অশেষ, অফিস থেকে ফিরে হোটেল সোনারগাও-এর উল্টো দিকের ছোট পার্কটিতে অনেকক্ষণ ধরে বসে রয়েছেন। লক ডাউন চলছে। চারদিক সুনসান নিরবতা। কারো সাড়াশব্দ নেই। সার্ক ফোয়ারার পাদদেশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা দুই হাত গালে ঠেকিয়ে বসে রয়েছেন। তিনিও মাক্স পড়েছেন। রাস্তার এখানে সেখানে অল্প কিছু
পথচারী এবং দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ছাড়া আর তেমন কেউ নেই।

আচমকা একটি আট থেকে নয় বছরের ছোট শিশু ছুটে এসে অশেষকে জড়িয়ে ধরে লুকাতে চেষ্টা করলেন। শিশুটির সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপছে। ততক্ষণে অশেষ শিশুটিকে গভীর স্নেহে জড়িয়ে ধরেছেন।
-কিরে, ভয় কি? আমি আছি তো!
শিশুটি কোন উত্তর না দিয়ে অশেষকে আরো নীবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। সামনে দু’জন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অশেষ এবার বুঝতে পারলেন, কেন শিশুটি এতো ভয় পেয়েছেন। অশেষ কিছু বলার আগেই পুলিশ সদস্যেদের একজন বললেন,
-শিশুটি খুব ভয় পেয়েছে। আমরা ওকে থামানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সম্ভবত শিশুটি আমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারেনি।
অশেষ পুলিশ সদস্যদের মুখ থেকে এতো আন্তরিক ও মানবিক কথা শুনে খানিকটা অবাক হলেন। অশেষ বললেন,
-ছোট বেলাতে কোন বাড়িতে পুলিশ এলে, আমরাও খুব ভয় পেতাম। পুলিশ বলতে আমরা আসলে বিশেষ কিছু ধরে নিতাম। এমন কি রাস্তা দিয়ে পুলিশ হেটে গেলেও আমরা ভয়ে পালিয়ে যেতাম। যে কারণে শিশুটিও সম্ভবত  আপনাদের দেখে ভয় পেয়েছেন।
-জী, ঠিক ধরেছেন।

শিশুটির সমস্ত চেহারায় আশ্চর্য রকমের মায়াবী আলো ছড়িয়ে আছে। ভীষণ সুন্দর দেখতে।! ময়লা, ছেড়া একটি নীল রঙের হাফ প্যান্ট ও হাতা কাটা গেঞ্জি শরীরে জড়ানো। নগ্ন পা দুটি যেন, সমস্ত দুনিয়ার মানুষকে তিরস্কার করছেন!
“এতো এতো প্রাচুর্য আছে তোমাদের! কতো রকমের বিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত তোমরা! অথচ দেখো, চেয়ে দখো- বিশ্বের এই মহামারীতে! দেশের এই মহামারীতে একটি ফেরেস্তার মতো ছোট শিশু, জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় পথে পথে ঘুরছেন।“ কেন? তোমাদের কোন দায় নেই? তোমরা কি তোমাদের হাত, এই রকমের হাজারো শিশুদের জন্যে বাড়িয়ে দিতে পারো না?
অশেষের আন্তরিক কথা বার্তা শোনে, সম্ভবত শিশুটির ভয় খানিকটা কমেছে।চেহারা দেখে তাই মনে হচ্ছে। শিশুটি অশেষকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পুলিশ সদস্যদের একজন হাঁটু গেঁড়ে বসে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আহা! এই বয়সের একটি শিশু তাঁরও থাকতে পারতো।
-এই, তুই এতো ভয় পেয়েছিলি কেন? আমরা তো তোকে ডেকেছিলাম এমনিতেই। তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?
শিশুটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো পুলিস সদস্যটির চোখের দিকে। শিশু মন সব সময়ই ভালোবাসার কাঙ্গাল থাকে। আদর ভালোবাসা পেলে সবাইকেই খুব তারাতারি আপন করে নিতে পারেন। শিশুটি পুলিশ সদস্যের কথার জবাব দিলেন,
-ফালান, আমার নাম ফালান।
-খুব সুন্দর নাম! কে রেখেছেন এতো সুন্দর নাম?
-আমার নানী রাখছেন।
-তোর নানী বেঁচে আছেন?
-না, মইরা গেছে।
-আহারে! কি হয়েছিলো?
-জ্বর হইছিলো। কয়দিন পর নানী মইরা গেলো।
-এখন কে কে আছেন তোর?
-শুধু মায় আছে আমার। বাবায় ছবিরন খালারে বিয়া কইরা, আমাগো ছাইরা চইল্লা গেছে। বিয়ার পরও ছবিরন খালায় আমাগো লগে থাকতো। ছবিরন খালারে দেশ থিক্কা মায়-ই লইয়া আইছিলো। ছবিরন খালায় সারাদিন বাবার লগে গল্প করতো। মায় অনেক কানতো। ঝগড়াও করতো। বাবায়, মায়রে খালি মারতো। তবুও মায় কিছু কইতো-না।
নামাজ পইড়া, আল্লার কাছে বাবার লিগ্যা অনেক অনেক দোয়া করতো। অহনও দোয়া করে। বাবায় আমারে খুব আদর করতো। কান্দে লইয়া ঘুইরা বেড়াইতো। মনে হয় আমারে বাবায় ভুইল্লা গেছে। কতোদিন দেহিনা বাবারে!
পার্কের ভিতরে একটি নীল রঙের পলিথিনের ছাঊনি দেওয়া ছোট একটি তাবুর মতো ঘর দেখিয়ে শিশুটি বললেন,
-ঐ যে, ঐ-টা আমাগো বাসা। আমি আর মায়, ঐ ঘরে থাকি।

অশেষের বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে উঠলো। ঘর বলতে একটি ছেড়া ময়লা পলিথিনের তৈরি ছোট একটি তাবু। আশে পাশে একই রকমের আরো বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছেন। ছোট সবুজ গাছের আড়ালে ঘর বেঁধেছেন এঁরা। অথচ তাদের ঘরের একপাশের রয়েছেন এই সোনার বাংলার সবচেয়ে বড় ও বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁও এবং অপর দিকে রয়েছেন হোটেল সুন্দরবন। বসুন্ধরা সিটি মার্কেট সহ আরো কতো কি স্থাপনা!

পুলিশ সদস্যটি পকেটে হাত দিয়ে মানি ব্যাগ বের করলেন। দুটি একশো টাকার নোট শিশুটির হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,
-নে, এটা রেখে দে। মা এলে, মাকে দিবি। বলবি আমরা দিয়েছি।
পুলিশ সদস্যদের নিজেদের সংগ্রহে রাখা দুটি লাইফবয় সাবান। কয়েকটি মাক্স ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার এক বোতল পানি ও একটি বিস্কুটের প্যাকেট; ছোট একটি কাগজের ব্যাগে করে শিশুটির হাতে দিলেন। একটি মাক্স শিশুটিকে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-শোন, এভাবে আর রাস্তায় বের হবিনা। পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস বলে একটি ভাইরাস এসেছে। তোঁকে এবং তোর মা’কে নিরাপদে থাকতে হবে। আমাদেরকেও নিরাপদে থাকতে হবে। আমি আবার আসবো। তুই এখন থেকে লেখাপড়া করবি। সব খরচ আমি দিবো।

ফালান কি বলবে, বুঝতে পারছিলো-না। খুশির ঝিলিকে, ফুটফুটে শিশুটির চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অশেষ ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো পুলিশ সদস্যদের প্রতি। ভীষণ ভালো লাগলো! একেই বলে মানবতা! মানবিকতা!
অশেষ, পুলিশ সদস্যদের দুজনকে উদ্দেশ্য করেই বললেন,
-ধন্যবাদ ভাই। আপানাদের মানবিক আচরণ দেখে আমার এতো দিনের মনে রাখা ধারণা বদলে গেলো। সত্যিই আপনারা মহান! অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা থাকলো আপনাদের জন্য। ভালো থাকবেন। সাবধানে থাকবেন।

বিদায় নিয়ে পুলিশ সদস্য দুজন দায়িত্ব পালন করতে চলে গেলেন। অশেষ ফালানকে আরো দুশো টাকা দিয়ে বললেন,
-নে এটা রেখে দে। তোর মাকে দিবি। আর এই নে আমার ভিজিটিং কার্ড। এখানে আমার ফোন নং আছে। কিছু লাগলে, আমাকে জানাবি। তোর মাকে বলবি আমাকে যেন ফোন করে।
-আইচ্ছা। আপনি খুব ভালো।
_তুইও খুব ভালো। আজকে আমি যাই, কেমন?
-আইচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ। টাটা।

পথের ধারে আশ্রয় নেওয়া, সুবিধা বঞ্চিত একটি ছোট শিশুর মুখ থেকে এই রকমের বিদায় সম্ভাষণ শোনে অশেষ চমকে উঠলেন। অবাক হলেন। আবার মনে মনে ভাবলেন,হয়তো অবস্থার প্রক্ষিতে আজকে পথের মানুষ হয়ে গেছেন। এমনতো হতে পারে যে,শিশুটির মা, সু-শিক্ষিতা এবং ভালো পড়িবারের মেয়ে। মানুষের জীবনে কতো
কিছুইনা ঘটে! তবুও মানুষ পথ চলতে থাকে। পথের শেষে কি আছে, তা-না ভেবেই এই পথ চলা।

(চলবে)।

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন