নবজাতকের আগমন বাবা মায়ের জন্য স্বর্গীয় অপার্থিব নির্মল আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে ।তাকে ঘিরে চলে নানা রকমের আনন্দের জল্পনা কল্পনা ।কিন্ত. সেই শিশু টি যদি শারীরিক বা মানসিক অথবা আচরণগত কোন বিশেষ চাহিদা ( special need ) বা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম লাভ অথবা তাঁর বিকাশ শারীরিক বিকাশ জনিত ক্ষেত্রে কোন রকম সীমাবদ্ধতা থাকে তবে সেই প্রভাব পরে সমগ্র পরিবারটির উপর ।এই রকম একটি শিশুর বাবা মা কে জীবনভর নানা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় , নানা অনিশ্চয়তার দোলায় সব সময় তাঁদের ।একজন ভুক্তভোগি মা বাবাই জানেন এই পথ কতটা বন্ধুর ।

এই রকম একটি বিশেষ শিশুর আর তাঁর পরিবারের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিন্ন মাত্রার দায়িত্ব বর্তায় । এই
পরিবারগুলির জন্য সহমর্মিতা আর সহানুভূতিশীল একটি ইতিবাচক সংস্কারমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন ।কিন্ত এর ব্যতিক্রম ঘটলে সমাজ ,পরিবার ও রাষ্ট্র ,রাষ্ট্রের পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠন যদি এদেশের বোঝা বিবেচনা করে তবে তা সার্বিকবিচারে কোন সুস্থ মানব সমাজ গঠনে আদৌ সহায়তা করে না আর একই সাথে সামাজিক স্থিতি আনয়নে কোন ভূমিকা রাখে না ।

আধুনিক রাষ্টের অন্যতম সংগঠন হলো এর গণ যোগাযোগ মাধ্যম অথবা সম্প্রচার মাধমেগুলি ( সংবাদ ,টেলিভিশন , বেতার ।কিন্ত সেই প্রচার মাধ্যমে হতে যদি নেতিবাচক ও ভুল প্রচারণা, কুসংস্কারচ্ছন্ন অপব্যাখ্যা সম্পন্ন একপেশে প্রচরণা চলে, তবে শিক্ষিক , স্বল্পশিক্ষিত, নিরক্ষর সহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মননে তা নিশ্চিতভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

অতি সম্প্ৰতি বাংলাদেশের প্রচারিত একটি নাটকে প্রদর্শিত হয়েছে একজন প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম পরিবারের বাবা মায়ের কোন অতীত পাপ কর্মফলের কারণে হয় । নাটকটি দেখার সুযোগ হয়নি আর সত্যিকার অর্থে তেমন আগ্রহবোধ করিনি। বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় অবগত হয়েছি জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে এই নাটকটির পরিচালক অভিনেতা সবাই আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চেয়েছেন ।

আমার প্রশ্ন হলো এইরকম সংকীর্ণ মনোভাব ,অমানবিক,ভঙ্গুরবোধ সম্পন্ন এই নাটকের স্ক্রীপ্ট কে প্রচারণার জন্য সম্মতি দেয়া হলো কেন ? প্রচার মাধ্যমগুলি জনগোষ্ঠীর সুস্থ ও ভারসাম্যময় মানসিককাঠামো গড়াতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে ।আর সেই দৃষ্টিকোণ হতেএই সীমাবদ্ধ ভ্রান্ত প্রচারণা একেবারেই প্রত্যাশিত নয় ।

পরিবেশগত ও মানুষের শারীরিক কোষ ,জিনকাঠমোগত সহ বিভিন্ন কারণে একটি শিশু শারীরিক ও মানসিক প্রতিবদ্ধকতা বা বিশেষ চাহিদার দিক নিয়ে জন্ম নিতে পারে।এই সব শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী ভাবে বিশেষ যত্ন ও সয়হতা প্রয়োজন হয় ।উন্নত বিশ্বে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি সহায়তার সুযোগ আছে ।আমার নিজের এগারো বছরের যমজ দুটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু অটিস্টিক ।গত প্রায় বারো বছরে এক কঠিন সময় পার করেছি আমরা ।কানাডাতে অবস্থান সত্তে এক পর্যায়ের এই শিশুটির জন্য অতিরিক্ত বেসরকারি ভাবে পরিচালিত আচরণ গত থেরাপির ব্যয়ভার প্রয়োজনে আমার মাতৃসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও বিবাহের অধিকাংশ অলংকার বিক্রি করতে হয়েছিল ।সরকারি ভাবে চালিত এই থেরাপি সয়াহতা পেতে দীর্ঘ অপেক্ষার তালিকায় থাকতে হবে তাই বাচ্চাটির জন্য কালক্ষেপণ না করে ব্যয়বহুল প্রাইভেট থেরাপি করিয়েছি ।ক্রমান্বয়ে ওর থেরাপিস্টদের বিভিন্ন কার্যক্রম শিখে বিভিন্ন আচরণগত দিক উন্নয়নের দিকগুলি সামান্য হলেও উপলব্ধি করেছি ।যদিও বাংলাদেশের আমার নিকটজনেরা দুঃখজনক ভাবে আমাকে সমালোচনা করেছে এই বৈষয়িক বিক্রির সিদ্বান্তের বিষয়টি নিয়ে , যা উপেক্ষা করাটা সমীচীন মনে হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আমার আর একটি অভিজ্ঞতা কিছুটা প্রাসঙ্গিক।কানাডায় হ্যালিফ্যাক্স এ অবস্থান রত আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের এক পরিচিতজনের দিক হতে অটিস্টিক এক শিশুর মা হওয়ার জন্য অনেকটাই নেতিবাচক আচরণের শিকার হয়েছি , উপেক্ষা করেছি আর এই শিক্ষিত সেই মানুষটির নির্বুদ্ধিতায় একসময় হতবাক হয়ে।একান্তে হেসেছি , বিমর্য হয়েছি তবে পিছপা হয়নি ,তবে একথা স্বীকার করতেই হয় কানাডার চিকিৎসকদের ইতিবাচক ও যুক্তিসঙ্গত সয়াহক মনোভাব আমাদের অনেকটাই সঠিক পথে পরিচালিত করেছে ।

ধর্মের গূঢ় অর্থ কে যদি আমরা সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করি তবে নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবো সমাজের বিশেষ চাহিদার শিশুরা আশীর্বাদ ও অনেকটা পরীক্ষাস্বরূপ ।এই সত্যি কে সঠিক ভাবে আত্মস্থ করা সর্বশক্তিমান পরিবারের কাছে কাছে একটি বিশেষ পরীক্ষা স্বরূপ আমানততুল্য এই শিশুটিকে পাঠিয়েছেন ।
তাই তাঁর সে অনুসারে সঠিক মর্যাদা দেয়া দরকার ং।সারা বিশ্বেজুড়ে বিভিন্ন মাত্রার বিশেষ চাহিদার শিশুদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে , এদের লুকিয়ে রাখা বা কোন মিথ্যা অপবাদ দেয়া কোন সুস্থ স্বাভাবিক আর মানবিক আচরণ নয় ।বরং তাঁদের সঠিক মানসিক , সামাজিক সয়াহতা দিলে উন্নত মানবসম্পদর রূপে একটি সফলজনগোষ্ঠী অবধারিতভাবেই গঠন করা সম্ভব ।

তাই বিশেষ একটি শিশু ও তাঁর বাবা মা যেন সঠিক মাত্রার সহায়ক পরিবেশ পান সেজন্য কু সংস্কার হীন , ভ্রান্ত চিন্তা একপেশে অবস্থান থেকে বিরত থেকে দেশে ও প্রবাসে সম্প্রচার মাধ্যম ,সমাজের শিক্ষিত সচেতন সবাই কে বিশেষ চাহিদা র মানুষ সহ সব নারী পুরুষ সকলের জন্য ইতিবাচক ভাবমূর্তি সমৃদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টির ও প্রচারনার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতি থেকে
পরবর্তী নিবন্ধবাড়িয়ে দাও হাত-পর্ব ১১
ফারজানা নাজ শম্পা
কানাডার হালিফ্যাক্সে স্বপরিবারে বসবাসরত ফারজানা নাজ শম্পা একজন লেখক , সংবাদ প্রতিনিধি ও অনুবাদক l নব্বই এর দশক হতে লেখালিখির সাথে সম্পৃক্ত ফারজানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসন বিষয়ে মাস্টার্স ও নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় নোরাড ফেলোশীপ নিয়ে 'জেন্ডার উন্নয়ন ‘বিষয়ে এম ফিল সমাপ্ত করেন ।কর্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশের 'দি ডেইলি ইনডিপেন্ডেন্ট ' এ সাংবাদিক ও ফিচার লেখক হিসেবে ও পরবর্তী তে নেদারল্যান্ডসের একটি গবেষনা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পুস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের " উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ" বিভাগের একটি প্রজেক্ট অফিসিয়ালের দায়িত্বে কিছুদিন কর্মরত ছিলেন l যুগান্তর , কানাডার জনপ্রিয় পরবাসী ব্লগ , ঢাকা প্রকাশ , ভারতের র কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে তার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে । ফারজানা টরেন্টোর কানাডিয়ান বাংলাদেশি নিউজ সি বি এন ২৪ এর সাথে একজন উপদেষ্টা সংবাদ প্রতিনিধি ও নিয়মিত লেখক হিসেবে সংযুক্ত আছেন । ফারজানা বর্তমানে উত্তর আমেরিকা প্রথম আলোর কানাডার আটলান্টিক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে সম্পৃক্ত আছেন l তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি কানাডার সাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্য ও সংষ্কৃতির মেলবন্ধন স্থাপন করে দুটি দেশের লেখক ও পাঠক সমাজে ভাষাগত পরিচয় ও সাংষ্কৃতিক ভাব বিনিময়ের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের প্রত্যয় নিয়ে তিনি বর্তমানে কানাডার মূল ধারার কয়েকজন লেখকদের বিশেষ সম্মতিক্রমে তাঁদের সাহিত্য কর্ম অনুবাদের প্রয়াস নিয়েছেন l সম্প্রতি কানাডার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ব্রুস মাযারের নির্বাচিত কবিতার সমন্বয়ে বাংলা দেশের আরো প্রকাশনী হতে তার প্রথম ভাবানুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে ,যা ২০২২ সালের অমর একুশের বই মেলায় যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে l কানাডার সাহিত্য ইতিহাসের পাশাপাশি তিনি বাংলাদশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ,যুদ্ধশিশু ও মহিয়সী বীরাঙ্গনা নারীর জীবন, আত্মত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর লেখা ও গবেষণার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছেন l তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি , একটি বই এর নুতন সংস্করণ জার্মানির একটি প্রকাশনা হতে প্রাকাশিত হয়েছে l

১ মন্তব্য

  1. একটি চমৎকার লেখা। খুবখুব ভালো লাগল। লেখককে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন