ফ্লোরিডা থেকে:-
আকাশে জাম্বুরার মত চাঁদ । কিছু মেঘ ছুটছে তাড়াহুড়া করে, কোথায় তাদের গন্তব্য কেউ জানেনা, কেন তাদের এমন ছুটতে হয় তাও না। অথচ এই পৃথিবীতে সব কেমন অন্য রকম। এই আমি রোগী দেখা শেষ করে বের হলাম , সাড়ে ৮ টা বাজে, রাত , চারিদিকে অন্ধকার বেশ।
এক মা নিয়ে এসেছিল তার ছেলেকে। বছর ১০ বয়েস, এত রাগী যে মা আর পেরে উঠছে না। রাগের মাথায় ভাই বোন গুলো কে পিটায় , মাকেও চড় চাপড় লাথি মারতে কসুর করেনা। বাপ নেই, মানে আছে, জেলে। সেই মা যখন গর্ভধারণের তিন মাসে, তখন কাকে হত্যা করার এটেম্পট নেয়ায় বাপ জেলে গেছে, বের হবে আরও বছর তিনেক পরে। মা অবশ্য বসে থাকেনি, অন্য স্বামীর ঘর করছে, কোলে একটি ছোট শিশু। সমস্যা এই দশ বছরের দস্যুটাকে নিয়ে। প্রায় সব ঔষধ ব্যবহার করে দেখেছে, কিছুই কাজ করেনি। কোথাও খবর পেয়েছে যে একজন ডাক্তার আছে, সে কিছু করতে পারলে পারতেও পারে। এখন সে ডাক্তারের কাছেই এসেছে।
বাপের বাইপোলার রোগ আছে। বাপের একটা বোন ছিল সেও বাইপোলার । ছিল , এখন আর নেই। একদিন সে তার তিনবছর বয়সের মেয়েটাকে গুলী করে মেরে তারপর নিজেও আত্মহত্যা করেছে। একটা শিশু, একটা মা সংসারে কমেছে, ঈশ্বরের হাত এখানে কতটুকু বলা মুশকিল , তবে ওই মা’টির হাত যে এখানে ছিল তাতো ইতিহাসই বলে। সমাজ কতটুকু তার আঙুলের ছাপ রেখেছে এখানে তার খোঁজ কে করে , আর দরকারই কি? এই হল জেনেটিক মেটেরিয়াল। সভ্যতা ও সব পেয়েছির দেশের রোগ।
বলি ,”কম বেশী সব ওষুধই তো চেষ্টা করা হয়েছে ,কাজ করেনি, আমি কি করতে পারি?”
“অনেক আশা নিয়ে এসেছি , কয়েক জনেই বলেছে তুমি কিছু করতে পারবে।”
ছেলে বড় সুন্দর কথা বলে, খুব স্মার্ট ও চার্মিং। বলি , “যে সব ছেলে-পুলে বাইপোলারের রোগী, তারা বাইরে খুব ভদ্র ও স্মার্ট, দেখলে মনেই হয়না যে এই ছেলে বাড়ীতে আপনজনের জন্য সন্ত্রাস। “
মা বলে , “তুমি একেবারে ঠিক কথাটাই বলেছো, বাইরের কেউ বিশ্বাসই করেনা, বলে আমি খারাপ মা, ছেলের সম্পর্কে বানিয়ে বলছি ।”
বলি ,”ছোট বয়েসে তাদের চিকিৎসা করা হয় এডি এইচ ডি ( ADHD) বলে, কিন্তু চিকিৎসা খুব একটা সফল হয়না। কারণ ডায়াগনোসিস ভুল, আর সঠিক ডায়াগনোসিস করাও সম্ভব নয়, এই দেশের সাইকিয়াট্রি মান্যুয়েল যার নাম ” ডি এস এম -৫ ” (DSM-5) বলে শিশুদের বাইপোলার রোগ হয়না। “
আমরা হলাম মাঠের সৈন্য ,ম্যানুয়েল লেখে সেনাপতিরা , কিন্তু জয় পরাজয় আমাদের হাতে। আমাদের সামনে রোগী, আমাদের চিকিৎসা করতে হয়, আমাদের ম্যানুয়েল মেনে চলা হয়ে ওঠেনা।
পুরো লিস্ট দেখে বললাম ঔষধ একটা আছে যা এখনও দেয়া হয়নি। এটা চেষ্টা করে দেখতে পারি। অফিসিয়ালী বাচ্চাদের বাইপোলার বলে কোন রোগ নেই, সুতরাং অফিসিয়ালী এই ঔষধ এই বয়েসে ব্যবহার করা যায়না। যদি বাবা মা রাজী থাকে সব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং রিস্ক সম্পর্কে অবগত হয়ে তবে ব্যবহার করতে কোন বাঁধা নেই, একে বলা হয় “অফ লেবেল ইউজ” (Off label use)। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে এই “অনুমতি ফর্ম” ( Consent) স্বাক্ষর করে দাও।
মা স্বাক্ষর করলে, আমি ঔষধের প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দেই ফার্মাসীতে ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশনে।
বলি ২৫ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট ১/২ ট্যাবলেট সকালে, ১/২ ট্যাবলেট রাতে ,দিনে দুইবার করে ১ সপ্তাহ দেবে , তারপরে সকালে ১ টি এবং রাতে ১টি করে দেবে দিনে দুইবার । ২য় সপ্তাহ পরে আমার সাথে দেখা করবে ছেলেকে নিয়ে।
আজ আমি অসম্ভব ক্লান্ত বোধ করছি । আজ আমার মাথায় কি একটা অসম্ভব যন্ত্রনা। গাড়ী চলছে বনের ভেতর দিয়ে । দুই পাশে হাজার হাজার পাইন গাছ, মাঝখানে রাস্তা। আমার গাড়ীর হেড লাইটের আলোতে যেটুকু দেখা যায়। নির্জন এই পথে গাড়ী প্রায় চলেই না। কবরে শুনেছি ফেরেশতারা মার ধর করে , সুতরাং ধারণা করি কবরেও এত নির্জনতা নেই যতটা রয়েছে আমার এই অরন্য পথে। জানালা খুলে দিয়েছি , বাতাসে চুল উড়ছে। পাইনের গন্ধে বাতাস মৌ মৌ করছে।
হঠাৎ যেন মনে হলে আমার গাড়ীর আশে পাশে গাছ গুলো গাছ নয় , লুঙি পড়া কত গুলো মানুষ। ওরা দৌড় মেরে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যায়, তারপরে আবার লুকিয়ে পড়ে । উকি ঝুঁকি মেরে দেখে আমি কে? আমাকে কি পাকিস্তানীর মত দেখায়? নাকি রাজাকার ? হঠাৎ কে যেন চিৎকার করে ওঠে , ” জয় বাংলা!”
আমি চমকে উঠি ,তারপরে মন্ত্র মুগ্ধের মতই বলে ফেলি, ” ওটাতো একটা দলের শ্লোগান”
ঠাস করে একটা চড় আমার বাম গালে, মাথাটা ডান দিকে ঘুরে যায় , গাড়ী কেঁপে ওঠে।
“তুই একটা নির্বোধ!” কে যেন চিৎকার করে ওঠে।
ভাবি সারা দিনের ক্লান্তির কারণে ভুল শুনছি বা ভুল বোধ করছি , আসলেই কেউ মেরেছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য আবারও বলি। “আমাদের তাই তো শেখানো হয়েছে, এবং আমি তাই শিখেছি , জয় বাংলা একটা দলের শ্লোগান । ”
ঠাস করে আর একটা চড় , ডান গালে।
“তুই একটা নির্বোধ।”
বাইরে হাজার হাজার পাইন গাছ গুলো উধাও , কিন্তু দেখি হাজার হাজার মানুষ, কেউ লুঙ্গী পড়া , কেউ প্যান্ট, কারো গায়ে গেন্জী, কারো গায়ে কাদা, কারো মাথায় ব্যন্ডেজ, কারো বা হাত ব্যন্ডেজ সহ বুকে বাঁধা ,ডান হাতে রাইফেল। সবার হাতে অস্ত্র । কারো গায়ে কোন দলীয় তকমা নেই, এরা সব বাংলাদেশের মুক্তিযাদ্ধা । তারা আমার গাড়ীর দুই পাশে, সামনে, পেছনে । আমার গাড়ী থেমে গেছে। ওরা চিৎকার করছে “জয় বাংলা”, ওরা একে অন্যকে আলিঙ্গন করছে। আর মেগা ভল্যুমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রেডিও বাজছে:
“জয়ধ্বনী কর তোরা সব জয় বাংলা বল
বর্গী খেদা ঐ বাংগালী চলরে জোরে চল।”
আমার বিজয়ের সমান বয়েস । আমি ঢাকা মেডিকেলে খুব ভালো রেজাল্ট করে সাথে সাথে আমেরিকার ডাক্তারী পরীক্ষা দিয়ে রেসিডেন্সী শেষ করেছি । এখন আমি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি। আমার নাগরিকত্ব হয়েছে । আমার সন্তানেরা ইংরেজীতে গড় গড় করে কথা বলে। আমার স্ত্রী এবং কন্যা বাংগালী মুখ হিজাবে ঢেকে রাখে এবং ওদের নবীজীর দেশের পবিত্র নারীদের মত দেখায়। আমার পসার অনেক , অনেক অনেক পরিশ্রম করি, অনেক ট্যাক্স পে করি, অনেক দান খয়রাত করে নাগরিক দায়িত্ব পালন করি। একটি মসজিদ আমার টাকায় চলে।
১৪ ডিসেম্বরের এই রাতে আমি খুব ক্লান্ত। বাংলাদেশে এই দিনটি কি জন্য যেন খুব স্মরণীয় । দুদিন পরেই বিজয় দিবস। আকাশে জাম্বুরার মত চাঁদ । একা , মনে হয় কাঁদছে , কাতরাচ্ছে। আমার সামনে হাজার হাজার বৃক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল বের করেছে, তারা কেউ কিছু দাবী করছেনা, অভিযোগ করছেনা, কেবল আনন্দে আত্মহারা হয়ে “জয় বাংলা”, “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করে আমার বনের নির্জনতা খান খান করে দিচ্ছে।
আমাকে কি সারা জীবন ভুল শিখানো হয়েছে?
জয় বাংলা কি কোন দলের শ্লোগান নয়?
কেন আমাকে ঠাস ঠাস চড় মারছে কেউ?
আমি শিক্ষিত মানুষ, আমি কি নির্বোধ ?
শাহাব আহমেদ
১৪ই ডিসেম্বর ২০১৬