খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সর্বশেষ কবে লিখেছি আমার মনে নেই, তবে আজ কেন জানি এই খাবারের টপিক নিয়ে লেখার ইচ্ছাকে কিছুতেই দমন করতে পাচ্ছি না। অথচ, আমার লেখার মোটেই সময় নেই। আমার প্রিয় পরবাসী ব্লগে বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে নিয়মিত লেখার কমিটমেন্ট ছিল, সেটা পাচ্ছি না। এদিকে অক্টবর মাস চলছে, বাংলাদেশে ফেব্রয়ারি মাসে বইমেলায় বই বের হওয়ার কথা। প্রকাশকের কাছ থেকে নতুন লেখা দেয়ার তাড়ণা ছাপিয়ে আজ খাবারের প্রসঙ্গে লিখতে বসলাম।

আমার অভিজ্ঞতায় যতটুকু জানি অধিকাংশ লেখক, কবি-সাহিত্যিক খাবারের ব্যাপারে বিশেষ সহানুভুতি তাঁদের লেখায় ফুটে তুলেছেন। তবে হোটেলে খাবার নিয়ে বিড়ম্বনা নিয়ে ছেলেবেলায় টেক্সটবুকে লেখক Somerset Maugham এর লেখা ‘The Luncheon ‘ লেখাটি আমার এখনও মনে পড়ে। আমার আজকের লেখার সাথে Somerset Maugham এর লেখার কোনো মিল নেই তবে কোথাও যেন একটি সুতার মতো মিল ঝুলে আছে। সে জন্যই ওনার প্রসঙ্গটি টানলাম। সে যাক, মূল পয়েন্টে আসি।

আমার সাথে এক সাদা ককেশিয়ান ভদ্র মহিলা প্রায় ৮/৯ বছর ধরে একই অফিসে নিউমার্কেট এলাকায় কাজ করেন। গত ১১ই অক্টবর বৃহস্পতিবার ছিল আমাদের লোকেশনে ওনার শেষ অফিস করা। উনি আমাদের একই অফিসে টরেন্টো লোকেশনে প্রমোশন পেয়ে কোর্ডিনেটর হিসাবে যোগদান করবেন আগামীকাল। প্রসঙ্গটি ওনাকে নিয়েই।

আমাদের অফিসিয়াল ইমেইলগুলিতে আমরা যখন আমাদের কোনো কলিগের সাথে অফিসিয়ালি বসতে চাই অথবা কলিগের সাথে কোনো ক্লায়েন্টের এপয়েন্টমেন্ট থাকে তখন আমরা সেই কলিগকে সেই এপয়েন্টমেন্টের সময়, তারিখ জানিয়ে ইনভাইটেশন ইমেইল করি। সেই ইনভাইটেশন ইমেইলে পেয়ে সম্মত হলে Accept and send response now অপশনে ক্লিক করলে অটোমেটিক ভাবে সেই এপয়েন্টমেন্ট আমাদের নিজ নিজ অফিশিয়াল ইলেক্ট্রনিক ক্যালেন্ডারে আপডেট হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, দুইদিন আগে আমার সেই কলিগের কাছ থেকে সেরকম ইমেইল আমি একসেপ্ট করেছি, তাই যথারীতি আমার অফিসের ফোনের ক্যালেন্ডারে সেটি আপডেট হয়ে আছে। এপয়েন্টমেন্টের নাম ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’ এবং লোকেশন নিউমার্কেটের একটি নামিদামি রেস্টুরেন্টে। নিয়ম অনুযায়ী আধাঘন্টা আগে আমার ফোন আমাকে সেই এপয়েন্টমেন্ট বিষয়ে আগাম রিমাইন্ড দেয়ায় আমি খাবারের উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসলাম এবং বেলা দুইটার সময় সেই রেস্টুরেন্টে গাড়ি হেঁকে রওনা দিলাম।

রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই আমার মনে ছ্যাৎ করে উঠলো। বড়ো বড়ো করে লেখা এখানে বেলা তিনটা পর্যন্ত নাস্তা সরবারহ করা হয়। দুপুরের এই খাওয়া উপলক্ষে লাঞ্চ করা হয়নি। তাই নাস্তা শব্দটি লেখা দেখে কিছুটা আঁতকে উঠতে হলো। মনের মধ্যে ধুকধুকানি নিয়ে কলিগদের সাথে টেবিলে বসতেই খাবারের মেনুর কয়েকটি বুকলেট সরবরাহ করা হলো। কানাডায় এর আগে কলিগদের সাথে এরকম আমন্ত্রিত হয়ে হোটেলে খাবার খাওয়ার আমার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। আজকের খাবারের বিলের ডিজাইন সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। বেয়ারা ছুঁটে এসে আমাদের কাছ থেকে অর্ডার নিচ্ছে। আমাদের কলিগ একেকজন bacon এর সাথে হ্যাসব্রউন এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে অর্ডার দিচ্ছেন। এই রেস্টুরেন্টের নিয়ম হলো, যে যাই অর্ডার দিবে তার সাথে দুটি ডিমের ওমলেট দেয়া হবে। যেহেতু আমি হালাল খাবার খেতে অভ্যাস্ত, bacon এর দিকে না তাকিয়ে ভেজিটেবলে আইটেম দেখে একটি অর্ডার দিলাম। সেই বুকলেটে আমার অর্ডার কৃত খাবারের মেনুর পাশে লেখা আছে আঠারো ডলার। বিলের ব্যাপারটি এখনো ভালো জানি না তাই, সাথে কফি বা জুস্ না দিয়ে প্লেইন ওয়াটার রাখলাম।

একে একে আমাদের সবার প্লেট চলে এলো। একেবারে এলাহী কান্ড। নাস্তার কথা বলে এরা বিরাট সাইজের প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে। আমার প্লেট দেখে আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। বিশাল সেই প্লেটে ছোট ছোট পিস্ করা আলুর টুকরা করা  ভাজি (হ্যাসব্রউন), কিছু মাশরুমের টুকরা, সাথে কুচি কুচি করে টমেটো, পেঁয়াজ, প্লেটের আরেকপাশে এক দলা অভোগ্যাডো-র পেস্ট, সবার ওপরে দুটি ডিমের ওমলেট এবং আরেকটি ছোট পিরিচে টোস্ট করা দুই স্লাইস ব্রেড, পাশে জ্যাম এবং মাখন।

আমি কলিগদের সাথে গল্প করছি আর ভাবছি আমার বিল কি আমাকেই দিতে হবে নাকি যে কলিগ আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে দিয়ে দিবে। ভাবতে ভাবতে প্রকান্ড প্লেট শেষ করে ফেললাম এবং এক পর্যায়ে বেয়ারার আমাদের সবার কাছ থেকে আলাদা আলাদা বিল নিতে এলো। কলিগরা সবাই নিজের নিজের বিল ও আলাদা ভাবে টিপস দিয়ে দিলো। আমাদের কালচারে কারো আমন্ত্রণে হোটেলে গেলে মনে হয় না নিজের খাবারের বিল দিতে হয়। আমি আমার সেই বিলের সাথে আরও পাঁচ ডলার টিপস দিয়ে কলিগদের সাথে গল্প শেষ করে গাড়িতে এসে উঠলাম। প্রবাসে প্রায় দুই যুগ ধরে বাস করে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে বাইরে বহুবার খেয়েছি, এর চেয়ে হয়তো অনেক বেশি বিল মিটিয়েছি। কিন্তু, আজ আমন্ত্রিত হয়ে এসে এভাবে আঠারো ডলার নাস্তার বিল মিটিয়ে বিলের পরিমানের কথা না ভেবে এই সাদা কানাডিয়ান জাতির আমন্ত্রনের কালচারের বিপরীতে আমাদের স্বদেশী বাংলাদেশী কালচারের প্রতি রাজ্যার মুগ্ধতা আমার ভাবনা জগৎকে সারাক্ষন আচ্ছন্ন করে রাখলো এবং আজ আমার এই লেখাটিকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করলো।

সমাপ্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধচালু হচ্ছে টরন্টো জেদ্দা ফ্লাইট
পরবর্তী নিবন্ধতৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের রূপ-পর্ব ৭
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন