নিউ ইয়র্ক থেকে:-

নিউ জলপাইগুড়ির পথে!

কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস যখন বোলপুর ষ্টেশনে ঢুকল তখন সময় রাত ১০টা বেজে ৪০ মিনিট। তড়িঘড়ি করে আমরা ট্রেনে চেপে বসলাম। আমরা যাবো নিউ জলপাইগুড়ি। বোলপুর থেকে নিউ জলপাইগুড়ির দূরত্ব ৪১৪ কিলোমিটার। সময় লাগবে প্রায় আট থেকে সাড়ে আট ঘন্টা।

রাতের ট্রেনে ভ্রমনের সুবিধা এবং অসুবিধা দু’টোই আছে। সুবিধা হচ্ছে যদি ভাল সিট পাওয়া যায় তাহলে এক ঘুমেই সকাল। অসুবিধা হচ্ছে সিট ভাল না হলে এবং তা বাথরুমের কাছাকাছি হলে ভোগান্তির শেষ নেই। ভ্রমণদেবী আমাদের সহায় আমরা সিট পেয়েছি জানালার পাশে এবং বাথরুম থেকে বেশ দূরে। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি টুরিষ্ট লজেই, কাজেই ট্রেনে খাবার দাবার এর ঝামেলা নেই। হালকা কিছু স্ন্যাকস এবং চা নিয়েছি ফ্লাস্কে করে।কাজেই আমরা ষোল আনার উপর সতের আনা তৈরী।

ট্রেনে আমাদের মুখোমুখি বসেছেন মধ্যবয়স্ক এক দম্পতি মিষ্টার ও মিসেস ব্যানার্জী, যাচ্ছেন দার্জিলিংয়ে, থাকেন কলকাতায়। উনারা যাচ্ছেন ছুটিতে।আমাদের মত ‘হাওয়া পরিবর্তন’ উনাদের উদ্দেশ্য!আমার বাম পাশে রয়েছেন নিখিলেশ স্যান্নাল, শান্তিনিকেতনের কলাভবন এর ছাত্র। যাচ্ছেন,নিজ দেশে।ট্রেন ছাড়ার প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওদের সাথে পরিচয়পর্ব সেরে ফেললাম।

মিষ্টার ব্যানার্জী যতটা মুখচোরা মিসেস ব্যানার্জী ততটাই মুখরা। মিষ্টার ব্যানার্জী পেশায় ব্যবসায়ী, মিসেস ব্যানার্জী , কলকাতায় একটা ইনশিওরেন্স কোমপানীর পরিচালক। মিসেস ব্যানার্জী কথা বলেই যাচ্ছেন, ইনশিওরেন্স কোমপানীর পরিচালক বলে কথা!
মিসেস ব্যানার্জী মাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তা দিদি ঘুরতে বেড়িয়েছেন বুঝি!’
‘হ্যা, হাওয়া পরিবর্তনে বের হয়েছি, সাথে ছেলে আছে’- মায়ের উত্তর।
‘তা, ছেলে বিয়ে থা করেছে?
‘না, ও কেবল ডাক্তারী পাস করে বের হলো,বিয়ে করেনি এখনো।’
মিসেস ব্যানার্জী মিষ্টার ব্যানার্জীর দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘দেখ দেখ ডাক্তার ছেলে, মা’কে নিয়ে বেরিয়েছে বিদেশ ভ্রমনে! এমনটাতো আজকাল দেখাই যায় না!’

এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘বেঁচে থাকুন, দীর্ঘজীবি হউন!আহা! মায়ের জন্যে এত ভালবাসা, দেখেও প্রাণটা জুডিয়ে যায়।’ একনাগাডে কথাগুলো বলে থামলেন মিসেস ব্যানার্জী।

একটু দম নিলেন, তারপর আবার শুরু করলেন- ‘আমার একটাই ছেলে দিদি, গতবছর বিয়ে করে বউকে নিয়ে গিয়ে উঠল সল্ট লেকের এক এপার্টমেন্টে। এখন কালে ভদ্রে আসে বুড়োবুড়িকে দেখতে’।

মিসেস ব্যানার্জী ‘প্যানডোরার বাক্স’ খুলতে শুরু করেছেন। খুব অচিরেই যে থামবেন তার সম্ভাবনা ক্ষীন। আমি নিখিলেশ বাবুকে বললাম চলুন সেলুনকার থেকে চা খেয়ে আসি- যদিও আমাদের ট্র্যাভেল ব্যাগেই রয়েছে ফ্লাক্স ভর্তি চা। নিখিলেশ বাবু কথা না বাড়িয়ে বললেন ‘চলুন’। আমরা দুজনেই পা বাড়ালাম সেলুনকারের দিকে।

নিখিলেশ স্যান্নাল এর বাডী দার্জিলিং।তাই এই জনপদটা ওর মুখস্ত!
সেলুনকারে বসে চা খেতে খেতেই ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম,’দাদা,দার্জিলিং নিয়ে কিছু বলুন’!

নিখিলেশ স্যান্নাল বললেন,’পশ্চিমবঙ্গে শৈল শহরের রানী বলে পরিচিত দার্জিলিং। দার্জিলিং তার ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চা ও দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিং-এর জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ রাজের সময় থেকেই। বিশেষ করে এটি যখন ব্রিটিশ রাজের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠেছিল। অনেক আগে দার্জিলিং ছিল প্রাচীন গোর্খার রাজধানী। পরে সিকিমের মহারাজা ব্রিটিশদের দার্জিলিং উপহার দেন। অনাবিল সৌন্দর্য আর মনোরম জলবায়ুর কারণে দার্জিলিং হাওয়া পরিবর্তনের গন্তব্য হিসেবে গডে উঠেছে।পর্যটন ছাড়াও, দার্জিলিং তার বিভিন্ন ব্রিটিশ শৈলীযুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির জন্যেও বিখ্যাত!যা ভারত জুড়ে এমনকি আশেপাশের দেশগুলি থেকেও ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করে আসছে বহু যুগ থেকে!

[asa]B000SATIG4[/asa]

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরে, পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে এই দার্জিলিং।এই জেলা নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে তিনটি আন্তর্জাতিক সীমানা স্পর্শ করে আছে। এছাড়াও এর সীমানা উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিম রাজ্য।

৩১৪৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এর অবস্থান।এই জেলার ভূখণ্ড মূলত: পাহাড়ি।তবে কিছু সমতল ভূমির রয়েছে।। এখানকার জনসংখ্যায় রয়েছে লেপচা, গোর্খা,ভুটিয়া ও বাঙালিদের সংমিশ্রণ!তাই বিভিন্ন ভাষা এখানে উচ্চারিত হয়। এখানকার প্রধান ভাষা হল – হিন্দি, বাংলা, নেপালি, গোর্খা, ইংরেজি এবং তিব্বতী’!

আমি বললাম,’দার্জিলিংয়ের আশে পাশের জায়গাগুলো কি রকম’?
দাদা বললেন,’সমগ্র দার্জিলিং জেলায় রয়েছে চারটি উপজেলা।এগুলো হচছে: দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ও শিলিগুড়ি। জেলার সদর-দপ্তর দার্জিলিং শহর।সমুদ্র পৃসঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৬৭১০ ফুট।শিলিগুড়ি হচছে দার্জিলিং জেলার একটি বৃহত্তম শহর। ঘনবসতিপূর্ণ শিল্প শহর। কালিম্পং, দার্জিলিং আর কার্শিয়াং হল জনপ্রিয় শৈল শহর’!

দাদা আরো বললেন,’দার্জিলিং মহাকুমার অন্যান্য শহরগুলো হল – পালবাজার, রাংলি রাংলিয়ট এবং সুখিয়াপোখারি। কালিম্পং মহাকুমার শহরগুলি হল কালিম্পং এবং গোরুবাথান। কার্শিয়াং মহাকুমার শহরগুলি হল কার্শিয়াং এবং মিরিক। শিলিগুড়ি মহাকুমার শহরগুলি হল মাটিগাড়া,নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, বাতাসী, বাগডোগরা এবং ফাঁসিদেওয়া’।

আমি বললাম,’এটাই সেই বিখ্যাত নকশালবাড়ি’?
দাদা বললেন,’হ্যাঁ, এটাই সেই বিখ্যাত নকশালবাড়ি!’নকশাল’শব্দটি এসেছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোটগ্রাম ’নকশালবাড়ি’ থেকে।

এখানে ভারতীয় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ ১৯৬৭ সালে তাদের নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি পৃথক উগ্র বামপন্থী দল গঠন করেন। এ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু স্যানাল ও জঙ্গল সাঁওতাল।

এ বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ২৫ মে তারিখে। তখন নকশালবাড়ি গ্রামে,কৃষকদের উপর স্থানীয় ভূস্বামীরা ভাড়াটে গুন্ডার সাহায্যে অত্যাচার করছিল। এরপর এই কৃষকরা ঐ ভূস্বামীদের সেখান থেকে উৎখাত করে। চারু মজুমদার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুং এর অনুসারী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ভারতের কৃষক এবং গরিব মানুষদের মাও সে তুং এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে শ্রেণিশত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা প্রয়োজন।তিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার লেখনীর মাধ্যমে। তার বিখ্যাত রচনাটি ছিল ‘হিস্টরিক এইট ডকুমেন্টস্’ বা ‘আট দলিল’।যা এই এলাকায় এক সময় নকশাল মতাদর্শের ভিত্তি রচনা করে’!

দাদা বললেন,’কি জানেন,এই নকশাল আন্দোলন নিয়ে পরে প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে!সমরেশ মজুমদার,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং কিন্নর রায়ের রচিত বেশ কিছু উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা এসেছে’।

নিখিলেশ স্যান্নাল এর সাথে আলাপের এক যুগ পর আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দু’টি বই পড়ার।
প্রথমটি হচছে অরুন্ধতী রায়ের বুকার পুরস্কার জয়ী ‘গড অব স্মল থিংস’!এই উপন্যাসে একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। দ্বিতীয়টি হচছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’!এই উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী নকশাল আন্দোলন নিয়ে লিখেছিলেন। ১৯৯৮ সালে এ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করেই একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। ছবিটির নাম ছিল ‘হাজার চুরাশি কি মা’!
নিখিলেশ স্যান্নাল এর সাথে আলাপে আলাপে দু’ঘনটা কেটে গেছে।যখন রুমে ফিরলাম তখন সময় প্রায় একটা।মিষ্টার ব্যানার্জীর,মিসেস ব্যানার্জী এবং মা, সবাই ঘুমিয়ে।’অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েসটারন ফ্রন্ট’!নিখিলেশ স্যান্নালও ঘুমুতে গেলেন।

আমার ঘুম আসছিলনা।জানালার পাশে গিয়ে বসলাম।ওপাটাশটায় অন্ধকার।অন্ধকারকে পেছনে ফেলে ট্রেন এগিয়ে চলেছে সামনে!
ঝিক-ঝিক,ঝিক-ঝিক!
ঝিক-ঝিক,ঝিক-ঝিক!
ওই ছন্দে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানি না!

Sinha10a

ঘুম ভাঙলো সকাল ৬টা দশে। বাইরে রোদ আছে, হালকা বৃষ্টিও আছে। ট্রেন যাচ্ছে চা বাগানের ভেতর দিয়ে। দুপাশে সবুজ আর সবুজ। বৃষ্টি ভেজা চায়ের পাতার রোদ পডছে।ওই রোদ বিচছুরিত হয়ে ছডিয়ে পডছে চারপাশে।সে এক অপরূপ দৃশ্য! আমার ধারণা আমরা জলপাইগুড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ির প্রচুর বৃসটি হয়।শিলিগুড়ি আর জলপাইগুড়ি নাম দু’টো মনে হতেই মনে পডলো লেখক সমরেশ মজুমদারের কথা!কারন শিলিগুড়ি আর জলপাইগুড়ি সাথে তিনিই আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন!

বিদগ্ধ পাঠক,আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সমরেশ মজুমদারের সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘কালবেলা’র কথা। এই শিলিগুড়ি আর জলপাইগুড়িই ছিল ‘কালবেলা’র নায়ক এর চারণভূমি!

আমাদের ট্রেন কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি জংশনে ঢুকল সকাল সোয়া আটটায়।নিউ জলপাইগুড়ি হচ্ছে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় জেলা শহর। এর উত্তরে ভুটান, দক্ষিণে বাংলাদেশ এবং কাছাকাছি দেশ হচ্ছে নেপাল। নিউ জলপাইগুড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটিরেলওয়ে জংশন।ভারতের উত্তর পূর্ব অংশের সাথে বাকী অংশের যোগাযোগ এই ষ্টেশনের মারফতই হয়ে থাকে। এখানে ব্রড গেজ এবং মিটারগেজ দু’ধরনের লাইনই রয়েছে। রেগুলার লাইন হচ্ছে ব্রড গেজ আর মিটার গেজ হচ্ছে- ‘দার্জিলিং-হিমালয়’ রেলওয়ে।এরই অন্য নাম ‘দার্জিলিং টয় ট্রেন।’

ষ্টেশন থেকে বের হয়েই আমরা ছুটলাম খাবারের সন্ধানে।গরম গরম লুচি,সবজি আর ডিমের ওমলেট দিয়ে সারলাম প্রাতরাশ।নিউ জলপাইগুড়ির থেকে দার্জিলিং যাওয়ার দু’টো রাস্তা।বাই রোডে যাওয়া যায়।সময় লাগবে দু’ঘনটা। ‘দার্জিলিং টয় ট্রেন’ করেও যাওয়া যায়।সেক্ষেতরে সময় লাগবে প্রায় সাত আট ঘনটা!আমরা বাই রোডে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।চেপে বসলাম ট্যাক্সিতে।গন্তব্য দার্জিলিং।

পাহাড়ের রানী দার্জিলিং, মেঘের সারথী দার্জিলিং আর হিমালয়ের প্রতিবেশী দার্জিলিং!

sinha10b

সিনহা মনসুর
চলবে…

১ মন্তব্য

  1. সিনহা মনসুর ভাই, আপনার লেখা খুব প্রাণবন্ত. পড়ে ভালো লাগলো. ধন্যবাদ আপনাকে.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন