বিভাজন ও বিভেদের চর্চা আধুনিক সুস্থ ধারার মানবিকতার বিকাশের পরিপন্থী ।ধর্ম বর্ণ ভাষাগত,জাতিসত্তা ভিত্তিক পরিচয়ে সৃষ্ট বিভাজন ও বৈষম্য সভ্যতার সঠিক প্রবাহকে অনিবার্য ভাবে ধ্বংসের মুখ ঠেলে দেয় ।প্রতিটি মানুষের তাঁর স্বকীয় অবস্থানে হতে স্বাধীন ভাবে চিন্তা ,মত,ধর্ম চর্চা, বিশ্বাসের বিকাশ ঘটানো হলো তাঁর মানবাধিকারের অপরিহার্য অংশ । আমার বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ আর অপর কোন চিন্তা বা বিশ্বাস ভিত্তিহীন এই ধরণের অসহনশীল ,অসহিষষ্ণু বিদ্বেষমূলক সংকীর্ণ মনোভাব সার্বিক ভাবে বিভাজন ও ধ্বংসের বার্তা কে ডেকে আনে ।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধচ লাকালীন সময়ে মুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ও ক্ষুদ্ৰ নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠীর অসংখ গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন দখলদার পাকিস্তানি হানাদাররা বিরুদ্ধে ।ফলস্বরূপ অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ।কিন্ত দুঃখজনক ভাবে সম্প্ৰতি বাংলাদশের সেই ঐক্যের প্রবাহে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রকাশ ঘটেছে ।বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির প্রতিবাদে কানাডার হালিফ্যাক্সে শনিবার তেইশে অক্টবর সকাল এগারোটা হতে দুপুর বারোটা পর্যন্ত আয়োজিত হলো এক বিশেষ প্রতিরোধ সমাবেশ ।হ্যালিফ্যাক্সর স্প্রিং গার্ডেন রোডে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেন ‘হ্যালিফ্যাক্স বাংলাদেশি হিন্দু কমিউনিটির সদস্যবৃন্দ।তাঁদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে যোগ দেন হলিফ্যাক্সে বসবাসরত কলকাতার কমিউনিটির অনেকেই।

সর্বমোট ষাট জন সদস্য এই সমাবেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নিরসনে প্রতিবাদমূলক বক্তব্য সম্বলিত ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদ করেন । উল্লেখ্য যে অতি সম্প্রতি সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচাইতে বড় ধমীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পূজায় বাংলাদেশে কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন,সহিংসতার প্রতিবাদে কানাডায় হালিফ্যাক্সে এই বিশেষ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে ।

‘হ্যালিফ্যাক্স বাংলাদেশি হিন্দু কমিউনিটি ‘সদস্যরা ছিলেন এর মূল আয়োজক ।তাঁদের এই বিশেষ আয়োজনের মূল ম্যান্ডেট গুলি নিম্নরূপ।
১ বিশ্ব ব্যাপী হিন্দু সহবিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু ধর্মালম্বী ও বিভিন্ন বিশ্বাসের অনুসারী মানুষের জন্য সার্বিক ধর্মীয় নিরাপত্তার পক্ষে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং বিষয়টি সকলের দৃষ্টিগোচর করা।

২ .বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বীদের উপর সহিংসতায় মৃত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলির প্রতি বিশেষ শোক জ্ঞাপন করা।

৩ বিপর্যস্ত পরিবারদের প্রতি পুনর্বাসনের জন্য যথাসম্ভব নৈতিক ও মানসিক সয়াহতা দান করা ।

৪ হিন্দু ধর্মের অনুসারী সহ যে কোন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর আগামীতে বৈষম্যমূলক আচরণ ও আঘাত আনা হলে তাঁদের জন্য তাৎক্ষণিক ভাবে ত্বরিতগতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণ করার ।

সর্বপরি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিরসনের স্বপক্ষে একটি বিশেষ অনলাইন ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পিটিশন ও স্বাক্ষর গ্রহণের মাধ্যমে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত কানাডা সহ বিশ্বের বৃহত্তর প্লাটফর্মে যে কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কঠোর ভাবে প্রতিরোধে একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হলো আয়োজদের মূল লক্ষ্য ।

লেখাটি বিভিন্ন পর্যায়ে এই বিশেষ সমাবেশ সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন হালিফ্যাক্সের সমীরণ পাল দাদা তাঁর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ।

একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেও শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্বের ও উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে ধর্মও বর্ণ , জেন্ডার , নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার পরিচয় বহনকারী মানুষ কে বিভাজন ও সহিংসতার মতো লজ্জাজনক বিভিন্ন ঘটনা পরিলক্ষিত হয়’আমাদের যে কোন বিভাজন ভিত্তিক ধ্বংসের বিলাপ নয় বরং সুস্থ শান্তিময় সহনশীলতার সংষ্কৃতিতে বিশ্বাসী হতে হবে ।
বিষয়টি মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন পারস্পরিক সহনশীলতা , সহাবস্থানের ও সম্প্রীতির উদার মনোভাব মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম নির্ধারক ।

ভিন্ন বিশ্বাস ও মতের প্রতি নিয়মিত ভাবে শ্রদ্ধাপূর্ণ সহনশীলতার সুবিস্তৃত এবং সুদৃঢ় মানসিকতা গড়ে তোলার অনুশীলনের দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র,সমাজ ও পরিবার সহ সকলের ।বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পক্ষে বিভিন্ন প্রতিবাদ ও সমাবেশ চলছে ।এই পরিবর্তনের নিরিখে আমাদের প্রতিদিনের চেতনা চিন্তায় ধারণ করতে হবে শুদ্ধ স্বাভাবিক সহনশীলতার দর্শন ।মানুষের সবচাইতে বড় পরিচয় সে মানুষ আর সেই জীবন বোধে র ও ধ্রুব সত্যের আলোকে আমাদের প্রতিদিনের চর্চায় ধারণ করতে হবে দ্রোহের আর মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনন্য সৃজনশীল সৃষ্টির সেই ভাষ্য
“হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু
একবার এই মহাগগন তলের সীমা হারা মুক্তির
মাঝে দাঁড়াইয়া মানব তোমার কন্ঠে সেই
সৃষ্টিতে আদিমবাণী ফুটাও দেখি। বল
দেখি “আমার মানুষ ধর্ম”; মানবতার এই মহান
যুগে একবার গন্ডী কাটিয়া বাহির
হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মন নও, শুদ্র
নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও, তুমি মানুষ –
তুমি ধ্রুব সত্য।”

আমরা আবার একতাবদ্ধ হবো
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কালজয়ী সেই সংগীতের মাধ্যমে
‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ,
বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান,
আমরা সবাই বাঙালী ।।

-ফারজানা নাজ শম্পা
হ্যালিফ্যাক্স কানাডা
[email protected]

 

 

 

 

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ইমিগ্রেশন- পর্ব ৭
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ইমিগ্রেশন – পর্ব ৮
ফারজানা নাজ শম্পা
কানাডার হালিফ্যাক্সে স্বপরিবারে বসবাসরত ফারজানা নাজ শম্পা একজন লেখক , সংবাদ প্রতিনিধি ও অনুবাদক l নব্বই এর দশক হতে লেখালিখির সাথে সম্পৃক্ত ফারজানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসন বিষয়ে মাস্টার্স ও নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় নোরাড ফেলোশীপ নিয়ে 'জেন্ডার উন্নয়ন ‘বিষয়ে এম ফিল সমাপ্ত করেন ।কর্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশের 'দি ডেইলি ইনডিপেন্ডেন্ট ' এ সাংবাদিক ও ফিচার লেখক হিসেবে ও পরবর্তী তে নেদারল্যান্ডসের একটি গবেষনা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পুস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের " উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ" বিভাগের একটি প্রজেক্ট অফিসিয়ালের দায়িত্বে কিছুদিন কর্মরত ছিলেন l যুগান্তর , কানাডার জনপ্রিয় পরবাসী ব্লগ , ঢাকা প্রকাশ , ভারতের র কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে তার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে । ফারজানা টরেন্টোর কানাডিয়ান বাংলাদেশি নিউজ সি বি এন ২৪ এর সাথে একজন উপদেষ্টা সংবাদ প্রতিনিধি ও নিয়মিত লেখক হিসেবে সংযুক্ত আছেন । ফারজানা বর্তমানে উত্তর আমেরিকা প্রথম আলোর কানাডার আটলান্টিক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে সম্পৃক্ত আছেন l তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি কানাডার সাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্য ও সংষ্কৃতির মেলবন্ধন স্থাপন করে দুটি দেশের লেখক ও পাঠক সমাজে ভাষাগত পরিচয় ও সাংষ্কৃতিক ভাব বিনিময়ের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের প্রত্যয় নিয়ে তিনি বর্তমানে কানাডার মূল ধারার কয়েকজন লেখকদের বিশেষ সম্মতিক্রমে তাঁদের সাহিত্য কর্ম অনুবাদের প্রয়াস নিয়েছেন l সম্প্রতি কানাডার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ব্রুস মাযারের নির্বাচিত কবিতার সমন্বয়ে বাংলা দেশের আরো প্রকাশনী হতে তার প্রথম ভাবানুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে ,যা ২০২২ সালের অমর একুশের বই মেলায় যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে l কানাডার সাহিত্য ইতিহাসের পাশাপাশি তিনি বাংলাদশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ,যুদ্ধশিশু ও মহিয়সী বীরাঙ্গনা নারীর জীবন, আত্মত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর লেখা ও গবেষণার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছেন l তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি , একটি বই এর নুতন সংস্করণ জার্মানির একটি প্রকাশনা হতে প্রাকাশিত হয়েছে l

১ মন্তব্য

  1. মানুষকে শুধু মানুষের পরিচয়েই বাঁচতে হবে। অন্তরে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি প্রভৃতি সচেতন ভেদবুদ্ধি থাকলে সেই নাগরির পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন না। আর এই অপারগতাই মানুষের কাঙ্ক্ষিত গতি পদে পদে রোধ করে দেবে। হয়তো তাকে ধ্বংসের পথেও ঠেলে দেবে তাদের। এই পরম সত্যটি কবে বুঝবে সবাই, কে জানে!!!

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন