(সহায়ক গ্রন্থঃ ১. মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি –সামাদ সিকদার; ২. মুক্তিযুদ্ধঃ কিছু কথা কিছু স্মৃতি — সামাদ সিকদার)
সহযোদ্ধা কামরুল আহসান খান একবার অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন করেছিলেন। তিনি এখন সেখানেই বসবাস করেন। অনেক দিন পর অনেক কথা হলো। কথা বলতে বলতে একসময়ে আমরা দু’জনই আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার কতো কথা কতো স্মৃতি!
আমার চেয়ে একটু সিনিয়র কামরুল ভাই এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী হলেও বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক চিন্তা- চেতনার কথা জানালেন। যৌথভাবে কিছু লেখা- লেখি করার প্রস্তাবও দিলেন।
কামরুল ভাই বাংলাদেশের মতো সেখানেও অনেক সংগঠনের সাথে জড়িত। অনেক ব্যস্ত নানা কাজ -কর্ম নিয়ে। ভালো লাগলো কথা বলে এবং শুনে। এতগুলো বছর পরও মানুষের আন্তরিকতা এতোটা অটুট থাকে?
২।।
ইদািনিং পুরনো অনেক বন্ধু, সহকর্মী, প্রাক্তন রাজনৈতিক সহকর্মী ও প্রাণপ্রিয় সহযোদ্ধা (১৯৭১ সনের রণাঙ্গনের সাথী) -এর সাথে যোগাযোগ হয়। ভালো লাগে। বিশেষ করে সহযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ হলে ৪৮ বছর পুর্বের কতো স্মৃতি মনে পড়ে! মনে পড়ে উঠতি যৌবনের কথকতা!
নোয়াখালীর সহযোদ্ধা আবুল কালাম, জনতা ব্যাংক- এর উচ্চপদস্হ কর্মকর্তা ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত, তার সাথে যোগাযোগ আরেকটি মিরাকল। তাকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম। ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়ে গেলো।
নোয়াখালীর বাবুলের কথা খুব মনে পড়ে। ভারতের নেফার বিশেষ ট্রেনিং -এর সময় বাবুলসহ আমরা কয়েকজন ট্রাক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলাম। এখন বাবুল কোথায় আছে, কি করে, আদৌ বেঁচে আছে কি না? তার সম্পর্কে জানতে খুব ইচ্ছে করে।
আজকাল সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর খবরই বেশি পাওয়া যায়। ফেসবুক ও মোবাইলের কল্যাণে, যতদূরেই হোক, সে খবর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যায়। অসুস্থতাতো লেগেই আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের আরও আন্তরিক হওয়া উচিৎ।
ফেসবুকের কল্যানে অনেকের সাথেই এখন যোগাযোগ হয় এবং হচ্ছ। এর পরিধি দিনেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে । ভৈরবের প্রিন্সিপাল মতিন ভাইকে দেখি, লাঠি হাতে ভাবীর সাথে সুন্দর সুন্দর জায়গায় হেঁটে বেড়াচেছন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভাইকে দেখি। তিনি সিপিবি – এর সভাপতি। ইত্তেফাকে তার লেখা পড়ি, টেলিভিশনে কথা শুনি, মাঝে- মধ্যে বক্তৃতাও শুনি। আমাদের সকলের প্রিয়জন ছিলেন তিনি।
ডাকসুর ভি. পি. সেলিম ভাই ছিলেন আমাদের আইডল। তিনি ছিলেন আমাদের ডেপুটি কমান্ডার/ লিডার। ওসমানগনি ভাই ছিলেন কমান্ডার। এটি আমাদের ভারতের ট্রেনিং পিরিওডের কথা বলছি।
আগরতলা থেকে আসামের তেজপুর, তারপর নেফা, নেফা থেকে আর্মস ট্রেনিং / বিশেষ ট্রেনিং শেষে বায়কোড়া এস. এস. বি. ক্যাম্প এবং বাংলাদেশে ইন্ডাকশন ( প্রবেশ) পর্যন্ত এই ব্যবস্হাই ছিলো।
ইন্ডাকশন অর্থ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ। আমাদের দিনতারিখ ঠিক হয়েছিল ১১ নভেম্বর। যে তারিখে আমর ৯ জন সহযোদ্ধা বেতিয়ারায় শহীদ হয়েছেন।
৩।।
১১ নভেম্বর বেতিয়ারা শহীদ দিবস। বেতিয়ারা হলো কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একটি গ্রাম। যেদিক দিয়ে আমাদের দেশে ফেরার কথা ছিল। হাই কমান্ডের নির্দেশে আমাদের বাদ দিয়ে আমাদেরই আরেকটি দলকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়।
ঢাকা -চট্টগ্রাম হাইওয়ের চৌদ্দগ্রাম এলাকার গাংরা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন গ্রামটির নামই বেতিয়ারা। এখানেই শুয়ে আছে আমার প্রিয় ৯ জন সহযোদ্ধা, যারা ১৯৭১ সালে ১১ নভেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সামনা-সামনি লড়াইয়ে শহীদ হন।
শহীদ এ ৯ জনের সাথে আমাদেরও স্বদেশ অনুপ্রবেশের কথা ছিলো। হাই কমান্ডের সিদ্বান্ত পরিবর্তনের কারনে আর সেদিন হয়নি। একথা আগেই বলেছি। তাই আজও বেঁচে আছি।
পরবর্তীতে আমি ও আমাদের ইউনিট কোনাবন সীমান্ত দিয়ে, বহু ঝড় – ঝাপ্টা অতিক্রম করে, স্বদেশ অনুপ্রবেশ করি।
এরপর স্হানীয়ভাবে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহন করি।
৪।।
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষ ভাগে ভারতের আগড়তলার রিক্রুটমেন্ট ( চূড়ান্ত নির্বাচন) শেষে আমরা ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা আর্মস ট্রেনিং- এর জন্য আসামের তেজপুর যাই। সেখানে প্রশিক্ষনের পর বিশেষ ট্রেনিং-এর জন্য আমরা ৪৫ জন সিলেক্টেড হই এবং নেফা (NEFA– North Eastern Frontier Area) যাই।
নেফা হলো ভারত-চীন বর্ডার। সে যাহোক, প্রশিক্ষন ও বিশেষ প্রশিক্ষন শেষে আমরা (১ম ও দ্বিতীয়) ২ ব্যাচের ৪০০ জন মুক্তিযোদ্ধা আগরতলার বাইকোরা এস্ এস্ বি (SSB– Special Security Branch) ক্যাম্পে জড়ো হয়েছিলাম। ওটাই ছিল ভারতে আমাদের সর্বশেষ মিলন কেন্দ্র। তারপর দলে দলে দেশে ফেরা। কেউবা শহীদ কেউবা গাজী। কেউবা মন্ত্রী, কেউবা নেতা। কারওবা ছা- পোষা জীবন, নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
৫।।
প্রতি বছরের মতো, ৪৮ বছর পর, আবার সেই দিনগুলো আমাদের সামনে উপস্হিত। কেমন করে যে এতোগুলো বছর কেটে গেলো! বেঁচে আছি বলেই হয়তো লিখতে পারছি, বলতে পারছি। কত কথা, কত স্মৃতি!
৬।।
বেতিয়ারার কথা বলেছিলাম। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বরের সেই শহীদদের স্মরণে বেতিয়ারায় একটি সুন্দর বেদী নির্মিত হয়েছে। বেদীর সামনে শ্বেত পাথরে লেখা আছে ৯ জন শহীদ সহযোদ্ধার নাম। বেদী সংলগ্ন গনকবরে শুয়ে আছে (১) নিজামুদ্দিন আজাদ, (২) সিরাজুম্ মুনির, (৩) জহিরুল হক দুদু, (৪) শফি উল্লাহ, (৫) আওলাদ হোসেন, (৬) কাইয়ুম, (৭) বসিরুল ইসলাম, (৮) মো: শহীদুল্লাহ এবং (৯) কাদের মিয়া।
— — —
***ডক্টর মুহম্মদ আব্দুস সামাদ সিকদার : মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা। কবি – প্রাবন্ধিক ও গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য। প্রকাশিত গ্রন্হ : ১৩টি।।