নীলা ফেসবুকে এক অদ্ভুত নামের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে খানিক্ষন হাসলো। যুবক টাইপের একটি ছেলে অনেকটাই নীলার বয়সী। নাম, আশফাক আলী। ছেলেটির প্রোফাইল আনলক করা ছিল। নীলা স্রেফ কৌতুহলবশতঃ ছেলেটির পেজে যেয়ে গট গট করে ওর পুরানো পোষ্টগুলি পড়তে থাকলো।

নীলার পরিচয়টা একটু শোনা যাক। নীলার মায়ের নাম সায়রা বানু আর বাবার নাম রিচার্ড। নীলারা কানাডার টরেন্টো শহরে গ্রান্ড পা ও গ্রান্ড মা এর সাথে থাকে। সায়রা বানু খুব ছোট অবস্থায় এদেশে এসেছিলো এক নিঃসন্তান কানাডিয়ান দম্পতির এডপ্টেড চাইল্ড হিসাবে। সায়রা বানু হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক হারিয়ে যাওয়া অনাথ শিশু, কিভাবে কিভাবে মুক্তি যোদ্ধারা সায়রা বানুকে খুঁজে পেয়ে ভারতে শরণার্থী শিবিরে রেখে আসে। তার পর, সেখান থেকে ভারতের এক এতিম খানা থেকে মূলত এই কানাডিয়ান দম্পতি অর্থ্যাৎ নীলার গ্রান্ড পা ও গ্রান্ড মা সায়রা বানুকে কানাডার টরেন্ট শহরে নিয়ে আসে।

সায়রা বানু কানাডার আলোবাতাসে বেড়ে উঠে একসময় হ্যাডলি নামে এক কানাডিয়ান সাদা যুবককে বিয়ে করে। বছর দুয়েকের মধ্যেই নীলার জন্ম হয়। নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে সায়রা বানু এই ভিনদেশে নিজে যেমন অনেক কষ্ট করে বাংলা ভাষা, বাংলা কৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছে, ঠিক তেমনিভাবে মেয়ে নীলাকেও নিজের মতো করে তিল তিল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যার ফলাফল হিসাবে আজকের এই নীলা ছোট্ট বদ্বীপের দেশ বাংলাদেশের প্রতি সীমাহীন আগ্রহ ও কৌতহূল। সায়রা বানু পরে বড় হয়ে তার দত্তক বাবা মাযের সাথে তার নিজ বাবা মার খোঁজে ভারতের সেই এতিম খানায় এসেছিল, কোনো লাভ হয় নি। সায়রা বানু কিছুতেই তার গ্রামের নাম, জেলার নাম মনে করতে পারে না, তাই জন্মভূমির প্রতি তার দুনিবার আকর্ষণ তাকে সারাক্ষন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। নীলার বয়স যখন মাত্র আড়াই বছর তখন ওর বাবা হ্যাডলি একটি গাড়ি একসিডেন্টে মারা যায়। নীলা তার বিলাতি নানা নানী ও মা সায়রা বানুর সাথে হেসেখেলে বেড়ে উঠে এখন কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় বছরের ছাত্রী। ছোটোবেলা থেকেই নীলা তার মায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক গল্প শুনেছিলো। তাই, সঙ্গত কারণেই, বাংলাদেশের প্রতি এতো দুর্বলতা থাকায় নীলা আজ ফেস বুকে সুদূর বাংলাদেশের এই যুবকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট নিয়ে আরো কিছুক্ষন গবেষণা করতে থাকলো । হটাৎ করে যুবকটির একটি পুরাতন পোষ্টে নীলার চোখ আটকে গেলো:

‘আজ ১৩ই ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবস থেকে মাত্র কয়ে দিন বাকি, আজ আমার দাদা, দাদিমণির মৃত্যু বার্ষিকী। আজ থেকে বহু বছর আগে আজকের দিনে রাজাকারেরা আমার দাদিমনিকে আরো কিছু মহিলা সহ আমাদের পাড়ার স্কুল মাঠের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এসে পাকহানাদার বাহিনীরা দল বেঁধে উপুর্যপরি ধর্ষণ করেছিল। পরে দাদু এগিয়ে এলে, দাদুকে ওরা চ্যাংদোলা করে এনে স্কুল মাঠের পূর্বদিকে বট গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দাদুর সামনে দাদিমনিকে খোলা মাঠে আবারোও ধর্ষণ করতে থাকে। লোক মুখে শুনেছি, সেদিন আমার দাদিমনি ও দাদার গগন বিদারী চিৎকারে পুরা এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারানো অবস্থায় পাকবাহিনীরা দাদুমনিকে ও দাদুকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। প্রাণ ভয়ে সবাই এদিক ওদিক ছুঁটে পালায়। আমার বাবা ভয় পেয়ে গোয়াল ঘরের এক কোনায় লুকিয়ে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু বাবার এক ছোট বোন ছিল বাবা তাকে অদ্যাবধি খুঁজে পাইনি। আমার বৃদ্ধ বাবা আজও দরজায় কেউ করা নাড়ালেই আসায় বুক বেঁধে থাকে এই বুঝি তার বোন এলো।
আমি ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি, আজকের দিনে প্রতিবছর নিয়ম করে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কিছু বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা দল বেঁধে এসে স্কুল মাঠের সেই বট গাছটির নিচে ফুলের তোরা রেখে বাবার সাথে দেখা করতে আসে। বাবাকে নিয়ে ছবি তোলে, এটা ওটা কথা বলে, যাওয়ার আগে বাবাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যায় । ওঁরা চলে যাবার পরে, আমি রোজ একা একা সেই বট গাছের নিচে যেয়ে সেই ফুলগুলিকে পরম স্নেহে স্পর্শ করি, যেন আমি আমার দাদু ও দাদিমনিকে স্পর্শ করছি। বাবা ওঁদের দেয়া টাকা গুলিকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন। আমার দায়িত্ব ছিল সেই টাকাগুলিকে মাঝে মাঝে গুনিয়ে দেখা। গত মাসেও আমি ট্রাঙ্ক খুলে বাবার সামনে গুনে দেখি মোট এক লক্ষ বাষট্টি হাজার টাকা। বাবার মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। আমি বাবাকে বললাম, ‘বাবা এত টাকা পয়সা দিয়ে কি করবে ?’ বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন ‘এ টাকা তো আমার টাকা না বাপজান, এটা হচ্ছে দেশের টাকা, এ টাকা দিয়ে এমন কিছু করতে চাই যাতে গ্রামের লোকের উপকার হয়। বাপজান, তুই একটু শহরে যেয়ে খোঁজ নিবি একটি ডিপ টিউব অয়েল বসাতে কত টাকা লাগে? চৈত্র মাসে পানির অভাবে জমির মাটি একেবারে খাঁ খাঁ করে, একটি ভালো টিউব অয়েল বসালে লোকেরা ভালো ফসল ফলাতে পারতো।’ আমি বাবাকে আশস্ত করলাম, ‘অবশ্যই আমি খোঁজ নিবো বাবা।’

আমি গতকাল শহর থেকে খোঁজ নিয়ে সন্ধ্যার দিকে বাসায় এসে দেখি আমাদের ঘরের দরজা ভাঙ্গা, আমি দ্রুত ভিতরে ঢুকে দেখি মাকে মুখে কাপড় গুঁজে দুই হাত দুই পা খাটের পায়ের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। মাথার চুল আলুথালু, গায়ের কাপড় এলোমেলো, মা সমানে গোঙ্গাচ্ছেন। মায়ের সামনে বাবার সেই ট্রাঙ্ক মেঝেতে উপর হয়ে পরে আছে, এদিক সেদিক কাগজ পত্র, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি দ্রুত যেয়ে মায়ের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলাম, মায়ের মুখে গুঁজে দেয়া কাপড় বের করলাম। বাসায় বাবা ছিলেন না, বাবা বাজারে গিয়েছিলেন । এরই মধ্যে কেউ হয়তো বাবাকে খবর দিয়েছিলো, বাবা হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে ঘরে ঢুকে মা কে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদলেন, মা এর কাপড় ঠিক করে মেঝেতে উপর করা ট্রাঙ্কটিকে সোজা করে দেখলেন ঠন ঠন করছে, একটি টাকাও নেই। মা ও বাবা চিৎকার করে কাঁদছেন। আমার মা ও বাবার কান্নার শব্দ তরঙ্গ আমাদের বাড়ির সাথে লাগানো সেই স্কুল মাঠের দেয়ালে প্রতিদ্ধনিত হয়ে আরোও করুন শোনালো। আমাদের পুরোনো বাড়ির আধা ভাঙা ইটের টুকরোগুলি, স্কুল মাঠের পূর্ব দিকের সেই বট গাছ সাক্ষী গোপালের মতো নির্বাক হয়ে বহু বছর পরে আরেকবার এক যুগল মানব-মানবীর আর্তনাত ও কান্না শুনতে পেলো। আর আমি দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুধাবন করলাম লোক মুখে শুনা ১৯৭১ সালের আমার সেই দাদিমনি ও দাদার গগনবিদারী চিৎকার ও কান্নার সাথে আজকের আমার বাবা-মায়ের কান্নার শুধু সময়ের পার্থক্য পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা।’

নীলা এক নিঃশ্বাসে লেখাটি পড়ে এক দৌড়ে পাশের রুমে মায়ের কাছে গেলো। মাকে ফেস বুকের সেই ছেলেটির কথা বলে তাঁর পুরোনো পোষ্টটি আরেকবার দ্রুত মাকে পড়ে শুনালো। নীলা তাঁর পড়া সম্পূর্ণ শেষ করতে পারলো না। নীলাকে মাঝপথে থামিয়ে মা তাকে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে সেই ছেলেটিকে ফোন করতে বললেন। নীলা মায়ের কথামতো মেসেঞ্জারে ফোন দিলো। মা ছোঁ মেরে নীলার হাত থেকে ফোন নিয়ে বেড রুমে যেয়ে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। কিছুক্ষন পড়ে মা ঘর থেকে দৌড়ে এসে নীলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন , ‘মা রে, এই আশফাক আলী তোর কাজিন, আমি ওর বাবার হারিয়ে যাওয়া সেই বোন।’
পরের দিনের সন্ধ্যার দিকের ফ্লাইটে সায়রা বানু তার মেয়ে নীলা, দত্তক প্রাপ্ত বাবা মাকে নিয়ে সপরিবারে টরেন্টো থেকে বাংলাদেশের আশফাক আলীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
—-
ঢাকা এয়ারপোর্টে আজ সচারচরের চেয়ে একটু বেশি মানুষের ভিড়। চ্যানেল আই, এ টি এন বাংলা, এন টিভি প্রভৃতি চ্যানেলের সাংবাদিকরা সায়রা বানু, নীলা ও নীলার কানাডিয়ান অতি বৃদ্ধ গ্রান্ড পা ও গ্রান্ড মাকে নিয়ে লাইভ কভারেজ করার জন্য প্যাসেঞ্জার পিক আপ এর জায়গায় জটলা পেকে আছে আর মাঝে মাঝে ঘড়িতে সময় দেখছে। আজ পঞ্চাশ বছর পরে ভাই-বোনের মিলন হবে। এই সংবাদ পত্রিকাগুলিতে ভালোই কভারেজ পাবে।আশফাক আলী কে আজ বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে। আশফাক আলীকে নীল রঙের জিন্স এর প্যান্ট ও সাদা শার্টে চমৎকার লাগছে। আশফাক আলীর বাবাকে নতুন ইস্ত্রি করা পাজামা পান্জিবে পরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আশফাক আলীর মা পায়ে বাতের ব্যাথার কারণে এতদূর এয়ারপোর্টে আসতে পারেননি।

নীলাদের প্লেনটি নিচু হয়ে রানওয়ের দিকে নামছে। সায়রা বানু প্লেনের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ঢাকা শহরের অজস্র দালান কোঠা, সবুজ ঘাস ও বদলে যাওয়া বাংলদেশ দেখে খুশিতে ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছেন। নীলা জীবনের প্রথম বাংলাদেশ, তাঁর কাজিন ও আঙ্কেলকে দেখার জন্য উত্তেজনায় ছটফট করছে। নীলার বিলাতি গ্রান্ড পা ও গ্রান্ড মা সেই পঞ্চাশ বছর আগে ইন্ডিয়াতে এসেছিলো, বাংলাদেশে এই প্রথম। তবে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারনা, তৃতীয় বিশ্বের হতো দরিদ্র এক দেশ, তথাপি এত বছর পরে প্লেনের জানালা দিয়ে উৎসুক হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছে প্রচুর হাইরাইজ বিল্ডিং, ছবির মতো রাস্তাঘাটে ফ্লাইওভারে সারি সারি গাড়ি, তাঁদের ধারণার বাংলাদেশ এই বাংলাদেশ যেন আকাশ পাতাল ফারাক।

অবশেষে, বহু যুগ পরে ভাই/বোনের মিলন সম্পন্ন হলো, নীলার বিলাতি গ্রান্ড পা ও গ্রান্ড মা এই দেশ থেকে এডপ্ট করা সায়রা বানুকে তার হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। নীলা তার নতুন কাজিন আশফাক আলীকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলো, টিভি চ্যানেলগুলির ক্যামেরার ক্রমাগত সাটার এর শব্দ হতে থাকলো ।

ওদিকে আশফাক আলীদের গ্রামের বাড়ির উঠানে নানান বয়সী মানুষের ঢল নেমেছে। তাঁরা এই গ্রামের হারিয়ে যাওয়া সায়রা বানুকে দেখতে চায়, সায়রা বানুর বিদেশি মেয়েকে দেখতে চায়। বাড়িতে আশফাক আলীর মায়ের নেতৃত্বে ছোট খাটো আয়োজন চলছে। উঠানে চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে। গাছ থেকে কতগুলি কচি ডাব পেড়ে রেখে, সেগুলির মুখ কেটে স্ট্রোক সেট করে রাখা হয়েছে।

আশফাক আলী তার দলবল সহ বিদেশী মেহমানদের নিয়ে প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। আশফাক আলীর মুখে আজ কথার যেন খৈ ফুটেছে। কানাডার ঠান্ডা, তুষার, সেখানকার মানুষের খাবারদাবার, ফসলাদি ইত্যাদি নিয়ে বিদেশি কাজিনের সাথে হাজারটা প্রশ্ন। সায়রা বানু তার বড় ভাইয়ের সাথে পঞ্চাশ বছরের জমে থাকা কথার বাক্স খুলে বসেছে, মা বাবাকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্নোত্তর পর্ব একটু পর পর কান্নায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ওদিকে নীলার বিলাতি গ্রান্ড পা ও গ্রান্ড মা বগুড়া শহরের অদূরে করতোয়ার কোল ঘেঁষে শাজাহান পুরের আশফাক আলীদের এই গ্রামের সবুজ শস্য শ্যামল গ্রামের অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখে দেখে একেবারে অভিভূত হয়ে সেল ফোনে একের পর এক ছবি তুলে চলেছে।

ঠিক বাড়ির একেবারে সন্নিকটে এসে আশফাক আলী যখন সদলবলে স্কুল মাঠের পুব দিকের সেই অনেক যুগের কালের সাক্ষী নির্বাক বট গাছটিকে পাস কাটিয়ে বাড়ির দিকে এগুচ্ছিলো আশফাক আলীর বাবা তার ছোট খাটো দল নিয়ে বট গাছ তলায় কিছুক্ষনের জন্য দাঁড়িয়ে খানিকটা দম নিয়ে ছোট বোনটিকে সেই পঞ্চাশ বছর আগে তাঁদের মা বাবাকে এখানে খানসেনা বাহিনীরা কিভাবে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছিল, কিভাবে মাকে সেই হায়েনার দল পাশবিক অত্যাচার করেছিল এসব বলতে যেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

প্রকান্ড বটগাছটির দিকে অবাক হয়ে নীলা, নীলার গ্রান্ড পা, গ্রান্ড মারা তাকিয়ে আছে। ওঁরা যে দেশে থাকে সেখানে কোনো বট গাছ নেই। বট গাছের কিছু কিছু আলগা শেকড় বাতাসে দুলে দুলে উঠছে। মনের আনন্দে সেই শেকড়গুলিতে দোল খেতে থাকা গুটিকয়েক শালিক পাখি লোকালয়ের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ডানা ঝাপটিয়ে ছুঁটে পালালো। বট গাছটির কিছু শেকড় থাম্বার মতো মাটির নিচে সেঁধে গিয়েছে। আশফাক আলীর বাবা খপ করে নীলার হাত ধরে বললেন:

‘মা দেখো এই শেকড় গুলিকে বই এর ভাষায় বলে ‘স্তম্ভ মূল, চেয়ে দেখো এই শেকড়গুলি কিভাবে এতো বড় গাছটিকে আঁকড়ে ধরে গাছ টিকে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে যাচ্ছে । প্রত্যেক মানুষেরও শেকড় থাকে রে মা, তবে সে শেকড় দেখা যায় না। তোমার, তোমার মায়ের যে শেকড় পোঁতা আছে আমাদের এই গ্রামটিতে, চেয়ে দেখো তোমাকে ঘিরে এই এতো মানুষগুলি আমাদের সাথে সাথে হেটে চলেছে এদের ভালোবাসা, মায়া এসব কেটে চলে যেতে পারবেতো বা মা? এখানেই থেকে গেলে হয় না মা মনি !’
বিলাতে বেড়ে ওঠা নীলা তার আঙ্কেলের শক্ত কথার অর্থ ঠিক সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে কি না ঠিক বুঝা না গেলেও নীলা ও তার বিলাতি গ্রান্ড পা, গ্রান্ড মাকে দেখা গেলো গভীর বিস্ময়ে বা কৌতুহূল হয়ে অথবা পঞ্চাশ বছর আগে এখানে ঘটে যাওয়া খান সেনাদের সেই পৈশাচিক কথা মনে করে এই বিচিত্র গাছটির দিকে, গছটির ঝুলে পড়া বিচিত্র শেকড়গুলির দিকে, স্তম্ভ মূলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে অনেকক্ষন তাকিয়ে আছে।

———
“আমরা যেন আমাদের শেকড় ভুলে না যাই, এই হোক স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির আমাদের অঙ্গীকার”

—-জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, কানাডা, মার্চ ২৭ ২ ০ ২ ১



পূর্ববর্তী নিবন্ধটরন্টো বাংলা স্কুলের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন
পরবর্তী নিবন্ধসাদা ঘোড়া-পর্ব ১৪
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন