রঘুর মুখের দিকে তাকালেই দুঃখে বুকটা ফেটে যায় প্রমিলার। কপাল চাপড়িয়ে বিলাপ করে ওঠে,-‘ভগবান, পোলাডা কোন্ কুক্ষণে যে জন্ম গ্রহণ করছিল, অরে ক্যান্ এত্তো বড় শাস্তি তুমি দিলা!’

জন্ম থেকেই রঘুর চোখ দু’টো ট্যাঁড়া, ঠোঁট কাটা। নাকটাও প্যাঁচার মতো বোঁচা। একেবারে নেই বললেই চলে। কথা বললে নাকে নাকে শোনায়। পরিস্কার বোঝা যায় না। দাঁতগুলি যেমন মুক্তার মতো সাদা, তেমনি কয়লার মতো কুচকুচে কালো গায়ের রং। বীভৎস চেহারা। দিনের বেলাই লোকে ভয় পায়। পাঠশালার ছেলে-মেয়েরা সবাই ওকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশা করে। কেউ বসতে চায় না ওর পাশে। খেলতেও নেয় না কেউ সঙ্গে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে সবাই দূর দূর করে তাড়ায়। কত আর বয়স, বছর দশেক হবে। বাচ্চা ছেলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে নাকে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে মায়ের কাছে এসে নালিশ করে। ব্যস, পড়লো মরার উপর খাড়া। রেগে ফুলে ওঠে মাতা প্রমিলা। প্রত্যেক দিন এসব সহ্য হয় কারো! একেই অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। সারাদিন মানসিক অশান্তিতে কাটে। রাত পোহালেই চিন্তা, কখন চূলোয় হাঁড়ি চড়বে, রান্না বসবে। ঘরে আনাচ থাকে তো চাল-ডাল থাকে না। তেল থাকে তো মশলাপাতি থাকে না। চিবোতে হয় শুকনো রুটি। কোনো কোনোদিন তাও জোটে না। এমতবস্থায় মাথা ঠান্ডা থাকে কখনো। রঘুকে কাঁদতে দেখলেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় প্রমিলার। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গর্জে ওঠে,-‘হইছে কি তর? কান্দস ক্যান? মারছে বুঝি কেউ? তগোর মাষ্টারগুলা দ্যাখে না চোখে! হ্যাগোর আস্কারা পাইয়াই বিয়াদপ পোলাপাইনগুলা কাউরে ডরায় না। তর মা-বাপ মইর‌্যা গ্যাছে? আমরা এত্তোগুলি মানুষ। আমাগো গ্যারাম পঞ্চায়েতও হইছে একখান্ ডাকাইত। গরীব মাইনষের রক্ত চুইসা খাইতাছে, কামের বেলায় কিসুই করে না। নালিশ করলে উল্টা আমাগোই ধমকায়। গরীব বইল্যা আমাগো মূইল্য নাই! মানুষডা কত্ত কষ্টে পোলারে ইস্কুলে দিছিল, অরে ল্যাখাপড়া শিক্ষাইবে, মানুষ করবে। দুইমাস হয় নাই, ছ্যামড়াগুলা অরে জ্বালাইয়া মারতাছে। পোলার হইব আর ল্যাখাপড়া? যাইব গিয়া রসাতলে। হ্যাগোর কি, হ্যারা ত্যালার মাথায় ত্যাল ঢালব, পকেট ভরাইব নিজেরার আর মরবে ঐ গরীবগুলা।”

সারাদিন বকতে বকতে চোখমুখ গর্তে ঢুকে গেছে প্রমিলার। চিন্তা-ভাবনায় শরীরটাও অর্ধেক হয়ে গেছে। কঙ্কালের মতো শরীরের হাঁড়গুলিসব বেরিয়ে এসেছে। রাতে যাও একটু ঘুম হোত, এখন সেটাও গেছে উধাও হয়ে। এদিকে সংসারের টলমল অবস্থা। সাধ-আহাল্লাদ তো দূর, ভালো-মন্দই জোটে না। ওদিকে ছেলের মনোরঞ্জনের জন্য গরুর বাছূর একটা বেচে দিয়ে হরিপদ কালার টি. ভি কিনে নিয়ে এসেছে। রঘুনাথ বাড়িতে বসেই লেখাপড়া করবে, পড়ার শেষে টি.ভি দেখবে, আনন্দ করবে। ওর সঙ্গী-সাথির প্রয়োজন হবে না। এছাড়া আর উপায় কি! সামর্থ থাকলে নয় দূরে কোনো বোডিং-স্কুলে ভর্তি করে দিতো। এতো জ্বালা যন্ত্রণাও সহ্য করতে হোত না। অন্তত শান্তিতে থাকতে পারতো। এমন সৌভাগ্য কপালে ধরবে কোনদিন প্রমিলার! আশা করাই বৃথা। বাপ-ঠাকুরদার আমলের ভিটে বাড়িসহ দুইবিঘা সমান জমিটুকুই হরিপদর একমাত্র সম্বল। তার মধ্যেই আনাচপাতীর চাষ করে। উৎপন্ন ফসলের বেশীরভাগই বাজারে বিক্রি করে। তাতে উপার্জন যা হয়, কূলোয় না। বড় সংসার হরিপদর। স্ত্রী-পুত্র ছাড়াও বিধাব মা প্রভাবতী দেবী, বিকলাঙ্গ ভাই নিকুঞ্জ এবং ছোটবোন রমলা, এদের সবার দায়-দায়িত্ব মাথার উপর চেপে আছে হরিপদর। অথচ গায়ে-গতোরে বিশাল চেহারা নিকুঞ্জর। একেবারে দৈত্যের মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছোটবেলায় পলিও রোগে ডান পা-টা প্যারালাইসের মতো হয়ে ওর হাত-পাগুলি বড় দুর্বল। কোনো ভারী কাজ করতে পারেনা। বাড়িতে বসে টুকটাক কাজ করে। কিন্তু হরিপদর একার রোজগারে ছ’জনের অন্ন জোগাতে ওকে হিমশিম খেতে হয়। পেরে ওঠে না। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কষ্ট হলেও কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। কোনো অশান্তি ছিল না। একমাত্র রঘুকে নিয়েই হয়েছে যতো জ্বালা। কিন্তু ওরইবা দোষ কি! বয়সের তুলনায় এখনো ছেলেমানুষ। বিবেক-বুদ্ধির বিকাশ তেমন ঘটেনি। অত্যন্ত চঞ্চল। এক জায়গায় সুস্থির হয়ে কখনো বসে থাকতে পারে না। বাধ্যগত ছেলের মতো ঘরে বসে থাকা, বড়দের অনুসরণ করে চলা, এসব ওর ধাতে নেই। ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হয়, গঞ্জনা শুনতে হয়। সারাদিন ভ্রমরের মতো আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো অভ্যাস। তা’ছাড়া একনাগারে টি.ভি দেখতে কতক্ষণই বা আর ভালো লাগে। ওদিকে প্রহরীর মতো পিসি রমলা দরজার গোড়ায় কড়া নজরে পাহাড়া দিয়ে বসে থাকে। ঘর থেকে বের হলেই দেবে ওর ঠ্যাঁং ভেঙ্গে। কিন্তু কতক্ষণ, একসময় অধৈর্য্য হয়ে দরজার শিখল তুলে দিয়ে রমলা চলে যায় রান্নাঘরে। রঘু তখন চিল্লিয়ে ওঠে। -‘দরজা খোলো, দরজা খোলো!’ বলে খুব জোরে ধাক্কা দিতে থাকে দরজায়।

এ আর নতুন কি! রাত পোহালেই প্রতিদিন একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি। সাত-সকালেই উৎপাত-উপদ্রপ, চিৎকার-চেঁচামিচি আরম্ভ হয়ে যায়। মাথা একেবারে চিবিয়ে খায়। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে রমলার। ইচ্ছা হয়, রঘুর ঘাড়টা মটকিয়ে দিতে। ওর গলা টিপে দিতে। শেষাব্দি অতিষ্ট হয়ে, তিক্ত-বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিতে হয়। আর তক্ষুণি উর্দ্ধঃশ্বাসে দৌড়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় রঘু।

ওদিকে শোচনীয় অবস্থা প্রমিলার। মানসিক অশান্তিতে বুকের ভিতরটা পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। শরীরের অঙ্গ-পতঙ্গগুলি ক্রমশ অসার হয়ে আসছে। সকাল থেকে ভারাক্রান্ত মনে রান্নাঘরের চৌকাঠে চুপচাপ বসে আছে। মাসের শেষ, একটা কানাকড়িও নেই ঘরে। চাল, ডাল, তেল-মশলা সবই বাড়ন্ত। হরিপদ সেই সাত-সকালে বেরিয়েছে। শাক-সব্জি-তরিতড়কারি বাজারে নিয়ে গিয়ে বসেছে। বেচা-বিক্রি হলে বাড়ি ফিরবে। তার নির্দিষ্ট কোনো সময় সীমা নেই। এলে পরে চূলোয় আগুন জ্বলবে, রান্না বসবে। এদিকে বেলা ক্রমশ বয়ে যাচ্ছে। এখনো পেটে কিছু পড়েনি। সবাই ক্ষুধার্ত। ক্ষিদায় চোঁ চোঁ করছে পেট। গতকালের একখানা বাশি রুটি ছিল হাঁড়িতে। রঘুনাথ সেটা নিয়েই আমগাছের ডালে বসে হনুমানের মতো চিবোচ্ছে। তা নাহলে এতক্ষণে ও’ কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতো। গুষ্ঠীর পিন্ডি চটকাতো।

বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। তখনও চূলোয় আঁচ পড়েনি। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ। সবাই চুপ চাপ। কেউ কথাবার্তা বলছে না। মুখ ভার হয়ে আছে। বারান্দায় বসে ব্ল¬াউজ রিপু করছে রমলা। গোয়ালঘরের পাশে নিকুঞ্জ লাউমাচা তৈরী করছে বসে বসে। উঠোনের একপাশে শুকনো নারকেল নিয়ে ছুলতে বসেছে প্রমিলা। ইতিমধ্যে হাতে পানদানি নিয়ে কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন হরিপদর মাতারানী প্রভাবতী দেবী। তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে পড়লেন বারান্দায়। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। ওদিকে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই লক্ষ্য করছিল রঘু। কিন্তু ওর মাথায় কিছুই ঢুকলো না। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো আমপাতাগুলিকে পদতলে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে আপনমনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গোয়ালঘরের দিকে। হঠাৎ ধমক দিয়ে ওঠে নিকুঞ্জ, -‘হেই, শান্ত হইয়া বহস না ক্যান এক জায়গায়? খালি বাইন্দরামি, না!’

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে,-‘ইচ্ছা করে ধইরা লাগাই দুইটা!’

চমকে ওঠে রঘু। পরিস্থিতি বেগতিক লক্ষ্য করে বাধ্যগত ছেলের মতো চুপচাপ নিকুঞ্জর পাশে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু গায়ে ফোসকা পড়ে গেল প্রমিলার। হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। সেটা পড়লো গিয়ে রঘুনাথের উপর। একেবারে তীক্ষè কণ্ঠে গর্জন করে ওঠে প্রমিলা, -‘হতচ্ছাড়া, কুলাঙ্গার, তরে নিয়া যামু কোন্ চুলোয় কয়? কে দিবে তরে ঠাঁই। সহ্যই হয় না কারো। দুনিয়ার মানইষে চেহারা সুরত দেইখ্যা হাসে, উপহাস করে। তবু রবাত ভালো আছিল, পোলা হইছিল, নইলে কাউরে মুখই দেখাইতে পাইত্তাম না। আমাগো পানিত ডুইব্যা মরতে হইত।’

পেটের ক্ষুধা সহ্য করা যায়। উপবাসে থাকা য়ায়। কিন্তু অবেলায় অসময়ে অকথা-কুকথা সহ্য হয় না হরিপদর মাতারানী প্রভাবতী দেবীর। তিনি হলেন সেকেলে মহিলা। সংস্কার বিশ্বাসী। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। দুইবেলা পুঁথী পাঠ করেন। তার ধারণা, এতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়, অমঙ্গল হয়। একেই শরীর একখানা তার রোগের ডিপু, হাই ব্লাডপ্রেসার, তন্মধ্যে প্রচন্ড বাতের ব্যথা। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। ক’দিন যাবৎ পা-দুটোতেও ফোলা ধরেছে। নড়তে চড়তে পারেন না। ঘাঁড় কুঁজো হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে বড্ড কষ্ট হয়। মন-মেজাজ একদম ভালো নেই। তদুপরী প্রমিলার কথাগুলো যেন তীরের মতো ছুটে এসে কানে বিদ্ধ হলো। সম্বরণ করতে পারলেন না। ক্রোধে চোখ-মুখ রাঙিয়ে ফোঁস করে উঠলেন,-‘কি অলক্ষুণে কথা শুরু করছ বৌমা! দুঃখ কি শুধু তোমার, আমাগো নাই? পোলাপাইন আমরাও তো মানুষ করছি! স্থান-কাল-জ্ঞান আছে কিছু তোমার?’
কিছুক্ষণ থেমে গলার স্বর নরম করে বললেন,-‘হক্কল সময় হক্কল কথা কহন ঠিক নয়। কি করবা, প্যাটে যখন ধরছ, অরে তো আর ফ্যালতা পারবা না। সবই ভাইগ্য। কিন্তু অভাব অনটন চিরকাল থাকব না। আমার বিশ্বাস, ভগবানে মুখ তুইল্যা একদিন চাইবই! অরে ল্যাখাপড়া শিখাও, মানুষ কর। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাও। শত হইলেও হেতো পুরুষমানুষ। হ্যার আবার দুঃখ কিসের? শুনছি, মাইনষে কানা ছেলেরেও কয় পদ্মলোচন। কথায় আছে না বৌমা,-“সোনা ব্যাঁকা হইলেও হেইডা সোনাই, এক্কারে খাঁটি সোনা।” বুঝলা। আমাগো রঘুনাথ একদিন খাঁটি সোনা হইয়াই বাহির হইব, তুমি দেইখ্যা নিও। বাশি হইলেও আমার কথা একদিন লাগবই লাগব।’

ইতিমধ্যে কখন যে হরিপদ এসে আমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে মায়ের কথাগুলি আড়ি পেতে শুনছিল, কেউ টের পায়নি। হঠাৎ সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়ে তীব্র কণ্ঠে গর্জে ওঠে,-‘মা, তুমি থামবা! ঐসব কইতেই সহজ! পোলারে লিখাপড়া শিখামু, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানামু, হেই ক্ষমতা আছে আমার, না হইব কুনদিন! হ্যার ল্যাখাপড়া তো রসাতলে গ্যাছে গিয়া। ছাইড়্যাই দিছে। এত্তো বড় বড় কথা কেম্নে কও? এসব আমাগো মুখে শোভা পায়? ল্যাখাপড়া আমার বাবায় শিখাইছে? ইস্কুলে পাঠাইছিল কুনদিন? চাষার পোলারে হে চাষাই বানাইছে। লাঙ্গল একখান্ ধরাই দিছে হাতে। ইস্কুলের মুখও দেখি নাই জীবনে। তুমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাইবার কথা কও। সবই বরাত, ভাইগ্য। জঙ্গলের পশ-পক্ষীরাও দুইটা খাইয়া বাইচ্যা থাকে, আনন্দ করে। আমাগো তো জনমই বৃথা! মনুষ্যকূলে আইসা আমরা কি করছি? মানুষই হইতে পারি নাই। আমাগো সারাটা জীবন লাঙ্গল চালাইয়াই খাইতে হইব, অন্ন যুগাইতে হইব। ভুইল্যা যাইও না, রঘুও চাষার পোলা, হেও চাষাই হইব। অরে এত্তো বড় বড় স্বপ্ন দেখাইও না, বুঝলা? কক্ষনো দেখাইও না।’

চটে যান প্রভাবতী দেবী। শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুঁজতে গুঁজতে উঠোনে নেমে আসেন। ভ্রু-যুগল উত্তোলণ করে বলেন,-‘দ্যাখামু না ক্যান? ক্যান দ্যাখামু না? তরা রোজ অশান্তি করস! অরে পিটাশ, মারধর করস। হে হাউ হাউ কইর‌্যা কান্দে। এসব দেইখ্যা চুপ থাকি কেম্নে কঅ? আমরা কেহই চিরকাল বাঁইচ্যা থাকুম না! হ্যার ভবিষ্যৎ কি হইব, একবার চিন্তা করছস!’

হরিপদ নিরুত্তর। মনে মনে ভাবল, কথায় কথা বাড়ব, তালে তাল দিব প্রমিলা। অরে ইন্ধন যোগাইব রমলা। সবাইরে উচকানি দিব নিকুঞ্জ। ব্যস, লাইগ্যা যাইব গিয়া কুরুক্ষেত্র, তুমুল ঝগড়া, তর্ক-বিতর্ক। তার চাইতে চুপ থাকাই মঙ্গল। চিন্তাই করুম না। পোলার অদৃষ্টে যা লিখা আছে, তাই-ই হইব। ভাবতে ভাবতে ধপ্ করে বসে পড়ে বারান্দায়।

প্রতিদিন বাজার থেকে এসে হরিপদর বিড়ি টানার অভ্যেস। অগ্নিসংযোগ করে সবে মাত্র দুটান দিয়েছে, হঠাৎ গরুর বাছূর ডেকে উঠতেই নজরে পড়ে, রঘু লাউমাচা তৈরী করতে বসেছে। নিকুঞ্জকে সহযোগীতা করছে। মনটা তৎক্ষণাৎ বিষাদে ভরে গেল। হতাশ হয়ে ফোঁস করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,-‘হায়রে কপাল আমার, এরেই কয় অদৃষ্ট। চাইলেই হয় না। পোলারে ইস্কুলে দিয়াও অর ল্যাখাপড়া হইল না। মানুষ হইব না আর!’

বারান্দার কোণায় বাঁশের খুঁটিতে ঝুলন্ত গামছাটা টেনে নিয়ে বলল,-‘হ্যারে কুঞ্জ, আজ রঘুরেও লইয়া আইস ক্ষ্যাতে। অরেও তো শিখান লাগব।’
বলে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে গোয়ালঘরের গা-ঘেষা সরু মেঠোপথ বেয়ে হরিপদ নেমে পড়ে বিশাল ক্ষেতিজমিতে। তার কিছুক্ষণ পরই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল নিকুঞ্জ। ওর পিছে পিছে এগিয়ে চলে রঘুনাথ।

( ২ )

দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকটা বছর। ততদিনে রঘু বড় হয়ে উঠেছে। ক্ষেত-খামারির কাজও রপ্ত করে নিয়েছে। শ্রমিক সংখ্যা বেড়ে তিনজন হয়েছে। আনাচপাতী প্রচুর পরিমানে উৎপন্ন হচ্ছে। বাজারেও বিক্রি হচ্ছে। পয়সা কড়ির আমদানিও বেড়েছে। ধীরে ধীরে হরিপদর আর্থিক উন্নতি দেখা দেয়। সংসারে স্বচ্ছলতা আসে। পরিপূর্ণতা অনুভব করে। সবাই খুব খুশী। একমাত্র প্রভাবতী দেবী পারেন নি খুশী হতে। রঘুর হাতে লাঙ্গল দেখলেই তিনি সাংঘাতিক চটে যান। রক্তের চাপ তিনগুন বেড়ে যায়। কত স্বপ্ন ছিল তার, কত আশা ছিল, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রঘুনাথ একদিন বড় হবে, মানুষ হবে। মা-বাবার দুঃখ চিরতরে মুছে দেবে। মুখ উজ্জ্বল করবে। বংশ মর্যাদা বাড়বে। কিন্তু তা পূরণ হলো না। হবার সম্ভাবনাও নেই। এ দুঃখে প্রভাবতী দেবীর মুখের হাসি একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। সারাদিন মুখ ভার করে বসে থাকেন। হরিপদ ‘মা’ বলে ডাক দিলেই একগাল পান নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বকতে শুরু করেন,-‘কি কপাল কইরা আইছিলি সংসারে, কত্তগুলা বান্দর পোলাপাইনের ডরে ইস্কুল ছাইরা দিছস, ল্যাখাপড়া বন্ধ কইরা দিছস। মুখ পোড়া, না খাইয়া পইড়া থাকলে হ্যারা খাওয়াইব তরে! আইয়া জিজ্ঞাইবও না কেউ! মাও হইছে একখান, খালি চিল্লায়, মাথা গরম করে। কামের কাম কিচ্ছু হয় না। কেবল আমিই হাউ হাউ কইরা মরি।’

মন্ত্রের মতো প্রতিদিন একই গাঁথা শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গেছে সবার। কেউ গায়ে মাখায় না। পাগলের প্রলাপ মনে হয়। এক কান দিয়ে ঢোকায়, আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। রঘুনাথ মুখ টিপে হাসে। কখনো বিচিত্র মুখাবয়বে গলার স্বর বিকৃতি করে বলে,-‘তোমার ছেলেকে তো পন্ডিত বিদ্যাসাগর বানিয়েছ। সারাদিন কানের কাছে বক বক বক! উফঃ বিরক্তি ধরে গেছে!’

প্রভাবতী দেবী আসতেই ছুটে পালায় রঘু। দূরে গিয়ে মনে মনে বলে, -হেঃ, পাগলে কি না বলে, আর ছাগলে কি না খায়!
কিন্তু রঘুর মতো ছেলে প্রভাবতীর কথার অর্থ কিইবা বুঝবে!

মাঘ মাস। শীতের বেলা। রৌদ্রখড়দ্বীপ্ত উজ্জ্বল আকাশ। ঠান্ডার দাপটে তা মালুমই হচ্ছে না। কনকনে শীতল হাওয়া বইছে। ঘরের ভিতরেই টেকা যাচ্ছেনা। বাইরের শীতল বাতাসে সারাঘর জুড়ে জমে হীম হয়ে যাবার জোগার। সূর্য্যরে তাপ গায়েই লাগছে না। রঘু দুইহাত বোগলে গুঁজে র্থ র্থ করে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে বাইরে। বেরিয়েই দ্যাখে, মা-ঠাকুমা দু’জনে আমগাছতলায় বসে বসে ডালের বড়ি দিচ্ছে। দ্রুতপায়ে গিয়ে বসে পড়ে সেখানে। তার একটু পরে রমলা এসে যোগ দিতেই ওর অলক্ষ্যে মুখখানা বিকৃতি করে একটা ভেঞ্চি দিলো রঘু।

নজর এড়ায় না প্রমিলার। মনে মনে হাসলো। হঠাৎ পিছন ফিরতেই লক্ষ্য করে, আশে-পাশে কোথাও নেই রঘু। কখন যে নিঃশব্দে সড়ে গেছে, কেউ খেয়াল করেনি। উঠোনের ডানদিকে বিরাট শাঁন-বাঁধানো পুকুর। দূপুরে এই সময়ে পুকুরের জল বেশ পরিস্কার থাকে। ভাবল, রঘু বোধহয় সাঁতার দিতে নেমেছে। কিন্তু এতো ঠান্ডায়? ভাবতে ভাবতে গলা টেনে প্রমিলা দেখলো, পুকুরেও নেই। তবে কোথায় গেল রঘু।

দৌড়ে গিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে দ্যাখে, গায়ে কাঁথা কম্বল জড়িয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখছে রঘু। গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে। ওর চোখেমুখেও আবেগ, উদ্বেগ। কখনো আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে একেবারে সশব্দে লাফ দিয়ে উঠছে। উঠবেই তো! ওতো আর বাচ্চা নয়। ষোল বছরের কিশোর। ক্রিকেট খেলা বেশ ভালোই বোঝে। প্রতিদিন দেখতে দেখতে একরকম নেশায় ধরে যায়। শুধু দেখবার জন্য নয়, এখন নিজেই ক্রিকেট খেলবে। ওও ক্রিকেট প্লেয়ার হবে। ইচ্ছাটা বেশ ক’দিন ধরে ওর মস্তিস্কের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন উদ্যাম-উদ্দীপণায় নিজেকে নতুন প্রত্যয়ে গড়ে তোলার উচ্চাভিলাষে ক্রমশ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু কথাটা মা-বাবাকে বলবে কেমন করে। সাহসেই কুলোচ্ছে না। শুনলে মাতা প্রমিলা নিশ্চয়ই অশান্তি করবে। রাগারাগি করবে, চিল্লাচিল্লি করবে। কিন্তু ক্রিকেট ও’ খেলবেই।
যা অনুমান করেছিল, ঠিক তা-ই হলো। শোনামাত্র প্রমিলা চোখমুখ রাঙিয়ে তীব্র কণ্ঠে গর্জে ওঠে,-‘মুখপোড়া, মোটেই শান্তি দিবিনে আমায়! কইছে কে তরে এসব! ক্রিরিকেট খ্যালা ক্যাম্নে খ্যালে তুই জানস?’
পরক্ষণেই নরম হয়ে বলল,-‘আমাগোর মতো গরীব ঘরে এসব মানায় না বাবা। খ্যালতে লাগব না। বল ছুইট্যা মাইনষের গায়ে পড়ব, হ্যারা চিল্লাচিল্লি করব, গালি দিব। যা বাবা যা, ঘরে গিয়া টি.ভি দ্যাখ গে যা। সক্কাল সক্কাল জ্বালাস নে। আমারে রেহাই দে!’

রঘুনাথ নাছোরবান্দা। মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, কনভিন্স করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রমিলা আপত্তি হানলে মায়ের মুখে মুখে তর্ক করে। প্রতিবাদ করে। অভিযোগের সুরে বলে,-‘আমি এখন বড় হয়েছি। ক্রিকেট খ্যালা কেমন করে খ্যালে আমি জানি। কাউকে লাগবে না। আমি একাই খেলবো। আমাকে পয়সা দাও।’

শুনে হাঁ করে থাকে প্রমিলা। -‘পোলায় কয় কি! ক্রিরিকেট খ্যালা তুই কি বুঝস! তর বাবায় খ্যালছে কুনদিন!’
আঙ্গুল দিয়ে ওর মাথায় একটা গুঁতো মেরে বলে,-‘ক্রিরিকেট খ্যালায় তরে ভাত দিব কুনদিন?’

গ্রাহ্যই করলো না রঘু। হাতটা বারিয়ে দিয়ে বিব্রোত কণ্ঠে বলে,-‘দাও দাও, শিগ্গীর পয়সা দাও!’

সবিস্ময়ে প্রমিলা বলল,-‘পইসা, পইসা কি গাছে ধরে? করবি কি তুই পইসা দিয়া? ’

-‘ব্যাড-বল কিনবো।’

রঘুনাথের কথা শুনে ক্রোধে ফুলে ওঠে প্রমিলা। চোখমুখ রাঙিয়ে তীক্ষè কণ্ঠে গর্জে ওঠে,-‘খ্যালা পাইছস তুই! কত্ত কষ্টের পইসা। মানুষডা রাইত দিন খাইটতাছে। চেহারাখান্ কি হাল হইছে দ্যাখছস? বিছানায় পড়লে সংসারডা দ্যাখবে কে! কইস একবার, দিবনে ধইরা। যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা।’ বলে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। গজ গজ করতে করতে পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে গেল প্রমিলা।

রঘুনাথ একরোখা ছেলে। প্রচন্ড জেদী। বিরল সেন্টিমেন্টাল। পয়সা ওর চা-ই চাই। ছুটে যায় ঠাকুমার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,-‘দাও তো ঠাম্মা, পয়সা দাও। আমার দরকার।’

এমনিতেই নাতি বলতে অজ্ঞান প্রভাবতী দেবী। রঘুর মনপছন্দ চাহিদা পূরণ করতে তিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আড়ি পেতে সব শুনছিল। কোনো প্রশ্ন না করে তৎক্ষণাৎ শাড়ির আঁচলে বাঁধা কুড়ি টাকার দু’টো নোট বের করে রঘুর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,-‘ঘুম থিকা উইঠ্যাই শুরু করছস। মায়ে দিব তরে কুনদিন পইসা!’

ততক্ষণে বাজপাখীর মতো টাকাটা ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে চোখের নিমিষে উধাও হয়ে যায় রঘু। দৌড়ে গিয়ে বাজার থেকে ক্রিকেট খেলার সব সরঞ্জাম সব কিনে নিয়ে আসে। ওর স্বপ্ন, ক্রিকেটার হবে। একজন ভালো খেলোয়ার হবে। ওর স্বপ্নকে স্বার্থক করবে। কিন্তু খেলতেই তো পারছে না! দল ছাড়া একা একা কখনো ক্রিকেট খেলা যায়? তা’ হলে?

মনের দুঃখে অভিমানে ব্যাড্, বল হাতে নিয়ে বিষন্ন মনে চুপচাপ বসে থাকে রঘু। ওকে দেখতে পেয়ে প্রভাবতী দেবী বললেন,-‘আবার কি হইল? গাল ফুলাইয়া বইসা আছস? ক্যাম্নে খ্যালে জানস না? ব্যাড্টা দিয়া বলটারে এক্খান বারি দিলেই তো বল ছুইট্টা পালাইব। যা, যা, উঠ!’

রঘুকে অনুপ্রাণিত করলেন প্রভাবতী দেবী। তৎক্ষণাৎ মানসিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলে রঘু উঠে দাঁড়ায়। চোখেমুখে খুশীর ঝিলিক দিয়ে ওঠে। অবিলম্বে ঠাকুমার কথা মতো আঙ্গিনার এমাথা ওমাথা ব্যাড্ দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে একাই বলের পিছে পিছে দৌড়ায়। মনে মনে খুব আনন্দ পায় রঘু। উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। ওর ক্রিকেট খেলার আগ্রহ দেখে পিতা হরিপদ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। ছেলেকে উৎসাহিত করে, সঙ্গ দেবার চেষ্টা করে। অপ্রত্যাশিত খেলার সাথী পেয়ে রঘুও খুউব খুশী। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। রঘু ব্যাড্ ধরে থাকে, হরিপদ দূর থেকে ছুটে এসে বল ছুঁড়ে মারে। বাপ বেটা দুজনের খেলা বেশ জমে ওঠে।
এভাবে প্রতিদিন খেলতে খেলতে সেটা একরকম রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। বিকেলে হলেই শুরু হয় পিতা-পুত্রের ক্রিকেট খেলা। দেখতে পেয়ে ছুটে আসে পাড়া-প্রতিবেশী। ছুটে আসে পাড়ার ছোটু, নিতাই, আবদুল, করিম, পান্না, রহিম, ঝন্টু, মন্টু, আরো অনেকে। সবাই করতালি দিয়ে রঘুকে অনুপ্রাণিত করে। উৎসাহিত করে। রঘুও খুব মন লাগিয়ে খ্যালে। খেলা ক্রমশ জমে ওঠে। একরকম নেশা ধরে যায়। ওর দেখাদেখি পাড়ার কেউ কেউ ক্রিকেট খেলতে এগিয়ে আসে। রঘুনাথও সবাইকে সানন্দে গ্রহণ করে। ক্রমে ক্রমে ক্রিকেট খেলার একটি পুণার্ঙ্গ দল গঠন করে। যখন ও’ বেমালুম ভুলে গেল, ওর অতীতের ভাগ্যবিড়ম্বণায় পদে পদে অপদস্থ। তিরস্কার, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান এবং অপবাদের দিনগুলি। ভুলে গেল, দারিদ্রপীড়িত জীবনের কঠোর দুঃখ-দৈনতার কথা। ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি গ্রামে, গঞ্জে নতুন ক্রিকেট দলের বিজ্ঞাপন। কালার-পেপারে অয়েল প্যাষ্টেলে রঘুনাথ সহ ক্রিকেট দলের পুরো টিমের আঁকা ছবি। এ কি কম কথা। কম সৌভাগ্যের কথা। এ যেন শাপে বর। স্বপ্নেরও অতীত। ভাবাই যায় না।
ভাগ্যক্রমে হাইস্কুলের প্রিন্সিপাল ধীরেন মন্ডল এর সুপারিশে স্থানীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সত্যেন মিত্রের তত্ত্বাবধানে বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী নামকরণে শুধুমাত্র হষ্টেলে থেকে পড়াশোনাই নয়, শহরের ক্রিকেট খেলার বিশাল ষ্টেডিয়ামে নিয়মিত প্র্যাক্টিস করবার সুবর্ণ সুযোগও হাসিল করে নেয় রঘুনাথ।
গুরুজনের আর্শীবাদ এবং স্নেহ-ভালোবাসায় রঘুনাথ ধীরে ধীরে পরিণত হয়, একজন অভিজ্ঞসম্পন্ন সমঝদার ক্রিকেট প্লেয়ার। প্রশংসিত হয় সারা গ্রামে। সগৌরবে গৌরবাণি¦ত হয় গ্রামের মানুষ, পাড়া-প্রতিবেশী। রঘুনাথের মা-ঠাকুমা, বাবা-কাকা পিসি সকলে। গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়ে শহরের মফঃস্বল এলাকার বিভিন্ন জায়গায়।

মানুষ পরিবর্তনশীল। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে প্রকৃতির রূপ-বৈচিত্র্য যেমন করে বদলে যায়, ঠিক তেমনি করে মানুষের জীবনও বদলে যায়। সময় এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে একটু একটু করে রঘুরও পরিবর্তন দেখা দেয়। কৈশরের দৌড়-ঝাঁপ পেরিয়ে আজ ও বাইশ বছরের হাট্টাগাট্টা তরুণ যুবক। সপরিবারে শহরে পদার্পণ করে ওর চেহারা এবং বেশভূষার লক্ষণীয় পবিবর্তন ঘটে। মনের উদ্যাম-উদ্দীপণায় এবং নিরলস প্রচেষ্টায় এগোতে থাকে নিজেকে নতুন প্রত্যয়ে গড়ে তোলার আশা ও কাক্সিক্ষত জীবনের চরম সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। যেদিন দেশের ন্যাশানাল্ ষ্টেডিয়ামে বয়েজ-ক্লাবের বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচে অংশ গ্রহণের আমন্ত্রণে সম্পূর্ণ বদলে গেল রঘুনাথের জীবন ও জীবনধারা।

শুনে অত্যাশ্চর্য্যজনকভাবে বিস্মিত হলেন, গ্রামীণ পাঠশালার হেড্ মাষ্টার দত্ত মশাই সহ হাইস্কুলের প্রিন্সিপাল ধীরেন মন্ডল। আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে মাতা প্রমিলা। আত্মগর্বে গর্বিত হয়ে সাবেগে সহাস্যে বলে ওঠে,-‘হ্যাঁ গো, পোলায় কি কয় শুনছো!’

অভ্যাসের দাস হরিপদ শহরে এসেও নিজেকে এতটুকু বদলাতে পারে নি। বারান্দায় বসে বসে বিড়ি টানছিল। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল,-‘পোলায় নয় গো গিন্নী, গ্যারামের মাষ্টারে ডাইক্যা কইছে অরে! হেই শহরের পঞ্চায়েত মশাইরে ধইরা সব ব্যবস্থা করছে, জানো কিছু!’

স্বপ্নের মতো মনে হয় প্রমিলার। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয়না। মনে মনে বিড় বিড় করে বলে,-এত্তবড় অসম্ভব সম্ভব হইল ক্যাম্নে! এ যে ভূতের মুখে রাম নাম। পোলায় সত্যিই ক্রিকেট খ্যালতে শিখছে, কিন্তু ক্যাম্নে? কেডায় শিখাইল!

বিস্ময়ে এতোটাই অভিভূত হয়ে পড়ে, হঠাৎ অব্যক্ত আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে প্রমিলার। অনুতাপে অনুতপ্ত হয়, অনুশোচনা হয়। আহা! পোলা আমার মনে কত্ত কষ্ট পাইছে। আঘাত পাইছে। কত্ত চোখের পানি ফ্যালছে। কত্ত গালি দিছি। মাইরও খাইছে অনেক। দু’চোখ বন্ধ করে ভক্তিভরে ঈশ্বরকে স্মরণ করে বলে,-‘সবই তোমার ইচ্ছা প্রভু!’

বলেই একধরণের কোমল বেদনাময় গহীন অনুভূতির তীব্র জাগরণে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। রঘনাথকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে। ওদিকে হৃদয়ের দুকূল প্লাবিত করে খুশীতে আটখানা প্রভাবতী দেবী। কি করবে, দিশা খুঁজে পায় না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় উচ্ছাসিত চোখে ঠোঁটদু’টো চিবিয়ে চিবিয়ে সহাস্যে বলে,-‘কি বৌমা, এহন কান্দ ক্যান, এ্যাঁ! কি কইছিলাম! কতায় আছে না, সবুরে মোয়া ফলে। আজ ফলছে গো ফলছে!’

ঠাকুমার গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে রঘুনাথ। নজর এড়ায় না প্রভাবতী দেবীর। দৌড়ে পিছন থেকে এসে খপ্ করে ওর জামাটা টেনে ধরে বলে,-‘ওই মুখপোড়া, কোই গ্যালি তুই। আয়, তরে একটু দেখি!’
ততক্ষণে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয় রঘু। একগাল হেসে বলে,-‘হীপ হীপ হুড়রে!’

কিন্তু কখনো কি কল্পনা করতে পেরেছিল কেউ, রঘুনাথ একদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচে অংশ গ্রহণ করবে। উড়ো জাহাজে চেপে দেশ-বিদেশ ঘুরবে। স্বপ্নেও কি ভাবতে পেরেছিল কেউ, হতলাঞ্ছিত, প্রবঞ্চিত, নিগৃহীত, নিপীড়িত রঘুনাথ একদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচে চাম্পিয়ান হবে। গোল্ড্ ম্যাডেল পাবে। খ্যাতি অর্জন করবে। সুপ্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হবে। মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। বংশ মর্যাদা বাড়বে।

ভাগ্যের লিখন রোধ করে সাধ্য কার। স্বয়ং বিধাতারও নেই। মিরাকলের মতো প্রথম প্রয়াসেই একদিন তাই-ই ঘটে গেল রঘুনাথের জীবনে। যেদিন গ্রামীণ হেড্ মাষ্টার দত্ত মশাই-এর রিকমেন্ডে ন্যাশানাল্ ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিয়ে রঘুনাথ প্রথম দিনেই বিরোধী দলকে একশ ত্রিশ রানে পরাজিত করে অনায়াসে জিতে নেয় জীবনের প্রথম পুরস্কার। সেই সঙ্গে ভূষিত হয়, দা বেষ্ট ক্রিকেট প্লেয়ার অফ্ দা ইয়ার। যেদিন গ্রামের কাঁচাবাড়ি পরিত্যাগ করে শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার স্বীকৃতি পত্র পাস হোলো।

স্বপ্নের মতো মনে হয়। অবিশ্বাস্যকর হলেও বাস্তব সত্য। রাতারাতি বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছাবার দুয়ারগুলি অচীরেই খুলে গেল রঘুনাথের। চারিদিকে ওর জয় জয়কার। গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়ে শহরে, শহর থেকে বহুদূর-দূরান্তে, রাজ্যের অলিতে-গলিতে, প্রতিটি ক্রিকেট ভক্তদের অন্তরে।

স্বাভাবিক কারণে পড়াশোনাতে আরো মনোযোগ বেড়ে যায় রঘুনাথের। সেই সঙ্গে ফাইনাল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মার্কস পাবার ইচ্ছানুভূতির তীব্র জাগরণ এবং জীবনে উত্তীর্ণ ও বড় হবার স্বপ্ন ওর মস্তিস্কের স্নায়ুকোষে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়। যেদিন উচ্চাকাক্সিক্ষত বাসনাগুলিকে বাস্তবায়িত করার প্রত্যয় নিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি এবং একাগ্রহে নিরলস সাধনায় নিমগ্ন হয়ে নির্বিঘেœ সাফল্যের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে যায় উচ্চাভিলাষী রঘুনাথ রায়চৌধুরী। সফলতা যেন নিজে এসে ওর কাছে ধরা দিতে লাগলো।

আর নাগাল পায় কে! মিরাকলের মতো ঘুরে গেল রঘুনাথের ভাগ্যের চাকাটা। রীতিমতো বদলে গেল ওর বাসভবন, লাইফ ষ্টাইল, বেশভূষা, জীবনধারার পদ্ধতি। মুছে গেল পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি। মিটে গেল ভাগ্যবিড়ম্বণায় দুঃখ দীনতার কঠোর যন্ত্রণা।
প্রত্যেক বছর স্কলারশীপ্ নিয়ে সগৌরবে একের পর এক সৌভাগ্যের সিঁড়ি বেয়ে খ্যাতনামা পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়ে রঘুনাথ অনায়াসে পোঁছে যায় জীবনের চরম সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। ওর এই সফলতায় জন্মধাত্রী মাতা প্রমিলা, পিতা হরিপদ, ঠাকুমা প্রভাবতী দেবী, পিসি রমলা, কাকা নিকুঞ্জ সহ কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী-প্রফেসর, প্রিন্সিপাল সকলে আত্মগর্বে গৌরবাণ্বিত বোধ করে। শুধু তা নয়, সকলের মন জয় করে সুপ্রসংশায় প্রসংশিত হয়ে দুহাতে কুড়িয়ে নেয় তাদের সকলের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা ও আর্শীবাদ।

রঘুনাথ আজ বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য বিশ্বকাপ ক্রিকেট চাম্পিয়ান বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী নামে অতি সুপরিচিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পঁচিশ বছরের তরুণ যুবক। বিশ্ব বিখ্যাত যার নাম, যশ এবং পদোন্নতির স্রোতে হারিয়ে গেছে, শৈশব ও কৈশোরের অতি নগন্য নিগৃহীত, নিপীড়িত, হতভাগ্য সেই রঘুনাথ। আজ দিগন্তের প্রান্তরে সদ্য উদীয়মান স্নিগ্ধ কোমল নির্মল সূর্য্যরে মতো রঘুনাথ নতুন পরিচয়ে জন্ম হোলো ভবের সংসারে। তারই শুভার্থী ভক্তরা বিজয়মাল্য হাতে নিয়ে সাবেগে সানন্দে সগৌরবে ওকে অভিনন্দন জানাতে ভীঁড় জমিয়েছে শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিশ্ব বিজয়ী ক্রিকেট চাম্পিয়ান শ্রী বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী আজ ইংল্যান্ড থেকে স্বদেশে ফিরছে, এ কি কম আনন্দের কথা! কম সৌভাগ্যের কথা! কম গৌরবের কথা!

আবেগে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রমিলা। আনন্দে আত্মহারা হরিপদ। অশ্রুকণায় চোখ ছলছল করছে। রঘুনাথকে দেখবার জন্য সবাই অস্থীর, উতলা হয়ে উঠছে। যার পর্দাপণে হরিপদর অন্ধকার ঘরে আজ জ্বলে উঠবে একরাশ উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় আলো। এ যেন মরা গঙ্গায় বান। ঠিক যেন শুকনো নদীর বুক জোয়ার জলে কানায় কানায় ভরে যাওয়ার মতো।

সত্যিই তাই। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। বিমানবন্দরে অগণিত ভক্তদের ভীঁড়। পা ফেলার জায়গা নেই। হঠাৎ শতসহস্র লোকের ভীঁড় ঠেলে প্রভাবতী দেবী সাশ্রু নয়নে এগিয়ে আসেন। সাবেগে সগৌরবে বলে ওঠেন,-‘প্যাটে সোনাই ধরছিলা বৌমা! তোমরা বুঝ নাই! আমাগো রঘুনাথ সত্যিই একখান্ খাঁটি সোনা।’

তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে রঘুনাথের বাল্যবন্ধু নিতাই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে,-‘সোনা নয়গো ঠাকুমা, বলো হীরে, হীরের টুকরো ছেলে। আমাদের রঘু সত্যিই হীরের টুকরো ছেলে।’

আহাল্লাদে গদ্গদ্ প্রভাবতী দেবী। আবেগে আপ্লুত হয়ে রঘুনাথকে বুকে সজোড়ে আলিঙ্গন করে ওর চিবুকটা তুলে ধরে বললেন,-‘কই দেখি, আমার দাদাভাই-এর মুখখান একবার দেখি। এইবার শিগ্গীর একখান্ লাল টুকটুকে বৌ আইন্যা দিমু তরে!’

সমাপ্ত

যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরোন্ট প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।[email protected]

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন