বেশ কিছু বছর থেকে কানাডার টরেন্টো শহরে বসবাসরত ইমতিয়াজ অরফে ইমু এবারের কোরবানি নিয়ে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আছে। স্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে প্রতি বছর তুমি তোমার বাবার বাসায় কোরবানির টাকা পাঠাও, আমি কিছু মনে করিনি, এবার আমি চাই তুমি আমার বাবার বাসায় কোরবানির টাকা পাঠাবে। আমার ছোট বোন সালমা কুয়েত থেকে এবার কোরবানি ঈদ করার জন্য বাবার বাড়িতে এসেছে, আমি চাইনা, ওর স্বামীর টাকায় কোরবানির গরু কেনা হোক। ওর স্বামী একটা আস্ত ছোটলোক। সবার সামনে মনে হবে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। ভিতরে ভিতরে বদের হাটি। বউকে সারাক্ষন বাপের বাড়ির খোটা দিয়ে কথা বলবে। এমনকি বউ এর গায়ে হাত তুলবে। প্রত্যেক বছর বাবা নিজের টাকায় কোরবানি দেন ৷ কিন্তু এবছর বাবার হাত একেবারে খালি। ছোট ভাই মন্টুকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিতে ঢোকানোর ব্যাপারে বাবাকে প্রায়  লাখ খানিক টাকা ব্যাংকে ডোনেশন করতে হয়েছে। ওদিকে মরার উপর আবার খাড়ার ঘা। পেটের ব্যথায় অস্থির আম্মাকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে অপারেশন করাতে হলো। এমনিতেই কোভিড প্যান্ডেমিকের জন্য সরকারি হাসপাতালে ঢোকার উপায় নেই, তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করাতে যেয়ে ডাকাতের মতো বিল দিতে যেয়ে বাবাকে হিমসিম খেতে হয়েছে। ভাগ্যিস মেঝ চাচা হেল্প করেছিল। এদিকে দেশে সবাই জানে তুমি কানাডাতে ভালো চাকরি কর, তাই এবার আমি ছাড়ছি না, তোমাকে আমার বাবার বাসায় কোরবানির টাকা পাঠাতেই হবে, তা না হলে তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্কই নাই।’ একনাগাড়ে গড়গড় করে কথাগুলি বলে রুবিনা খানিকটা দম নিল।

ইমতিয়াজের অস্বস্তির কারণটি অবশ্য শশুরবাড়িতে কোরবানি দিতে হবে ঠিক এজন্য না, তবে অস্বস্তির কারণ কোরবানিকে ঘিরেই। সত্যি কথা বলতে, ইমতিয়াজের আসলে এবারের কোরবানির ব্যাপারটি একেবারে মাথাতেই ছিল না। একটি বিরাট ব্যাপার নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ইমতিয়াজকে বেশ ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে ইমতিয়াজকে এই ঝামেলার ব্যাপারটা স্ত্রী রুবিনার কাছে একেবারে চেপে গিয়ে বিবাহিত জীবনের প্রথম বারের মতো বড়ো কোন ঝামেলা রুবিনাকে ছাড়া একাই ঠান্ডা মাথায় ট্যাকেল করতে হয়েছে। ইমতিয়াজের বিবাহিত অবিবাহিত জীবনের এমন কোনো ঘটনা নেই রুবিনা জানে না। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় নীলু নামে ক্লাসের সে সময়ের সেরা সুন্দরী মেয়েকে যে প্রেম পত্র দিয়েছিলো ইমতিয়াজ বিয়ের রাতেই হড়হড় করে রুবিনাকে বলে দিয়েছে। সেই বাসর রাত হচ্ছে মবিনের জীবনে রুবিনাকে জীবনের সব গোপন কথা বলার হাতে খড়ি। বিয়ের প্রায় পঞ্চম দিনের মধ্যে রুবিনাকে ইমতিয়াজ জীবনের শুধুমাত্র একটি ঘটনা বাদে প্রায় সব গোপন কথা বলে দিল। পরের দিনেই শশুর বাড়িতে হাই ভোল্টেজের রাতের খাবার খেয়ে রুবিনাদের ছাদে উঠে ইমতয়াজ আয়েসি ভংগিমায় মিস্টি পান খেতে খেতে রুবিনাকে সেই বাদ দেওয়া ঘটনাটি বলা শুরু করল:

– ‘বুঝলে রুবিনা, দাওয়াতে গেলে খাবার টেবিলে আমার হুসভুস বিশেষ থাকে না। খেতে খেতে একেবারে গলা অবধি খেয়ে ফেলি । আমার এক বড়ো লোক বন্ধু রিপন ক্লাস এইটে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। রিপনের মা রিপনের বন্ধুদের দাওয়াত করেছে। আমি সত্যিই  বলছি সেদিনের সেই খাবার টেবিলে এত আইটেমের খাবার জীবনে কোনদিন দেখেছি বলে মনে হয় না। মনের সুখে আমি খেয়েই চলেছি । ওদিকে রিপনের মা বগুড়ার বিখ্যাত মনিকা ষ্টুডিও থেকে ফটো তোলার জন্য একজন প্রফেশন্যাল ক্যামেরা ম্যান তরুণকে নিয়ে এসেছে। খাবার শেষে ফটো সেশনের সময় রিপনের সব বন্ধুরা আছে, কিন্তু আমি নেই। সারাবাড়িতে আমার খোঁজ পরে গেলো। এদিকে আমি পাকস্থলীর নিম্নচাপের কারণে ভিতরের দিকের টয়লেটে ঘাপটি মেরে বসে স্ট্রাগল করছি। গেষ্ট টয়লেটে কে যেন গিয়েছে। আমি দেশেহারা হয়ে চাপ সামলাতে না পেরে বাড়ির ভিতরের দিকের টয়লেটে আশ্রয় নিয়েছিলাম, এতেই সমস্যা হয়েছে, আমাকে কেউ খুঁজে পায়নি। অবশেষে, বাড়ির এক কাজের লোক টের পেয়ে রিপনকে বলে দিয়েছে যে আমি ভিতরের দিকে টয়লেটে আছি। রিপন বন্ধ টয়লেটের দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার করে বলছে, ‘ইমন এই ইমন তাড়িতাড়ি বের হয়ে আয় দোস্ত, ছবি তোলা হচ্ছে।’ কিন্তু আমার পশ্চাৎদেশ থেকে কিছুতেই আমি ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছি না। অগত্যা আমাকে ছাড়াই বন্ধুরা ছবি তুলল। আমার তাতে মোটেই আফসোস নেই। আমি টয়লেটে বসে প্ল্যান করছি অন্যকিছুর। আমার প্যান্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কী উপায় হবে!!

ইমতিয়াজের মুখে বাসর রাতে এসব গল্প শুনে রুবিনা হেসে একেবারে বিছানায় গড়াগড়ি দেওয়ার অবস্থা। রুবিনা পরম আগ্রহে হাসি থামিয়ে বললো, তারপর কী হলো? ইমতিয়াজ ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে গল্পের মাঝে একটু সাময়িক বিরতি দিল। এটা হচ্ছে গল্প বলার ক্ষেত্রে ইমতিয়াজের স্টাইল। গল্প বলতে বলতে চরম মুহূর্তে একটু থেমে শ্রোতার উপর খানিকটা চাপ সৃষ্টি করা। এতে করে আরেকটি সুবিধা আছে, সেটা হচ্ছে, গল্পের মাঝে শ্রোতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, গল্পটি সত্যিই শ্রোতার কাছে ভালো লাগছে কি না। ইমতিয়াজ পানি খেয়ে আয়েশ করে আবার বলা শুরু করলো, ‘আমি টয়লেটের ভিতর থেকে রিপনকে ম্যানেজ করলাম, বললাম, ‘দোস্ত , আমার পেট নেমে গেছে, খেতে খেতে বেশি খেয়ে ফেলেছি। তোর একটা প্যান্ট দে আর একটা প্লাস্টিক ব্যাগ দে, আমি আমার প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেছি।’ রিপন বাথরুমের দরজার ফাক দিয়ে ওর ব্যাবহার করা একটি হাফ প্যান্ট এগিয়ে দেওয়ায় আমি সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আমি রিস্ক না নিয়ে রিপনের ঢোলা প্যান্ট পরে ড্রয়িং রুমের এক কোনায় বসে আছি, কারণ এই ঢোলা প্যান্ট পরে বেশি হাটাহাটি করলে অভিকর্ষীয় ত্বরণের কারণে প্যান্ট নিম্নমুখী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

এদিকে রিপন যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। রিপন আমার প্যান্ট নষ্টের বিষয়টি ওর মাকে বলে দিয়েছে। আমাকে নিয়ে বাসায় হুলুস্থূল কান্ড হয়ে যাচ্ছে। রিপনের মা যে এতটা বাড়াবাড়ি করবে আমি ভাবতেই পারিনি । আমার জন্য একটি নতুন হাফ প্যান্ট কিনতে আমার কোমরের মাপ নিয়ে বগুড়া নিউমার্কেটে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিপনের মা আমাকে জোর করে গেস্ট রুমে নিয়ে যেয়ে বললেন, ‘বাবা, এই যে গ্লাসে খাবার স্যালাইন, এটা খেয়ে লাইট অফ করে শুয়ে থাকো। একটু রেস্ট নিলেই দেখবে ঝরঝরে লাগছে।’ ওদিকে অন্যান্য বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, আমি অসহায়ের মতো চিৎ হয়ে রিপনের গেষ্ট রুমের দামি বিছানায় শুয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছি।’ গল্পের এই পর্যায়ে ইমতিয়াজ খেয়াল করল, রুবিনা মুখ হা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের বিয়ের ধকলে বেচারা হয়তো টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিল। ইমতিয়াজ বিস্ময়ের র সাথে খেয়াল করলো ঘুমিয়ে পড়লেও রুবিনার মুখে একধরণে হাসি হাসি এক্সপ্রেশন বজায় রেখেছে। রুবিনার জন্য ইমতিয়াজের বেশ মায়া হলো, আহা, বেচারা কত কষ্ট করে ঘুম চেপে রেখে শুধু স্বামীকে খুশি করার জন্য মন দিয়ে স্বামীর অতীত জীবনের বিরক্তিকর গল্প শুনতে হয়েছে। সংসারে স্ত্রীদের স্বামীকে খুশি করার জন্য কত কিছুই না করতে হয়!!

ইমন এর মতো যে ছেলে  অক্ষরে অক্ষরে স্ত্রী রুবিনাকে একেবারে দাড়ি কমা বাদ না দিয়ে জীবনের যাবতীয় ঘটনা সবিস্তারে বলে দেয়, সেই ইমতিয়াজ এই কয়েকদিন আগের এতো বড়ো একটি ঘটনা রুবিনার কাছে চেপে যাবে সেটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এই ব্যাপারটিই মূলত আজ এবার কোরবানির ব্যাপারে ইমতিয়াজকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তা হলে মূল ঘটনা শোনা যাক:

ইমতিয়াজ সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে 401 হাই ওয়ে থেকে সবে বের হয়ে রেড লাইটে রাইট টার্ন নিচ্ছিলো, ওদিক কোত্থেকে এক বয়স্ক মহিলা তার দিকে সবুজ লাইটে সোজা যাওয়ার পথে ইমতিয়াজের গাড়ির সাথে সজোরে ধাক্কা লেগে গেল। এক্ষেত্রে, ইমতিয়াজের শতকরা একশত ভাগ দোষ, কারণ রেড লাইটে শুধুমাত্র সেফ অবস্থায় থাকলেই কেবল টার্ন নেয়ার অনুমতি। মহিলার শারিরীক কোনো ক্ষতি হয়নি, তবে গাড়ির বডির ডান সাইডে একেবারে দুমড়েমুচড়ে গেছে। মহিলা, পুলিশ ডাকার আগেই, ইমতিয়াজ স্যালেন্ডার করল, ‘ ‘আই উইল পে ইউ হোয়াট ড্যামেজ এই মেড’, প্লিয ডন্ট কল পুলিশ।’  ইমতিয়াজ মহিলাসহ কাছাকাছি গাড়ির বডিশপ গ্যারাজে গেল। আড়াই হাজার ডলারে সব স্যাটেল্ড করা হলো। ইমতিয়াজ যখন মহিলার সাথে গ্যারেজে এসব স্যটেল্ড করছে, বাসা থেকে রুবিনার একের পর এক ফোন। ‘এই, অফিস থেকে আসতে এতো সময় লাগে ? তুমি কোথায় ? এত দেরি হচ্ছে কেন? আসার সময় নোফ্রিলস থেকে এক প্যাকেট দুধ, আর দুই ডজন ডিম নিয়ে আসবেতো।’ ইমতিয়াজ বুকে বাতাস পেলো, বাজারের অজুহাতে আরও খানিকটা সময় পাওয়া যাবে। ইমতিয়াজ আরও ঘন্টা খানিক পরে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরল।

ইমতিয়াজ গাড়ি এক্সিডেন্টের এই পুরা ব্যাপারটি রুবিনার কাছে চেপে গিয়ে দক্ষ অভিনেতার মতো রুবিনার সাথে এটা ওটা নিয়ে গল্প করে সময় কাটাল। সংসার হচ্ছে অভিনয় জাগতের তীর্থ ক্ষেত্র , এখানে স্বামী -স্ত্রী যে যার যায়গায় থেকে সারাক্ষন অভিনয় করে থাকে।

গাড়ি এক্সিডেনটির ব্যাপারটি ওখানেই শেষ হলে ভালোই হতো, কিন্তু তা হয়নি, ইমতিয়াজ গাড়ির ইন্সুরেন্স থেকে ফোন পেয়েছে, সম্ভবত, সেই মহিলাটি চালাকি করে ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে বলে দিয়েছে, দুই দিক থেকেই টাকা খাবার কি এক অভিনব কৌশল। ইমতিয়াজ কয়েকদিন ধরে পাগলের মতো মহিলাকে ক্রমাগত ফোন দিয়ে চলেছে, কিস্তু মহিলাটির ফোন বন্ধ। এসব ঝামেলার মধ্যে কোরবানির ব্যাপারটি ইমতিয়াজের মাথার মধ্যেই ছিল না। এতগুলো টাকা এক্সিডেন্টের ব্যাপারে চলে গেল, এখন আবার ইন্সুরেন্স যদি বেড়ে যায়, তবে অবস্থা আরও খারাপ। রুবিনা এসবের কিছুই জানে না । ব্যাঙ্কের একাউন্টের অবস্থা তেমন ভালো না। বাপের বাড়িতে রুবিনার প্রেস্টিজ রক্ষার্থে ইমতিয়াজকে টাকার সন্ধানে বন্ধু সেলিমের কাছে যেতে হলো। ‘দোস্ত হাজার খানিক টাকা দে, খুব জরুরি। ইমতিয়াজ সাধরণত খুব ঠেকায় না পড়লে যে টাকা ধার চায় না সেলিম নিশ্চিত। তাই সেলিম বললো, ‘কী এমন জরুরি দরকার যে এতগুলো টাকা ধার চাচ্ছিস ?’

ইমতিয়াজ আমতা আমতা করে গাড়ি এক্সিডেন্টের কথা, রুবিনা যে এসবের কিছুই জানে না, তাও বললো, শশুর বাড়িতে কোরবানির ব্যাপারটিও বাদ দিলো না । সব শুনে সেলিম বললো, ‘সব বুঝলাম, তাই বলে ধার করে থাকা নিয়ে শশুর বাড়িতে কোরবানি দিতে হবে, এটা একটা কথা হলো !!’

কয়েকদিন বেশ ভালভাবেই যাচ্ছিল, কিন্তু এই মাত্র রুবিনার কাছে ধরা পরে যাওয়ায় ইমতিয়াজের মুখ ভয় পেয়ে আতঙ্কে একেবারে সাদা কাগজের মতো হয়ে গেল। ঘটনা ঘটেছিল, রুবিনা মেয়ের জন্য ঈদ উপলক্ষে দেড়শো টাকা দিয়ে সেলোয়ার -কামিজ কিনে ব্যাঙ্ক কার্ড দিয়ে বিল দিতে যেয়ে দেখে কার্ড কাজ করছে না , পরে ব্যাঙ্কে ফোন করে দেখে একাউন্ট মাইনাস। সাধারণত, একাউন্ট মাইনাস হলেও তাও কিছু টাকা ব্যাকাপ হিসাবে পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে তাও ঘটেনি, তার মানে বেশ কিছু টাকা মাইনাস। রুবিনা ও ইমতিয়াজের জয়েন্ট একাউন্ট। ওদের দুইজনেরই স্যালারির টাকা সরাসরি চেকিং একাউন্টে জমা হয়, তাই একাউন্ট মাইনাস থাকার কথা না । রুবিনা , সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে ইমতিয়াজকে প্রশ্ন করলো:
-‘কি ব্যাপার একাউন্ট মাইনাস কেন ?’
মিথ্যা কথা সহজে আসলে মুখে আসে না, ইমতিয়াজ উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে তাৎক্ষণিক বলার চেষ্টা করল, আসলে গাড়ির চাকা ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েছিলো, পরে গ্যারেজে যেয়ে দেখি পট্টি লাগিয়ে লাভ নেই, ভালোভাবেই গেছে, ওই টায়ার ফেলে দিয়ে দেখি বাকি টায়ারগুলির অবস্থ ভালো না , ৫/৬ মাস পরে আবার শীতে আবার উইন্টার টায়ার লাগাতে হবে, তাই বুদ্ধি করে একেবারে চারটি চাকায় অল সিজন টায়ার লাগিয়ে ফেললাম।
রুবিনাও তাৎক্ষণিক পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘কত টাকা লেগেছে?’
– ‘সেকেন্ড হ্যন্ড টায়ার কিনলে কিছুটা কম পড়তো, আমি চিন্তা করলাম, সেকেন্ড হ্যন্ড কিনলে আবার কখন কি হয়, শীতের দেশ, দেখা গেল কী হতে কী হয়, বরফের মধ্যে রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকতে হবে,
তাই ব্র্যান্ড নিউ কিনেছি, সব মিলে সাড়ে বারোশো টাকা পড়েছে।’
– ‘কিন্তু একাউন্টেতো তাও টাকা থাকার কথা ছিল, একাউন্ট মাইনাস হলো কি করে ?’
রুবিনা বিচ্ছুর মতো লেগে আছে, কতক্ষন যে এভাবে মিথ্যা কথা বলবে ইমতিয়াজ বুঝতে পাচ্ছে না, তবুও ঝুঁকি নিয়ে আরও এগুতে থাকল।
– ‘আরে, আর বোলো না, আজকাল গ্যারেজগুলি হচ্ছে ডাকাতের ঘরের ডাকাত, আমি গেলাম চাকা সারতে, এবার বলে কিনা , তোমার পিছনের বাম দিকের ব্রেক প্যাড একেবারে পাতলা হয়ে গেছে, এখনই যদি না ঠিক করি বড়ো রকমের সমস্যা হবে, কি আর করা, আমরাতো ওদের কাছে জিম্মি, যা বলবে তাই শুনতে হবে, পরে সাত শো টাকা দিয়ে ব্রেক সারতে হলো।’

রুবিনা যে কথাগুলি বিশ্বাসঃ করেনি, ইমতিয়াজ নিশ্চিত, কারণ রুবিনা তির্যক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজের কাছে রুবিনার এই দৃষ্টি পরিচিত। একটু পরে, হয়তো রুবিনা বাঘিনীর মতো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইমতিয়াজের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। সংসারের যাঁতাকলে সত্য -মিথ্যার এই সংলাপে, এই পর্যায়ে প্রমাদ গুনতে থাকল ইমতিয়াজ। 

এই পৃথিবীর জগৎ সংসারে কত যে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে কে জানে, রুবিনা হটাৎ করে মিটিমিটি হেসে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ঠিক করে বলতো, সত্যই ঘটনা কী? তুমি যে মিথ্যা কথা বলছো, আমি কনফার্মড।’  ইমতিয়াজ, গাড়ি এক্সিডেন্টের পুরা ঘটনাটি রুবিনাকে বললো। এবার রুবিনার হাসিটি কিছুটা কান্নায় রূপান্তরিত হলো। রুবিনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ এতো বড়ো একটা ঘটনা ঘটল, তুমি আমাকে বললে না, আর যদি একসিডেন্টে বড়ো কিছু ঘটে যেত, আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও, সাবধানে গাড়ি চালাবে।’

ইমতিয়াজ সুযোগ বুঝে রুবিনাকে বললো,’ আমার সত্যই খুব খারাপ লাগছে, তবে চিন্তা করো না দেশে তোমাদের বাসায় কোরবানির টাকা পাঠানোর জন্যে আমি সেলিমের থেকে টাকা ম্যানেজ করে এনেছি।

 রুবিনা কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বললো, তুমি এক্ষুনি যেয়ে সেলিম ভাইয়ের টাকা ফেরত দিয়ে আসো, আমার বাবার বাসার টাকা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমার কাছে জমানো টাকা আছে। আমি প্রত্যেক মাসে সংসার থেকে কিছুটা টাকা বাঁচিয়ে একটি বাক্সে জমা করি। কালকে, সেই বাক্স খুলে দেখেছি প্রায় আড়াই হাজার ডলার হয়েছে। ওখান থেকে দেশে কোরবানির টাকা পাঠিয়ে দিলেই চলবে।’ রুবিনার শুরুতে ঝগড়াটে মুড থেকে এই অকস্যাৎ ‘U ‘ টার্নের ব্যাপারটি ইমতিয়াজকে মুগ্ধ করলো। সংসার এক আজব কারখানা । এখানে অনেক বাঘা বাঘা মেধাবী ছাত্র ছাত্রীও সংসার করতে এসে অনেক সময় হিমশিম খেয়ে থাকে, কেউবা আবার জটিল জটিল রকমারী বিচিত্রসব সমস্যায় থেকে সংসারের মালা থেকে ছিটকে যায়, অথচ অনেকসময় ক্লাসের পিছিনের সীটে বসে থাকা পড়াশুনা না করা ছেলে/মেয়েও অনেক সময় সাবলীলভাবে বহালতবিয়তে সুখে শান্তিতে নির্বিকার ভাবে সংসার করে যায়।

সং —–সা ——র

———————————-

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল আজহা ও কোভিড-১৯
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীন কাপ ২০২১ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন