দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন তাদের সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা !! যারা আমাদের মাঝে নেই তাদের আত্মার প্রতি রইলো প্রানঢালা দোয়া। আপনাদের কারণেই আজকে বলতে পারি, “মাতৃভুমি বাংলাদেশ”. ভারত বা পাকিস্তান নয়। যেমনি হোক একটি পাসপোর্ট এর অধিকারী হতে পারি। আমার দীর্ঘ ২/৩ যুগের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘোরা বা অবস্থানের কারণে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে যাদের নিজের দেশ নেই, নিজের পাসপোর্ট নেই। এমন অনেক মানুষ এই কানাডাতেও আছে। ২/৩ বছর আগে আমার এক ক্লায়েন্ট ছিল যে তিব্বতীয় তবে সেখান থেকে তার পূর্বপুরুষ চাইনিজদের তাড়া খেয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ৬১ বছর আগে। দুঃখজনক যে ভারতে জন্মগ্রহণ করেও তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাইনি।
যেসমস্ত তিব্বতীয় লোক ভারতে আছে তাদেরকে ভারতীয় সরকার IC বলে একটি ভ্রমণের ছাড়পত্র দেয়, কিন্তু নাগরিকত্ব বা পাসপোর্ট দেয় না। ওই ক্লায়েন্টের PR হারিয়ে যায়, এবং তার ICর মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং তার সাথে ছিল তার ডিপোর্টেশন অর্ডার। যাহোক ঐসমস্ত ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে যেয়ে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি যে, দেশ যেমনই হোক না কেন, একটি নাগরিকত্ব বা একটি পাসপোর্ট পাওয়ার বা ভোটাধিকার পাওয়া কি জিনিস।
এছাড়া আমার এক ভূতপূর্ব ছাত্রী যে কিনা এখন একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার তার তিব্বতীয় স্বামীকে তার চাকরির ব্যাপারে সাপোর্ট দিতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় হয়। খুবই ভালো মানুষ এবং খুবই ট্যালেন্ট ডাক্তার। উনি ভারতে খুব ভালোভাবে ছিলেন, ভালো চাকরি ছিল, আত্মীয়স্বজন ছিল কিন্তু সব ছেড়ে উনি কানাডাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, এবং এখানে এসে প্রচুর স্ট্রাগগল করেন। আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করছিলাম অত ভালো পজিশন এবং জীবন ছেড়ে কেন এলে ? সে বলেছিলে, ” একটি দেশের জন্য, একজন নাগরিক হওয়ার জন্য, একটি পাসোর্ট পাওয়ার জন্য”. তার বয়স ছিল ৫৪ বছর। উনি বলতেন, এই বয়সে এখানে হয়তো তেমন কিছু করতে পারবো না, কিন্তু এখন অন্তত আমি এবং আমার ছেলেমেয়ে বলতে পারি, “I am a Canadian”. একটি দেশে থেকে, সেখানে চাকরি করে, সেখানে ট্যাক্স দিয়ে, সেখানকার সমাজে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখার পরেও সেখানকার নাগরিক না হওয়ার যে মনোকষ্ট সেটি আমি আমার সন্তাদেরকে দিতে চাইনি, এখন আমার মরন হলেও শান্তি।
এখন আসি শুরুতে কেন বলেছি আর একটি বিজয় দরকার ! ভৌগোলিকভাবে আমাদের একটি দেশ হয়েছে, কিন্তু মনমানসিকতা এবং মূল্যবোধের দিক থেকে এখনো শতভাগ জয়ী হতে পারি নাই। এই বিজয়ের জন্য যে যুদ্ধ সেটি করতে হবে সবাইকে, দলমত নির্বিশেষে। একজন আরকে জনের উপর দায়িত্ব বা দোষ চাপিয়ে দিলে চলবে না, যেটি হয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে। আমরা একা একা পুরা সমাজ পরিবর্তন করতে হয়তো পারবো না, এবং আমাদের সবার সেই ক্ষমতাও নেই, তবে নিজের সাথে তো নিজে যুদ্ধ করতে পারি। নিজের ভিতরের সংকীর্ণতাকে পরাজিত করতে পারি, নিজের সন্তান বা কাছের দুই একজনকেতো শুধরাতে সাহায্য করতে পারি !! আসুন আমরা সবাই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কি সেটি করছি, সেই যুদ্ধে তো আমার গোলাবারুদ দরকার হয় না !!
ছোট একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। দেশে আমার এক পরিচিত জনের মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে। একটি ছেলের সমন্ধে তার বাবার সাথে আমার কথা হচ্ছিলো। আমি মেয়ের পরিবার সমন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন বাবা একজন দ্বিতীয়শ্রেণীর কর্মকর্তা,পরিবার ভালো, ছোট সংসার, শিক্ষিত, ঢাকাতে ২টি বাড়ি আছে এবং দেশের বাড়ি শহরে কিছু জায়গায় আছে। আমি বললাম, ” একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা” তাহলে তার ২টি বাড়ি আর জমির উৎসটাকি জানতে চেয়েছেন। উনার উত্তর ছিল, ” সে যেভাবেই করুক, “আমরা তো তার ছেলেকে আনছি” তার সম্পত্তির সাথে তো আর বিয়ে দিচ্ছি না। হা, এই কারণেই আমি মনে করি আমাদের মন বা মূল্যবোধ এখনো পরাজিত !!! আর এইক্ষেত্রে যতদিন বিজয় না আসবে ততদিন স্বাধীনতার পুরাপুরি আস্বাদ আমরা পাবো না। আবারো বলছি এই যুদ্ধ প্রত্যেকের। তবে আশা করছি হয়তোবা নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এই বিজয় একদিন আসবে।
আমার পরিবারে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এক আমার বাবা আর তার ছোট ভাই অর্থাৎ আমার ছোট চাচা, আর সে জন্যে দিনটি আরো বেশি তাপপর্যপূর্ণ আমাদের জন্য। বাবা গত হয়েছেন অনেক আগে, আর ছোট চাচার একেবারে শেষ সময় চলছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের জন্য দোয়া চেয়ে এখানেই শেষ করি। শুভ বিজয় দিবস ! মুকুল। টরন্টো।