তমাল যে এতো দ্রুত বদলে যেতে থাকবে তিথি কল্পনাও করতে পারেনি। যে তমাল বৃষ্টি হলেই খিচুড়ি করতে বলতো, রবীন্দ্র সংগীত শুনতো এখন কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকে। কিছু বললেই ছেঁত করে উঠে। গতকাল তিথি ভালো মানুষের মতো কেবল বললো, ‘এই চলো না তোমার পরাগ বন্ধুকে বলে সবাই মিলে fall দেখতে যাই, দেখ না সবাই কেমন সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যেয়ে রঙিন পাতাসহ গাছের নিচে বসে স্বামী স্ত্রী ছবি তুলে ফেস বুকে দিচ্ছে।’ মুখের উপর তমাল সপাট করে বলে দিলো, ‘তোমার শখ হয়েছে যাও, আমার মনে অত রং নেই।’

ঠিক, একইভাবে তিথির ধারনা, তার নিজের মধ্যেও অনেক চেঞ্জ হচ্ছে। তিথি আগে দেশে থাকতে কখনো ঝগড়া ফ্যাসাদ তো দূরের কথা কখনো চিৎকার করে কথা বলেনি অথচ এখন সারাক্ষন খিটমিটে মেজাজ। ওদের এই পারস্পরিক চেন্জিং এর ব্যাপারটি ওদের একমাত্র সন্তান তিতাসও কিছুটা হয়তো আচঁ করতে পেরেছে। তিতাস আজকাল প্রায়ই অনেক রাতে বেড রুম থেকে বাবা মায়ের চড়া গলায় কথা বলতে শুনতে পায় যা আগে কখনো দেশে থাকতে শোনেনি। আম্মুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ তিতাসকে অনেক আহত করে। ওদিকে, তমালের আশংকা পাছে তাদের এই চ্যাচামেচি যেন আবার ঝগড়া থেকে হাতাহাতির পর্যায়ে না যেয়ে পুলিশি ঝামেলায় না জড়িয়ে পরে, তার চেয়ে দেশের ছেলে দেশেই চলে যাওয়া উত্তম হবে।

এই আজ যেমন সকাল বেলা সেলফোনে অ্যালার্ম অফ করা নিয়ে সাত সকালে তিথিদের বেডরুমে তুলকালাম কান্ড বেঁধে গেল। তমালের ফোনে অ্যালার্ম দেয়া যায় না, সাধরণত সকালে কাজ থাকলে তিথির আইফোনে অ্যালার্ম দেয়া হয়। গত মাসে বন্ধু পরাগের কাজের জায়গায় ফ্যাক্টরি থেকে ফায়ার হওয়ার পর থেকে তমাল এজেন্সির মাধ্যমে কাজ করে আসছে । কোনো ফিক্সড কাজ না, এজেন্সি একেক দিন একেক জায়গায় পাঠায়। মাঝে মাঝে আবার অফ থাকে । বেশ কয়েকদিন হলো তমালের কাজ ছিল না, তাই অনেকদিন অ্যালার্ম দেওয়া হয়নি। কিন্তু আজ সকালে তমালের ড্রাইভিং টেস্ট থাকায় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল। এটি তমালের তিন নাম্বার টেস্ট, তমাল এর আগে দুইবার ফেল করেছিল। তাই, আজকের টেস্টটি তমালের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

ঘুমের মধ্যে তরিঘরি করে এলার্ম অফ করতে যেয়ে বালিশের পাশে রাখা তমালের চশমা টুপ্ করে খাটের নিচে পরে গেল। চশমা না পরে যদি চশমার পাশে থাকা সেলফোনটি পড়তো, তাতেও তমালের অত আপত্তি ছিল না, কারণ এখন চশমা ছাড়া তিথির ফোনে অ্যালার্ম কিছুতেই বন্ধ করা সম্ভব না। খাটের ওই পাশেই দেয়াল। খাট না সরালে চশমাটি কিছুতেই নেয়া যাবে না, ওদিকে অ্যালার্ম বেজেই চলেছে । তমাল কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে খাট টি একটু সরাতেই তিথি খ্যাঁক করে উঠলো-

-‘তোমার হয়েছেটা কী? একটু কী শান্তিতে ঘুমাতেও দিবে না?
তমাল করুনতম গলায় মিন মিন করে বললো, ‘চশমা নিচে পরে গেছেতো তাই খাট সরাতে হচ্ছে।’
‘চশমা বালিশের পাশে রাখার দরকার কী? যেদিন মট করে চশমা ভেঙে যাবে, সেদিন বুঝতে পারবে, এটাতো আর বাংলাদেশ না, কয়েকশো টাকা দিলেই চশমা কিনতে পারবে, টাকা কী আকাশ থেকে পরে ? এজেন্সি থেকে মাসে দু চার দিন কাজ, তার উপর এবার উনার শখ হয়েছে গাড়ি চালানো শিখবে, একের পর এক ড্রাইভিং পরীক্ষায় ফেল করে যাচ্ছে আর ড্রাইভিং এর পিছনে মুড়ি মুড়কির মতো টাকাপয়সা খরচ হচ্ছে, ড্রাইভিং না জানলে নাকি ভালো চাকরি হবে না, আরে ড্রাইভিং শিখলেই কী আর সুইমিং শিখলেই কী, ভালো করে ইংলিশ না বললে ওদের কি দায় পড়েছে তোমাকে চাকরি দেয়ার, সামান্য কয়েক টাকা দিয়ে কীভাবে যে সংসার চলছে সেদিকে হুশ আছে? বাচ্চার জন্য সরকারি টাকা আর দেশ থেকে আনা টাকা না থাকলে না খেয়ে মরে ভুত হতে হতো, সেদিকে উনার খেয়াল আছে ?’

তিথির সব প্রশ্নের উত্তর তমালের জানা ছিল। কিন্তু, এই সকাল বেলায় এসব নিয়ে কথাবার্তা বলা যত কম ততো নিরাপদ। তবে, বলতে বলতে তিথি বেকুবের মতো একটু বেশিই বলে ফেলেছে। এসব দেশে না খেয়ে কেউ মারা যায় না ।

তমাল তারপরেও মনে মনে ভাবলো, এ যাত্রা বুঝি সে বেঁচে গেল, চশমার ব্যাপারটি টাকা /পয়সার উপর দিয়েই যাচ্ছে, ভাগ্যিস ফেসবুকের উপর দিয়ে যায়নি। তিথি অবশ্য বলতে পারতো, ‘রাতে বৌ পাশে শুয়ে আছে, আর উনি ফেস বুক নিয়ে ব্যাস্ত। বালিশের পাশে কী ফোন আর চশমা না রাখলেই না ! এমনি কাজ কর্ম নেই , কিন্তু উনার ফেসবুক বুক দেখা চাই! কাল থেকে হয় আমাকে বেছে নিবে না হয়তো ফেস বুক?’

এমনিতেই তিথি তমালের নিউকামার হিসাবে চাকরি.বাকরি সহ নানাবিধ সমস্যায় আছে, তার মধ্যে আবার ছেলে তিতাসকে নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। তিথি তমালেরা অটিস্টিক ছেলে তিতাসের ব্যাপারে যতটা আশা নিয়ে এসেছিলো দিন দিন কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে নায়াগ্রা ফলস দেখতে যেয়ে তিতাস নায়াগ্রা ফলসের গভীর পানিতে পরে যেয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে। তারপর থেকে ছেলেটি বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে।

অটিস্টিক বাচ্চারা সাধারণত কম কথা বলে। সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব সহজে তৈরী হয় না। খুব প্রব্লেমেটিক না হলে এই ধরণের বাচ্চাদের নরমাল স্কুলেই দেওয়া হয় যাতে সাধারণ বাচ্চাদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পায়। কিন্তু, তিতাসের ক্ষেত্রে তা মনে হয় আর সম্ভব হচ্ছে না, স্কুলে দিন দিন বুলিং (bullying) বেড়ে যাওয়ায় ওকে বোধ হয় স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে। গতকাল স্কুলে তিতাস আবারও মারামারির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। ক্লাসের এক ইন্ডিয়ান ছেলে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান কে নিয়ে বলেছিলো,’তোদের সাকিব আই পি এল যে পারফরম্যান্স দেখালো ওর জন্যই KKR এবারের কাপ জিততেই পারলো না, ফাইনালের দিন বল হাতে শূন্য উইকেট আবার ব্যাটেও শূন্য , হাহা হা, ওয়ার্ল্ড নাম্বারে ওয়ান অল রাউন্ডার।’ তিতাস অনেক কড়া জবাব দিতে পারতো, কিন্তু ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চুপ করে থেকেছে। কিন্তু যখন দেশ নিয়ে কথা বলেছিল,      ‘তোদের বাংলাদেশ তো এবার আই সিসি টি টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ডকাপের মূল পর্বের একটি খেলাও জিততে পারে কিনা সেটাই বিষয়, স্কটল্যান্ডের সাথে হার, ওমানের সাথে টেনেটুনে জয় নিয়ে সুপার টুয়েলভ পর্বে এলে কী হবে, এবার অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের সাথে খেললে এমন নাকানি চুবানি খেতে হবে যে, একেবারেই দশ ওভারেই খেলা শেষ, দেখা গেল টি টুয়েন্টি চেঞ্জ হয়ে টি টেন হয়ে গেল, হাহা।’ তিতাস এ পর্যায়ে আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি, বোকার মতো ইন্ডিয়ান ছেলেটিকে সজোরে ঘুষি চালিয়ে রক্তারক্তি করে ফেলেছে, ফলাফল আবারও ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে গার্জেনসহ মিটিং। এবার সম্ভবত পাকাপাকি ভাবে ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে তিতাসকে যেন স্পেশাল চাইল্ড স্কুলে ট্রান্সফার করানো হয়। তিথি তমালেরা এসব নিয়েও বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। প্রবাসে বাংলাদেশিরা যারা অনেক দিন ধরে এখানে আছেন দিনের পর দিন নানাবিধ চ্যালেন্জিং বিষয়গুলিকে পাশ কেটে কিছুটা থিতু হয়ে এলেও নিউ ইমিগ্রান্টদের আরো খানিকটা সময় নেয়। আবার কেউ কেউ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে হাই স্কুল/কলেজ /বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের মতো ড্রপ আউট হয়ে তল্পি তোলপা গুটে দেশে ফিরে যায়। তিথি তমালদের ইদানিং এই আচরণগত ভৌতিক পরিবর্তন সেরকম ড্রপ আউটের পূর্ব লক্ষণ কী না সেটা বুঝতে পাঠকদের আরোও খানিকটা হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।


আজ সকাল সকাল তমাল তার ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টরের সাথে চলে যাওয়ার পর থেকে তিথি আর ঘুমায়নি। প্রায় সোয়া সাত টার মতো বাজে। এখনও ভোরের আলো পরিষ্কার ফোটেনি। এখন সূর্য উঠে প্রায় সাত টা বিয়াল্লিশ/তেতাল্লিশ মিনিটে। এখানকার নিয়ম অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘড়ির কাটা আবার চেঞ্জ হবে। কী সব অদ্ভুত নিয়ম। তিতাসকে ঘুম থেকে ডাকা দরকার। সাড়ে আটটার সময় তিতাসের স্কুল বাস। ভোরের দিকে বিছানা যেন চুম্বকের মতো লেপ্টে থাকে, কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না।

তিথি আরো কিছুক্ষন বিছানায় শুয়ে থাকে। তমালের জন্য কিছুটা মায়া হচ্ছে। এই সাত সকালে ব্যাচারাকে অনেক কথা বলা হয়েছে, এতো সব না বললেও পারতো। আসলে, স্থান, কাল মানুষকে বদলিয়ে ফেলে। দেশে থাকতে, তিথি রাজশাহী ইউনিভার্সিটির মাস্টারির করতো। তমাল করতো পেস্টিসাইড কোম্পানির কাজ। ছুটির দিনে ইউনিভার্সিটি থেকে রিকশা করে প্রায়ই পদ্মার ধারে টি বাধে বেড়াতে আসতো। কতোই না মধুর ছিল সেসব দিনগুলি। তমালের আবার স্বভাব ছিল, রিকশায় উঠে রিকশা ওয়ালাদের সাথে গল্প জুড়ে দেওয়া। একবার রাজশাহী ইউনিভার্সিটির স্টাফ কোয়ার্টার থেকে শহরের নিউমার্কেটে আসার পথে এক রিকশা ওয়ালা মামার সাথে তমাল খোশ গল্পে মেতে উঠলো। ভাড়া দেয়ার সময় কড়কড়ে পাঁচ শত টাকার নোট পেয়ে রিকশা ওয়ালা কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললেন, ‘স্যার আপনাদের মনের আশা বলেন, আমি আল্লাহর কাছে খাস দিলে দোয়া করবো ‘ তমাল হাসতে হাসতে বললো, ‘মামা , আল্লাহর কাছে দোয়া করেন আমরা যেন স্বপ্নের ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় একবারে চলে যেতে পারি।’ তিথি এসব মনে করতে যেয়ে কিছুটা আফসোস হলো, আহা সেদিন যদি সব কিছু বাদ দিয়ে তমাল যদি শুধু উনাকে শুধুমাত্র সুখে শান্তিতে থাকার দোয়া করতে বলতো তাহলে হয়তো ওদের অধরা সুখ সত্যই ধরা দিতো !!

সকাল দেখে দিন বুঝা যায় । তমালের সকালটি যেভাবে শুরু হয়েছিল, তখনই বুকের মধ্যে ধক করে উঠেছিল, আজ দিনটা বোধ হয় ভালো যাবে না। যা ভেবেছিলো তাই হলো, এই মাত্র তমাল তার তৃতীয়বারের মতো ড্রাইভিং এর রোড টেস্টে ফেল করলো। তমাল এবার বাংলাদেশী ইন্সট্রাক্টার ধরে টরেন্ট থেকে বেশ দূরে গুয়েল্ফ শহরে এসেছিলো। পরীক্ষার আগে টানা এক ঘন্টা ওখানে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে তালিম নিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও তমাল ভুল করলো। রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ডানে বামে তাকায়নি । এটা হচ্ছে ভুল নাম্বার ওয়ান, ভুল নাম্বার টু আরো বড় অপরাধ, গাড়ি চালানোর সময় ডান দিকে সাইকেল লেনের উপর দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, সুতরাং যা হবার তাই হলো, সুন্দর ব্যাক পার্কিং আর প্যারালাল পার্কিং করেও তমাল ফেল করলো।

ড্রাইভিং এক্সজামিনার যখন রোড টেস্ট শেষে খচ খচ করে লিখে তমালের হাতে হলুদ রঙের ফলাফলের কাগজ ধরিয়ে দিলো, তমাল ভাবলেশহীন ভাবে কগজটি হাতে নিয়ে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। দূরে অপেক্ষা করা তমালের ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টার দ্রুত গাড়ি নিয়ে তমালের গা ঘেসে পার্কিং করে তমালকে ভিতরে আসতে ইশারা করলো। ইন্সট্রাক্টরের পাশের সীটে আরেকটি স্টুডেন্ট বসে আছে, ছেলেটি কল কল করে কথা বলে চলেছে, ছেলেটির উচ্ছলতা দেখে তমালের বুঝতে অসুবিধা হলো না ছেলেটি রোড টেস্টে পাশ করেছে। তমালের নিজেকে অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হলো।

অথচ এই তমালের ড্রাইভিং এর অভিষেক টেস্টেই পাশ করার কথা ছিল, সব ঠিক ঠাক ভাবে আগাচ্ছিলো, হটাৎ করে বৃষ্টি শুরু হলো, তমাল কিছুতেই গাড়ির উইপার এর বাটন খুঁজে পাচ্ছে না, লাইটের সুইস দিচ্ছে, এটা ওটা করছে , অগত্যা পাশে বসা এগজ্যামিনার নিজের সেফটিটির জন্য এক সেকেন্ডে উইপার চালিয়ে, শুধু বলল, ‘You should know your car.’

দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সময় যেটা করলো সেটা নিয়ে তমালের যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল, কিন্তু কে শোনে কার কথা। রেড লাইটে রাইট টার্ন নিতে হবে। সবই ঠিক ছিল, আড়াআড়ি দিকের রাস্তায় সবুজ লাইট থাকায় তমাল কিছুক্ষন থেমে পুরাপুরি নিরাপদ দেখে যখন রাইট টার্ন নিবে, ঠিক তখনি এক বৃদ্ধ আড়াআড়ি রাস্তায় ওপর প্রান্ত থেকে রাস্তা পার হওয়ার জন হেটে রওনা দিলেন। তমালের গাড়ি অনেক অনেক দূরে, তাই তমাল নিশ্চিন্তে রাইট টার্ন নিলো, কিন্তু বিধি বাম। এক্সগজামিনার যে কাগজ হাতে ধরে দিলো তাতে ফেল করার কারণ হিসাবে লেখা, while turning you should wait for pedestrian.’

আজ ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টার ফিরতি পথে নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে। পাশের সীটে বসেছে সেই ইন্ডিয়ান ছেলেটি এই মাত্র যে রোড টেস্টে পাশ করে মনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি যাচ্ছে। তমাল মুখ লম্বা করে বসে গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার দুইধারে Fall season এর অপরূপ সাজে সজ্জিত বিচিত্র রং বেরঙের গাছ গাছড়ার সৌন্দর্য দেখছে। বেচারা তিথি গতকাল fall দেখতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিলো। তমাল খারাপ ব্যাবহার করেছে। তবে, তমালের মনে সত্যই আজ কোনো রং নেই। তমাল তার চরম দুর্দিনে রোড টেস্টে ফেল করে নিজের দুঃখ কষ্টগুলিকে ডাইভার্ট করার জন্য গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে কখনো দার্শনিক কখনো বা বিজ্ঞানের ছাত্রের মতো জটিল জটিল বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে।

প্রকৃতির কি সব অদ্ভুত ক্যালকুলেশন। তমাল ক্লাস নাইনের বিজ্ঞানের বই এ পড়েছিল শীতকালে গাছের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি পাতা দিয়ে প্রস্বেদন (transpiration ) প্রক্রিয়ায় বাতাসে ফিরে যায়। শীতকালে যেহেতু গাছে পানির চাহিদা বেশি থাকে তাই প্রস্বেদন প্রক্রিয়া কমানোর জন্য শীত আসার আগে আপনা থেকে গাছে পাতা ঝরে যায়, প্রকৃতির কি চমৎকার খেলা। মানুষের ক্ষেত্রেও কি এমন হয়!ছেলেমেয়েদের সংসারে বোঝা হয়ে থেকে ওদের কষ্ট না বাড়ার জন্য কী সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে দুনিয়া থেকে তুলে নেয় !!

তমাল শুনেছে , এখানে চারিদিকের এই রঙিন পাতাগুলি শীত আসার আগেই ঝরে যেয়ে গাছগুলি একেবারে ন্যাড়া হয়ে যাবে তারপরে, শীত তার প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে হাজির হবে। কখনো সাদা তুলার মতো তুষার ঝড় হবে, কখনোবা তাপমাত্রা শূন্য থেকে দশ, বা বিশ ডিগ্রির নিচে চলে যেয়ে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা নিয়ে আসবে। বিশেষকরে পথচারীরা যারা বাসের জন্য এই মারাত্মক ঠান্ডায় অপেক্ষা করবে তাদের কষ্টের সীমা নেই। তাই, শীতের আগে তমালের ড্রাইভিং লাইসেন্সটি পাওয়া বেশ জরুরি ছিল। যাক কী আর করা, তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে তমালরা টরেন্টোতে থাকে। অন্যান্য প্রভিন্সের চেয়ে এই অন্টারিও প্রভিন্সে বিশেষকরে টরেন্টোতে শীতের স্থায়ীত্ব ও তীব্রতা তেমন বেশি হয় না, তা না হলে আরোও সমস্যা হতো। তমালদের এটিই হবে প্রথম উইন্টার। তিথি এখনোও উদগ্রীব হয়ে আছে কখন শীত আসবে, এখানকার বরফ পড়া দেখবে। স্কুলে, পথে ঘাটে বাচ্চারা স্নোবল বানিয়ে একে অন্যকে ছুড়ে মেরে মজা করবে, তিথি এসব দেখার জন্য মুখিয়ে আছে।

আজ তৃতীয়বারের মতো রোড টেস্টে ফেল করে বিবর্ণ মন নিয়ে প্রকৃতির বর্ণিল শোভা দেখতে যেয়ে তিথির জন্য বেশ খানিকটা মায়া হলো তমালের। প্রকৃতি কেন জানি এই মেয়েটির শখ আহ্লাদের সাথে যথার্থ আচরণ করেন না। বেচারা কত শখ করে পর পর দুই বার মিস ক্যারেজের পরে যে ছেলে নিলো, সেও অটিস্টিক। কত শখ করে নায়াগ্রা ফলস দেখতে গেল সেখানেও সমস্যা, জলপ্রপাতের গভীর পানিতে তলিয়ে যেয়ে মৃত্যর হাত থেকে ফিরে এলো। এবার, কানাডার শীতের বরফ পড়া দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে, বোকা তিথি জানে না, শীতে এখানে গাড়ি ছাড়া চলাফেরায় কত কষ্ট হয়।

তাছাড়া, শীতকালে কল কারখানা আরো স্লো থাকে, এজেন্সির মাধ্যমে যে কয়েক দিন কাজ করা হতো তাও হয়তো শূন্যে নেমে আসবে। তবে, কি শীত আসার আগে আগে একবারে তল্পি তল্পাসহ দেশে ফিরে যাবে ? না কি নেক্সট টার্ম থেকে কোনো কমিউনিটি কলেজে লম্বা কোর্স নিয়ে পড়াশুনা শুরু করবে ? তাই যদি হয়, তবে জানুয়ারির সেমিস্টার এখন আর ধরার উপায় নেই , তবে কী দেশ থেকে আনা টাকা পয়সা গুলি একেবারে শেষ করার আগে এখানকার সোশ্যাল এসিস্টেন্স এর জন্য এপ্লাই করবে!!!

——–(চলবে)

জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, ২০২১

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধনা ফেরার দেশে চলে গেলেন -ডাঃ সিনহা আবুল মনসুর
পরবর্তী নিবন্ধকানাডার হালিফ্যাক্সে বাংলাদেশি হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিশেষ প্রতিবাদ সমাবেশ ও আমাদের সম্প্রদায়িক চেতনা ।
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন