১৯৭৪
ঢাকার এক  বস্তিতে আফজাল ছোট্ট একটা কামরা ১০০  টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়েছে, যেখানে   স্বামী স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে মাথা গোজার ব্যবস্থা হয়েছে । শহরে আজকাল হাজার হাজার বাস্তু হারা  লোকের ভিড় ,কোনো বস্তিতে  লোকের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা মিলে না। অনেক ভিক্ষুক ও দৈনিক  মজুর দিনের কাজের শেষে রাতে বস্তিতে আশ্রয় নিতে যায় । যদি জায়গা না পায়,এখানে ,সেখানে রাস্তায়, একটু নির্জন স্থানে ঘুমিয়ে পড়ে।  অনেক চেষ্টা  করে আফজাল মুছা নামের এক দালালকে অনুরোধ করে কিছু টাকা তার পকেটে দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছে । গত দুই বৎসর সে এই বস্তিতে তার পরিবার নিয়ে থাকে ।

আফজাল প্রায় প্রতি রাতে সদর ঘাটের  বাস টার্মিনালের মোড়ে  রহমতকে রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে, সে রহমতের অবস্থা অনুধাবন করে  । আজিমপুর কলোনির সিঁড়ির নিচে এবং খোলা আকাশের নিচে ,এখানে সেখানে,না খেয়ে ও অনিদ্রায় রহমতের  পরিবারের সবাই অসুস্থ । রহমত ও তার পরিবারের এই অবস্থা দেখে আফজাল তার নিজের পূর্বের অবস্থা অনুধাবন করে ,  যে  করেই হোক অসহায় রহমতকে সাহায্য করা দরকার  ।  সে মুছাকে অনুরোধ করেছে একটা রুমের জন্য । কিন্তু রুম খালি হয় না। এ দিকে রহমতকে কথা দিয়েছে যে যখনই রুম   খালি হবে,তাকে  দেয়ার চেষ্টা করবে  এবং তার মালিককে বলে রিক্সার ব্যবস্থা করে  দেবে। ।   আফজাল রোজ রোজ মুছাকে অনুরোধ করে একটা রুম দেয়ার জন্য। অবশেষে  পকেট থেকে কিছু টাকা দিয়ে রাজি  করিয়েছে । এখানে কে মালিক,কে দালাল কিছুই বুঝা যায় না, সবাইকে  এই দালালের মাধ্যমে থাকার ব্যবস্থা করতে হয় । এতো ঘর নয়,কোনো রকমে মাথা গোজার ব্যবস্থা ।   ঘরের  উপরে টিন, চারিদিকে  মুলির বেড়া এবং মাটির ফ্লোর , রান্না   করার কোনো ব্যবস্থা নাই । সবাই রুমে  যার যেই কেরোসিনের চুল্লিতে রান্না করে । রুম খালি হওয়ার পর মুসা আশ্বাস দেয়াতে আফজাল রাতের কাজ শেষ করে আজিমপুর কলোনী থেকে রহমত ও তার পরিবারকে নিয়ে মুছার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং মুছাকে দুই মাসের ভাড়া পকেট থেকে দিয়ে ঘরের চাবি নিয়ে  তাদের থাকার ব্যবস্থা করে । বিকেলে তারা দুইজনে  বাজার থেকে শোয়ার খাট(চোকি) , প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনে এনে থাকার ব্যবস্থা করে । আফজাল বুঝতে পারে যে রহমত ও তার পরিবার অত্যন্ত ভালো মানুষ এবং ওরা তার পয়সা মেরে খাবে না । রহমতের একদিকে প্রতিবেশী আফজাল,ওপর দিকে  স্বামী স্ত্রী ও আর একজন ২৫/২৬ বৎসরের ছেলে শেয়ার করে এক রুমে থাকে ।   সর্ব মোট ৮ পরিবারের জন্য একটা ল্যাট্রিন ,একটা চাপা   কল ও তৎসংলগ্ন ঘেরাও দেয়া গোসলখানা । একটা ( tubewell )  চাপা  কল যা প্রতি মাসে দু/তিন   বার মেরামত   করতে হয় । পার্শে কাঁচা রাস্তা, একটু বৃষ্টি হলে কাদা মাটি এবং বৃষ্টির পানি জমে এলাকা প্লাবিত হয় । এই বস্তিতে  থাকা কষ্টকর, তথাপি  অসহায় মানুষ প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায়।  রহমত ও হাসি এবং তাদের ছেলে মেয়েরা স্বস্তির  নিঃশাস ফেলে, একটা ঘুমানোর জায়গা হয়েছে । রাত হলেই আর পুলিশ বা সিকিউরিটির তাড়ানোর ভয় নাই ।  তবে প্রতিরাতে কতিপয় লোক এই বস্তিতে মদ খেয়ে উৎপাত করে যার জন্য লোকজন ঠিকভাবে ঘুমাতে পারে না ।  হারু ও রেনু প্রথম রাতে ভয়ে ঘুমাতে  পারে নি । রাত্রে ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,” মা আমরা এখানে থাকতে পারবো না ।” চলো, এখান  থেকে চলে যাই ।  দরজা খুলতেই নজরে পড়ে আরও দুইজন ছিন্নমূল (৪০/৪৫ বৎসর) স্বামী/স্ত্রী  যারা দিনের বেলা বের হয় রুজি রোজগারের জন্য এবং রাত হলেই  এখানে আশ্রয় নেয় । একটু এদিক সেদিক হলেই মুছা এসে   ধমক দিয়ে বলে ,” এখান থেকে  বের করে দেব ।”  কিছু বলতে গেলে বলে ,”পছন্দ হয় থাকবে,নতুবা চলে যাবে ।” দু’চার দিন থাকার পর ছেলে মেয়েরা অস্থির হয়ে উঠেছে, এখানে আর থাকতে চায় না, কিন্তু দেশের বাড়িতে রমিজ আঙ্কেল এর আশ্রয়ে ও এরা আর ফেরত যেতে চায়  না ।

সকালে রহমত কাজ থেকে আসলে, রেনু বলে,” জানো আব্বু, কাল রাতে এক দল লোক এখানে এসে হই চৈ করেছে । আমরা ভয় পেয়েছি ।রহমত বলে,” দেখো মা , আমরা কোথায় যাবো? কিছু টাকা পয়সা হলে তোমাদের জন্য ভালো বাসা ভাড়া নেবো । শুনে ছেলে মেয়েরা খুশি । ওরা বুঝে ,আব্বু/আম্মু অনেক পরিশ্রম করে । ঢাকা ওদের ভালো লাগে, গ্রামে আর ফেরত যেতে চায় না।  তোমার আম্মু কোথায় গিয়েছে? আম্মু ,আন্টির সঙ্গে কাজ খোঁজ করতে গিয়েছে? তোমার জন্য আম্মু রান্না করে রেখে  গেছে।  তোমাকে বলেছে,খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। ঠিক আছে।  আব্বু, আমরা কবে স্কুলে ভর্তি হব ? আরো  দুই / তিন সপ্তাহ সময় দাও, আমি তোমাদের ভর্তি করিয়ে দেব । হারু ও রেনু অনেক খুশি ঢাকা শহরে স্কুলে পড়াশুনা  করবে।  রহমত দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে এবং ভাবে ” হাসি আমার সংসারে  অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি তাকে কিছুই দিতে পারি নি। সে সব কিছু মেনে নিয়ে আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অজান্তে চোখ জলে ভরে উঠেছে। সে জামা কাপড় ছেড়ে বাহিরে গোছল করতে যায় ।  “হাসি সকাল সকাল ফুলমতির সঙ্গে এক বাসায় গিয়েছে কাজের খোঁজে ।বলে গেছে যদি   কাজ হয় তা হলে দেরি হবে,নতুবা চলে আসবে। রহমতের  এত সকালে ভাত খাবার রুচি হচ্ছে না।  তাই সে আলু ভাজি দিয়ে রুটি খেয়ে  বিছানায় শুয়ে পড়ে।  হারু ও রেনু আস্তে আস্তে কোনো শব্দ করছে না , পাছে আব্বুর ঘুমুতে অসুবিধা হয়। ভাই /বোন রুমের এক কোনে  বসে বই খোলে পড়া শুনা  করছে। ভাই /বোন দুইজনে স্বপ্ন দেখছে স্কুলে পড়া শুনা করবে,একদিন অনেক বড়ো হবে ।  হাসি ঘরে ফিরেছে একটু দেরি করে  ।  সে আস্তে আস্তে দরজা খোলে ঘরে ঢুকেছে   পাছে রহমতের ঘুম ভেঙে যায়,সে ইঙ্গিতে ছেলে /মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। হাসি কাজ পেয়েছে এবং কাজ শেষ করে আসার সময় বাড়িওয়ালি তাকে একটি বাটিতে করে ভাত ও একটু তরকারি দিয়েছে । হাসি না খেয়ে বাসায় ছেলে/মেয়েদের জন্য নিয়ে  এসেছে। রহমতের ঘুম ভাঙলে সে হাসিকে দেখে ছেলে/মেয়েদের সঙ্গে এক কোনে   বসে আছে ।  হাসি রহমত কে বলে,আমার এক বাসায় ঘর,থালা বাসন পরিষ্কার ও মাছ ,তরি তরকারি কাটাকুটার কাজ হয়েছে  প্রতিদিন   দুই ঘন্টা (সকাল ৭টা থেকে ৯টা পয্যন্ত) ।  মাসিক ৫০ টাকা করে দেবে, সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করবো বলে জানিয়েছে  । রহমত বলে, দুই ঘন্টায় এত কাজ কিভাবে করবে হাসি ? কিন্তু তোমার রোজগারের উপর ভরসা করে তো আর সংসার চলবে না। তোমার কি মনে হয় রিক্সা চালাতে পারবে ? সে বলে, মালিককে ৫০ টাকা দেয়ার পর আমি ২৫ টাকা ঘরে এনেছি।  ৬ দিন দু’জন কাজ করবো, একদিন ছুটি করব এবং  ছেলে মেয়েদের সময় দেব। হাসি বলে  আর একটা কাজ পাইলে করবো,নতুবা এই সামান্য টাকা দিয়ে কিছুই হবে না ।  শুনো,হাসি ! ধীরে ধীরে চেষ্টা কর।  ফুলমতি কাজ থেকে আসতে একটু দেরি হয়েছে।  সে এসেই  জিজ্ঞাসা করে ” ভাবি ,কেমন মনে হয় প্রথম দিন ? হাসি বলে না করে তো উপায় নাই। ভাবি , আর একটা জোগাড় করে দেন  । আপনি আর ভাই ছাড়া তো এখানে আমাদের কেউ নাই। দেখি কি করা যায় এই বলে ফুলমতি তার নিজের রুমে ঢুকলো । রহমত ঘুম থেকে উঠে বাহিরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসেছে । হাসি যে ভাত /তরকারি  এনেছে ছেলে মেয়ে ও রহমতকে একটু একটু করে দিয়েছে । ছেলে মেয়েরা আপত্তি করে মা, তোমার জন্য তো কিছুই নাই । হাসি বলে,”তোমরা খাইলে আমার খাওয়া হয় ।ছোটকালে আমি বাবার বাড়িতে অনেক খেয়েছি,এখন ও তার স্বাদ মুখে লেগে আছে । ”

রহমত  ও আফজাল  দুইজনে সন্ধ্যা হলে রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বের  হয়।   ঝড়,বৃষ্টি কোনো কিছুতেই তাদের বাধার সৃষ্টি করতে পারে  না। রাতে মাঝে মধ্যে অগত্যা ওদের একে অন্যের সঙ্গে দেখা হয়, তখন একে ওপরের সঙ্গে আলাপ করে ।  রাতে লোক চলাচল খুবই কম থাকে । ওরা সাধারণত সদরঘাট টার্মিনাল থেকে লঞ্চের প্যাসেঞ্জার নিয়ে এখানে সেখানে যায় । যদি ভালো রোজগার না থাকে তা হলে,আগে আগে বাসায় চলে আসে ।  আফজালের  স্ত্রী ফুলমতি ও হাসি দুজনেই রাতে ছেলে মেয়েদের আকড়িয়ে ধরে  রাখে।  ফুলমতির ছোট দুই ছেলে  তিন ও এক বৎসর বয়স।ভোরে কাজে   যাওয়ার  পূর্বে হাসি ও ফুলমতি কেরোসিনের চুলায় রান্না সেরে  ফেলে যাতে করে রহমত ও আফজাল কাজ থেকে ফিরে  খাওয়া সেরে ঘুমাতে  পারে। ভোর ৭:০০  কি ৭:৩০  টার দিকে দুইজনে রিক্সা জমা দিয়ে ঘরে ফিরে আসে। ততক্ষনে হাসি ও ফুলমতি কাজে বের হয়ে যায়।  এই এক ঘন্টা ফুলমতি তার ছোট্ট ছেলে মেয়ে হারু ও রেনুর নিকট রেখে যায়।    দেখতে দেখতে দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বতা  গড়ে  উঠেছে  ।  দুই পরিবার যা কিছু রান্না করে শেয়ার করে এবং একে ওপরের ছেলে মেয়েকে নিজের ছেলে মেয়ের মতো মনে করে দেখা শুনা করে । এখানে সর্ব মোট ৩০/৩৫ জন লোক থাকে   ।  ভোর হলে ল্যাট্রিন আর tubewell  এর  লাইনে দাঁড়াতে হয়।  তবে আফজাল ও রহমত যে সময় ঘরে ফিরে সে সময় ল্যাট্রিন বা গোছল খানায় ভিড় থাকে না ।   এখানকার নিয়ম মাসিক ভাড়া দেয়ার পর ও মাঝে মধ্যে দালাল   আসলে তার হাতে কিছু দিতে হয় । নতুবা সে অন্য লোক এনে বাসা দেখায় ।

মুছা, লোকটার কু-নেশা রয়েছে ।পাশের রুমে রুবিনা নামে এক মহিলা তার স্বামী আব্দুল কে নিয়ে থাকে । রুবিনার স্বামী   মধুমিতা সিনেমা হলে  কাজ করে এবং রুবিনা এক বাসায় আয়ার কাজ করে,ছেলে মেয়েদের স্কুলে আনা/নেয়া ও বাসায় কাজ করে ।   ভোরে দুইজনে একত্রে বের হয় এবং বিকেলে আসে ।  এই মুছা  রুবিনাকে  দেখলেই টিটকারি করে কথা বলে,তা ছাড়া রাতে এখানে এসে আড্ডা জমায় । সপ্তাহে দু/এক দিন এসে দরোজায় আওয়াজ করে । কিন্তু বেশি কিছু বলা যায় না, সকলে ভয়ে ভয়ে থাকে । একটু এদিক সেদিক হলে জোর করে বের করে দেয় ও অন্য লোক এনে ঘরে ঢুকায় ।    তাকে সবাই সমীহ করে চলে । লোকটার মুখ থেকে সব সময় মদের  গন্ধ বের হয় ,সে নেশা করে ।

গ্রামের স্কুলে হারু ক্লাস সিক্স ও রেনু ক্লাস ফোরের ছাত্র /ছাত্রী ছিল । নদী ভাঙার দরুন এবং ঢাকা আসার পর কয়েক মাস তাদের স্কুল বন্ধ ছিল ।    ছেলে মেয়েদের কিছু কাপড় না কিনে স্কুলে পাঠানো যায় না ।   নিজেদের কোনো স্থায়িত্বতা না থাকার কারণে   গত কয়েক মাস ওদের স্কুলে পাঠানো হয় নি ।   কাজে বের হওয়ার পূর্বে  রহমত বলে,” এই সপ্তাহে তোমাদের আম্মু সহ বাজারে গিয়ে  স্কুলের কাগজ,পেন্সিল  এবং তোমাদের পোশাক কিনে দেব ।   ছেলে/মেয়েরা শুনে আনন্দে আত্মহারা এবং বাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর  করে ।   ” উইকেন্ডে  রহমত ও হাসি ছেলে/মেয়েদের গুলিস্তান নিয়ে কাপড় এবং অন্যান্য দরকারি জিনিস পত্র কিনে তৈরী করে পরদিন  স্কুলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেবে ।    গ্রাম থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছে, তাই ভর্তি হতে কোনো অসুবিধা হবে না ।    পরদিন কাজ থেকে এসে রহমত হারু ও রেনুকে স্কুলে নিয়ে হেড মাস্টারের সঙ্গে দেখা করলে ক্লাস সিক্স ও ফোর এ ভর্তি করিয়ে নেয় ।   তাদেরকে একই ক্লাসে থাকতে দিয়েছে সে জন্য বই বেশি কিনতে হবে না । প্রথম দিন স্কুল করে ঘরে ফিরলে, তাদের কেমন লেগেছে জানতে চাইলে দুইজনে বলে ,” আমাদের ভালো লাগে । ” হারু ও রেনু গ্রামের স্কুলে ভালো   ছাত্র ছাত্রী ছিল । ওরা ভালো ভাবে পড়াশুনার জন্য মানুষিক ভাবে তৈরী । ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ওদের তেমন কোনো কথা বার্তা হয় নি ।বাসায় সকলে কেরোসিনের বাতি ব্যবহার করে ।    ঘরের এক কোনে ছোট্ট টেবিল দেয়া হয়েছে  ছেলে/মেয়ের পড়া শুনার জন্য । রেনু হোমওয়ার্ক হারুর কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকে ।   কিন্তু হারু তার কাজ না পারলে কারো কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায় না । রহমত ও হাসি ছেলে মেয়েদের বুঝিয়ে বলে ,” তোমাদের জন্য কোনো টিচার রাখতে পারবো না । তোমরা স্কুল থেকে ভালো ভাবে ক্লাসের পড়া শুনা শিখে আসবে ।    আমাদের আর্থিক অবস্থা  তা’ছাড়া এই বস্তিতে কোনো টিচার আনা সম্ভব না ।  হারু বলে ” আব্বু ,আমি রেনুকে সাহায্য করতে পারবো,আমার নিজের হোমওয়ার্ক স্কুল থেকে শিখে আসবো । ” ওদের আগ্রহ দেখে মা বাবা খুই খুশি ।

বস্তির এই ছোট ছোট দুই কামরা দুই পরিবার রহমত ও আফজাল শেয়ার করে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থাকে ।    রাত আর দিন সব সময় ইঁদুর ও তেলাপোকার  দৌড় প্রতিযোগিতা এই কামরা থেকে ওই কামরায়   শুরু হয় । মাটিতে হোগলা পেতে  খেতে বসলে ইঁদুর ও আগ্রহ সহকারে কাছে আসে খাবারে   ভাগ নিতে । খেতে বসলে পার্শে কিছু   নিয়ে বসতে হয় ওদের তাড়া  করার জন্য । কোত্থেকে একটা বিড়াল আসে মাঝে মধ্যে এবং ইঁদুর ধরে নিয়ে যায় । ইঁদুরকে   তাড়া করতে গেলে ওরা বেশি   দূর যায় না । এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন এই খাওয়াতে তাদের ও ভাগ আছে । সব চেয়ে অসুবিধা হয় যখন ওরা বিছানার উপর দিয়ে দৌড়া দৌড়ি করে  ও কিচির মিচির করে একে অপরকে আক্রমণ করে ।  হারু ও রেনু বলে “আব্বু আমরা গ্রামের চেয়ে অনেক ভালো আছি ।এখানে সব কিছু পাওয়া যায় । আমরা একটু হাটতে পারি ও শহর দেখতে পারি ।আমরা আর গ্রামে যাবো না । ছেলে মেয়েদের ভয় যদি মা বাবা আবার গ্রামে ফিরে যায় সে জন্য বার বার বলে,”আমরা এখানে অনেক ভালো আছি ।”  ছেলে মেয়েরা থাকতে থাকতে এখানে সব কিছু মেনে নিয়েছে । ওরা স্কুলে যায় এবং ঘরে ফিরে আর কোথায় ও যায় না, কোনো কিছু দরকার হলে হাসি ছেলে মেয়েদের গোপিবাগ,টিকাটুলি বা অন্য কোথায় ও নিয়ে যায় । রহমত দিনের বেলা ঘুমায়,সারা রাতে জেগে রিক্সা চালাতে হয় । রাতে রিক্সা চালাতে তার কয়েকবার বিপদে পড়তে হয়েছে । একবার এক প্যাসেঞ্জার তাকে পয়সা না দিয়ে চলে গেলে সে তাকে বাধা দেয় ,লোকটি তাকে আক্রমণ করে এবং সে কোনো রকমে চলে আসে ভাড়া না নিয়ে । আফজাল বলেছে যে এ সমস্যা রমনা পার্ক, রেস কোর্স এরিয়া রাতের বেলা বেশি হয় । দিনের বেলা সবাই কাজ করতে চায়, রিক্সা পাওয়া যায় না । কাজেই ওরা রাতে রিক্সা চালায় ।  রহমত  সব সময় রিক্সা চালিয়ে অভ্যস্ত । ঢাকা শহরের রাস্তা তার জানা নাই,অনেক সময় কাস্টমারের কাছ থেকে ঠিক ভাবে ভাড়া আদায় করতে পারে না । গত রাতে ৫০ টাকা রিক্সা চালিয়ে পেয়েছে অথচ তার ভাড়া মহাজনকে দেনা  ৫০  টাকা । এ ভাবেই কোনো রাতে ১০ টাকা কোনো রাতে কিছুই তার পকেটে থাকে না । ঢাকা শহরে আর কোনো কাজ তার জানা নাই । সে কোনো কাজ শিখে নি । তা ছাড়া  কে ই বা তাকে কাজ দেবে। আফজালের মতো দিল দরদী লোক তো আর সব সময় পাওয়া যায় না।

গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা বাবা ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকে । মাঝে মধ্যে তাদেরকে কিছু টাকা পাঠানো দরকার। মাসে ঘর ভাড়া,দৈনন্দিন খরচ চালিয়ে কাপড় চোপড় কিনতে হয় । ঢাকা শহর সব কিছু কিনতে হয় । গ্রামের বাড়িতে হাসি বড়শি দিয়ে পুকুর থেকে বা খাল থেকে মাছ ধরে এবং বিভিন্ন জাতীয় শাক পাতা এনে রান্না করে চালিয়ে দিতো । গ্রামে শাপলা, কলমির শাক ,পাট পাতা  মাঠ থেকে  এনে রান্না করা হতো ।

হাসির মনে অনেক দুঃখ । মনে পড়ে হাসি মা বাবার মতের বিরুদ্ধে   রহমতকে বিয়ে করে । রহমত প্রতিদিন হাসিকে রিক্সা করে স্কুলে নিয়ে যেত । আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে মন দেয়া নেয়া শুরু হয় । রহমত প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়া শেষ করে আর পড়া শুনা করে নি । সংসারে অবস্থার চাপে সে রিক্সা চালান শুরু করে । সে বেশ সুপুরুষ,প্রথম দৃষ্টিতেই আমি তাকে ভালো বাসি । আস্তে আস্তে গ্রামের লোক জন আমাদের ভালো বাসা সম্পর্ক জেনে ফেলে । আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী । মা বাবা আমাকে পড়া শুনা বন্ধ করে দেয় । আমি রোজ তার আসা যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতাম । মা বাবা আমাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চেষ্টা করে । কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হইনি । অবশেষে আমাকে রহমতের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে । আমরা দুইজনে প্রতিজ্ঞা করি যে  কাজ করে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করবো ।
ক্রমশ:

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিজ্ঞা
পরবর্তী নিবন্ধঅন্তরীক্ষ কথন ***
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন