সরকারী নির্দেশে কঠোর ভাবে লকডাউন পালিত হচ্ছে। রাস্তায় অজোপাড়া গাঁয়ের ভ্যান গাড়ী এবং পা দিয়ে চালিত রিক্সা চলাচল করছেন। তা-ও খুবই অল্প সংখ্যক। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ রাস্তায় বের হচ্ছেননা। আর খানিক বাদে বাদে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতো সক্রিয় রয়েছেনই। চারপাশে তাকালে মনে হচ্ছে এ যেন এক অন্যরকমের দেশ। যেখানে সদাসর্বদা বিভিন্ন পরিবহনে ঠাঁসা থাকতো, এখন সেখানে ভয়ার্ত নিরবতা। যুদ্ধ শুরু হলে যেমনটা চোখে পড়ে, বর্তমান অবস্থা তার থেকেও ভয়ংকর।

ছোট্ট এক ভাইরাসের কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষই এখন অসহায়। কারোরই যেন করার মতো কিছুই নেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালেই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, তাঁরা প্রত্যেকেই কতোটা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের মলিন মুখ, বেশভূষা, এবং জীর্ন-শীর্ণ দেহই প্রমান দিচ্ছে যে, দেশে অঘোষিত দুর্ভিক্ষ চলছে। এক একটা মানুষ আগ বাড়িয়ে নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা বর্ণনা করছেন। মানুষের অসহনীয় বেদনার কথা শুনে এবং  দেখে বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে।

অফিসের বস সবকিছু জেনেবুঝেও প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি টাকা আর সম্পদ ব্যতীত অন্যকিছুই বোঝেননা। আফিমের খাওয়ার নেষার মতোই তিনি টাকা এবং সম্পাদের নেশায় ডুবে রয়েছেন। যদিও এর সবকিছুই আপেক্ষিক। তবুও টাকা সম্পদ তার চাই-ই চাই।

বসের এই অমানবিক আচরণে অশেষ ভীষণ বিব্রত বোধ করছেন। সবকিছুরই একটা সীমারেখা থাকে। এই অতি লোভী এবং অমানবিক মানুষটা ইতিপূর্বেই নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করেছেন। এধরণের হীনমন্যতাকে অশেষ ছোটবেলা থেকেই এড়িয়ে চলেছেন। কি করবেন এই নিষ্ঠুর মানুষটার জন্য, তা ভেবে ভেবেই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছেন। জব ছেড়ে দেওয়া বা সমস্ত অন্যায় বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই অশেষের জন্য।

শেষ পর্যন্ত জবটাই ছেড়ে দিলেন। সৃষ্টিকর্তাতো আছেনই। তাঁর উপর ছেড়ে দিলেন সবকিছু। দানবের দানবীয়তা হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কারণ তাঁরা শুধুই দানব। সৃষ্টি থেকেই তাঁদের স্বভাব এইরকমেরই। কিন্তু মানুষতো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তাঁরা কেন এই দানবীয় বলয়ে বন্দী থেকে সর্বক্ষণ ঘৃণিত থাবায় খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে খামচে ছিন্ন-ভিন্ন করবেন। কিন্তু কেন?

অশেষ থানায় এসেছেন একটি সাধারণ ডায়েরি করতে। থানার ভেতরে ঢুকতেই একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। একজন ভদ্রগোছের লোক ফ্লোরে বসে চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছেন। বেশভূষা দেখে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ভালমতই উত্তমমধ্যম দেওয়া হয়েছে লোকটিকে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। লোকটিকে দেখে অবশ্য অপরাধীর মতো লাগছেনা।

ডেস্কে কর্মরত নারী পুলিশ অফিসারের কাছে অশেষ জানতে চাইলেন,
-আপা, লোকটির কি হয়েছে?
অশেষ মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন যে, হয়ত এর কোন নিকট আত্মীয় থানাতে আটক রয়েছেন। যে কারণেই লোকটিকে এতো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছেন!

নারী পুলিশ অফিসারটি কটাক্ষ করে অশেষের দিকে তাকালেন এবং ভ্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিলেন,
-চোর! পকেট মার!
অশেষ খেয়াল করলেন, নারী পুলিশ অফিসারটির কথাতে লোকটি লজ্জিত এবং ব্যথীত হলেন। তিনি যে যে কাঁদছেন সেটা তাঁর ফোপানোর শব্দ শুনেই বোঝা গেল। লোকটির জন্য অশেষের খুব মায়া হলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অশেষ ঘার ঘুড়িয়ে লোকটিকে দেখছিলেন।

খানিকক্ষণ বাদে একজন ভদ্রগোছের লোক এসে উপস্থিত হলেন। লোকটির হাবভাবে স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো যে, তিনি খুব রেগে আছেন। নিশ্চিত করেই বোঝা গেল যে, এর টাকাই খোয়া গেছেন।

আচমকা বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই অপরাধী লোকটি আগন্তুক ভদ্রলোকটির পাদু’টো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন এবং বলতে থাকলেন,
-স্যার, আমি চোর না। আপনি বিশ্বাস করুন! গার্মেন্টসে কাজ করতাম। করোনা ভাইরাসের কারণে আমাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও একটা কাজ পাই নাই স্যার! ঘরে আমার দুটি সন্তান, স্ত্রী এবং বৃদ্ধা মা রয়েছেন। আজ দুইদিন ধরে ঘরে কোন খাবার নাই। তাঁদের ক্ষুধার্থ মুখগুলো দেখে আমার মাথা বেঠিক হয়ে গিয়েছিল। আর তাইতো দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে আপনার মানি ব্যাগটা চুরি করেছি স্যার! আমাকে ক্ষমা করে দেন স্যার!  অভাবের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এই ঘৃণিত কাজটি করেছি স্যার। আমাকে জেলে দিলে আমার পরিবারের সবাই না খেয়ে মারা যাবেন। আপনি দয়া করেন স্যার!

অশেষ লক্ষ্য করলেন, ভদ্রলোকটির ভেতরে মায়ার উদ্রেক হয়েছেন। ভদ্রলোকট যে মানবিক বোধ সম্পন্ন একজন মানুষ সেটা তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো। ভদ্রলোকটি অশেষের দিকে তাকালেন। অশেষও সবটুকু মানবিকতার সঙ্গে চোখের ভাষা দিয়ে বোঝালেন যে লোকটিকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়। ভদ্রলোকটি অশেষের চোখের ভাষা বুঝলেন। মানবতার কাছে সমস্ত রূষ্ঠতা হার মেনে পালালো। ভদ্রলোকটি অপরাধী লোকটির প্রতি দয়া করলেন এবং ক্ষমা করে দিলেন।

অপরাধী লোকটি আর কোন কথা না বলে যতটা সম্ভব দ্রুত থানা থেকে বেড়িয়ে গেলেন। অশেষ তাঁর চলে যাওয়ার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। ভীষণ ভালো লাগলো। রবির কিরণের আলোকরশ্মির মতো আলোকিত হয়ে উঠলো এই মানবতার দর্শন। কভিড-১৯ কতোটা ভয়াল এবং আক্রমণাত্মক, তাঁর বোধহয় আর শেষ নেই। শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনাবসানই করেই থেমে নেই। তাঁর ভয়ার্ত থাবা দিয়ে অগণিত মানুষকে টেনেহিঁচড়ে পথের ভিখারিতে পরিণত করে দিচ্ছেন।

অশেষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন। ভদ্রলোকটি অশেষের দিকে এগিয়ে এলেন। হাতে হাত মেলালেন এবং বললেন,
-চলি ভাই।
-ঠিক আছে ভাই। অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানবেন। ভাই, আপনি সত্যি সত্যি একজন বিশাল মনের একজন মানুষ।

অশেষের কথায় ভদ্রলোক বেশ প্রীত হলেন। ভদ্রলোক গৌরবের হাসি দিয়ে বিদায় নিলেন। এতো এতো কষ্ট এবং মানুষের হাহাকারের মধ্যেও বিস্ময়কর আনন্দে বুক ভরে গেল অশেষের। তৃপ্তি সহকারে বুকভরে শ্বাস নিলেন। ভেতরের গ্লাণি কিছুটা প্রশমিত হলো। খুব ভালো লাগছে। তারপর কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য পথের দিকে পা বাড়ালেন।

(চলবে)

১ মন্তব্য

  1. শ্রদ্ধেয় হাফিজুর রহমান ভাই তাঁর আলোর ভূবণ সমতুল্য পত্রিকায় আমাকে স্থান দিয়েছেন। তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন