বগুড়া জিলা স্কুলে বাবার সাথে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার জন্য তদানীন্তন হেড স্যার জনাব তাজমিলুর রহমান স্যার ,(আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসিব করুক ) এর রুমে বাবা সহ ঢুকলাম। স্যার ভর্তি পরীক্ষার এডমিডকার্ড দেখতে চাইলেন। আমি প্যাণ্টের পিছন পকেট থেকে ভয়ানক ধরনের অতি ময়লা ভাজকরা কাগজ টেবিল উপর রাখতেই আব্বা তার সঙ্গে থাকা লাঠি দিয়ে আমার পচাৎদেশে প্রবল বেগে আঘাত করলেন। পরে, দপ্তরি এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে সেসময়ে বাবা/মায়ের অপরিসীম ভালোবাসা ও স্নেহের পাশা পাশি এ ধরণের ট্রিটমেন্ট এর ব্যাবস্থা ছিল বলে হয়তো এ পর্যন্ত সুদূর বগুড়া থেকে আজ টরেন্ট শহরে আসতে পেরেছি। জানিনা, আমাদের সন্তানেরা যারা লাঠি পেটাতো দূরের কথা যেভাবে দুধ/মাখন খেয়ে বড় হচ্ছে ওদের  কপালে আল্লাহ্পাক কি লিখে রেখেছেন ।

আমার আব্বাকে নিয়ে পরবর্তীতে অনেক বড় করে লেখা আমার অন্তিম বাসনা। আজ এই করোনা ভাইরাসের যুগে বাঁচা /মরা যেহেতু অনিশ্চিত তাই ভবিষ্যতে সুযোগের আসায় না থেকে অতি সংক্ষেপে কিছু লিখছি ।

আমার আব্বা অত্যন্ত মেধাবী মানুষ ছিলেন। আমার জেলা স্কুলের অনেক মেধাবী বন্ধুরা যখন খেলতে যাওয়ার সময় আমার বাসায় আমাকে ডাকতে আসতো আব্বা তাদের নানান ধরণের প্রশ্নবানে জর্জরিত করতেন। যেমন: পিকরিক এসিডের রাসায়নিক সংকেত, ফিটকিরির রাসায় নিক সংকেত, ওহমের সূত্র, ইত্যাদি। আস্ত পিরিয়ডিক টেবিল ও পুরা ডিকশনারি আমার আব্বার প্রায় মুখস্থ ছিল। ইংরেজি ও বিজ্ঞানে ওনার সমান দখল ছিল। ওনার কলেজ জীবনে মঞ্চায়িত সেকসপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের ইংরেজি ডায়ালগ অনর্গল বলতে পারতেন। মিতার সাথে আমার তখনও বিয়ে হয় নি, বেচারা আমার বাড়ির কাছাকাছি এসেছে আমার সাথে দেখা করার জন্য। আব্বা আসর নামাজের জন্যে বের হতেই মিতার সামনে। আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন ‘মা তুমি কি সায়েন্সে পড়? মিতা ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ‘জি’। আব্বা বললেন ‘বলতো মা মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র কি?’

আমার মেধাবী আব্বার কাছেই আমার ইংরেজি, বিজ্ঞানের হাতে খড়ি। অষ্টম শ্রেণীতে বগুড়া জিলা স্কুল হতে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হওয়ার সিংহভাগ কৃতিত্ব আমার আব্বার। সে কথা মাথায় রেখে বৃত্তির টাকা দিয়ে আব্বাকে একটা কিছু কিনে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।  আব্বাকে বেশ উন্নত মানের স্যান্ডেল কিনে দিলাম। একদিন রাতে আব্বার বেডের পাশে বই পড়ছি। আমাদের পাড়ার কানচগাড়ী জামে মসজিদ থেকে আব্বা এসার নামাজ পরে আমাকে হটাৎ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। পরে জানলাম, আমার আব্বার সেই স্যান্ডেল মসজিদ থেকে চুরি হয়েছে । আব্বার কান্নার কারণ সেই স্যান্ডেল চুরির জন্যে না, আব্বা কাঁদছেন আমি কষ্ট পাবো সেই জন্যে।

শেষ আরেকটি কথা না বললেই না। আমার আব্বার স্বাস্থ্য রক্ষা বিষয়ে প্রচুর সজাগ ছিলেন এবং আমাদেরও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হতে শেখাতেন। আব্বা ফজর নামাজের সময় আমাদের সবার মাথার বালিশ সরিয়ে ফেলতেন। আমাদেরকে ডেকে তুলে ৩/৪ মাইল পায়ে হেটে গ্রামের বাড়িতে যেয়ে গ্রামের বাড়ির মসজিদে ফজরের আজান দিতেন। আব্বা প্রায়ই বলতেন,” শোন, একদিন আল্লাহ হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে ডেকে বললেন ‘হে আল্লাহ ধরো তুমি মুসা, আমি আল্লাহ, তুমি আমার কাছে কি চাও? জবাবে, আল্লাহ বললেন স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য’ । তো সেই বাবার পুত্র হয়ে আমি বিস্ময়করভাবে উচ্চমাধ্যমিক এর পরে ধূমপানে আসক্ত হলাম। তখন, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি । আমাদের সময় রাতের বেলায় একটা ইন্টার সিটি ট্রেনে করে ময়মনসিংহ যেতাম। এক রাতে পাড়ার বন্ধুরা এসেছে আমাকে সি অফ করতে। আমি তাড়াহুড়াকরে বাসার সামনে থেকে ষ্টেশনে যাওয়ার জন্যে রিকশায় উঠছি। হটাৎ দেখি, আমার সহজ সরল আব্বা আমার পিছনে পিছনে এসে আমার রুমে ফেলে আসা স্টার সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বলেন, বাবা, এটা রুমে ফেলে এসেছো।’। আব্বা খুব সচেতন ভাবে কাজটি করলেন আমাকে লজ্জা দিবার জন্যে।

আল্লাহ্পাক যদি আমাকে হায়াৎ দান করেন, আমার অতি প্রিয় সহজ সরল, মেধাবী ‘আব্বাকে নিয়ে বড় করে অন্যদিন লিখবো ইনশা আল্লাহ। হে আল্লাহ, আমার আব্বা, আম্মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। হে আল্লাহ, পৃথিবীর সব বাবাদের ক্ষমা করুন । হে আল্লাহ শুধুমাত্র বাবা/মা দিবসে আমাদের বাবামাদের কে বাক্সবন্দী না করে বছরের প্রত্যেকদিন, প্রত্যেক ক্ষণ আমরা যেন আমাদের নিজ নিজ বাবা/মা দের যত্ন নেই আমাদেরকে এমন তৌফিক দান করুন, এখন হাহুতাশ না করে দাঁত থাকতে আমরা যেন দাঁতের মর্যদা করি। আমিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“ভালোবাসার রামদা”
পরবর্তী নিবন্ধবাড়িয়ে দাঁও হাত
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন