সে যুগে এই ছোট্ট গ্রামটিতে একটিমাত্র বিল্ডিং ছিল। আমরা বলতাম “বড়ো বাড়ি” এই নামেই প্রসিদ্ধ ছিল, আবার কেউ কেউ বলতো “বাগল বাড়ি“। মূলত বাড়িটা বড়োই, বাড়িতে প্রকান্ড এক বট বৃক্ষ, নিচে গ্রামের ঈদগাহ মাঠ,পাশেই বিশাল পুকুর,এক পাশে পায়ে চলার পথ, গোয়াল ঘর ও খড়ের পারা, বৈঠক খানা বা কাচারী ঘর ,মসজিদ এবং ওপর দিকে সারি সারি ছনের ও টিনের ঘর, মাঝখানে খুরশিদ সাহেবের একটি মাত্র দালান।
খুরশিদ সাহেব বাবামায়ের একমাত্র ছেলে, চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করেন। সংসারে অভাব অনটন নেই, চাকুরী করার কি দরকার? বাবামা এবং গ্রামের লোকজনের ইচ্ছা উনিয়নের চেয়ারম্যান ইলেকশন করবেন। ইলেকশনে পাশ করে উনিয়নে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন ও বটে।
সন্ধ্যা হলে বট গাছের নিচে দাঁড়ালে কত রংবেরঙের পাখি, সকাল হলে ওরা কোথায় চলে যায় এবং বিকেলে ফিরে আসে। পাখিদের মধ্যে আবার একে অপরকে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ ও হয়। কিছু সময় কিচিরমিচির করে শেষে চুপচাপ কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাতের অন্ধকারে মনেই হবে না যে এই বট গাছে কোনো পাখি আছে।মনে হয় যেন খালি হাতে ও পাখি ধরা যাবে, দুই/এক বার চেষ্টা করেছি; তবে এতটা আবার সহজ না। ভোর হলো, আহারের সন্ধানে খাল বিলে চলে যায় । অনেক ধরণের পাখি এই গাছে রাতে আশ্রয় নিয়ে থাকে তন্মধ্যে বক উল্লেখযোগ্য, জলাভূমিতে বিচরণকারী গোত্রের কয়েক প্রজাতির পাখি, যাদের দীর্ঘ পা, গলা ও মাথা সরু ও লম্বা এবং ঠোঁট চোখা। এদের পালক সাধারণত সাদা, শুনেছি এক সময়ে রাজকীয় পোশাকে এবং মহিলাদের টুপিতে এর পালক ব্যবহূত হতো। বক শিকারের কত রকম কলাকৌশল যে আছে, বিশেষত আমাদের গ্রামের ছেলেপেলেরা ফাঁদ পেতে বড়শি দিয়ে বা পালা বক দিয়ে,বক ধরার অপূর্ব দৃশ্য দেখার মতো।বক শিকার ঝুঁকি পূর্ণ , আমাদের গ্রামের এক ছেলের এক চোখ ঠোক্কর দিয়ে কানা করেছে।
নিজেদের জমিতে ধান,পাট, বিবিধ শস্য সরিষা,মুঘ, কালাই, তিসি , তিল, এবং সবজি হয়। এ ছাড়া পুকুর, খালে মাছ,নিজের গরু দুধ, মুরগি,হাঁস ও ডিম্ সবই বাড়িতে পাওয়া যায়। মৌসুমী ফল আম,জাম,কাঁঠাল, গোয়াভা,লিচু হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।
সকাল হলেই গ্রামের পাশে ফতেপুর আড়ং (বাজার), না গিয়ে কি কোনো উপায় আছে ? কেনাকাটার নাম করে দোকানে চায়ের আড্ডা, ছোটোখাটো দেন দরবার, এ গ্রাম সে গ্রামের লোকজনের দেখাশুনা, কুশল বিনিময় প্রতিদিনের রেওয়াজ। প্রয়োজন আছে বা নাই, এটাসেটা বাজার থেকে নিয়ে আসা, অনেকেই ঘরের চাল বিক্রি করে বাজার করে, তাছাড়া চায়ের দোকানের আড্ডা, এই দোকানে গ্রামীণ দরবারের রিহার্সেল ও হয়। গ্রামের কিছু মাতবর শ্রেণীর লোক দেন দরবারের অজুহাতে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা জমানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাছাড়া সাপ্তাহিক বাজার তো রয়েছে যেখানে পাট, ধান বিক্রি করে বাজার ও নগদ টাকা পয়সা নিয়ে ঘরে আসে। ভাবলে আজ ও আমার হাঁসি পায়, বাজারে ডিম্ ব্যবসায়ী কি ভাবে হাতে ডিম্ নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে বলে এই ডিম্ নষ্ট, সে সময় বুঝতে কষ্ট হতো।
ঘটনা :একটি ঘটনা আজ ও মনে পড়ে, ফতেপুর গ্রামে, গ্রাম্য প্রধান বা মাতবরের খাটে ছেলেরা এক বাড়িতে দিনে রাতে গাছের আম পেড়ে নিয়ে যায় এবং উঠতি বয়স্কা মেয়েদের উত্যক্ত করে। বাড়ির কর্তা ব্যক্তি ভীতু, কোনো কথা বলতে রাজি না; মেয়ের মা ঝাড়ু নিয়ে ছেলেদের তাড়া করেছে, সে বিচার হবে । চায়ের দোকানে এ নিয়ে কথাবার্তা, রিহার্সেল চলছে, বাজারের পর ও বাড়ি গিয়ে বিচার করবে, জরিমানা হবে। সে দিন আমি আড়ং বাজারে গিয়েছিলাম, কয়েকজন মাতবর শ্রেণীর লোক বলে চলো, আজ বড়ো বিচার হবে। বিচারকদের দেখেই মহিলা ভয়ে কান্না কাটি শুরু করেছে। গৃহকর্তা হেবলার মতো তাকিয়ে আছে, মুখে কোনো কথা নেই। অনেক কথা কাটাকাটির পর দরবারীদের এক তরফা বিচারে সিদ্ধান্ত হলো, মহিলা দোষী এবং ঝাড়ু নিয়ে তাড়া করা অপমান, ৫০০ টাকা জরিমানা হবে। আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র ও অসুবিধা হলো না যে এই অন্যায় বিচারে মহিলা বখাটে ছেলেদের হাত থেকে মেয়েদের নিয়ে অসুবিধায় পড়বে। আমি রেগে মহিলাকে বললাম , ” তোমার উচিৎ ছিল, ওদের ঝাড়ু দিয়ে পিটানো,তা না করে তাড়া করেছো, পরের বার দেখলে ঝাড়ু পিটা করবে। দরবারে হইচই শুরু হয়েছে” অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছে আমার জন্য জরিমানা আদায় করতে পারে নি। কিসের জরিমানা ? পরে শুনেছিলাম এই পরিবার বাড়িঘর বিক্রি করে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে।
সচরাচর আমাদের গ্রামের বৃদ্ধরা ভোর হলে সকালের নাস্তা, মুড়ি,পিঠা খেয়ে হুক্কা টানবেন এটাই সকালের নিয়ম । গৃহকত্রী হুক্কা সাজিয়ে দিলে, মুরুব্বি টান দিয়ে ধুঁয়া ছেড়ে দিলে নেশা জাতীয় তামাকের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ; আমি নিজেও শৈশবে কোনো কোনো সময় দুই/একবার হুক্কা টেনে এর স্বাধ কেমন দেখেছি। আমাদের রাহিম চাচার হুক্কা টানার অভ্যাস ছিল;সম্ভবত উনি তাঁর বাবার কাছ থেকে এই অভ্যাস পেয়েছিলেন ।
এক সময় টরন্টো শহরে কোনো এক ইরাকী ব্যবসায়ীর একাউন্টস ও ইনকাম ট্যাক্স আমি দেখাশুনা করতাম। তাঁর দোকানে অনেক পিতলের হুক্কা এবং মশলা তামাক বিক্রি করে। ওদের ব্যবসা দেখতে গেলে আমি পূর্বের অভ্যাসানুসারে ওদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে মশলা তামাকের স্বাধ গ্রহণ করতাম। মালিক আমাকে একটা পিতলের পাইপ সহ হুক্কা এবং তামাক পুরস্কার হিসাবে দিয়ে বলে এটা তোমার জন্য; বেশ মূল্যবান, বর্তমান বাজার মূল্য ২০০ ডলারের মতো হবে, এটা আমার বাড়ির নিচের তলায় নিজের কম্পিউটারের ডেস্কের পাশে সাজিয়ে রেখেছি। আমার স্ত্রী কয়েকবার বলেছে সরিয়ে ফেলতে। আমি বলি যতদিন আমি আছি,এটা আমার ডেস্কের পাশে থাকবে। তবে হুক্কা টানার অভ্যাস আমার নেই, এত সুন্দর হুক্কা প্রতিদিনই তাকিয়ে থাকি।
বড় বাড়ির কাদের হাজি ইয়া লম্বা,ফর্সা এবং সুদর্শন, গ্রামের দেনদরবার ভালো জানতেন,যে কোনো দরবারে বা বিয়েশাদিতে সবার সঙ্গে অতি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতেন । তাছাড়া আবিদ বড় দরবারী, চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করতেন , সামাজিক মানুষ, ছুটিতে বাড়ি আসলে গ্রামের জমানো দেনদরবার নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন। গ্রাম্য দরবার যারা করতেন, তাদের অনেকের পড়াশুনা তেমন ছিল না, যেভাবে কথা বলতেন, মনে হতো যেন পাশ করা উকিল। এই গ্রামের রাজ্জাক,মোহাম্মদ আলীর মতো অনেকেই সালিসি করতেন । এরা কথাবার্তায় ছিলেন পারদর্শী, সুন্দর ভাবে গ্রামের সমস্যা মীমাংসা করে দিতেন এবং সবাই মান্য করতেন । কাদের হাজির নিজের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না,পাটের ব্যবসা করতেন, বর্ষা মৌসুমে এই বাজার সেই বাজার গিয়ে পাট কিনে হাজীগঞ্জ পাটকলে সাপ্লাই দিতেন এবং সমাজ সেবক ছিলেন।
এই যে বড়ো বাড়ির ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং, আমরা ছোট সময় শখ করে ওই বিল্ডিঙের চার দিক ঘোরাঘোরি করতাম , মনে মনে ভাবতাম, হায় !এমন একটা বিল্ডিং যদি আমাদের থাকতো । বাকি গ্রাম ভর্তি টিনের চার চালা, দো‘চালা বা ছনের । সে যুগে প্রায় প্রতিগ্রামে ছনের চাষ হতো, আজকাল গ্রামে গেলে এ সব চোখে পড়ে না। এ সব ঘরের খুঁটি হয় বাঁশ বা কাঠের, প্রতি বৎসর ঝড়ে ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঝড় হলে কি আমার, কি আর একজনের, কোনো চয়েস নেই, উড়িয়ে কোথায় নিয়ে যায় ? ঝড়ে আমরা ঘরের দরজা, বেড়া ধরে রাখতাম এবং ঘর থেকে আজান (আল্লাহ হু আকবার ) দিয়ে শেষ রক্ষা পাইতে চেষ্টা করতাম ।তবে আল্লাহ সবার কথা শুনতো কি না জানিনা ,অনেকের ঘরের চালা উড়িয়ে পুকুরে, বাগানে বা উঠানে এমন ভাবে পরে থাকতো যে পুনরায় মেরামতের অবস্থা রইলো না। যাদের ঘর শক্ত/খুঁটি দেয়া হয়েছে, তারাই একমাত্র রক্ষা পেতো। বাকিদের চালা বাতাসে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যেত, আল্লাহ মালুম। পরদিন সকালে শুরু হলো বাঁশ , চন, কাঠ খোঁজ করে ঘর মেরামত করার পালা। চার চালা টিনের ঘর গুলি অবস্থা সম্পন্ন লোকদের যারা ভালো কাঠ, টিন ও মুলি দিয়ে শক্ত করে তৈরী করেছে ,তাদের ভয় কম; যত ঝামেলা গরিবের যারা কোনো রকমে দিন এনে দিন খায়, “সৈয়ালের ভাঙা ঘর” অর্থাৎ যে অন্যের ঘর মেরামত করে, তার ঘর-ই আগে ঝড়ে উড়িয়ে নেয় । এদের ঘরের অবস্থা নড়েবড়ে এবং একটু জোরে বাতাস আসলে ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায় । পর দিন থেকে ভাবনা, ঘর মেরামত করতে হবে। নিজের গ্রামে চন, বাঁশ পাওয়া যায় না, দূর দূরান্তর ফতেপুর,তুলপাই থেকে ও মাথায় বা কাঁদে করে এ সব এনে মিস্ত্রিকে সাহায্য করেছি।
সে যুগে কি গরিব, কি অবস্থা সম্পন্ন, সবার রোজি রোজগার এই জমির উপর ছিল । সবাই সবার সুখ- দুঃখের খোঁজ খবর নিতো , কেউ গ্রামে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে, সবাই গিয়ে খোঁজ খবর নিতো , কেউ মৃত্যু হলে দেখা যেত সবার চোখে পানি,কবর দেয়া হবে, সবাই এসে সাহায্য করে। অপর দিকে কারো বিয়েশাদি, বাড়ির লোকজন পুকুরে জিয়ানো মাছ মেরে,ঘরের চাল, ডাল, পিঠা বানিয়ে মেহমানদারী করিয়ে বুঝিয়ে দিতো,” আমরা সবাই এক পরিবার”, কোন এর-ই নাম আন্তরিকতা। ।
লোকজন ছনের ঘরে বাস করতো ,কারো মনে কুটিলতা ছিল না। সন্ধ্যা হলে খেয়ে মাটিতে হোগলা বিছিয়ে বা চকিতে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তো। মাবাবা ছেলেমেয়ে সবাই একত্রে ঢালাও ঘুমিয়ে পড়তো।
বাবা/চাচাদের আমলে লোক অল্প শিক্ষত ছিল , কেউ গুরু ট্রেনিং নিয়ে শিক্ষকতা, বা অফিস আদালতে ছোট খাটো কাজ করতো , বেতন বেশি না , নিজেদের বেতন ও জমি জমার ইনকাম সহ কোনো রকমে সংসার চলে যেত, কারো কোনো অভিযোগ নেই।
আমাদের যুগে এসে পড়াশুনা শুরু হলো, লোকজনের মধ্যে আগে বাড়ার চিন্তা ভাবনা বাড়লো , কেউ পড়াশুনার জন্য , কেউ পয়সা রোজগারের জন্য বিদেশে পারি জমিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে মাটির, চনের , টিনের ঘর সরিয়ে দালান করার খেয়াল হলো। মানুষের মধ্যে আগে বাড়ার খেয়াল আসলো, তার সঙ্গে অশান্তি ও দেখা দিলো। আস্তে আস্তে লোকজন আরো ও পড়াশুনা প্রতিযোগী হয়ে দেশ বিদেশে পারি জমিয়ে বা দেশে ইঞ্জিনিয়ার , ডাক্তার, আরো ও অন্যান্য পেশায় এগিয়ে রোজগারের ধ্যানে মনোযোগ দিলো এবং তার সঙ্গে দুর্নীতি ও অশান্তি ও দেখা দিলো।
এই যে আমরা বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গ্রামে পুরাতন নিয়মের পরিবর্তন করে জমি জমা নষ্ট করে পুকুর আর দালান করে বিলাসী জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আজকাল গ্রামে গেলে অনেক পরিবর্তন নজরে পড়ে , কোথায় সে খাস জমি যেখানে গরু ছাগল ছড়ানো হতো, আমরা ছুটাছুটি এবং খেলাধুলা করে সময় কাটাতাম। বাড়ির চারিদিকে খাল যেখানে বর্ষায় নৌকা দিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে যাইতাম, সে সব চিহ্ন আজকাল নজরে পড়ে না। এমন কি জিজ্ঞেস করলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা সে সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে ও পারে না, বলতে গেলে ওরা মনে করে এ সব গল্প । ফসলি জমি নষ্ট করে বিদেশ থেকে পয়সা নিয়ে যার যেই খেয়াল খুশি বড়ো বড়ো দালান উঠাচ্ছে। খোঁজ নিলে জানা যাবে মানুষ আজকাল এত এত দালান করলে ও রাতে ভালো ঘুম হয় না। ছেলেমেয়েদের নিজেদের আলাদা কামরা চাই, দরজা বন্ধ, ফেইসবুক মোবাইল, iphone কার কত বন্ধুর সংখ্যা বাড়লো, এ নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত। মাবাবা, আপনজন রুমের দরজা নক না করে রুমে ঢুকা অভদ্রতা। কি পড়াশুনা করতেছে,কার সঙ্গে যোগাযোগ করে , কোথায় যাচ্ছে ? লাইব্রেরি ? গ্রুপে পড়াশুনা ? খোঁজ নিতে গেলে বলে,” I am adult “। সে যুগে এ সব ছিল না, মাবাবা শান্তিতে ঘুমাতো, এ যুগে মাবাবার ঘুম নেই , রাত কত ? রাত ১২টা/১টা,মেয়ে/ছেলে ঘরে আসে নি। একদিন রেজাল্ট আউট হলো,অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিছুই করার নেই। দেখা গেলো কার সঙ্গে কোথায় ঘোরাঘোরি করতেছে। কিছু বলতে গেলে’ ” আব্বু/আম্মু তোমরা আউটডেটেড লোক “। একের সঙ্গে অন্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে, মানুষ যেন যন্ত্রের মতো দ্রুত চলছে।
আমাদের সে যুগে সবাই রাজনীতি করতো না। ১৯৫৪ যুক্ত ফ্রন্টের ইলেক্শনের কথা আজ ও কিছু মনে পড়ে। তার পরে ও অনেক ইলেকশন দেখেছি, শ্রীরামপুরের মুজিবুল হক(MLA) ইলেকশন এ পাশ করেছেন। তার পরে ও ১৯৭০ এর ইলেকশন আব্দুল আউয়াল(MP) পাশ করেছেন। এ সব ইলেকশন এ কোনো রকম দাঙ্গা, মারামারি হতে দেখি নি, কে কাকে ভোট দেবে ? ওটা ব্যক্তিগত। আজকাল সবাই রাজনীতি করে এবং সবাই বড়ো নেতা ।
লাঙ্গল যার জমি তার: ব্রিটিশ আমলে ভারতের জমিজমা জমিদার, উপ -জমিদারদের হাতে চলে যায়। হিন্দ ও মুসলমান জমিদার তাদের পছন্দের লোকদের জমিজমা দিয়ে খাজনা আদায় করে ব্রিটিশ রাজকোষে একাংশ জমা দিয়ে বাকি নিজেরা ভোগ করতো। তাতে এক শ্রেণীর লোক জমি থেকে উপকৃত হলে ও অধিকাংশ লোক প্রতারিত হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিতুমীর, হাজি শরীয়তুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আরো ও অনেকেই আন্দোলন করেছেন । কয়েক শত বৎসরের আন্দোলনের ফলে জমিদারি উচ্ছেদ হলেও ভূমির প্রকৃত মালিকানা থেকে গরিব কৃষরা বঞ্চিত । গ্রামে গঞ্জে আজ ও তাকালে দেখা যাবে এক শ্রেণীর লোক জমিজমার মালিক, গরিব কৃষক ভূমির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।সে যুগে যারা একটু পড়াশুনা জানতো, চালাক-চতুর এবং জমিদার বা উপ- জমিদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে, ওরাই ভূমি বেশি দখল করেছে । আশেপাশের গরিব কৃষকদের দিয়ে চাষাবাদের কাজ করিয়ে পায়দা লুটেছে এবং যুগের পর যুগ এই কৃষি জমির সঠিক মালিকানা না দিয়ে নিজেরা জমিদার, উপজমিদার সেজে অসহায় কৃষকদের ভূমি থেকে বঞ্চিত করেছে। এ নিয়ে সে যুগে অনেক আন্দোলন যেমন “লাঙ্গল যার জমি তার” হলে ও ব্রিটিশ সরকার কর্ণপাত করে নি। এ সব আন্দোলনের অগ্রদূত এ কে ফজলুল, তিতুমীর, মওলানা ভাসানী, হাজি শরীয়ত উল্লাহ এবং ভারতের অসংখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। এ সব জমিদার ব্রিটিশ সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে তিতুমীরের মতো লোকদের বিরুধ্যে যুদ্ধ করিয়েছে। ১৯৪৭ সনে ভারত ভেঙে দুই ভাগ হলে ও কৃষকদের ন্যায্য দাবির কোনো মীমাংসা হয় নি। ধীরে ধীরে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও ন্যায্য মালিকানা অবহেলিত কৃষক পায় নি। আজ ও গ্রাম গঞ্জে গেলে দেখা যায় ভূমিহীন গরিব খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছে।
আমাদের আশেপাশে ও সেই চিত্র দেখে আমি অনেক সময় দুঃখ পেতাম। একই বাড়ি ৫ কি ৭ পরিবার বাস করে, দেখা যায় ৩-৪টি পরিবার অনেক জমিজমা, গোয়াল ভর্তি হালের গরু, চাকর, কামলা সবই আছে। পুকুরের ৯০% তাদের, বাকিদের কিছুই নেই বা যা আছে এ দিয়ে ভরণপোষণের ব্যবস্থা হয় না এবং কাজ করে কোনো রকমে খেয়ে/ না খেয়ে বেঁচে আছে । আমাদের গ্রামে করিমন ও কলিম এর মতো বহু পরিবার আজ আছে দু’বেলা খাওয়া জুটে না। কিছুদিন আগের কথা , এই গ্রামেরই এক ছেলে সহায় সম্বলহীন, ঢাকা শহরে ঠেলা গাড়ি চালাইতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে পাছে স্ত্রী, অসহায় ছেলেমেয়ে রেখে। তার অসহায় ছেলেমেয়েরা আজ ও কোনো রকমে খেয়ে/না খেয়ে বেঁচে আছে।
গ্রাম ভর্তি গাছপালা, সন্ধ্যা হলে মনে হতো যেন অনেক রাত্রি। বিদ্যুৎ থাক দূরের কথা অনেকের হারিকেন ও ছিল না। রাতে বাহিরে পায়খানা প্রস্রাব করতে যাইতে হলে,হয় লণ্ঠন (চেরাগ) বাতি বা এই অন্ধকারে পা টিপে টিপে যেতে হতো। কাঁচা পায়খানা, এতো দোজখ (হেল) বৎসরের পর বৎসর পরিষ্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া লোকজন রাতের অন্ধকারে এখানে সেখানে পায়ে চলা পথের পাশে পায়খানা করে রাখে। সে যুগে গ্রাম তো দূরের কথা , ছোট ছোট শহরগুলিতে ও সেনিটারি সিস্টেম ছিল না। পুকুরে নিজেরা গোছল করা থেকে শুরু করে,মাছ ধরা,কাপড় ধোয়া,গরু গোছল করানো, এবং এই পানি দিয়ে রান্না,খাওয়া সবই হতো। সে যুগে আমাদের ছোট্ট গ্রামে কোনো টিউবয়েল ছিল না। এই পুকুরের পানির উপর সবাইকেই নির্ভর করতে হতো।
সুদিন মৌসুমে আমরা আধ কিলোমিটার দূরে “ গান্দার আন্দি” থেকে কলসি ভর্তি করে খাবার পানি নিয়ে আসতাম। তার একমাত্র কারণ হলো এই দীঘির চারিদিকে কোনো বাড়ি ঘর ছিল না। দীঘির চারি পাড়ে ভিটা ও অসংখ্য আম গাছ ছিল এবং সন্ধ্যা হলেই পাখির কিচির মিচির শুরু হতো। কিন্তু এই দীঘির পানি কতটা পানের উপযোগী , এই দীঘিতে গরু, মানুষ গোছল করতো ।
কলেরা শুরু হলে এই গ্রাম, সেই গ্রাম ছড়িয়ে পড়তো। লোক জনের মলমূত্র সহ কাপড়, কাঁথা সবই পুকুরে ধোয়া হতো এবং পুকুরের পানি দিয়ে রান্না খাওয়া সবই হতো। ভয়াবহ কলেরা শুরু হলে দ্রুত এই ঘর/ সেই ঘর ছড়িয়ে পড়তো। এই মহামারীর কোনো চিকিৎসা নেই, লোকজন মারা যাচ্ছে। গ্রামের কবিরাজি আর হুজুরের পানিপড়া,তাবিজ দিয়ে চিকিৎসা করানোর উপর অন্ধ বিশ্বাস তো ছিলই। নিকটে কোনো হাসপাতাল ছিল না, মতলবের (ICDDRB ) কলেরা হাসপাতাল তখন ও হয় নি। তাছাড়া আমাদের গ্রাম থেকে ৮ মাইলেরও অধিক দূরত্ব এবং বর্ষায় নৌকা বা সুদিনে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামের মানুষের রাত/দিন চিৎকার করে বলতে শুনেছি:
“আলী আলী জুলিফিকার ,
মারবো হাতের তীর,
যাই পথে আয়েছত বালা ,
হেই পথে গির ,
লাইলাহা ইল্লাল্লাহু। ”
এই স্লোগান হলো মহামারী কলেরার চিকিৎসা, লোকজন মনে করতো কলেরা গজবি বালা, এই বালা আলীর নাম নিলে ভয়ে চলে যাবে। তার ও অনেক পরে ১৯৬০ দিকে আমেরিকার সাহায্যে প্রথম কলেরা হাসপাতাল মতলবে (চাঁদপুর) স্থাপিত হয়। এত এত রোগী হাসপাতালে নেয়া হতো, রোগী জায়গা দেয়া হাসপাতাল কতৃপক্ষের সম্ভব হতো না; রোগী নৌকায় এবং বাহিরে তাবু খাটিয়ে ও চিকিৎসা করানো হতো।
গুটি বসন্ত : সে যুগে গুটিবসন্ত শুরু হলে সারা গ্রাম ছড়িয়ে যেত, রোগীকে মশারি খাটিয়ে রাখা হতো যাতে মাছির দ্বারা এই রোগ ছড়াতে না পারে ; শরীরে গুটি বসন্তের দাগ কখন ও মুছে যায় না। কলেরার মতো এটা ও মহামারী যা শুরু হলে গ্রাম কে গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সে যুগে গুটি বসন্তের টিকা ছিল না, তুকতাক চিকিৎসা করানো হতো এবং ব্যাথায় জ্বর এবং শরীরে ক্ষত হলে সহজে শুকাতে চাইতো না। এই গুটিবসন্তে বহু লোক মারা যেত।
আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র,এই প্রথম থানা থেকে হেলথ ইন্সপেক্টর এসে প্রতিটি ছেলেমেয়েকে টিকা দিতে দেখলাম। আমার দুই হাতে দুইটি করে চারটি টিকা দেয়া হয়েছে, ঘা শুকাতে তিন/চার মাস লেগেছে।মারে বাবারে বলে ও রক্ষা নেই, মা তো গ্রামের বনাজী বা কবিরাজি চিকিৎসা একটার পর একটা করে যাচ্ছে। কিন্তু আরোগ্য হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। জ্বর এবং টিকার দাগ তুকতাক পাউডার দিয়ে ঘা শুকাতে দিন লেগেছে। আমার দুই হাতের কালো দাগ আজ ও স্পষ্ট দেখা যায়। দ্বিতীয় বার আমি স্কুলে দরোজার কাছে বসেছি , ইন্সপেক্টর সর্ব প্রথম আমার বিপরীত দিক থেকে টিকা দিতে শুরু করে। আমি বই খাতা নিয়ে দরজা দিয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে দৌড় আর দৌড়, পিছনে তাকানোর সময় কোথায়?
ক্রমশ :