মাঝে মাঝেই আত্মউন্নয়ন বিষয়ক বই পড়ার ইচ্ছে হয়। এই ইচ্ছের পিছনে কাজ করে কিছুটা আত্মবিশ্লেষণের তাগিদ আবার কিছুটা ছোটবেলায় বাবা মাকে ডেল কার্ণেগীর বই পড়তে দেখার স্মৃতি। ডেল কার্ণেগীর “দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন” বইটির কথা এখনো মনে আছে। আব্বাকে দেখতাম এই বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্টায় সবুজ কালির বলপয়েন্ট দিয়ে আন্ডারলাইন করে রাখতে। এই বইয়ের বিষয়বস্তু, তাৎপর্য বোঝার বয়স এবং বুদ্ধিমত্তা কোনোটাই তখন ছিলোনা। বইটি এখনো সযতনে রক্ষিত আছে আমাদের পারিবারিক গ্রন্থাগারের আলমারিতে। ডেল কার্ণেগীর যুগ অনেক আগেই পার হয়ে আমরা এখন প্রবেশ করেছি সুপার হাইটেকের যুগে। ২০২০ সালের অলিম্পিক গেমসের আগেই জাপানে চালু হতে পারে ঘন্টায় ৬০৩ কিলোমিটার গতিবেগের মেগলেভ ট্রেন, যার টেস্ট রান হয়ে গেছে ২০১৫ সালের অক্টোবরে। প্রযুক্তিগত বিপুল উৎকর্ষ অর্জিত হলেও সম্ভবত তার চেয়েও দ্রুতগতিতে নৈরাশ্য, ভয়, দুশ্চিন্তা অনবরত তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদেরকে। দ্বিধা, দ্বন্ধ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। নিজের সাথে নিজেরই ছায়াযুদ্ধ চলে অবিরাম. জীবন নদে তরী ভাসালেও অনেকেই জানি না ভিড়তে চাই কোন ঘাটে.  ফলে জীবন হয়ে উঠে লক্ষহীন, ভাসমান। সৃষ্টির সেরা জীব হলেও কেউই আমরা পার্মানেন্ট রেসিডেন্টশিপ নিয়ে আসিনি, বরং প্রতি সেকেন্ডেই এগুচ্ছি মৃত্যুর দিকে। আবার যতদিন বেঁচে আছি, সবাই আমরা পরিপূর্ণভাবেই বাঁচতে চাই। কিন্তু কিভাবে ? এ প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় বই লেখা হয়েছে বিস্তর।

বেঁচে থাকার যথার্থতা, সত্যিকারের সুখ, সমৃদ্ধি নিয়ে রবিন শর্মার লেখা এমনি চমৎকার একটি আত্মউন্নয়ন মূলক বই ‘The Monk Who Sold His Ferrari’ । চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হওয়া এই বইয়ের নাম  শুনে মনে হবে এটি জগৎ সংসারের সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বৈরাগী হওয়ার গল্প। কিন্তু আসলে এই বইটি সম্পূর্ণ ভিন্নধাঁচের। ফিকশন স্টাইলে লেখা এই বইয়ে লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট অতি উচ্চমাপের এক আইনজীবি অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জনের পরেও অনুভব করেন জীবনের অন্থঃসারশূণ্যতা। বিক্রি করে দেন তার শখের ফেরারি। শুরু হয় তার purpose of life খোজাঁর এক নিরলস, অদম্য প্রয়াস, সন্ধান লাভ করেন মানব মনের অবিশ্বাস্য ক্ষমতার। এভাবেই এগুতে থাকে কাহিনী। এই বইয়ের রিভিউ লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জানার মধ্যে দিয়ে আত্মনির্মাণের যে তাগিদ এই বইয়ে ফুটে উঠেছে, সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে  তার গুরুত্ব অনেক বেশি।

আল্লাহ্পাক মানুষকে অসীম ক্ষমতা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। অবারিত এই ক্ষমতার উৎস এবং ব্যাপ্তি কতটুকু, মানুষ সম্ভবত নিজেও তা জানে না। কিন্তু শুধু নিজে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার চাইতেও পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আরো বড় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। পবিত্র কোরানের সূরা মুমিনুনের ১১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক জিজ্ঞেস করেন, ” তোমরা কি মনে করো তোমাদেরকে অযথা সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরবে না ?” সূরা মুলক এর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, “যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করলেন তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে কে শ্রেষ্ট তা পরীক্ষা করার জন্য, তিনি মহা পরাক্রমশালী, পরম দয়াময়।” পবিত্র কোরানের তফসীরবিদরা এই “আমলকে” শুধুমাত্র নামাজ, রোজার মধ্যেই সীমাবদ্দ না রেখে জীবন ও জগতের হাজারো কল্যানে নিয়োজিত করার তাগিদ দিয়েছেন। স্রষ্টার প্রশংসা করাও তার ইবাদতের সমান। মানুষের কল্যাণ এবং আল্লাহ প্রদত্ত অফুরান নিয়ামতের প্রশংসা কোনোটাই আমরা সঠিকভাবে করতে পারিনা। মহিয়সী হজরত রাবেয়া বসরীর (রা:) অসাধারণ একটি উক্তি এখানে স্মরণযোগ্য, “Alas ! your teeth have fallen out consuming the blessings of Allah, but your tongue has not worn out singing His praises.” সেজন্যই হয়তো আমার মতো অনেকেই খুঁজে বেড়াই “purpose of life”, ভুলে যাই যে ” all lives have a purpose to live.”

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন