( চার )

রাত পোহাতেই এ্যন্থনি টের পায়, ওকে ফাঁকি দিয়ে ওর খাঁচার পাখী উড়ে পালিয়েছে। ওর শিকার উধাও। ওর সমস্ত মাল কড়ি সাফাই করে রাতের অন্ধকারেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গতরাতে লিলিকে প্রেমালিঙ্গনে বেঁধে নিতেই ওকে সোহাগ করে একগ্লাস শরবত পান করতে দিয়েছিল। তারপর কিছুই আর মনে নেই এ্যন্থনির। লিলিও বেপাত্তা। ওকে তিনতলা ফ্ল্যাটের কোথাও নজরে পড়ছে না। কিন্তু এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে লিলি গেল কোথায়?

উদ্ভ্রান্ত হয়ে তিনতলার উপরে নিচে, এঘর ওঘর, ঘরের কোণায় কাণায় সব জায়গায় সন্দীপ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ লিলিকে সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে। তবু বুঝতে দিলো না। নিজের পুরুষত্ব বজায় রেখে বলল,-‘সারারাত কোথায় ছিলে লিলি?’

লিলি কটাক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ওর চোখদু’টোতে যেন আগুন জ্বলছে। এ্যন্থনির আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে কটাক্ষ করে বলল,-‘ছিঃ সন্দীপ ছিঃ, তুমি এতখানি নিচে নেমে যাবে, কভি সোচা নেহি। দূর হয়ে যাও মেরি নজরোসে।’

সন্দীপ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। চোখমুখ বিকৃতি করে তেড়ে এসে বলে,-‘ছুড়ি, আমার এতবড় লোকসান করে আবার লেকচার দিচ্ছিস তুই।’

উত্তেজনায় র্থর্থ করে গা কেঁপে উঠলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে লিলি। তবু সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে সজোরে বলে ওঠে,-‘চিল্লাও মত্। ধোকেবাজ হো তুম। ফ্রড্ হো। সব কুছ মালুম হো গয়া মুঝে।’

বড়বড় চোখ পাকিয়ে তাকায় সন্দীপ। কিছুক্ষণ থেমে একটা ঢোক গিলে সামান্য নরম হয়ে ফ্যাস্ ফ্যাস্ শব্দে বলল,-‘কি, কি মালুম করেছিস? কি জানিস তুই?’

-‘মুখ সামলে বাত করো এ্যন্থনি। বিবি না সই, কমসে কম এ্যাক অউরতকে নাতে কুছতো শরম করো, ইজ্জত করো। আপনে বারেমে শোচ। বতাও, ওলোগ কৌন থি? ক্যায়া মাঙ্গ রহি থি? কিউ আনেওয়ালে থি কালরাত?’

আমতা আমতা করে তো তো স্বরে সন্দীপ বলল,-‘দ্যাট্’স মাই বিজিনেস্। হু আর ইউ? নো রাইট্ টু ইন্টারফেয়ার ইন মাই বিজিনেস।’

-‘আচ্ছা, তো এহিই হ্যায় আপকা সাইড্ বিজনেস্। মুঝে ইতনি বড়ি ধোকা, ইতনি বড়ি সাজা। কিঁউ দিয়া তুমনে? বতাও কিঁউ দিয়া ইতনি বড়ি ধোকা।’

অট্টহাসি সন্দীপের। বলে,-‘হুঁম্, ছন্নছাড়া জীবন আমার। ধান্দা করে খাই। মেয়েছেলে নিয়ে ব্যবসা করি। ওদের নিয়ে সংসার করবো ভাবলি কি করে! প্যায়ার বেয়ার সব মামুলি চিজ্। বেকার কি বাত। ওতে রুপিয়া আসবে না, বুঝলি? দফা হয়ে যা।’

এবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল লিলি। ক্ষোভে দুঃখে অপমানে ক্রোধ সম্বরণ করতে পারল না। সন্দীপের গায়ের ওপর আঁছড়ে পড়ে শক্তহাতে ওর জামা খিঁচে ধরে বলে,-‘তাহলে কেন ভালোবাসার নাটক করেছিলে? কেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমায় নিয়ে এসেছিলে? বলো দ্বীপ বলো! তোমার কি ক্ষতি করে ছিলাম?’

-‘আঃ, প্যান্ প্যান করিস না! জাহান্নামে যা। আমার জামা ছাড় তুই। ছাড় বলছি!’
বলেই লিলিকে এক ধাক্কা। লিলিও নাছোরবান্দা। শুরু হয় হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি। সন্দীপ পা তুলে লাথি মারতেই লিলি ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,-‘তুমি রেহাই পাবে ভেবেছ। ভান্ডা ফোঁড় দুঙ্গি ম্যায়। মুঝে সবকুছ মালুম হ্যায়। কোই পরোওয়া নেহি মুঝে। যা কে পুলিশকো সব বতা দুঙ্গী।’ বলেই উত্তপ্ত মেজাজে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে চলে যায়।

সন্দীপ বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বেকায়দায় নিজেই নিজের জালে ফেঁসে গেল। পড়ে যায় বিপাকে। উভয় সংকট ওর। আগে-পিছে দুদিকেই পথ বন্ধ। মুক্তির পাবার উপায় নেই। চেয়েছিল, এক ঢিলে দুইপাখী শিকার করবে। কিন্তু তা আর হলো না। খেল ওখানেই খতম হয়ে গেল সন্দীপের। ওর মতো একজন ধূর্ত নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষকে কথায় তীর ছুঁড়ে বেমালুম কাবু করে ফেলল লিলি। অগত্যা, নিজের অপরাগতার কারণে লিলির কাছে পরাস্ত হয়ে শামূকের মতো নিজেকেই গুটিয়ে ফেলে সন্দীপ। মুখে একটা রা নেই। কোনো প্রতিবাদ নেই। দিনের শেষে সূর্য্য ডোবার পর অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই বাধ্যতামূলক স্বামী-স্ত্রীর মতোই বসবাস করতে থাকলে সন্দীপ ছিনিয়ে নেয়, স্বামীত্বের পূর্ণ অধিকার। লিলিও সামাজিক ও পারিবারিক রীতি নীতি অনুসারে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও পবিত্র ভালোবাসাকেই সাক্ষী রেখে নিজেকে সর্বান্তকরণে সঁপে দেয় স্বার্থাণ্বেষী সন্দীপের একান্ত কামনার জলন্ত অগ্নিকুন্ডে। অথচ লিলি যখন সন্তনসম্ভবা, তখনই বেঁকে বসে সন্দীপ। নির্দিধায় অস্বীকার করে লিলির গর্ভে সন্তর্পণে লালিত ওর ভালোবাসার ফসলকে। ওর অনাগত নিস্পাপ সন্তানকে। বলে,-‘এ পাপ আমার নয়। গিরা দে। মার ডাল উসে!’

লিলির হাতে হাজার ডলারের একটা নোটা গুঁজে দিয়ে বলে,-‘প্যাসা চাইয়ে? লে প্যাসা লে। মেরা পিছা ছোড়।’

লিলি নাছোড়বান্দা। কড়োজোরে কত মিনতি করলো। অনুনয় বিনয় করে বলল,-‘এ্যাসী বাত কেন বলছ দ্বীপ? ম্যায় তো তুমহারি হু। ইয়ে বাচ্চা ভি তুমহারি হ্যায়। হামারি প্যায়ার কি নিশানি!’

-‘আঃ, তং করিস না! ভাগ এহাসে। আই সেইড্ গেট্ আউট!’

গর্জে ওঠে সন্দীপ। পাষান হৃদয় ওর। কোনভাবেই গলার নয়। ওকে যে কোন্ ধাতূ দিয়ে বিধাতা গড়েছিলেন, এতটুকু করুণা, দয়া-মায়া, আবেগ-অনুভূতি কিছুই নেই ওর শরীরে। সবই কচুপাতার জলাবদ্ধের মতো ক্ষণস্থায়ী। ওর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই ঘটতে দেখা যায় না। লিলিও হার মানার পাত্রী নয়। বড্ড শক্ত মেয়ে। এসেছিল একটা বিহীত করতে, সমাধান করতে, সন্দীপের সাথে একটা বোঝা পোড়া করতে, সমঝোতা করতে। অথচ গ্রাহ্যই করলো না সন্দীপ। উল্টে দিনে-দূপুরে ষ্টোরের এতগুলো মানুষের সম্মুখেই অমানবিক ও কান্ডজ্ঞানহীনভাবে ওকে বেইজ্জত করলো। গলা ধাক্কা দিয়ে ওকে অফিস ঘর থেকে বের করে দিলো। কিন্তু অবহেলিত, প্রবঞ্চিত, নিগৃহীত লিলির চোখে যে আগুন জ্বলতে দেখেছিল, সন্দীপ তাতেই বুঝতে পেরেছিল, এর কিমত ও’কে পাই পাই করে চুকাতে হবে। ঐ আগুনে একদিন ও’কেও জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে হবে।

(পাঁচ)

লিলি সুশিক্ষিতা, রুচীশীল, বুদ্ধিমতী, ধৈর্য্য ও সহনশীলা মেয়ে। মাতা-পিতার মুখে চূণকালী ঘসে দিয়ে যেদিন অন্ধ ভালবাসার মোহে সন্দীপের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল, সেদিন থেকে আর পিছন ফিরে তাকায় নি। কিছুতেই সে হার মানবে না। হার মানার পাত্রী সে নয়। ও মুখ খুললে সন্দীপের নির্ঘাৎ হাজত বাস। হয়তবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। কিন্তু ওতো অনেক আগেই পারতো সন্দীপকে ধরিয়ে দিতে। ওর সমস্ত বৈষয়িক সম্পত্তি আত্মসাৎ করে ওকে ভিক্ষারী করে একেবারে পথে বসিয়ে দিতে পারতো। কুৎসা রটিয়ে ওর উঁচু মাথাটাকে একেবারে হেট্ করে দিতে পারতো। অথচ লিলি তা করেনি। কিন্তু কেন? কেন এতকিছু জানবার পরও এতবড় একটা আঘাত নীরবে নির্বিঘ্নে সহ্য করে চলেছে লিলি?

তবে কি সত্যিই ওকে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছিল লিলি? সত্যিই কি নিঃভৃতে একান্ত আপন করে ওকে পেতে চেয়েছিল লিলি? দিনের পর দিন প্রতারিত, প্রবঞ্চিত হয়েও কেন সন্দীপের মতো একজন হিংস্র ব্যভিচারি পুরুষ মানুষের কাছে আত্ম সপর্মণ করেছিল লিলি? যাকে হাজার হাজার ডলার আর পাউন্ডের বিনিময়ে অত্যাচারী পাষন্ডের হাতে সন্দীপ নিজেই তুলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ এতসব ঘটনা ঘটে যাবার পরেও ওকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখছে লিলি? সত্যিই ওর সুকোমল হৃদয়ে সন্দীপকে ঠাঁই দিতে পারবে লিলি? কিন্তু ঠাঁই দেবে কোন্ অধিকারে? কিসের জোরে? কোন্ সূত্রে? ওতো বিয়েই করেনি লিলিকে! তা’হলে!

আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নতুন করে মুগ্ধ ভালোলাগার আবেশ দেহে-মনে ছড়িয়ে পড়ে সন্দীপের। স্পর্শ করে ওর পাষাণ হৃদয়কে। সিক্ত হয়ে ওঠে। ভিজিয়ে একেবারে নরম করে দেয় ওর অন্তরাত্মাকে। নড়ে ওঠে ওর হৃদস্পন্দন। আবেগের প্রবণতায় হৃদয়-মন-প্রাণ মুহূর্তে সজীব হয়ে ওঠে। পুলক জেগে ওঠে। মনকে বিকশিত করে। টের পায়, এক অভিনব আনন্দানুভূতির তীব্র জাগরণ। এর নামই কি প্রেম-ভালোবাসা! ভালোবাসায় এত সুখ! এত আনন্দ!

খুশীর প্লাবনে হৃদয়ের দুকূল ভরে ওঠে সন্দীপের। সংম্বরণ করতে পারে না। একসময় নিজেই আবিস্কার করে, লিলিকে সত্যিই সে ভালোবাসতে শুরু করেছে। আজ যেন লিলিই ওর জীবনের সব। ওর সুখ, শান্তি, আশা-ভরসা সব। লিলিকে বাদ দিয়ে আজ আর কিছুই ভাবতে পারছে না। মনে মনে সন্দীপ অবাক হয়। ওর এই আবেগ-ইচ্ছানুভূতিগুলি এতকাল কোথায় লুকিয়েছিল!

হঠাৎ অপরাধবোধ উদয় হয়ে অনুতাপ অনুশোচনায় মনকে প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত করতে থাকে লজ্জিত সন্দীপের। ক্ষণপূর্বের বেদনানুভূতির দংশণে ওকে বিচলিত করে তোলে। মনে মনে ভাবলো, স্বেচ্ছায় নিজের গুনা কবুল করলে পাপ মুক্ত হয়। ভগবানও মাপ করে দেয়। লিলিতো রক্তে মাংসে গড়া একজন সরল সহজ মহিলা, ওকি কোনদিন পারবে না ওকে ক্ষমা করতে। ওকি পারবে না, ওর অন্তরের নিঃসৃত ভালোবাসা দিয়ে সন্দীপের জীবনকে নতুন করে সাজাতে! একটি সুখের রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলতে!

ভাবতেই বিদ্যুতের শখের মতো শরীরের সমন্ত শিরা-উপশিরায় এক অনবদ্য মধুর ভালোলাগা আর ভালোবাসার একটা কোমল নিদারুণ অভিনব অনুভূতি সঞ্চালন হতে থাকে সন্দীপের। সবুর সয় না ওর। হঠাৎ নতুন উদ্যাম-উদ্দীপণায় একরাশ স্বপ্ন নিয়ে উ™£ান্ত হয়ে অফিস ঘর থেকে ঝড়ের বেগে উর্দ্ধঃশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে।

ততক্ষণে ধূয়োর মতো ঘন কূয়াশায় ছেয়ে গিয়েছে চারিদিকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা কিছু। আবছা ক্ষীণ আলো অন্ধকারে হঠাৎ ম্যানেজার এ্যন্থনিকে দেখে আমরা দুজনেই চমকে উঠি। ভাবলাম, এক্ষণিই আবার চেঁচামিচি শুরু হয়ে যাবে। গালিগালাজ করবে। কিন্তু না, তা আর হলো না। হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

ধীর পায়ে লিলির সন্নিকটে এগিয়ে আসে সন্দীপ। নরম হয়ে মৃদু স্বরে বলল,-‘মুঝে মাপ কর দো লিলি। ঘর চলো। অনবরত শিশির পড়ছে। ভুখার হবে। এই ঠান্ডার মধ্যে করছ কি? আও উঠো, ঘর চলো!’
বলেই অপরাধির মতো ক্ষমা প্রার্থীর চোখে তাকায় লিলির মুখের দিকে। ইত্যপূর্বে আমি চুপি চুপি নৈঃশব্দে সরে গেলাম। লিলি তক্ষুণি সাপের ফণার মতো তীব্র কন্ঠে ফোঁস করে ওঠে। -‘আবার কি মতলবে! জরুর কোই নয়া চক্কর চালায়া! আব জান বুঝকর দোবারা ধোকা নেহি খাউঙ্গী ম্যায়। চলে যাও ইঁহাসে। মুঝে একেলা ছোড় দো।’

সন্দীপ সামান্য সড়ে এসে লিলির গা-ঘেষে দাঁড়ায়। লিলির কথায় এতটুকু রাগাণ্বিত হলো না। অসন্তুষ্টও হলো না। সেই প্রথম দেখার উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় চেহারা নিয়ে কিছু বলার ব্যকুলতায় যেন সুযোগ খুঁজজে। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করে প্রসন্ন মেজাজে টানতে থাকে। হঠাৎ সচ্চা প্রেমিকের মতো আবেগে আপ্লুত হয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে বলে ওঠে,-‘মুঝসে সাধী করোগী?’

ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও লিলি নিরুত্তর, নির্বিকার। প্রচন্ড অবাক হয় মনে মনে। কি শান্ত-স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, কোমল, নির্মল, অনাবিল মুখ সন্দীপের। ক্রোধের লেশমাত্র নেই। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় লিলি। এ যেন এক নতুন মানুষ। কোনো অজ্ঞাত কূলশীল ব্যক্তি। যাকে আগে কখনোই দ্যাখে নি। তবু বিশ্বাস হয় না নিজের কানদু’টোকে। অপ্রত্যাশিত ওর আগমন, প্রেমিকসুলভ আচরণ, ওর উপস্থিতি লিলিকে বেশ কিছুক্ষণ বুদ করে রাখে।
মুহূর্ত্যের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সন্দীপের উষ্ণ স্পর্শে ওর আপাদমস্তক চমকে ওঠে। রক্তরাঙা সাশ্রু নয়নে চোখ মেলে তাকায়। মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণায় চোখদু’টো ওর চিক্চিক্ করে ওঠে।
ইতিপূর্বে ওর মসৃণ পৃষ্ঠদেশে আলতো স্পর্শে হস্ত সঞ্চালন করে সন্দীপ বলল,-‘অপরাধী আমিই! জানি এর কোন ক্ষমা নেই। কারণে অকারণে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আঘাত করেছি। তাই আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমায় ফিরিয়ে দিও না।’

পকেট থেকে একটা ব্যাঙ্ক চেক্ বের বলল,-‘নও, তোমার যত ইচ্ছে টাকার সংখ্যা ভরে নাও। বাধা দেবো না। স্থাবর অস্থাবর বৈষয়িক সম্পত্তির আজ আমার যা কিছু আছে, সবই তোমার। আমি সর্বান্তকরণে সব তোমাকেই সঁপে দিলাম। আর জীবনের বাকীদিনগুলি যদি তোমায় নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি, নিজেকে ধন্য ও ভাগ্যবান মনে করবো। আর যাই হোক, অন্তত একটিবার প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ আমায় দাও। প্রতিজ্ঞা করছি, এ পথ আমি বর্জন করবো। তোমার মনের মতো করেই নিজেকে গড়ে তুলবো, কথা দিলাম!’

হ্যাঁ না ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্য করলো না লিলি। গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মুখ ফিরিয়ে রাখে। বিষন্ন হয়ে সন্দীপ বলল,-‘ওঠো লিলি, ঘর চলো লক্ষিটি। রাত বাড়ছে। কমসেকম নিজেকে সুধরে নেবার একবার মৌকা তো দো। দেখো, এক্ষুণি লোকজন সব ভীড় করবে এসে। বিশ্রি একটা কান্ড ঘটে যাবে। সেটা কি ভালো হবে! লিলি, এ্যাই লিলি! শুন রহি হো না তুম? মুঝসে বাত নেহি করোগে? ঠিক হ্যায়, ম্যায় হামেশাকে লিয়ে যা রাহা হুঁ। কক্ষনো তোমার সামনে আর আসবো না। পারো তো ক্ষমা করে দিও।’
বলে ব্যাঙ্ক চেকটা লিলির হাতে গুঁজে দিয়ে পিছন ফিরতেই লিলি ওর পশমাবৃত বুকের মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হু হু করে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অপ্রস্তুত সন্দীপ মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলেও ও’কে সজোরে উষ্ণ বক্ষপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতেই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে লিলির মন-প্রাণ সারাশরীর। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে সন্দীপ বলল,-‘আই লাভ ইউ লিলি, মাই সুইট্ হার্ট। মুঝে মাপ কর দো। ’

সন্দীপের পিঠে আলতোভাবে একটা চিমটি কেটে লিলি বলল,-‘হুঁমঃ, ঝুটে, বেশরম, লফঙ্গে কাঁহিকা। তুমনে মুঝে বহত দুঃখ দিয়া!’

ক্ষীণ আলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখলাম, মান-অভিমানের ইতি টেনে দু’জনে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে সহাস্যে হঠাৎ ঘন কূয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সমাপ্ত

যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন