১৯৪৭ সনে অবিভক্ত ভারতের লোকসংখ্যা ছিল ৩৮০- ৪০০ মিলিয়নের মধ্যে , বর্তমানে এই লোকসংখ্যা ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় চার গুনের বেশি (অর্থাৎ . বিলিয়ণ ) এবং  এই একই হারে সারা পৃথিবীর লোকসংখ্যা বেড়েছে। 

অতীতে  মানুষের বেশি চাওয়া/পাওয়ার আখাঙ্খা  ছিল না, মানুষ খেয়েদেয়ে সুখেই ছিল;  জমি বা চাকরি থেকে  যে রোজগার হতো, দিয়ে কোনও রকমে সংসার চলে যেত। সন্ধ্যা হলেই বাতি নিবিয়ে মাটিতে হোগলা বিছিয়ে বা চৌকিতে শুয়ে পড়লে ঘুমিয়ে পড়তো , সুন্দর ঘুম হতো,কারও প্রতি  হিংসা/ বিদ্বেষ ছিল না মানুষের চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল, তার কারণ মানুষের বহির্জগতের জ্ঞান আজকের মতো এত ব্যাপক ছিল না। 

মেয়ে বিয়ে দেবে ? সে যুগে ছেলেবাড়ি গিয়ে ঘর , ধানের জমি , খড়ের পারা, বৈঠকখানা, পুকুর ঘাট, সব দেখা হতো; মূলতঃ মেয়ে পরদা মতো থাকতে পারবে কি না ?   

যুগের পরিবর্তনে,  আস্তে আস্তে মানুষের মধ্যে আগে বাড়ার ধ্যান/ধারণা আসলো , চাওয়া/পাওয়ার শেষ নেই , মাটির ঘর,টিনের বা ছনের ঘর সরিয়ে পাক্কা বিল্ডিং করতে হবে। কি চাই ? আরো এগিয়ে যেতে হবে; ছেলেমেয়েকে স্কুলে,কলেজে এবং ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতে হবে । 

আমরা সে যুগে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ  লিখিতইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র , মুহম্মদ আবদুল হাই এর লেখাবিলেতে সাড়ে সাতশ দিনকত মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। একবার নয়, বহুবার পড়তাম, কি অসাধারণ ? ভাবতাম কত বড়ো মানুষ ! 

সারা দুনিয়ার মানুষ দেখতে কেমন? সব দেশের ছোট ছোট বাচ্চা কি একই সুরে কান্না করে? কোনো একজন সাদা ইয়া লম্বা লোক  দেখলে আমরা ভিড় জমাতাম, আর কত কি অদ্ভুত চিন্তা করতাম।  

১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই, আমেরিকা চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠালো ।  কি অসম্ভব ব্যাপার ?  অনেকেই ভাবতো মানুষ কিভাবে চাঁদে যাবে, এ কি সত্য ?  যুগে সব ডালভাত, পৃথিবী এগুচ্ছে , এখন মানুষের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আসছে। 

 ১৯৮৫১৯৮৬ আমি আমেরিকা, স্ত্রী ছেলেমেয়ে দেশে, স্ত্রীর চিঠির আশায় দিনের পর দিন পার করতাম।  আজকাল আমূল পরিবর্তন, কেউ একজন গ্রাম থেকে মোবাইল ফোনে বলেছিলো, ” ভাইজান, কথা বলি, আপনার ছবি  তো দেখি না ! ” কি আশ্চর্য্য ? গত ৫০৬০ বৎসরে পৃথিবী কতখানি এগিয়েছে ?

অনেকেই বলে থাকেন দুনিয়া থেকে সৎ লোক   বিদায় নিয়েছে, চারিদিকে অসৎ লোকে ভর্তি।  আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অবস্থার দিকে তাকালে তাই মনে হয়।  মানুষের চাহিদা বেড়েছে, এখন আর মানুষ সাধারণ জীবন যাপন করতে চায় না।  পরিবার পরিজনের জন্য   বাড়ি চাই,গাড়ি চাই, চলাফেরা ও খাওয়াদাওয়ার মান বেড়েছে;  সাধারণ ডালভাত খেয়ে কেউ জীবন যাপন করতে চায় না। 

চাওয়ার শেষ নেই, কি চাই ?  আরো ও চাই, আরো চাই , ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, ধনসম্পদে বাড়িয়ে দিতে হবে।  একটা বাড়িতে সন্তুষ্ট না , কয়েকটা বাড়ি থাকা চাই , দেশে বিদেশে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স এবং বাড়ি গাড়ি  থাকতে হবে।     

সে যুগে শিক্ষিত লোকের হার এতই কম ছিল, ছেলে বা মেয়ে কোনোরকমে স্কুল/কলেজ পাশ করলে যে কোনো কাজ পেয়ে  যেত। তৃতীয় বিভাগে বা রেফার্ড নিয়ে স্কুল পাশ করে ও টাইপ শিখে যে কোনো কাজ পেয়ে যেত।  সে যুগে কতজন পাশ করতো ?  একটা স্কুল থেকে ৩০ জন  ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলে বড়ো জোর ১০ জন পাশ করতো, বাকি  ফেল করতো,যারা ফেল করতো হয়তো ক্ষেতখামারে কাজ করতো, নতুবা কলকারখানায় কাজ করে কোনোরকমে জীবন নির্বাহ করতো।  

আজ থেকে ৫০ বৎসর পূর্বে একজন লোক MA পাশ করলে, আর কিছু না করুক, প্রাইভেট কলেজে একটা কাজ পাওয়া যেত।  আজকাল সে আশা করা যায় না।  আজকাল ঘরে ঘরে শিক্ষিত লোক, আর যদি কাজ না পাওয়া যায়, পড়াশুনার দোষ দিয়ে  লাভ  কি ?    

আজকাল লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে দেশ বিদেশে পড়াশুনা করে, সেই হিসাবে পৃথিবীর কোথায় ও সাদা অফিস  জব বাড়ে নি।  পড়াশুনার পাশে পাশে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জন করতে  হয়। 

এই টরন্টো শহরে,  আমার বাড়ির পার্শে এক রেস্টুরেন্টে ভারতের এক ছাত্র  দৈনিক ১২ ঘন্টা করে সপ্তাহে তিনদিন কাজ করে ইউনিভার্সিটির খরচ বহন করে।  জিজ্ঞেস করলে বলে “আংকেল কাজ না করলে, কি ভাবে পড়াশুনার খরচ চালাবো ? ”   

অনেকদিন আগের কথা , আমি কানাডায়, টরন্টো সিটিতে “জর্জ ব্রাউন” কলেজে কোনো একটা কোর্স করছি , আমার সাথেই বসা এক সাদা  ইয়ং ছেলে । ক্লাসের এক ফাঁকে চায়ের বিরতি, ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পড়াশুনার প্রেক্ষাপট  কি ? সে বলে আমি ইকোনমিক্স নিয়ে টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছি।  কথা প্রসঙ্গে সে বলে ইকোনমিক্স নিয়ে ভালো রেজাল্ট না করলে এই চাকুরীর বাজারে সুবিধা করা যায় না; সে জন্য কম্পিউটার ও একাউন্টিং নিয়ে পড়াশুনার লাইন পরিবর্তন করছি ।  এ দেশে ছেলেমেয়েরা  তাই করে এবং সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ ও শিখে নিয়ে থাকে যাতে বেকার থাকতে হয় না।  কিন্তু আমাদের দেশে কেউ কেউ বলতে শুনেছি,একটা বিষয় নিয়ে পাশ করে, ভালো কিছু করতে না পারলে, ১০টি বিষয় নিয়ে পাশ করলে ও তেমন কিছু করতে পারে না । 

এ দেশে ছেলেমেয়েরা বসে না থেকে সাময়িক যা পায়  তাই করে এবং মাবাবার উপর বোজা হতে চায়  না,  পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে প্রয়োজনে ভলান্টিয়ারিং করে যোগ্যতা বাড়ায় । গ্রামের প্রবাদ “দাদা বলছে বানতে ধান,  বানতে আছি ওদা ধান ” এই মনোবৃত্তি পরিবর্তন করতে হবে।  

আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি, সে ও বহুদিন পূর্বে “ইনকাম ট্যাক্সের” কোনো একটা কোর্স আমি এবং আরো অনেকেই করছি । এক মহিলা বয়স আনুমানিক ৭৫ এর  উপর হবে , হুইল চেয়ার এ বসে ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস এর সাহায্য নিয়ে পড়াশুনা করছে , মহিলার পড়তে অসুবিধা হচ্ছে দেখে আমি একটু সাহায্য করলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম তুমি এই কোর্স শিখে কি করবে ? প্রকাশ্যে না বললে ও বুঝাতে চাইলাম “তোমার চোখের যে অবস্থা “।  সে বলে, “ আমি লোকদের ব্যাক্তিগত ইনকাম ট্যাক্সের কাজে সাহায্য করবো,” আমি হেঁসে বললাম “তোমার মহৎ  চিন্তাভাবনার পরিকল্পনা শুনে ভালো লাগলো।  ” 

আমরা অনেকেই বলে থাকি, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দুর্নীতি দিন দিন বাড়ছে ; কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে ও আজকাল অশান্তি, মারামারি বেড়েই চলছে। 

২০১৯ জুলাই মাসের কোনো এক সময় টরন্টো শহরের অদূরে মারখাম এলাকায় একবাড়িতে বাংলাদেশী এক পরিবারে চারজন খুন হয়েছিল। বাবা দৈনিক ১২ঘন্টা ট্যাক্সি চালিয়ে অতি আদরের ছেলেকে প্রকৌশুলি করার স্বপ্ন;  পরিবারের ২৩ বৎসরের এইএকমাত্র ছেলে বাবামা, বোন এবং নানীকে হত্যা করে মিডিয়াতে দিয়েছে ।  এই চাঞ্চল্যকর মৃত্যুতে কানাডার বাঙ্গালী, পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং অন্যান্য মহলে এক শোকের ছায়া নেমে আসে। আজকাল, টেলিভশন,ইন্টারনেট বা নিউজপেপার  খুললে, কি আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, আফ্রিকা বা এশিয়া সর্বত্রই এ জাতীয় খবর  নজরে পড়ে।   লোকসংখ্যা যত বেশি বাড়বে, অপরাধ সে হারে বৃদ্ধি পাবে।  

টমাস ম্যালথাস ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন ব্রিটিশ দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ যিনি ম্যালথুসিয়ান তত্ত্ব  মডেলের জন্য বিখ্যাত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত একটি সূচকীয় সূত্র আবিষ্কার করেন । এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে খাদ্য উৎপাদন মানুষের জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হবে না, যার ফলে রোগ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ এবং দুর্যোগ দেখা দেবে। 

শুধু আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নয়, সর্বত্রই   অপরাধ বেড়েছে। পৃথিবীর সব কটি দেশেই দুর্নীতি অপরাধের মাত্রা সীমাহারিয়ে গেছে; কোথায় জানমালের নিরাপত্তা নেই, এটার মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি।  প্রতিটি দেশেই সরকার কঠোর আইন প্রয়োগ করলে ও বর্ধিত জনগণের চাপের মুখে, আইন অমান্য পৃথিবীর সর্বত্রই অহরহ হচ্ছে

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের ছোট্ট গ্রাম – পর্ব ৪
পরবর্তী নিবন্ধসিটি অফ টরন্টোতে Shelter, Support & Housing Admin ডিভিশনে লোক নিয়োগ
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন