তারিখ মনে নাই, জুলাই ১৯৭২ ,আমি আরও কয়েক জন মিলে খুলনা থেকে ভোরে লঞ্চে ঢাকা সদর ঘাট টার্মিনাল   উপস্থিত হয়েছি । আমরা ৪-৫ জন একত্রে এসেছি এবং সবার একই অবস্থা । লঞ্চে আলাপ হলো আপনারা কে কোথায় যাবেন ? আমরা যার যেই পরিচিত বা আত্মীয় স্বজন কারো বাসায় গিয়ে উঠবো এবং কাল অফিসে গিয়ে জয়েনিং দিয়ে সরকারি নিয়ম অনুযায়ি যে কদিন ছুটি পাই ,বাড়িতে পরিবার/আপন লোকদের সঙ্গে থেকে আসবো । আমি বললাম , আমার ও ওই ধরণের ইচ্ছা রয়েছে । আমি চিন্তা করতে পারছি না কোথায় যাবো? এই মুহূর্তে কারও- ঠিকানা-ই মনে আসতেছে না । আমি সুটকেস নিয়ে টার্মিনাল থেকে বের হয়ে ভাবছি কোথায় যাওয়া যায় ? শেষে মনে হলো , রিক্সা নিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠি । সে তো আমাকে দেখে হাউ-মাউ করে বলে- আমি ভাবতেই পারছি না, বাস্তবে না স্বপ্নে তোমাকে দেখছি । তোমার মা-বাবা এখনও কোনো রকমে বেঁচে আছেন, মনে হয় ওরা তোমাকে দেখার জন্যই বেঁচে আছেন । তুমি হঠাৎ করে কিভাবে আসলে ? আমি বললাম,সে অনেক কাহিনী পরে বলা যাবে । তুমি দেরি না করে বরং বাড়ি চলে যাও এবং বাড়ি থেকে ঘুরে এসে অফিসে রিপোর্ট করো । সেদিনই লঞ্চে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । মাছুয়াখাল, নারায়ণপুর লঞ্চ ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো । মাবাবার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে সে দিন আমার বুঝতে ভুল হলোনা, আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো । আমার অনুপস্থিতে ওদের কি পরিমান কষ্ট হয়েছে ,তা দু’চোখে দেখেই অনুভব করলাম । আমি বাবামা ও ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরে সেদিন এই কথাই উপলব্ধি করেছিলাম যে ,আমি ভুল করেছি । খবর পেয়ে বাড়ি ভর্তি লোক ,যে শুনেছে সেই এক নজর আমাকে দেখতে এসেছে । দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছে , লক্ষ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে , তাছাড়া দেশের এই পরিস্থিতে মাবাবা ,ভাইবোন, আপনজন আমার সম্পর্কে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ ।

১৯৭০ মার্চ ১২, তৎকালীন পাকিস্থান সরকারের চাকুরী নিয়ে লাহোর,পশ্চিম পাকিস্তান গিয়েছি । দেশে সে সময় ছিল অনেক অশান্তি । বন্ধু বান্বধ অনেকেই দেশের বর্তমান পরিস্তিথি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং আমাকে এ অবস্থায় চাকুরী নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করতে নিষেধ করলে ও আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি । আমি ধারণা করেছিলাম, লাহোর বড়ো শহর,সুযোগ পেয়েছি , দেশের ওপর অংশটাও দেখা যাবে । তাই কারো উপদেশ না শুনে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে জটপট চলে গেলাম । কিন্তু আমার ভয় ছিল ভাষা নিয়ে, আমি ওদের ভাষা জানি না । অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ যেহেতু ইংলিশ, সে নিয়ে বেশি চিন্তা ও করিনি ।

আমি পূর্ব পাকিস্থান ত্যাগ করার পূর্বে এক মৌলানা সাহেবকে অনুরোধ করে কয়েকটা উর্দু শব্দ বাংলায় লিখে নিয়েছিলাম । ওটাই ছিল আমার ভাষাগত সম্পদ, কারণ লাহোর এয়ারপোর্ট থেকে বের হলেই আমাকে টাঙাওয়ালা বা ট্যাক্সিওয়ালা-কে ডেকে ঠিকানা দেখিয়ে কত ভাড়া  দু-চারটা কথা গুছিয়ে বলতে হবে । ঢাকা এয়ারপোর্ট (কুর্মিটোলা) প্লেনে উঠে সিট নিয়ে বসে উইন্ডো দিয়ে টার্মিনাল ব্যালকনিতে আমার বাবাকে দেখে চোখের পানি সম্ভরণ করে তাকিয়ে থাকলাম । বার বার বাবার কথা মনে পড়তে ছিল, ” তুমি আমাদেরকে ফেলে এত দূরে যেও না। ” এটাই ছিল আমার প্রথম প্লেনে ভ্রমণ, যদি ও একই দেশ ,মনে হচ্ছিলো কোনো এক অজানা দেশে যাচ্ছি । লাহোর এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর মনেই হয় নি যে এক দেশে আমরা বাস করি । এখানকার লোকদের চেহারা, পোশাক,কথা বার্তা,সম্পূর্ণ আলাদা ।

সামান্য কাপড়-চোপড় সহ একটা সুটকেস হাতে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাহিরে আসতেই আমার পরিচিত জনের সঙ্গে দেখা । এক লোকের ঠিকানা আগে থেকেই নেয়া হয়েছিল এবং ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম । সে আর একজনকে নিয়ে এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিল । ওরা হেসে হাত মিলিয়ে বললো , কোনো অসুবিধা কি হয়েছে ? আমি বললাম , না । কুশল বিনিময়ের পর ট্যাক্সি নিয়ে ওদের বাসায় চলে গেলাম । আমার ঠিকানা বের করা, তাছাড়া আপাততঃ মৌলানা সাহেবের লেখা উর্দু কথা বার্তা ব্যবহার করতে হলো না । বাসায় গিয়ে দেখি ওরা কয়েকজন মেস করে থাকে, কথা-বার্তা বলার পর ওরা বললো কাজে যোগদানের পর এখানে থাকতে পারবেন । আমি খুবই আস্বস্ত হলাম জেনে যে আমাকে থাকা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা করতে হবে না ।

ওখানে তখনও অতিরিক্ত ঠান্ডা । আমি বললাম , পূর্ব পাকিস্তানে তো ফ্যান ব্যাতিত ঘুমানো যায় না, এখানে তো এখনও ঠান্ডা । ওরা বললো ,পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে এর দূরত্ব ১,২০০ মাইল , টেম্পারেচার ও অনেক পার্থক্য ।
পর দিন আমি অফিসে যোগদানের জন্য যাই । ভাগ্য ভালোই অফিসে আরও কয়েক জন পূর্ব পাকিস্তানী পেয়ে আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম । ওরা আমাকে সাহায্য করলো জয়েনিং এর ব্যাপারে । কিন্তু সমস্যা হলো, হেড অফিসে কোনো ওপেনিং নাই এবং আমাকে লাহোর থেকে ১৮০ মাইল দূরে ক্যাম্পবেলপুর আর্টিলারি সেন্টারে সিভিলিয়ান অফিসে গিয়ে জয়েনিং দিতে হবে । আমি নিরুৎসাহিত হলাম এবং বললাম, আমি লাহোর থাকতে পারবো এই ভেবে এসেছি। আমাকে বরং ফেরত যাওয়ার টিকেট দিলে চলে যাবো। আমি জোর দিয়ে বললাম যে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত চলে যাবো । কিন্তু , আমাদের লোকজন বললো যে -আপনি তো সেনাবাহিনীতে কাজ করবেন না । জয়েন করে দেখেন ,ওখানে ও আমাদের লোকজন পাবেন । যদি একান্ত-ই ভালো না লাগে ,দুই-এক মাস পর ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন । আমি চিন্তা করে দেখলাম, ওটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ।

বিকেলে ওরা আমাকে কতগুলি ঐতিহাসিক জায়গা দেখাতে নিয়ে গেলো । লাহোর মুঘল আমলের বিখ্যাত শহর এবং রাজ্-রাজাদের অনেক নিদর্শন রয়েছে । খানিকটা ঘুরে রেল স্টেশনে গিয়ে টিকেট সংগ্রহ করে , খোঁজ খবর নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম । বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে একটা টাঙ্গা ভাড়া করে স্টেশনে চলে গেলাম । ওরা আমাকে ট্রেন-এ উঠিয়ে দিয়ে বিদায় দিলো । সন্ধ্যা ৮টার দিকে ট্রেনে উঠে বসলাম এবং সারা রাত একা-একা ট্রেনে বসে থাকতে হবে । প্যাসেঞ্জার ভর্তি ট্রেন তবে কথা বলার কেউ নেই । আমি দূরের যাত্রী, এক কর্নারে সিট নিয়ে বসে আছি । লাহোর থেকে খবর নিয়েছি , এই ট্রেন এক টানা পেশাওয়ার পয্যন্ত যাবে এবং আমাকে ট্রেন পরিবর্তন করার দরকার পড়বে না । আমি উর্দু বা পাঞ্জাবি জানি না, কারো সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই বা প্রয়োজনে টিকেট চেকারকে জিজ্ঞাসা করতে পারবো । পতিমধ্যে এক আর্মি ইউনিফর্ম পড়া লোক পার্শে এসে বসলো । সে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল এবং দুই-এক একটা বাংলা শব্দ জানতো এবং আমার সঙ্গে শেয়ার করলো । সে জিজ্ঞাসা করলো আমি পূর্ব পাকিস্তানের কোথাকার লোক? আমি বললাম যে আমি কুমিল্লার লোক । সে বললো,” আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ডিউটিতে ছিলাম ।” আমি বললাম , ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমি বেশি দূরে নই । সে কিছুটা অভয় দিয়েছিলো, তুমি ক্যাম্পবেলপুর অনেক বাঙালি পাবে । সে একটি কাগজে নিজের নাম ও ক্যাম্পবেলপুর একজন আর্মি অফিসারের নাম দিয়ে বলেছিলো পরিচয় করিয়ে নিতে । সে কথা প্রসঙ্গে বললো, যেহেতু তুমি অফিসে কাজ করবে, অনেকে-ই তোমার সঙ্গে খাতির করবে । কারণ তোমার সঙ্গে খাতির করলে ওরই লাভ হবে , তুমি কোনো না কোনো কাজে সাহায্যে আসবে । সে মাঝ পথে নেমে গেলো এবং আমাকে বললো ক্যাম্পবেলপুর স্টেশন-এ নেমে খোঁজ খবর নিতে, আমি বললাম, ঠিক আছে ।

রাতে অনেক ঠান্ডা , আমার গায়ে হালকা সুয়েটার ও চাদর , শীত মানে না । মাঝে -মধ্যে ট্রেন থামলে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চা নিয়ে নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নেই । এই করে ভোর ৭টার দিকে ক্যাম্পবেল পুর স্টেশনে ট্রেন থামলে আমি নেমে পড়ি । কিন্তু কোথায় যাবো, এই ভোর সকালে, কোথায় গিয়ে বাঙালি খুঁজে বের করবো । তাছাড়া ওই দিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি । আমি স্টেশন ম্যানেজারের অফিসে গিয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা বললাম ,আমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি এবং কাগজ দেখলাম ।

সে বললো ,তুমি বস, আমি দেখি কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারে কি না । আমি আস্বস্থ হলাম । সে একজন টাঙাওয়ালাকে ডেকে তাদের ভাষায় জিজ্ঞেস করলো আমাকে সাহায্য করতে পারবে কিনা? টাঙাওয়ালা মাথা নেড়ে সায় দিলে। ম্যানেজার বলে,তুমি ওর সঙ্গে যাও,সে তোমাদের লোকদের কাছে নিয়ে যাবে । তুমি তাকে ১০টাকা ভাড়া দেবে । টাঙাওয়ালা আমার সুটকেস নিয়ে আমাকে টাঙাতে বসিয়ে চালাতে লাগলো । রাস্তার দুই দিকেই তাকাচ্ছি ,পুরানো শহর , ছুটির দিন এখনও লোকজন বের হয় নাই ।

এই টাঙ্গা খচ্চর চালিত, যা আধ- ঘন্টার মতো চালিয়ে এক বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খট খট আওয়াজ দিলে এক লোক ভিতর থেকে এসে দরজা খোলে আমাকে দেখে সালাম দিয়ে বলে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন নুতন চাকুরী নিয়ে । আমি বললাম,ঠিকই ধরেছেন। আমি ১০টাকা দিয়ে ওকে বিদায় দিয়ে, ভদ্রলোককে সালাম ও কুশল বিনিময় করে ঘরে ঢুকে দেখি আরও চারজন মেস করে এই বাসায় থাকে । আমি কুশল বিনিময়ের পর নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি কাল সন্ধ্যায় লাহোর থেকে ট্রেনে রওয়ানা হয়েছি এবং সারা রাত লেগেছে ক্যাম্পবেলপুর আসতে । যে আমাকে দরজা খুলে ঘরে নিয়ে এসেছে , ওর নাম ওয়াজেদ সাহেব । সে বললো , লাহোর এখান থেকে অনেক দূরে । তা আপনি লাহোর কেন গিয়েছেন? আমি বললাম যে আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটারে জয়েনিং করার জন্য লাহোর হেড অফিস বলেছে । কাজে-ই আমি ওখানে গিয়েছি । ওয়াজেদ সাহেব বললো, এটা ঢাকা অফিসের ভুল । আপনাকে সরা সরি এখানকার ঠিকানা দিলেই পারতো । আমি বললাম, ক্যাম্পবেলপুরের ঠিকানা দিলে আমি হয়তো আসতাম না । ওয়াজেদ সাহেব বলে , আপনি সারারাত না ঘুমিয়ে আছেন, কাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করে শুয়ে পড়েন ।

এটা একটা ওয়াল দেয়া আলাদা এক তলা বিল্ডিং । আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনাদের বাথরুম কোথায় ? সে বলে বাথরুম পাবেন কোথায়? কাঁচা পায়খানা ,বাহিরে বালতি দিয়ে কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে নিয়ে গোছল করে ফেলেন । সে আমাকে কি ভাবে বালতি দিয়ে পানি উঠাতে হয় দেখিয়ে দিলো । অতিরিক্ত ঠান্ডায় কোনোরকমে গোছল সেরে ঘরে ঢুকে দেখলাম ওয়াজেদ সাহেব নিজেই রুটি বানাচ্ছে । আমি বললাম , আমি তো ভাই রান্না -বান্না কিছুই পারি না । ওয়াজেদ সাহেব বলে, আস্তে আস্তে সবই পারবেন । ওনার রুমমেট বলে , না পারলে অসুবিধা নেই , পাঞ্জাবি মহিলা দেখে বিয়ে করিয়ে দেবো , সব ঠিক হয়ে যাবে । আমি না হেসে পারলাম না, বললাম , আমাকে তো জিজ্ঞাসা করলেন না, আমি দেশে বিয়ে করছি কিনা ? ও বলে , ওতে কোনো অসুবিধা হবে না,” সব কুচ ম্যানেজ হো জায়েগা।” আমি হেসে বললাম , ভাইসাব ,এত সুন্দর উর্দু কি করে শিখলেন? সে বলে , ঠেকায় পড়লে সবই শিখা যায় । আমরা কিছুই জানতাম না , এখন ও শিখি । আমি রুটি খেয়ে ঘুম দিলাম এবং দিনের ১২টা বাজে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম ।

বিকালে ওয়াজেদ,খলিল ও আশরাফ সাহেব আমাকে দোকানে নিয়ে বলে আপনাকে চারপায়া, বেড, কমফোর্টার এবং আরও কিছু টুকি টাকি জিনিস কিনতে হবে, নতুবা কোথায় ঘুমাইবেন ? আমি বললাম যে আমার নিকট কোনো পয়সা -কড়ি নাই ,কি দিয়ে বেড কিনবো ? তাছাড়া , চাকুরী জয়েনিং নিয়ে কোনো সমস্যা হবে কিনা ? ওয়াজেদ সাহেব বললেন যেহেতু আপনি হেড অফিস থেকে এসেছেন , জয়েনিং-এ কোনো অসুবিধা হবে না । এখানে দোকান থেকে মালামাল বাকিতে কিনতে পারবেন ,কিনতে কোনো পয়সা – কড়ি লাগবে না, সব কিছু বাকিতে দেবে । আমি বললাম ,ওরা এতো ভালোমানুষ তাতো জানিনা । সে বলে ওরা জানে যে আপনি ওদের পয়সা না দিয়ে কোনো দিন ও যাবেন না । আমি বললাম, সে ঠিক আছে ,না হয় কিনলাম ,তবে কাজে জয়েনিং দিয়ে নিতে চাই, আবার যদি কোনো সমস্যা হয় সে জন্য একদিন দেরি করতে চাই । ওয়াজেদ সাহেব বললেন , ঠিক আছে ,তাহলে কালকে কিনবো, এই বলে খানিকটা ঘুরা ঘুরি করে বাসায় চলে আসলাম । পরদিন আমি অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করলাম । অফিস থেকে এসে ওয়াজেদ সাহেবকে নিয়ে বেড ,স্টোভ, কেরোসিন,চাল ,ডাল কিনে ঘরে নিয়ে আসলাম । শুরু হলো আমার নুতন রান্না খাওয়ার জীবন । জীবনে কোনো দিন রান্না খাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করি নি । পরদিন শুরু করলাম রান্না ।বাজারে গুঁড়া হলুদ, মরিচ ,মসলা পাওয়া যায় না । চাল,ডাল ,তরকারি সব একত্রে দিয়ে রান্না বসিয়ে ওয়াজেদ ,আশরাফ ও খলিল সাহেবকে ডেকে দেখাই ।

গরুর মাংস ১.৫০ টাকা ,খাসির মাংস ৫.০০ টাকা । মাছ ওজন করে বিক্রি করে ,মাথা ও লেজ ফ্রি । বিক্রি করে মহিষের মাংস ,কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বলে গরুর মাংস । দু’চার দিন রান্না করে খাওয়ার পর আর ইচ্ছা হয় না রান্না করে খাই । শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আর্মি অফিসার্স মেসে খাবো । কিছু দিন খেলাম ও , সে ও নানাহ সমস্যা ,রুটি ,ডাল মহিষের মাংস খেতে খেতে আর সহ্য হয় না । আবার ফিরে আসলাম নিজে রান্না করে খাওয়ার জন্য । ওয়াজেদ, আশরাফ আর খলিল কি ভাবে রুটি বানায় বসে বসে ট্রেনিং নিচ্ছি । আটা গুলে রুটি বানাইতে চেষ্টা করি , জ্যামেতিক ত্রিভুজ, পঞ্চভুজ, ষড়ভুজ তৈরী করতে পারি , কিন্তু রুটি আর হয় না । সে রুটি খাওয়ার মতো না ,আটা গুলতে গিয়ে হয় পানি বেশি দিয়ে ফেলি, নতুবা বেলুনে লেগে থাকে , এতো মহা সমস্যা । আমাকে নিয়ে সবাই মজাক করে , শেষে রুটি বানান ছেড়েই দিলাম । আমার ছাত্র জীবনের এক পরিচিতকে জিজ্ঞাসা করলাম রান্না খাওয়া সম্পর্কে । এক দিন গিয়ে দেখলাম সে ও চাল,ডাল , তরকারি সব একত্রে হাড়িতে বসিয়ে দিচ্ছে । বলে, অপেক্ষা করো ,আজ তোমাকে খাওয়াবো । দেখলাম ওর রান্না একটু ভালোই হয় । এভাবেই চললো নুতন অভিজ্ঞতা আর আমরা চাকুরী জীবন ।

মাঠে দুলা বালি, টিন শেড অফিস, ১০০র ও বেশি লোক কাজ করি ,তার মধ্যে কয়েকজন হাতে গনা বাঙালি । কয়েক দিনের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের মুখ চেনা আরও একজন পরিচিত এসে যোগ দিয়েছে । ও আসাতে-ই আমি কিছুটা একাকিত্ব কেটে উঠলাম । বিকাল ও উইকেন্ডে হাঁটা-হাঁটি গল্প করার লোক পেয়ে গেলাম । দুজনেই ফাঁক-ফোঁকর খোঁজ করতেছি ভেগে যাওয়ার । চাকুরীতো সব সময় পাওয়া যায় না, তা ছাড়া এখানে কাজ হালকা ,অফিসে আসি আর যাই,ধরে রাখবো এবং ইসলামাবাদ ৪৫ মাইল দূরে , কোনো মিনিস্ট্রিতে চেষ্টা করে দেখি, সুযোগ পাইলে চলে যাবো । সে বলে এটা ভালো উদ্যোগ, চেষ্টা করে দেখি ।

আমার কাজ অফিসে আর্মিদের,রেশন, চিকিৎসা ও অন্যান্য ভাতার বিল রেকর্ড করা । কোনো সেক্শনে আমাদের বাঙালি এক পথবা দুই জন কাজ করি । দুপুরে লাঞ্চ টাইম, বাসায় গিয়ে খেয়ে দেয়ে ধীরে সুস্থে চলে আসি ।
অফিসে পাকিস্তানিরা কদাচিৎ ইংরেজি বলে, ইংরেজিতে কিছু জিজ্ঞাসা করলে চেহারায় বিরক্ত , ভাবখানা এমন, উর্দু তাড়া তাড়ি শিখে নাও । অন্য একটা ভাষা শিক্ষা করা দু’চার দিনের ব্যাপার নয় । ক্যাম্পবেলপুর এক বিরাট আর্টিলারি সেন্টার । অফিসে থেকে বের হলে-ই দেখি আর্মি ট্রেনিং হচ্ছে । দেখতে দেখতে কয়েকদিনের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । আমাদের অফিসের লোক ব্যাতিত বাকি সব-ই আর্মি ইউনিফর্ম পড়া । শহরে গেলে অবশ্য সেলওয়ার কামিজ পড়া সিভিলিয়ান লোক দেখা পাই ।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসার প্রাক্কালে অনেক অশান্ত অবস্থা দেখে এসেছি । ওখানে কি হচ্ছে জানার কোনো ব্যবস্থা নাই । আমাদের বাঙালিদের মেসে কারো-ই কোনো রেডিও নাই । আর থাকলে-ই বা কি? আমরা তো উর্দু আর পাঞ্জাবি জানিনা । পত্র পত্রিকা পড়বো, সবই উর্দু পত্রিকা । দুপুরের দিকে সবাই চিঠির অপেক্ষায় থাকি, কারো চিঠি আসলো তো জিজ্ঞাসা করি পূর্ব পাকিস্তানের কি অবস্থা ? কেউ যদি দেশের পরিস্তিতি নিয়ে কিছু লিখে সে আসায় সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকি ।চিঠিতে সীমিত আকারে খবর থাকে ,তা ছাড়া সব চিঠি-ই গ্রাম থেকে আসে পারিবারিক খোঁজ- খবর নিয়ে । বেশির ভাগ চিঠির খবর-ই টাকা-পয়সার সংকট , টাকা পাঠাও এ জাতীয় খবর । দু-একটা চিঠিতে মাঝে মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল কারফিউ সম্পর্কে লেখা, তাও অনেকেই ভয়ে ভয়ে কিছু লিখতে চায় না ।

আমার রুমমেট লস্কর আবু হেনা সে ও আমার মতো একজন ব্যাচেলর । সে ঠিক করেছে তারই এক কলেজ জীবনের পরিচিতাকে বিয়ে করবে । মাসে অন্ততঃ দুইটা চিঠি আসে এবং কবে মিলন হবে এ সব নিয়ে দীর্ঘ লেখা চিঠি । আমি বলি , আবু হেনা তুমি বলবে তোমার বান্ধবীকে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে চিঠি দিতে । দেশে গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসো । এখানে বাসা ভাড়া খুবই কম এবং বাসা করে থাকো । সে বলে ছুটি নিয়ে যাবো বিয়ে করে আসবো । আমি বললাম , এখানে ৫০ টাকার মধ্যে বাসা ভাড়া পাবে , খাওয়া দাওয়ার কষ্ট আর হবে না । সে বললো, দেখি কি করি । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশে এসে তার বান্ধবীকে বিয়ে করেছিল কিনা জানি না । তবে এই মহিলা সাহস করে দেশের অনেক খবর পাঠাতেন,আমরা উপকৃত হতাম ।

আমাদের বাসার সামনে শিয়া মসজিদ এবং তার পার্শেই সেলুন এবং পিছনে খোলামেলা অনেক জায়গা । কিছুদূর হেঁটে গেলে টাঙ্গা পাওয়া যায় । শুনেছি ক্যাম্পবেলপুরের নাম পাল্টিয়ে attock রাখা হয়েছে এবং এটা ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার । বিকেলের দিকে লস্করকে নিয়ে শহরের দিকে যাই । শহরে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল সবই আছে । পোস্ট অফিসে সপ্তাহে অন্তত একবার যাই , পার্শেই এক দরগাহ ,শত শত কবুতর , লোকজনের আসা-যাওয়া আছে । আমাদের দেশের মতো এখানে ও মানুষ জনের দরগার প্রতি আকর্ষণ আছে ।

ক্রমশ:

পূর্ববর্তী নিবন্ধশব্দ শক্তি
পরবর্তী নিবন্ধশিকারী-পর্ব ২
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন