এই মূহুর্তের দমকা বাতাসে ঘরের যে জানালা গুলোর হুক নড়বড়ে এদিক ওদিক দড়াম দড়াম আওয়াজ করছে।  মা বলেছিলো জয়ী ছাদের থেকে কাপড় গুলো তুলে ফেলিস কিন্তু ঐ যে কল্যাণটার জন্য হলো না।  আজও আমায় হারিয়ে দিলো।  কি খায় ছোকড়াটা?  দেখতে তো সেই ঐ একেবারে লিকলিকে লাউয়ের ডগার মত অথচ হাতজোড় বাজিতে সব সময় হারিয়ে দেয়।  আমিও তেমন ওর টিফিন চুরি করে খেয়ে নেই। খাবোই তো একশো বার খাবো, হাজারবার খাবো,  বেশ করি কি করবি আমিও দেখে নিবো। একবার দুবার নিজে হেরে যেতে তো পারে।আজ ইচ্ছে করে মহিষকাকার দোকান থেকে ডিম, বিস্কুট নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে যখন দেখলাম রাস্তার ধারে ফুটবল খেলছে ওমনি ধাক্কা মেরে ড্রেনে ফেলে দিলাম।  অনেক দিন তাক্কে তাক্কে ছিলাম আমি । আহারে পড়ে যাবার পর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে সে কি কান্না হি হি হি মজা লাগছিলো।  আমায় যখন মাইর খাওয়ায় মার কাছে এসে নালিশ করে আবার বলে আমি তোর বড় …
আহা ইইইসসস্  কি এমন বড় মাত্র চার মাসের।  এক ক্লাস উপরে তাই কি দাদাগিরি।
ঠিক হয়েছে হাত পা ছুলে চিৎপটাং।
নাহ দাদুর আমলে পুরানো জানালা কবে যে বিছানায় শুইয়েই ছাঁদের ফুটা দিয়ে চাঁদ দেখবো কে জানে  …
এই রে বৃষ্টি  নামবে এখুনি। কাপড় গুলো না তুললে এবার আমার পিঠে দড়াম দড়াম হবে।  জানালাগুলো বন্ধ করার নামে কল্যান কি করছে দেখা যাবে।  কি আর করবে যে আঁতুড়ে নিশ্চয় ম্যাঁ ম্যাঁ করছে।
কাপড় গুলো সব মার ঘরে রেখে দিয়েই পেছন ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি দিব্বি আড়ামছে মিতিন বুড়োর শোন পাপড়ি খাচ্ছে আমায় না দিয়ে।  তবে রে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন কল্যাণ।
ঐ ইঁটের ঢিল মারলি কেনো ?  বেশ করেছি মারবো না তুই একা একা খাচ্ছিস কেন?
তুই আমারে ফেলে দিয়েছিস মনে থাকবে জয়ী।
রেখে দে মনের মধ্যে খোদাই করে রেখে দে।  এখন তো মনে হচ্ছে ঢিলটা তোর কপালে মারলে শান্তি পেতাম।
মা ও মা দেখো জয়ী আমাকে মারবে বলে …
হ্যারে এতো ম্যাঁ ম্যাঁ করিস চার মাসের বড়,  তোর কখনো মেরুদন্ড সোজা হবে রে ?
মা দেখো আমাকে কি সব বলে ।
কেউ আসছে ভেবে তাড়াতাড়ি আমি জানালার কপাট টেনে ছিটকিনি লাগিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হাসলাম।__________ ,

কারা জেনো কাল রাতে ঠাকুর ভেঙেছে।  মা হৈ চৈ বুঝেই শিব ঠাকুরকে ঘরে তুলেছিলো।  মুন্ডুহীন ঠাকুর দেখতে কেমন জেনো। গত বছর দাদাঠাকুর যখন মূর্তি গড়ছিলো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম।  কি সুন্দর ঐ চোখ জোড়া,  নাক, ঠোঁট,  চিবুক, বুক,  হাত কি এক অসাধারণ মায়াবী চাহনি।  আজ তার প্রথম তৈরির মত অর্ধ-নগ্ন।

ভাঙার স্বাদ কেমন?  ভাঙা যত সহজ গড়া তো অতো সহজ নয়।  গড়ার পিছনে শুধু শ্রম থাকে না,  থাকে অনেক মায়া, স্বপ্ন,  স্নেহ, অতি যত্নের গভীরতা আর অসহিষ্ণু  ধৈর্য্য। সব কিছু ভাঙা যত সহজ  ততটাই কঠিন  সৃষ্টি করা।
তোমরা সব কিছু যতটা সহজে ভেঙে ফেলো পারবে ওমন ধৈর্য্য নিয়ে গভীর মায়া  তৈরি করতে …  !_______________ ,

আমি শক্তই আছি কিন্তু আমি ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। শরীরের জড়ানো শাড়ির আঁচল কেমন ভেজা ঘামে প্যাঁচ প্যাঁচ করছে। মিনিট খানিক আগেও এমনটা হয় নি যা এখন হচ্ছে। গতবছর এমন দিনে ট্রাকের উপর গানের তালে নেচে নেচে ধূপ ধূনো উড়িয়েছি। মাইকে গান বাজছে

” ঢাঁকের তালে কোমড় দোলে খুশিতে নাচে মন, আজ বাজা কাঁসর জমা আসর,থাকবে মা আর কতক্ষন

মায়ের রুপে মন ভরে যায়, প্রনাম জানাই ঐ রাঙা পায়

ওরে ধুনচি দু’হাতে নাচরে এখন

বল দূর্গা মায় কি – জয়..

গান বাজছে আমরা মহা আনন্দে মা কে বিদায় দেবার জন্য আয়োজন করছি।

মাইকে বলে ওঠে ” ধর্মসভা মন্দির কমিটি থেকে ” উমানন্দ শিব মন্দিরকে জানায় মায়ের বিদায়ী শুভেচ্ছা। আসছে বছর আবার হবে … বল দূর্গা মায় কি জ………য়……

সবাই এক দলে গলা ফাটিয়ে চিল্লায়।

জলের ধারে আরো অনেকে এসেছে। কত কত মাইকে নানান গান বাজছে। সবাই উল্লাসে নাচছে।  আমি ধীরে ধীরে সবার অগোচরে নাচতে নাচতেই ট্রাক থেকে নেমে গেলাম। আমি হাঁটছি বাড়ির দিকে। বাসায় এখন কেউ নাই। এটাই সর্বচ্চ সদ্ব্যাবহারের সময়। মাঝেমধ্যে জীবনের কোন মূল্য নেই এমনটাই মনে হয়। বেঁচে থাকা যখন অতিরিক্ত হয়ে উঠে ,মৃত্যু তখন দোড় গোড়ায় কড়া নাড়ে । প্যাঁচানো সিড়ি বেয়ে আমি উঠছি। একটা সময় কল্যানের ঘর যেদিক থেকে দেখা যায় ওদিকের জানালার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কল্যাণ তুই কি আমায় দেখতে পারছিস? আজ তিনটা বছর হতে চললো এ ঘরটায় তুই নাই। খুব কি দরকার ছিলো ? খুব তাড়া ছিলো রে তোর ? একটা বারও কাজটা করার আগে আমার চেহারা চোখে ভাসেনি ? তুই আসলেই মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ।

বেডের নিচের থেকে দড়ি খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। তাই নিজের শরীরের বারো হাত শাড়ি চেপ্টে লেপ্টে জড়ানো একটানে খুলে ফেললাম, ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। নিজের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম ..

কোন অপেক্ষা না করে ফ্যানের সাথে টাঙিয়ে ফেললাম শাড়িটি।খাটের উপরে প্রথমে চেয়ার তারপর ছোটো টুল বসালাম, শরীরে শক্তি দিয়ে তোষক উঠিয়ে মেঝেতে রাখলাম।মেঝেতে রাখার কারণ হল টুলটা পড়লে যেন শব্দ না হয়।ঘরের দরজা বেশ শক্ত করে লাগালাম।সুইসাইড নোট লেখার ইচ্ছা নেই তাই লিখলাম না। কারন আমার মৃত্যুর কোন কারন এ মূহুর্তে মনে আসছে না। আমার শুধু কল্যাণকে দেখতে মন চাইছে। যা করতাম সব কিছু একসাথেই করতাম। সেই বার পৌষের শেষে আমি তেরোখাদা গিয়েছিলাম বাড়ি ফিরে রাগ ভাঙাতে বহুত কষ্ট হয়েছিলো। একটুও চোখের আড়াল হতে পারতাম না আর সে কি না কাউকে না জানায় …

নবমীর রাতে ও এসেছিলো আমার কাছে। মাথার কাছে বসে খুব করে ডাকলো আমায়, বললো জয়ীতা তুই আয় নারে, আমার একা ভালো লাগছে না। ঐ ডাকটা উপেক্ষা করার শক্তি নাই এ মূহুর্তে।

হার্টবিট প্রচণ্ড বেড়ে গেছে,শরীরের শক্তি দ্রুত কমে যাচ্ছে। খাটের উপরে উঠে,চেয়ার থেকে টুলের উপরে উঠলাম, আসামীর মত লাগছে আমায় ফাঁশির দড়ি শাড়িটা ঝুলছে উপরে। চেয়ারের উপর টুল তারপর আমি। আসলে হাতে পাচ্ছিলাম না ফ্যানটা। দাদুর আমলের বাড়ি ছাদটা বেশ উঁচু।

শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে ।চোখ গুলো বড় বড় হয়ে আসছে,হার্ট বের হয়ে আসার মত অবস্থা হচ্ছে।সমস্ত শরীর কাঁপছে , টপটপ করে ঘাম পড়ছে ।নিশ্বাস দীর্ঘ হতে শুরু করেছে,বেশ বড় বড় শ্বাস নিতে হচ্ছে। বুকের ওঠানামা টা মনে হচ্ছে দ্রুত হচ্ছে। গলায় শাড়িটা প্যেঁচিয়ে দিলাম,হাত উপরে উঠিয়ে ধীরেধীরে নিচের দিকে শাড়িটাকে টানছি।গলায় একদম চাপা চাপা হওয়া মাত্রই মুখ থেকে জিহ্বা বের হয়ে আসা আসা ভাব নিচ্ছে ।আরেকবার ডানে বামে দেখতেই দেখলাম একটা জানালা লাগাতে ভুলে গেছি। আর বাইরে কারও কথার শব্দ আসছে না। জানালারটার দিকে আবারও তাকালাম। লোডসেডিং এর কারনে নিমেষ কাকুর মেজো মেয়ের ঘরে মোমবাতি জ্বালানো। খাটের উপর সদ্য এক সপ্তাহের কুহু শুয়ে কাঁদছে। আশেপাশে কেউ নেই। গলা থেকে শাড়ির প্যাঁচটা বের করে জানালার কাছে গেলাম জানালা আটকানোর জন্য। জানালা লাগাতে যাবো এমন সময় কুহুর দিকে চোখ পড়লো। কেন জানি আমার চোখ স্থীর হয়ে গেলো। দূরে কোন দল ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে ডুবাতে। গান বাজছে ___

* তওবা তুমহারে ইয়ে ইশারে, হামতো দিবানে হ্যা তুমহারে। রাজ ইহ্ ক্যাসে খোল রাহি হো, তুম আখোঁকে সে বোল রাহি হো, জাদু আতিহে তুমকো ইশারে।

তওবা তুমহারে ইয়ে ইশারে ..

লাগানো জানালাটা জলদি খুলে দেবার আগে ফ্যানের থেকে ফাঁশির দড়ির মত নিজের শাড়ি গিটটা খুলে ফেললাম,চেয়ার আর টুল সরিয়ে রেখে দিলাম জায়গা মত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি আমিকে আমার মধ্যে ফিরে পেলাম। অব্যাহতি দিলাম পুরোনা উদ্দেশ্যেহীন চিন্তা কে । বেঁচে থাকার কি হতে পারে এবার না হয় খুঁজি বেঁচে থাকার মানে কি

ভালো থাকাও তো হতে পারে । ভালো থাকাটার অর্থ কি, এবার না হয় খুঁজে ই …

তৎক্ষনাৎ সুতীর সাদা লাল পাড়ের শাড়িটা শরীরে প্যাঁচিয়ে আমি জয়ী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

এ মূহুর্তে বেঁচে থাকার মানে তুলসিদের বাড়ির ঠাকুরের গানের তালে তালে ট্রাকের সামনে এগিয়ে যাওয়া।

* জানিনা কোথায় আছো, তুমি কতো দূরে, আমার এ মনের কথা যায় ভেসে সুরে ,যদি পারো সামনে এসো, কাছে এসে ভালোবাসো

বুঝোনা কি ভালোবাসা করে হাহাকার ,  ছুঁয়ে যাবে এই সুর হৃদয়ে তোমার

এই গান আমার,ও এই গান আমার …

কেনো এই লুকোচুরি, কি কারণে জানি না  কাছে যেতে চাই তবু , কেনো যেতে পারি না ,  বলো নাকো কার ভুলেতে, দেখা তুমি চাও না দিতে, বলো কবে দুটি মন হবে একাকার, ছুঁয়ে যাবে এ সুর হৃদয়ে তোমার…

ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও … ,

এই গান আমার ও এই গান আমার ও …… ! ! !

___________________ ,

মঞ্চে দাঁড়িয়ে যারা দিনের পর দিন অভিনয় করে আজ ভাবছি আমিও কম নই তাদের থেকে।  আমি জয়ীতা নিজের সাথে নিজের অভিনয়ে নিজেই বলি আমি কে আমি কি জয়ী  নাকি জয়ীতা ?

আয়নার ও পাশে যে আছে তাকে দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে  কারন এর পর কি হবে –  না জানে সে,  না জানে তার ভবিতব্য !

___________  অন্তরীক্ষ কথন

®

চলবে ….

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন