রুহিদের সাথে খুব বেশি লাগেজ নাই। চাকা লাগানো দুইটি ঢাউস সুটকেস, আর তিনটি ছোট ব্যাগ। ফুপুর বাড়ি বাস স্টপ থেকে ওয়াকিং ডিস্ট্যান্ট। তবুও রুহি একটু দ্বিধায় ছিল, বাচ্চা/কাচ্চা, লাগেজ পত্র নিয়ে ফুপুর বাসায় হেটে যাবে না ট্যাক্সি নিবে। অগত্যা, টাকা পয়সার কথা ভেবে রুহিরা হেঁটেই রওনা হলো। টরেন্টোর বাহিরে মেইন রোড থেকে ভিতরের দিকে রাস্তার ধারের তুষারগুলি ঠিকভাবে ক্লিন না করায় লাগেজ নিয়ে হাটতে রুহিদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছিলো। এতটুকু রাস্তা আসতেই ওদের প্রায় আধা ঘন্টা খানিক লেগে গেলো। আধা ঘন্টা সময় মাইনাস দুই ডিগ্রিতে হেটে যাওয়া কম কথা না। বাচ্চা মেয়ে তিথির ফর্সা গাল লালচে হয়ে গেছে। রিফাত বড় ভারী লাগেজের একটি বয়ে নিয়ে আসছিলো, পিঠে ব্যাকপ্যাক ছাড়াও আরেক হাতে ছোট ব্যাগ নিয়ে মোটামুটি কাহিল অবস্থা। রুহি কলিং বেল টিপছে, কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া নেই। ফুপু জানে যে রুহিরা আজ আসছে,কারণ রওনা হওয়ার আগে রুহি ফুপুকে ফোন করেছিল। রুহি বাড়ির সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবারো ফোন করলো, কোনো সাড়া নেই। প্রমাদ গুনলো রুহি। ছেলে/মেয়ে ও লাগেজ পত্র নিয়ে ফুপুর বাড়ির সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাইনাস টেম্পেরেচারেও রুহি ঘামতে শুরু করলো ।

মিনিট পাঁচেক পরে, ফুপু দরজা খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো: ‘সরি, আমি ওয়াসরুমে ছিলাম, বাসায় আর কেউ নেই যে তোদের দরজা খুলে দিবে, আহারে ! এতক্ষন তোদের এই ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো, কিন্তু বাস থেকে নামার আগে একটি অন্তত ফোন দিতে পারতিস, আমি গাড়ি নিয়ে তোদের আনতে পারতাম, ইশ রে বাচ্চাগুলার দিকে তাকান যাচ্ছেনা। ঠান্ডায় একেবারে কুঁকড়ে গেছে, আমি গরম সুপ রান্না করে রেখেছি, পাশেই বাথরুম, হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে যা ঝট পট ফ্রেস হয়ে নে, পরে সব কথা শুনবো, আর হ্যা, এই হচ্ছে বেজমেন্টের আর ডান দিকের ইউনিটের ঢোকার চাবি। আগে ফ্রেস হয়ে আয়, সুপ টুপ খেয়ে পরে নিচে যেয়ে সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিস। লাঞ্চের কথা চিন্তা করতে হবে না, আমি তোদের আজকের মতো লাঞ্চের খাবার পাঠিয়ে দিবো। বিকালে, আমার সাথে নো ফ্রিলস এ যেয়ে টুক টাক চাল/ডাল তরিতরকারি কিনে নিবি, কাল থেকে তোদের নিজেদেরটা নিজেরাই রান্না করে খাবি।’ রুহি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ফুফুকে জাপ্টে ধরে অনেক্ষন বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদলো। মানুষের এই দিকটা বেশ অদ্ভুত, একটুখানি সহানুভূতি পেলেই ভিতরের সব জমানো কষ্ট প্রবল বেগে বানের পানির মতো ছুঁটে বেরিয়ে আসতে থাকে।

রুহি এর আগে কখনো বেজমেন্টে থাকাতো দূরের কথা কোনোদিন কারো বাসার বেজমেন্টে কোনোদিনই যায়নি। আজ সাগরের ফুপুর বেজমেন্টে এসে অবাক হয়ে দেখলো মাটির নিচে মানুষ কি সুন্দর করে গুছিয়ে ঘর বানায়। পরিপাটি করে একটি ডাবল বেড পাতা, একটি আলাদা ওয়াশরুম, রুমের পাশে একটু খোলা জায়গা, এক পাশে ছোট্ট কিচেন। রুহি খোলা জায়গায় একটি মেট্রেস বিছিয়ে ছেলে রিফাতের জন্য বেড বানিয়েছে। ওদিকটায় পার্টিশন দিয়ে আরেকটি ইউনিটে একটি ছোটো ফ্যামিলি থাকে। রুহিদের ঘরে ভেন্টিলেটারের মতো একমাত্র ছোট্ট জানালা দিয়ে দিনের বেলায় খুব সামান্য আলো আসে। রুহিদের মতো সিঙ্গেল মাদারের জন্য এতোটুকু আলোই কি যথেষ্ট নয়? বেশি আলোয় এ সমাজের অনেক অনেক মুখোশধারী মানুষের নগ্ন চেহারা দৃষ্টিগোচর হওয়ার চেয়ে ফুপুর এই বেজমেন্টকেই রুহির অনেক অনেক আপন মনে হয়।

বাড়ির মালিক ফুপু রিজিয়া রহমান বাংলো বাড়ির বেজমেন্টের উপরে গ্রাউন্ড লেভেলে মোটামুটি একাই থাকেন। উনার স্বামী হাবিবুর রহমান গত হয়েছে বছর তিনেক আগে। ভদ্রলোক হার্ট এট্যাক এর কারণে মারা গিয়েছিলেন। একমাত্র ছেলে নিহাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে ডালাসে সংসার পেতে থাকে। মেয়ে ত্রপা ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সহপাঠী পাকিস্তানি যুবক সাব্বিরকে বিয়ে করে মিসিসাগাতে থাকে, মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসে। ফুপু একটু আগে নিজে বেজমেন্টে এসে রুহিদের জন্য একটি বড় ডিস এ করে চিকেন বিরানি ও আরেকটি ডিসে চিংড়ি মাছ দিয়ে পাস্তা রান্না করে নিয়ে এনেছেন। ফুপু খাবার হাতে করে হাসি মুখে বললেন: ‘বাচ্চাদের নিয়ে এগুলি খেয়ে রেস্ট /টেস্ট নে, ঘন্টা দুয়েক পরে এক সাথে বাজারে যাবো। রুহি কিছুটা লজ্জিত হয়ে ফুপুর হাত থেকে খাবার নিতে নিতে বললো: ‘ফুপু, আপনি এতো ভালো কেন?’

তিথি ও রিফাত প্লেটে পাস্তা নিয়ে গোগ্রাসে খাচ্ছে। রিফাত আবার পাস্তা শেষ করে চিকেন বিরানির খানিকটা প্লেটে নিতে নিতে খেয়াল করলো তাদের মা প্লেটে কিছুই না নিয়ে কি যেন ভাবছে। রিফাত তার মায়ের এই না খাওয়াকে আমলে না নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,’আম্মু, উপরের দিদামনিকে বলে ইন্টারনেটের পাসওয়ার্ডটা নিবে ? কালকে থেকে আবার আমার অন লাইন ক্লাস। সৃষ্টিকর্তা সম্ভবত ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে আলাদা অনুভূতি দিয়ে থাকেন। রিফাত যখন ইন্টারনেটের পাসওয়ার্ড নিয়ে চিন্তিত ছোট্ট তিথি মায়ের খালি প্লেট দেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে একেবারে বড় মানুষের মতো বলে উঠলো,’আম্মু, তুমিতো কিছুই খাচ্ছ না , আমাদের দুষ্টু বাবার জন্য কি তোমার খুব বেশি মন খারাপ হচ্ছে? রুহি এতটুকু মেয়ের কথা শুনে থতমত খেয়ে বললো, ‘ না মা, মোটেই না, কিন্তু বাবাকে দুষ্টু বলতে নেই মা’। ‘উনিতো তোমাদের কিছু করেননি মা, উনি তোমাদের কত আদরের বাবা’। -আদর না ছাই, ওঁ একটা পঁচা বাবা। ও যদি ভালোই হবে তোমাকে মেরেছিলো কেন ?’

এক সপ্তাহের মধ্যে রুহি ফুপুর বেজমেন্টে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই না , নিজের লাইফ স্কিলেরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছে। রিফাত ও তিথির দুজনেরই স্কুল এরই মধ্যে একা একই চেঞ্জ করেছে। ব্যাংকে যেয়ে নিজের নামে আলাদা চেকিং একাউন্ট খুলেছে। একা একই রেভেনিউ কানাডাতে ফোন করে ঠিকানা আপডেট করেছে, চাইল্ড বেনিফিটের টাকা যেন রুহির একাউন্টে ডিরেক্ট জমা হয় সে ব্যাবস্থা করেছে। তিথিকে কাছেই ডেন্টিস্টকে দিয়ে দাঁত দেখিয়েছে। ড্রাইভিং টেস্ট সেন্টারে যেয়ে জি ওয়ান টেস্ট দিয়ে জি ওয়ান লাইসেন্স ম্যানেজ করেছে। এখন শুধু এক বছর অপেক্ষা করতে হবে রোড টেস্টার জন্য। ইতিমধ্যে ভালো ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টরের খোঁজ নিতে শুরু করেছে। রুহি নিজের এতো উন্নতি দেখে এতটাই অবিভুত যে নিজেকে নিজেই চিনতে পাচ্ছে না । আসলে, এতদিন স্বামীর উপর এতটাই ডিপেন্ডেন্ট ছিল যে এসব লাইফ স্কিলের কখনো প্রয়োজিনীয়তা অনুভব করেনি। এখন ঠেকায় পরে তিলে তিলে বুঝতে হচ্ছে স্বনিভর হওয়া মহিলাদের জন্য কতটা জুরুরী।

ফুপুর সাথে রুহির রফা হয়েছে, মাসে আপাততো আটশত টাকা করে দিবে। ফুপুকে টাকা না দিলেও কোনো ক্ষতি ছিল না, কিন্তু রুহির আত্মসম্মান বোধ অনেক টনটনে। সমাজে কারো কাছ সুবিধা নেয়ার মাঝে অনেক অলিখিত নিয়ম কানুন থাকে যা নিজের বুদ্ধি বিবেক দিয়ে বুঝে নিতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই সম্পর্ক তেতো হয়ে উঠে। এসব বিষয়ে রুহি অনেক সজাগ।

 ব্রাম্পটন থেকে রওনা দিয়ে পুরান বাসার কাছে স্কারবোরোতে কে এফ সি -র স্টোরে দুটি বাস বদল করে এত দূর কাজ কাজে আসতে এই কয়েকদিনে রুহি একেবারে হাপিয়ে উঠেছে। এভাবে কাজ করার কোনো মানেই হয় না। প্রায় দিনই কাজে আসতে আধা ঘন্টা খানিক লেট হচ্ছে । আজ রুহি ঠিক ঠিক সময়ে চলে এসেছে। আজ রুহি মনে মনে ঠিক করে এসেছে ম্যানেজারকে বুঝিয়ে সুধিয়ে বলবে যাতে ব্রাম্পটনেই কাছে পিঠে কোনো লোকেশনে যেন ট্রান্সফার করে। কাষ্টোমার সার্ভিস ধরণের চাকরির ম্যানেজারদের ইমোশন সাধারণ ভোতা টাইপের হয়ে থাকে। তবে এতখানি যে নির্মম তবে রুহি কল্পনাও করতে পারেনি।রুগী কাজে ঢুকতে না ঢুকতেই ম্যানেজের এসে বললো ‘ ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার গতকাল এসেছিলো, যেহেতু স্টোরে বেচাকেনা তেমন নাই, তাই তারা এত স্টাফ মেইনটেইন করতে পারবে না। কাল থেকে আর কাজে আসার দরকার নেই । রুহি নিজের কানকেই বিশ্বাসঃ করতে পাচ্ছে না , সে কি শুনছে। চাকুরী চলে যাওয়ার কথাটি শুনে রুহি একেবারে হতো বিহ্ববল হয়ে কয়েক সেকেন্ড মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। রুহি অনেক কাকুতি মিনতি করলো লাভ হলো না।

চোখ মুছতে মুছতে রুহি বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাসে যেতে যেতে রুহি ভাবতে থাকে, এমপ্লয়মেন্ট ইন্সুরেন্স (EI) এর জন্য এপ্লায় করতে হবে। এর আগে দুই বাচ্চা হওয়ার পরে রুহি ম্যাটার্নাল ই আই তে গিয়েছিলো, কিন্তু কিভাবে কি করতে হয় কিছুই জানে না। এর আগে সব স্বামীই করে দিয়েছিলো। এখন তো আর সে সুযোগ নেই। তাকে একাই সব করতে হবে। ইতোমধ্যে একই রেভেনিউ কানাডাতে চাইল্ড বেনিফিটের ব্যাপারে ফোন করে রুহির অত্মবিশ্বাসঃ অনেকটাই বেড়েছে। বাসে বাড়ি যেতে যেতে রুহি ভাবতে থাকে চাইল্ড বেনিফিট, সি এ আর বি, এবং ই আই ইত্যাদি টাকা নিয়ে অন্তত কয়েক মাস চলা যাবে, তারপরে আবার নতুন করে চাকরি খুঁজতে হবে। আর চাকরি যদি নাই পাওয়া যায়, সরকারি ওয়ালফেয়ার তো আছেই, অন্তত চাকুরী না পাওয়া পর্যন্ত সরকারি ওয়েলফেয়ার-এ থাকা যেতে পারে। রুহি শুনেছিলো, ই আই -তে থাকা অবস্থায় সেকেন্ড ক্যারিয়ারের জন্য বিনা পয়সায় কিছু শর্ট টার্ম ট্রেনিং বা ডিপ্লোমা জাতীয় প্রোগ্রাম করা যায়। সেকেন্ড ক্যারিয়ার হিসাবে চাইল্ড কেয়ার নিয়ে পড়লেও মন্দ হয় না। চাইল্ড কেয়ারের চাকুরীর বাজার খারাপ না, চাকুরী না পেলেও রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে বাসায় বসেও চাইল্ড কেয়ার করা যাবে, ঘরে বসে নিজের বাচ্চাও দেখা হলো আবার টাকা ইনকাম করাও হলো। তবে বিষয়টি যত সহজ মনে হচ্ছে হয়তো ওতো সহজ না, তবুও হতাশ হয় না রুহি। একজন সিঙ্গেল মাদারের অভিধানে ‘হতাশ’ শব্দটি থাকতে নেই, নিজেকে সান্তনা শান্তনা দেয় রুহি।

রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে দেশ থেকে মেসেঞ্জারে মন্টু ফোন দিলো। ‘আপা কয়েক সপ্তাহ কোনো ফোন টোন নাই, সব খবর ভালোতো।’ রুহি কতখানি ভালো আছে সেটা গোপন রেখে বেশ শান্ত ও স্বাভাবিকভাবে ছোট ভাই মন্টুকে বললো,’ভালো আছি রে, তবে শরীরটা কেমন যেন ম্যাচ ম্যাচ করছে, মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও বেড়েছে। ভাবছি অফিস থেকে কিছুদিন ছুটি নিবো, তোদের দুলাভাইতো আমাকে কিছুতেই কাজ করতে দিবে না, বললেইতো হবে না, কাজ না করলে বিদেশে একজনের কামাই দিয়ে সংসার কি আর চলে?’ মন্টুর কাছে তার আপার সংসার চলে কি না সেটা তেমন ইম্পরট্যান্ট ব্যাপার না, এমনকি আপার অসুস্থতা নিয়েও মন্টুর তেমন আগ্রহ নেই। মন্টু কিছুটা ফিস ফিস করে বলতে থাকে:

‘আপা, তোকে একটা জরুরি কথা বলি, মা কে আবার বলিস না, গতকাল পলিন কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ছিলাম, ডাক্তার কি সব টেস্ট ফেস্ট করে ফোস করে বলেদিলো পলিন নাকি প্রেগনেন্ট। বলতো দেখি, কি কেলেঙ্কারি ব্যাপার, এমনি ব্যাবসা পাতির যা শোচনীয় অবস্থা যাচ্ছে, হাত একেবারে খালি, বাড়িতে তো কেবল নাই নাই সিচুয়েশন, তুই তো সব জানিস বাবার পেনশনের টাকা আর তোর পাঠানো টাকা নিয়ে মা যে টেনে টুনে কিভাবে কি করছে সেটা আল্লাহ পাক জানেন, এদিকে, এর মধ্যে আবার পলিন এই কান্ড ঘটিয়ে ফেললো, ওর শরীরের যে অবস্থা একটু ফল মূল ভালো মন্দ কিছু খাবে সেই টাকাই বা কোথায় ? তাই বলছি কি, মন দিয়ে শোন আপা, বাবাকে বুঝিয়ে যদি ডেভেলোপারকে আমাদের এই বাড়িটা দিয়ে দেই আমাদের চারটি ফ্লাট দিবে, মনে কর বাবা মা কে নিয়ে আমি একটিতে থাকলাম, তোর টা তুই ভাড়া দিলি বা একটি রুম তালা দিয়ে বাকিটা ভাড়া দিলি, তার পরেও আরো দুটি ফ্লাট হাতে থাকলো। ওই দুটি ফ্লাট ভাড়া দিলে কমসেকম পনেরো হাজার টাকা করে হলেও তিরিশ হাজার টাকা, তুই বল আপা, সংসারে কি আর কোনো অভাব থাকার কথা ! তোকে আর বাসায় আলাদা করে টাকা পাঠাতে হলো না, তুইও ওখানে টাকা পয়সা কিছু জমিয়ে কিছু একটা কিনে ফেললি, আর এদিকে আমাদের হাতে কিছু টাকা জমা হলে দুই একটি সি এন জি কিনে রাস্তায় নামিয়ে দিলেতো হু হু করে স্রোতের মতো টাকা আসবে কি বলিস আপা?’

স্মামীর সাথে রুহির সেপারেশনের ব্যাপারটি দেশের এখনো কেউ জানে না। চাকুরী হারিয়ে সিঙ্গেল মাদার রুহি যখন আকাশ পাতাল ভাবছে তখন মন্টুর কথাগুলি রুহির কানে কেবল কতগুলি যান্ত্রিক শব্দের মতো মনে হয়। তবুও ছোট ভাই মন্টুর কথাগুলিকে রুহি মনে মনে সারাংশ করতে থাকে। মন্টুর বৌ প্রেগনেন্ট, তাই তাকে বাড়তি কিছু টাকা পাঠাতে হবে, বাবাকে বাবাকে বুঝিয়ে যদি ভালো কোনো ডেভলোপার দেখে তাদের বাড়ি টি দিয়ে দেয়, প্রস্তাবটি মন্দ না। তবে, দেশে ভালো ডেভলোপার পাওয়াও কিছুটা কঠিন ব্যাপার, দেশের কথা ভাবতেই রুহির কেবল ঠক বাটপারের চেহারা ভেসে উঠে। কেবল মন্টুর উপর ভরসা করে ডেভলোপার নিলে চলবে না, ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে তাই, অনেক চিন্তা ভাবনা করে এগুতে হবে। আর, বাবাও সহজে রাজি হওয়ার মানুষ না। বাবা সহজেই চাইবে না, শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত তার বাবার বাড়ি চোখের সামনে ভেঙ্গে ফেলতে। রুহি মন্টুকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রমিজ না করে বললো,’মন্টু আমার বেশ মাথা ধরেছে রে, মনে হয় মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে, তোকে আরেকদিন ফোন দিবো’। মন্টুর ফোন রাখতেই ফুপু দরজাও নক করছে। এতো রাতে ফুপু, এসেছে রুহি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে দরজা খোলে।

-‘রুহি, একটি খারাপ খবর আছে। ভাবছিলাম তোকে জানাবো কি না, তোর সাথে তো আর সাগরের সম্পর্ক নেই, তবুও বলি, একটু আগে সাগরের এক বন্ধু ফোন করেছিল, সাগর ড্রাঙ্ক অবস্থায় গাড়ি চালাতে যেয়ে হাই ওয়েতে মারাত্মক একসিডেন্ট করেছে, ইনটেনসিভ কেয়ারে রেখেছে, অবস্থা একেবারে ভালো না। ওর সাথে আরেক বন্ধু ছিল ওর অবস্থা ততটা খারাপ না, ওই বন্ধুই হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। আমি ছাড়া ওরতো এখানে আর কেউ নেই, আমার মনে কেন জানি কূ ডাক দিচ্ছে, একটু পরে আমি হাসপাতাল যাচ্ছি, তুই বরং তোর বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় থাক, সেরকম খারাপ খবর হলে তোদের নিতে আসবো।’ কথাগুলি বলতে যেয়ে ফুপি রুহিকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। ‘এতো কোরে গাধাটাকে বলেছি, ওসব মদ/তদ ছাই পাস ছেড়ে দে, বাচ্চা /কাচ্চার বাবা হয়েছিস, কে শোনে কার কথা’।

রুহির এসময় ঠিক কি করা উচিত বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে ফুপুকে ধরে থাকে।সাগরের সাথে এখনোও তার সম্পর্ক অফিসিয়ালি শেষ হয় নি। তবে যতকিছুই হোক, রুহি তার সিদ্ধান্তে অটল,  মাতাল, দুশ্চরিত্র বৌ পেটানো লোকের সাথে ঘর করা প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এদিকে, ওর যদি সত্যি সত্যিই খারাপ কিছু হয়ে যায় বাচ্চারা অন্তত তাদের বাবাকে দেখতে যেতেই পারে। তিথি অনেক কখন আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রিফাত ল্যাপ্টোপ নিয়ে পড়াশুনা করছিলো। বাবার কথা শুনে ল্যাপটপ বন্ধ করে মায়ের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।


(চলবে )
————
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, ফেব্রুয়ারি ২০২১

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিকৃতি
পরবর্তী নিবন্ধ২১ এখন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন