জীবনে চলার পথে আমাদের অনেক মানুষের সান্নিধ্যে আসতে হয়. এদের এক এক জনের প্রভাব আমাদের জীবনে এক এক রখম অভিজ্ঞতা বয়ে আনে. এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার হয়ে উঠেন আমাদের জন্য অনুকরণীয়. এমনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব মিস্টার ক্রোন-  টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের এক এলিমেন্টারি স্কুলের সাবেক প্রিন্সিপাল. তার সাথে আমি কাজ করেছি খুবই অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু শিখেছি বিস্তর.

সে প্রায় দশ এগারো বছর আগের কথা যখন আমি কানাডায় আমার কাংখিত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছি. আমি যে স্কুলে সেটেলমেন্ট ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করি, সেই স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন মিস্টার ক্রোন. আমি তখন সবে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় এসেছি. কানাডার স্কুল ব্যবস্তা, ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক বিষয়ে খুব বেশি একটা জানতাম না. মিস্টার ক্রোনের স্কুলে অভিভাবকরা অবাধে স্কুলে প্রবেশ করতে পারতেন, কোনো এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে যেতেন. স্কুলের সেক্রেটারি, প্রশাসন সবাই অসাধারণ সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন. আমার প্রথম প্রথম মনে হতো সব স্কুলই মনে হয় একই রখম enabling environment . কিন্তু ধীরে ধীরে যখন অন্নান্য স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, তখন বুঝলাম সব স্কুল একই রকম welcoming নয়. যাহোক আমার কাজের এই স্কুলটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী. আর ব্যতিক্রমী এই পরিবেশ তৈরিতে প্রিন্সিপালের ভূমিকা ছিল অনন্য. আমি যখন এই স্কুলে যোগ দেই, মিস্টার ক্রোন তখন প্রিন্সিপাল হিসেবে ওই স্কুলে ছয় বছর. প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রিন্সিপাল বদলের নিয়ম থাকলেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং ছাত্র অভিভাবকদের অনুরোধের কারণে সাত বছরের আগে তিনি এই স্কুল ছেড়ে যেতে পারেননি.

আমি প্রায়ই অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম ছোট বাচ্চাদের সাথে মিস্টার  ক্রোন এর ব্যবহার. আমি কখনো তাকে কোনো বাচ্চার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি. হলওয়ে ধরে হেটে যাওয়ার সময় দেখতাম মিস্টার ক্রোন হাটুগেড়ে বসে সমান উচ্চতায় কোনো বাচ্চার সাথে কথা বলছেন অথবা মনোযোগ দিয়ে  শুনছেন তাদের কথা. অনেক সময় লক্ষ্য করতাম বাচ্চাদের কানে কানে কি বলতেন এবং বুকপকেট থেকে লুকিয়ে কিছু একটা বের করে বাচ্চাদের দিতেন. অন্য কেউ দেখতে পারতো না. কিন্তু বাচ্চাটা বিশ্বের অমূল্য রতন হাতে পাওয়ার খুশি নিয়ে একরাশ আত্মবিশ্বাস আর অনুপ্রেরণা নিয়ে ক্লাসে ফিরে যেত. বাচ্চাদের সাথে মেশার এবং তাদেরকে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল তার.

আমার কাজে জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো তুষারপাত. একদিন এরকম এক সকালে আমি বাস থেকে নেমে হেটে স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছি. তাকিয়ে দেখি স্কুলের কেয়ার টেকারের সাথে আরো একজন দাঁড়িয়ে তুষারে ঢাকা রাস্তা পরিষ্কার করছেন. কাছে যেয়ে দেখলাম উনি স্কুল প্রিন্সিপাল মিস্টার ক্রোন. অভিবাবকদের যাতে ছোট বাচ্চাসহ স্ট্রলার ঠেলে স্কুলে আসতে কষ্ট না হয়, সেজন্য নিজেই সাইড ওয়াক পরিষ্কার করছেন. কেয়ার টেকাররা নিজেদের দায়িত্বের অতিরিক্ত কোনো কাজ সচরাচর করেন না. অভিভাবকদের সুবিধার কথা ভেবে মিস্টার ক্রোন স্কুলের সীমানার বাইরের সাইড ওয়াক পরিষ্কার করে চলেছেন. ভীষণ শ্রদ্ধা জন্মালো তার প্রতি. মহিলা বৃদ্ধ এবং শিশুদের প্রতি তার আলাদা এক শ্রদ্ধাবোধ এবং স্নেহ কাজ করতো. অভিবাবকরা কোনো সমস্যা নিয়ে আসলে শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় দিতেন. একদিন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে বাচ্চাদেরকে উনি বুকপকেট থেকে বের করে কি দেন যে তারা খুশি মনে ক্লাসে প্রবেশ করে. হাসতে হাসতে উনি উত্তর দিলেন যে আমি যদি প্রতিশ্রুতি দেই যে ক্লাসে শিক্ষকদের কথা শুনবো, তাহলে তিনি এরখম জিনিস আমাকেও দিবেন. বলেই বুকপকেট থেকে একটা কেন্ডি বের করে দিলেন. বাচ্চাদেরকে ডিসিপ্লিনের মধ্যে রাখার অভিনব এই প্রয়াস অন্যান্য স্কুলের প্রিন্সিপালরা অনুসরণ করেন বলে শুনিনি. ছোট বাচ্চাদেরকে বুঝাতে গেলে শুধু বকা আর শাসন দিয়ে হবে না. তাদেরকে পেতে হলে তাদের অন্তরকে ছুঁতে হয়. আদর আর মায়া দিয়ে মিস্টার ক্রোন তাই করতেন প্রতিদিন. ছোট বড় সবাইকে তিনি যার যার জায়গা থেকে বিচার করতেন, নিজের দায়িত্বের বাইরে এসেও মানুষকে সাহায্য করতেন. এটাই হয়তো সাধারণ আর অসাধারণ মানুষের পার্থক্য. অসাধারণ মানুষেরা নিজেদের সীমাবদ্দতাকে ডিঙিয়ে অন্যকে সাহায্য করার জায়গা তৈরী করে নেন. সংখ্যায় কম হলেও এসব মানুষ সমাজের পরিবর্তনে অনেক বড় ভূমিকা রাখেন. সমাজের অর্ধেক মানুষও যদি মিস্টার ক্রোন এর মতো হতো, তাহলে হয়তো পাল্টে যেত সমাজ, মানুষ সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠতো মানুষের জন্য. মানুষের বুকপকেট থেকে তখন কেন্ডির সাথে সাথে বেরিয়ে আসতো সব মানুষের কল্যাণের জন্য নিখাদ ভালোবাসা.

নওশিন হামিদ চৌধুরী
টরন্টো থেকে

[asa]B013WU0CZW[/asa]

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন