ফুল ইত্যাদি। রুহি ফ্যাল ফ্যাল করে ট্রাকের দিকে তাকিয়ে আছে, রাজু ভাই বললেন , ‘গাধার মতো কি দেখছিস, জানিসনা আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি,  ভালবাসা দিবস। যা, ঝটপট রেডি হয়ে নে, মোড়ের হোটেলে কলিজা ভুনা দিয়ে পড়াটা মেরে দিয়ে আজ সারা দিন ট্রাকে করে পুরা শহর ঘুরে বেড়াবো আর পথে ঘাটে দুজন মিলে ফুল ছিটাবো। সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে এই ট্রাক ড্রাইভার সহ ভাড়া করেছি। আইডিয়াটা হ্যাবি হয়েছে না?

বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হওয়া উপলক্ষে অলিম্পিকে যদি কোনো ইভেন্ট থাকতো, রুহি আজ নির্ঘাত স্বর্ণ পদক পেতো। এক মিনিটের কম সময়ে রুহি বের হয়ে ট্রাকে উঠে রাজু ভাই এর পাশে বসলো। ট্রাকে সামনের দিকে সাধারণত ড্রাইভারের পাশে এক জনের সিট থাকে, তবে দুজন বসাতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়, আকাশ কালো করে এসেছে, কিছুটা হালকা বাতাস ছেড়েছে। রাজু ভাই মলিন মুখে বললো, ‘ শালার বৃষ্টি সব প্ল্যান বুঝি মাটি করে দিবে। ট্রাকের ফুলগুলি ত্রিপোলি দিয়ে ঢাকা থাকলেও এক দিকের বাঁধন কিছুটা আলগা থাকায় চলন্ত ট্রাকের জোরে বাতাসের কারনে ফুলগুলি রাস্ত দুধারে উড়ে উড়ে পড়ছে। ছেলেপেলে দল বেঁধে অনেকটা কাটা ঘুড্ডি ধরার মতো করে একেকটি উড়ন্ত ফুল দৌড়ে দৌড়ে কুড়াচ্ছে। এরই মাঝে মুসল ধারে বৃষ্টি শুরু হলো। সামনে পিছনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার একটি স্কুলের পাশ কেটে যাওয়ার সময় একপাশে সাইড করে ট্রাক থামিয়ে ভুস করে সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধে রুহির দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। রাজু ভাই আনন্দ চিত্তে কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, ‘রুহি,চল নেমে পরি, অনেক দিন পড়ে বৃষ্টিতে ভিজবো।’

কোনোরকম সময় নষ্ট নাকরে রুহি রাজু ভাইয়ের হাত ধরে ট্রাক থেকে নেমে মাঠের মাঝখানটায় চলে এলো। প্রবল বৃষ্টিতে রুহি ভিজে একেবারে জুবুথুবু হয়ে আছে । একটু একটু শীত শীত করলেও রাজুভাইয়ের আনন্দিত মুখ দেখে এতো ভালো লাগছে যে মনে হচ্ছে রুহি তার সারা জীবনে এতো বেশি আনন্দ উল্লাস কোনোদিন করে নি । রাজু ভাই চিৎকার করে রুহিকে বললো,’ একটা গান টান ধরলেও তো পারিস, সিনেমা নাটকে দেখিস না বৃষ্টিতে ভিজে গান টান গায়।’ রুহি প্রানপনে গান গাওয়ার চেষ্টা করছে ‘ মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না। কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না…….’ । কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে রুহির মুখ থেকে গান তো দূরের কথা একটি শব্দও বের হচ্ছে না, কেবল গো গো শব্দ হচ্ছে । এদিকে হটাৎ করে স্কুলের মাঠটি কানাডার স্কারবোরোর ব্ল্যাফারস পার্ক হয়েগেলো। বৃষ্টিগুলি সাদা তুষার হয়ে অঝোর ধারায় গায়ে মুখে লেগে রাজু ভাইয়ের জ্যাকেট একেবারে সাদা হয়ে গেছে। রাজু ভাই মুঠি ধরে স্নোবল বানিয়ে তিথি ও রিফাতদের সাথে ঢিল ছোড়াছুড়ি খেলছে আর চিৎকার করে বলছে, রুহি বোকার মতো হা করে তাকিয়ে থাকিস না, আয় আমাদের সাথে স্নোবল দিয়ে খেলি।’

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও প্রায় আধা ঘন্টা খানিক রুহি কেমন যেন ধন্দের মধ্যে কাটলো। রিফাত, তিথি এখনো বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। রুহি ফজর নামাজ পড়ে খানিকক্ষণ কোরান শরীফ পড়ে সকালের নাস্তা বানানোর আয়জন করছে। আগের দিনগুলি হলে এতক্ষন বাসে করে কাজে যেয়ে যন্ত্রের মতো স্টোরে কাজ করতে হতো, এখন চাকরিবিহীন জীবন যাপন করতে হচ্ছে। আজ দুপুরে উপরে ফুপুর বাসায় দাওয়াত। এখনও বাসা বাড়িতে পেন্ডেমিকের কারনে দাওয়াত তাওয়াত তেমন দেখা যায় না। খুব কাছের লোকজন ছাড়া বাড়িতে ডেকে আগের মতো আর কেউ সেভাবে মেহমানদারী করে না। ফুপুর এক বন্ধুর ছেলে মিরাজ তার পরিবার সহ ফুপুর বাসায় দুপুরে খেতে আসবে। ফুপু সাত সকালে রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। উপর থেকে ফুপুর রান্না ঘর থেকে ভালো রান্নার সুগন্ধ পাওয়ায় যাচ্ছে। উপরে যেয়ে ফুপুকে একটু হেল্প করা দরকার। ফুপুর কথা ভাবতে না ভাবতেই ফুপু ফোন করলো, ‘মা একটু উপরে আসবি, তোর সাথে জরুরি কথা আছে’ । ফুপুর জরুরি কথা মানে নিশ্চয় বড় কোনো ঘটনা। টেবিলে বাচ্চাদের নাস্তা রেখে রুহি দুরু দুরু বুকে উপরে গেলো ফুপুর জরুরি কথা শুনতে।

চা খেতে খেতে ফুপু যা বুলালেন শুনে রুহির চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো:’বুঝলি মা, কাল রাতে আমার ছেলে আর মেয়ে দুজনেই আমার সাথে অনেক কথা বললো। এখন বাড়ির দাম নাকি আকাশচুম্বী। যেমন তেমন একটি ডিটাচড বাড়িই প্রায় মিলিয়ন ডলারের মতো দাম। আমার ছেলে মেয়ে চাচ্ছে আমি যেন এ বাড়ি বিক্রি করে ডালাসে ছেলের ওখানে পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য চলে যাই। ছেলের ওখানে বিশাল বাড়ি। তাছাড়া, ওখানে ঠান্ডাও কম, থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ। বয়স হয়ে যাচ্ছে, হজ্জ করা উচিৎ। বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে হজ্জ করার পরে যা থাকল ছেলে মেয়ের মর্টগেজে যদি ঢেলে দেই তবে মাসে মাসে পেমেন্টও অনেক কমে আসলো, ওদের জন্য সুবিধাও হল কি বলিস মা।’

রুহি ফুপুকে হ্যা বা না কি বলবে বুঝতে না পেয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় পরে গেলো। এখানে বাচ্চারা তাদের স্কুলের সাথে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছিল, এখন আবার নতুন করে বাড়ি ভাড়া খুঁজতে হবে। ফুপু বোধ হয় রুহির মনের কথা বুঝতে পেরেছে। ‘মা, তুই চিন্তা করিস না, আজ দুপুরে যে ছেলেটি খেতে আসছে ওদের বেজমেন্ট খালি পরে আছে। আমি বললে, আমার কথা ফেলবে না, তুই ওদের ওখানেই থাকবি।

দুপুরে ডাইনিং টেবিলে ফুপু হরেক রকমের রান্না করা সব খাবার । মাটন-কাচ্চি বিড়ানি, হাঁসের মাংস, টিকিয়া কাবাব, আলাদা করে আবার সাদা ভাত, কাঁচা আম দিয়ে ঘন করে মসুরের ডাল, শুকনো লাল মরিচ দিয়ে ঝাল করে আলু ভর্তা , মিষ্টি কুমড়ার ভাজি ইত্যাদি দিয়ে টেবিল সাজানো। এতো এতো মজার খাবার তবুও রুহির ভালো লাগে না। এই কয়দিন ফুপুর বাসার বেজমেন্টে বেশ সুখেই ছিল রুহি রা । সামনের আবার কষ্টের দিনগুলির কথা ভেবে রুহির মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায় ।

বাচ্চাদেরকে আলাদা ভাবে ব্রেকফাস্ট টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। মিরাজ সাহেবের বাচ্চারা রুহির বাচ্চাদের সাথে নিজেদের মধ্যে এটা ওটা নিয়ে  ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। কত সহজেই এরা নতুন পরিচিতদের সাথে মিশে যেতে পারে। ছোটদের এই এক মজা। এই পৃথিবীর কোন সমস্যা এদেরকে স্পর্শ করেনা। যত সমসা কেবল বড়দের জন্য তোলা থাকে।

ফুপুর চার সিটের ছোট্ট ডাইনিং টেবিলের এক কর্নারে ফুপু বসেছেন। রুহি বসেছে টেবিলের এক পাশে। রুহির পাশের চেয়ার খালি। টেবিলের বিপরিত সাইডে মিরাজ ও মিরাজের স্ত্রী পাশাপাশি বসেছেন ।  রুহি যে চেয়ারে বসেছে, মিরাজ বসেছে ঠিক তার বিপরীত সাইডের চেয়ারে। রুহি ইতিমধ্যে খেয়াল করেছে, মিরাজ ছেলেটি অকারণে রুহির সাথে বেশ বক বক করে কথা বলছে। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদেরকে কিছু আলাদা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে থাকেন, যা দিয়ে তারা পুরুষদের অনেক কিছু বুঝতে পারে । ফুপুকে ও ঠিক পাশেই বসা নিজের স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে মিরাজের কূ দৃষ্টি তাই রুহির চোখে এড়ায় না। ফুপু যে মুহূর্তে খেতে খেতে মিরাজদেরকে ওদের বেজমেন্টে রুহিদের থাকার প্রস্তাব দিচ্ছে ঠিক সে মুহূর্তে রুহু অনুভব করলো মিরাজ পা দিয়ে রুহির পায়ে হালকা চাপ দিচ্ছে । মিরাজের অবাধ্য পা ক্রমশ বেপরোয়া হতে চলেছে। রুহি বাধ্য হয়ে উঠে যেয়ে বাচ্চাদের টেবিলে খাবার তদারকিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।  এরকম একজন কুরুচিপূর্ন লোকের বাসায় থাকতে হবে ভেবে রুহি ভয়ে শিউরে উঠছে।

পরবর্তীতে, রুহি ফুপুর অনেক উনরোধ সত্ত্বেও বিকৃত রুচির মিরাজের বেজমেন্টে  আর ওঠেনি। কিন্তু, তাকে কোথাও না কোথাও তো থাকতেই হবে, বাচ্চাদের মানুষ করতে হবে। রিফাতের উঠতি বয়স। বাবাহীন এ জগতে ক্রিকেট খেলা নিয়ে কথা বলার কাউকে না পেয়ে ব্যাচারা রিফাত সবসময় মন মরা হয়ে থাকে। রুহি ভেবে রেখেছিল অন্ততঃ ছেলের খেলা দেখার জন্য ক্যাবল বক্স নিলে মন্দ হয় না। আজকাল মাসে দশ পনেরো টাকা দিলেই ক্যাবল বক্স পাওয়া যায়। তিথির দাঁতের ব্যাথা আপাতত সাড়লেও ডেন্টিষ্ট বলেছেন আঁকাবাঁকা দাঁতগুলো ঠিক করতে দাঁতে ব্রেসেস পড়ানো উচিৎ।  অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার। ওদিকে দেশে বাবার বাড়িতে অভাবের সংসারে টাকা পাঠাতে হবে, বিশেষ করে মন্টুকে বাড়তি কিছু টাকা না পাঠালেই না, ওর বৌ প্রেগনেন্ট, দেশে একেকটি সিজারিয়ান অপারেশনে পানির মতো টাকা পয়সা খরচ হয়। এই রহস্যের পৃথিবীতে রুহিদের মতো সিঙ্গেল মাদারেরা যখন পাহাড়সম সমস্যা থেকে উতরে উঠতে চায় তখন এই রুহিদের প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সময়ের চাকায় পিষ্ট হয়ে একেক সময় হাত ঘুরে কখনো সাগর, কখনো বান্ধবী ইরার স্বামী অথবা কখনো  বা বিকৃত রুচির মিরাজের খপ্পরে পড়তে হয়। কিন্তু এদের পাশাপাশি ফুপু, রাজু ভাই প্রভৃতি কিছু ভালো মানুষদের সাহচর্যে সিঙ্গেল মাদার রুহিদের প্রচন্ড দুঃখ কষ্টেও ভেঙে না যেয়েও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয় সামনের দিকে, বেঁচে থাকার জন্য আশায় আশায় বুক বাঁধতে হয়। আর তাই, গভীর রাতে যখন বাড়ির সবাই বেঘোরে ঘুমাতে থাকে রুহি লাইট অফ করে সেল ফোনে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে অল্প ভলিউম দিয়ে বালিশে মুখ গুজে একা একা  রবীন্দ্র সংগীত শুনতে থাকেঃ

“আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভ’রে।
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহাদানেরই যোগ্য করে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।……..”-

—————————————————————–

সুধী পাঠকবৃন্দ, আজ এখানেই থাক, কখনো যদি সময় ও সুযোগ হয় রুহির এই বিদেশ বিভূঁইয়ে  পুরো স্ট্রাগলের কাহিনী নিয়ে আস্ত উপন্যাস আকারে আরোও বিস্তারিত ভাবে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করবো ইনশাল্লাহ। তাই, বলতে হচ্ছে, সিঙ্গেল মাদার রুহিকে নিয়ে ধারাবাহিক গল্প আজ আপাততঃ এখানে শেষ তবে সমাপ্ত না। সামনের দিনগুলিতে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আবারো গল্পের ঝুলি নিয়ে হাজির হবো। শুভ কামনা।
—————–
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, কানাডা

আগের পর্বগুলির জন্য ক্লিক করুন :

সিঙ্গেল মাদার: ১ম পর্ব –সিঙ্গেল মাদার: ১ম পর্ব

সিঙ্গেল মাদার : ২য় পর্ব- সিঙ্গেল মাদার : ২য় পর্ব

সিঙ্গেল মাদার : ৩য় পর্ব-সিঙ্গেল মাদার : তৃতীয় পর্ব

পূর্ববর্তী নিবন্ধজন্মদিনের বিস্ময়!
পরবর্তী নিবন্ধপাপেট (Puppet)
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন