আমার জীবনের প্রথম চাকুরী ব্র্যাকে। বিশাল এক প্রতিষ্টানের অতি সাধারণ এক কর্মী। নুতন চাকরির বদৌলতে  পেশাগত জীবন ছিল নিত্য নুতন অভিজ্ঞতায় ভরপুর। গর্বিত ভাব নিয়ে ব্র্যাকের পরিবহনে করে অফিসে যাতায়াত করি।  প্রতিদিন সকাল আটটার মধ্যে পরিপাটি হয়ে জিগাতলা বাস স্ট্যান্ডের মোড়ে একটি নিদৃষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকি। মোহাম্মদপুর থেকে ছেড়ে আসা মিনিবাসে অন্য সহকর্মিদের সাথে আমিও  উঠে বসি। গাড়ি ছুটে চলে ৭৫ মহাখালীর ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে। এই বাসে যাতায়াতের সুবাদে পরিচয় হয় প্রয়াত নাসরিন হক (পরবর্তীতে আমার বস এবং একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর), ফেরদৌস (ড: আমানউল্লাহ ফেরদৌস, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং রফিকুল ইসলাম সাথী ভাইয়ের সাথে। বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় যে কজন মানুষ সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে মোটেও দ্বিধাবোধ করেন না, ফেরদৌস নিঃসন্দেহে তাদের শীর্ষে। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা বা চেতনা বাণিজ্য বিবর্জিত তার  বস্তুনিষ্ট, নিরপেক্ষ সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মুগ্ধ হয়ে পড়ার মতো । এই তিনজন মানুষকে নিয়ে ভবিষ্যতে আলাদা ভাবে লেখার ইচ্ছা আছে । আজকের প্রসঙ্গ রফিকুল ইসলাম সাথী ভাইয়ের একটি গানকে ঘিরে। রফিক ভাই সেসময় কাজ করতেন ব্র্যাকের শিক্ষা বিভাগে (NFPE)। সুরেলা কণ্ঠ আর অনন্য গায়কীর কারণে যেকোনো সাধারণ গান তার কণ্ঠে হয়ে উঠে অসাধারণ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। রফিক ভাই কিছুদিন আগে তার নিজের কণ্ঠে গাওয়া হবিগঞ্জের এক মরমী সাধক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি গান শুনতে পাঠিয়েছেন আমাকে। গানের প্রথম লাইন, “সোনা বন্ধুরে, আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি”। আক্ষরিক অর্থে বন্ধু বিচ্ছেদ, বিরহ মনে হলেও  ভাবার্থের বিচারে  এই গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাস আসলে তার শ্রষ্টাকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন এই গানে। আমার প্রপিতামহ সৈয়দ আব্দুন নূর হোসাইনী চিশতী সাহেব ‘দীনহীন’ ছদ্মনামে অসংখ্য মরমী সংগীত রচনা করেছিলেন। তিনিও গেয়েছেন, “তুমি না রহীম হইলে মরণ নিশ্চয়”। এরকম অসংখ্য মরমী গান ও মরমী সাধকদের পুণ্যভূমি হবিগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল।

পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদা’র ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্পাক ঘোষণা করেন, “হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা আল্লাহ সচেতন হউ ! তার নৈকট্য লাভের উপায় বা ওসিলা অন্নেষণ করো।আল্লাহর পথে নিরলস কাজ করো। তাহলেই তোমরা সফল হবে” ।  যুগে যুগে সুফী সাধকরা নীরবে, নিভৃতে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের আশায় ইবাদতের আনুষ্টানিক ও অনানুষ্ঠানিক দুই রাস্তাতেই কাজ করে গেছেন। কেউ কেউ সুরের মধ্যে দিয়েও স্রষ্টাকে খুঁজে গেছেন জীবনভর। প্রাসঙ্গিকভাবে এখন মনে পড়ছে জার্মান কবি Henrich Heine এর সংগীত নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত একটি মন্তব্য। তিনি বলেছিলেন, “শব্দের সীমানা যেখানে শেষ, সুরের যাত্রার সেখানেই শুরু”। সংগীতের Therapeutic value এখন সর্বজনস্বীকৃত।  আমি নিজে সব গান শুনি না। সব গান শুনতে ইচ্ছেও করে না। লারে লাপ্পা টাইপের গানতো নয়ই।  কিন্তু যে গান আমাকে মানব জনমের তুচ্ছতা নিয়ে ভাবায়, যে গান আমাকে মনে করিয়ে দেয় মহাবিশ্বের বিশাল সৃষ্টির মধ্যে আমার মতো মানুষের অস্তিত্ব কতটা অকিঞ্চিৎকর,  যে গানে ধ্বনিত হয় যে স্রষ্টার অপার করুনার ছায়া তার ঘোষিত শাস্তির ভয়াবহতার চাইতেও কোটি কোটি গুন বড় ও বিস্তৃত, যে গান জীবনের সব সীমাবদ্ধতা, দীনতা নিয়ে আমাকে স্রষ্টায় সমর্পিত হতে উজ্জীবিত করে, – সে গান শুধু গান নয়, সেই গান আমার কাছে প্রার্থনার সমান তাৎপর্য বহন করে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের মতো ভিন্ন ভিন্ন যে নামেই ডাকি না কেন, দিনের শেষে আমরা তার নাম নিয়েই কাঁদি, অনন্ত যাত্রায় ফিরে যাই তারই কাছে।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন