হ্যালিফ্যাক্স থেকে:-
তমাল এই তমাল ,কোথায় তুই ? অনামিকা একনাগাড়ে ডেকে চলছে,কিন্তু উত্তর মিলছে না। তমাল তার একমাত্র ছেলে। বেলা প্রায় দুটো বাজে, আজ ছুটির দিন তাই নিয়মিত রুটিনে একটু ব্যাতিক্রম ঘটেছে। তার মনে হলো তমাল তিনতলার ছাদে গিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। সে খুব পছন্দে করে রঙিন ঘুড়ি। গতবছর শহরের নামকরা একটি বিপনী বিতানের বাচ্চাদের খেলনার দোকান থেকে একটি খুব সুন্দর রঙিন একটি ঘুড়ি কিনে দিয়েছিলো তাকে। তার সীমিত বাজেটের সংসারে যদিও তা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য । তবে তমালের সরল হাসিমাখা মুখের আলোকিত প্রাচুর্য তাঁর সব কষ্টকে ম্লান করে দিয়েছিলো । দ্বিধাগ্রস্থভাবে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে সে তার সাত বছরের ছেলে তমালের পড়ার টেবলে এর সামনে দাঁড়াল। নানা রকম রংচঙে কার্টুন স্টিকার দিয়ে সাজিয়েছে সে তার পড়ার টেবিল। কি স্বপ্নময় বর্ণিল এই জগৎ ,আর এই ছেলেবেলা। আনমনে তাই বলে নিজের মনে সে খানিক হেসে ফেললো। ছেলেটি খুব দুরন্ত হয়েছে অনেকটা ওর বাবার মতো। আসিফ ,তার কথা মনে হতেই দুচোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো।
আজ দুই বছর হতে চললো আসিফ তাঁদের মাঝে নেই। তাঁদের আড়াই কামরার ঘরের পূর্বদিকের দেয়ালে আসিফ এর প্রাণবন্ত হাস্যজ্জল একটি ছবি টাঙানো আছে। আসিফ এর ছবিটির সামনে এসে এবার সে দাঁড়ালো সে । আজ শুধুমাত্র কি ফ্রেমবন্দী একটি ছবি মাত্র? না তা নয় অনামিকার তার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে আসিফ এর উপস্থিতি সকল সময় বর্তমান । একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আসিফ এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে না ফেরার দেশে। তারপর থেকে নানা ভাঙা গড়ার খেলায় তমালকে কে নিয়ে চলছে অনামিকার নিরন্তর কঠিন সংগ্রাম। ক্লান্তিহীন এই পথে একটি সন্তুষ্টি তাকে খুব প্রাণিত করে ,তা হলো এই ক্লান্তিহীন সংগ্রামের অমসৃণ বন্ধুর পথে নারী সত্তার অমর্যাদা হতে দেয়নি । কাছের দু একজন তাঁদের নিজের বলয়ে গুটিয়ে নিয়েছেন ধীরে , আর বাচ্চাটিকে নিয়ে চলছে তার একার যুদ্ধ।
আসিফ চলে যাবার পর স্কুলের একটি কাজ জুটিয়ে নিয়েছে ,এছাড়া বিকেলে দুটি বাচ্চা তার কাছে গান শিখতে আর পড়তে আসে।এইভাবে চলে তাঁদের সংসার। খুব মেধাবী ছাত্রী সে কখনোই ছিল না। তবু সে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছিল। বাবার অনুরোধেই তার পড়া ,তাঁর প্রয়াত অধ্যাপক বাবা বলতেন শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন কখনো বৃথা যায় না বিপদের দিনে শিক্ষা বা জ্ঞান সবচাইতে বড় বন্ধু। তিনি বলতেন ভালো মানুষ হও ,আজ তার কথার যথার্থতা সে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে । নিজের সব শখ শৌখিনতা সীমিত রেখে শুধু মাত্র ছোট তমালের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্নে সে এগিয়ে চলে ,হঠাৎ রেডিও তে একটি আলোচনা ও গানের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলো যেন সে ,মনে পড়লো আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা দিবস। আসিফ থাকলেএরকম দিনে চমকে দিতো কোন ফুল বা ছোট উপহারে। ভালোবাসার আলিঙ্গনে ভরিয়ে রাখতো সারা দিন, তার ছোট ছোট কোন চমক আর উষ্ণ আলিঙ্গনে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো সব কিছুই।
আবার তমালের টেবিল এর কাছে এসে দাড়ালো তা পরিষ্কার করার উদ্দেশে। হঠাৎ চোখে পড়লো ছোট একটি গোলাপী কাগজের একাংশ ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে আসছে যেন,অনামিকার মনে হলো এই কাগজ টি সেন আগে কোথায় সে দেখেছে। সে উৎসাহী হয়ে অনেকটা তড়িঘড়ি করে খুলে যা দেখলো তা তাকে খুব বিস্মিত করলো। অনেক আগে তাকে আসিফের দেয়া একটি কার্ডের প্রচ্ছদটির অনুকরনে ছোট তমাল একটি গোলাপি কাগজে দু ভাঁজ করে এর উপর ফুল হৃদয় খুব সুন্দর ভাবে আঁকার একটি প্রচেষ্টা করেছে । সেখানে লেখা ‘অনামিকা আমার মাকে আজ ভালোবাসা দিবসে আমাদের হারিয়ে যাওয়া শ্ৰেষ্ঠ বন্ধু আমাদের বাবার দেয়া কার্ডটি থেকে এই ছবিটি ভালোবাসার উপহার দিলাম’.
মা মা তুমি কি করছো ? -এক ছুটে সে তমাল কে জড়িয়ে ধরে বললো , বাবা তুমি সুন্দর কার্ড বানিয়েছো তাই দেখছিলাম। -মামনি ,তোমার ভালো লেগেছে ? কিছুটা ভীত স্বরে সে বললো ,তুমি রাগ করোনি তো মামনি ,আমি তোমার আলমারি থেকে এই কার্ডটি না বলে নিয়েছি তাই ? -ঠিক বাবা যেমন করে কার্ড দিয়েছিলো সেইরকম বানিয়ে দিয়েছি। বড় হয়ে তোমাকে কিনে দেবো। মনের মাঝে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্ন টি এবার করেই বসলো অনামিকা -বাবা , তোমার তৈরী কার্ডের গোলাপি এই কাগজ টি কোথায় যেন দেখেছি ? – ও এটা তো আমার ঘুড়ির কাগজ। আজ ভ্যালেনটাইনস ডে ,ভালোবাসার দিন। আর তুমি আমার ভ্যালেনটাইন মা তাই আমার ঘুড়িটি ছিড়ে তোমার জন্য বানিয়ে দিয়েছি।
ছোট তমালকে দুই হাতে দ্বিতীয়বারের মতো পরম স্নেহের আবেশে জড়িয়ে ধরলো সে। অনামিকার দু চোখের কোল ঘেঁষে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়লো ভালোবাসার ভালোলাগার রুপালি অশ্রুবিন্দু। আর কল্পনার হৃদয়ের নীল আকাশে ভেসে চললো এক ভালোবাসার গোলাপি ঘুড়ি। মহান করুনাময়ের তাঁর কৃপায় দুজনের সংসার ভরিয়ে দিলেন ভালোবাসার অনন্য আলোয়। অনামিকা হৃদয় পূর্ণ হলো তমাল আর আসিফের ভালোবাসার শ্ৰেষ্ঠ উপহারে ।
গল্পটি অসাধারণ আপা। আপনার লেখার গভীরতা আমাকে অনুপ্রাণিত করে।