ফ্লোরিডা থেকে:-

মানসিক রোগ নিয়ে কাজ, ছোয়াচে নয় , তবু মনে হয় নাকের সুরঙ্গ বেয়ে কিছু কিছু অবাস্তবতা অবমানসিকতা কোথাও যেন ঢুকে হারিয়ে যায় অনেকটা ইন্টারনেট ভাইরাসের মত। কি সব কথা বার্তা চলে, কি সব দেখতে পাই, কি সব ঘ্রান আর স্মৃতি, চেনা চেনা; স্মৃতি কি বাস্তব বুঝে উঠতে কষ্ট হয়।

না হ্যালুসিনেশন নয় ,যদিও তা ভুল হতে পারে । ভাবি এ বয়সের রোগ , নতুন তথ্য আহরন কমে আসছে কিন্তু যে বিশাল তথ্য ভান্ডার জমা হয়েছে মগজের ডিস্কে (হার্ড ? সফট?) এ তারই উদগীরণ । বই কম পড়া হয়নি, দেখা ও শোনা হয়নি কম , অন্ধ বধির হলে ভালো হত কিন্তু অন্ধ বধির নই।

যা বলি তা আদৌ আমি বলি ,না অন্যেরা বলায় বুঝে উঠতে পারিনে । একটা জেনেরাল ডিস্কেলেমার দিয়ে সাধারন ক্ষমা চেয়ে নিয়ে রাখা ভালো । আমার কথায় যদি কোথাও তোমার কথার গন্ধ বা স্টাইল দেখতে পাও , প্লিজ ধরে নিও ওটা তোমারই কথা , আমি কোথাও শুনেছি বা পড়েছি । যদি কোন ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলি তুমি নিশ্চিত হয়ে যে আমি সে ঘটনা নিজ চোখে দেখিনি বা তাতে অংশ গ্রহন করিনি। যে সব ভ্যামপায়ার, জ্বীন,পরী হাজার বছর বেঁচে থাকে আমি তাদের কোন আত্মীয় বা বান্ধবও নই যে তারা কানে কানে ইতিহাস বলে যাবে। সুতরাং কোন এক সময়ে কোথাও না কোথাও পড়েছি , দেখেছি বা শুনেছি , উৎসটি মনে নেই। স্বজ্ঞানে সিঁদ কেটে চুরি করার সময় হয়ে ওঠেনি , খুব বেশী ব্যস্ত সময় কেটেছে মহাদেশ থেকে মহাদেশে ঘুরে। এখন মহাকাশ থেকে মহাকাশে পারি দেবার আগে যা বললেই নয় তা হলো এই , আমার ভাষা বড়ই অক্ষম , আমার স্মৃতি বড়ই বিশ্বাস ঘাতক । আর আমার পাশের তুমি ? তুমি এই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন । আমি যদি তলস্তয়ের কথা মেনে চলতাম , যদি শুধু বর্তমান মুহূর্তটিকে অন্যত্র অপচয় না করে তোমার পাশে থাকতাম , তোমার প্রশ্নগুলোর সমাধান করতাম, তোমাকে আঘাত না দিতাম, তাহলেই বসন্তের সোনা রোদে ঝলমল করে উঠতো এই পৃথিবী , সোনার বাংলা হতো সোনার বাংলা, সোনার লন্কা হতো সোনার লন্কা, আরব দেশগুলো হতো সন্তের দেশ।

না, আমার হয়তো মৌলিক কিছু নেই । তবে আমার আবেগ ও অনুভুতি গুলো একান্ত আমারই। আমি যা দেখলাম চোখ মেলে এই পৃথিবীতে তা কিন্তু আমারই দেখা , আমি যে যন্ত্রনা বা সুখ বা আনন্দগুলো অনুভব করলাম তা অন্য কারুর নয়। আমি যে ভালোবাসলাম তা আমার ই ভালোবাসা । হয়তো প্রকাশ করতে যেয়ে নিজের ভাষা ,নিজের স্টাইল খুঁজে পেলাম না, কারো না কারোর মত হয়ে গেল । আমাদের অনুভূতি অসীম কিন্তু আমাদের ভাষা বড়ই সংক্ষিপ্ত!

এই সকাল বেলায় আমি বসে আছি আমার পুল আংগিনায়,স্ক্রিন ভেদ করে উষ্ম রোদ পড়েছে গায়ে, পুলের ব্লু তলানী আর স্বচ্ছ জল রিফ্লেকট করছে আকাশ। ইয়ত্তাহীন পাখী গুলো গাইছে যে যার মত অথচ সব মিলিয়ে তৈরী হয়েছে সুরের ঐক্যতান । তিনটে উইলো ট্রি দাড়িয়ে থম করে, সচরাচর ওরা খুব চন্চল। পাশে দৈত্যাকার ওক গাছটি ও গম্ভীর। একচল্লিশটি পাম ট্রি চুপচাপ । এই গাছেরা যদি কথা বলতো, যদি গাইড করতো এই জীবনের পথে ! ফ্লোরিডার যেখানে প্রচুর গাছপালা ঝিল্লি পোকা জাতীয় (cricket) কিছু একটা ঝি ঝি করে শব্দ করে একটানা , কিছুটা বিরক্তিকর কিন্ত এও যোগ হয়েছে এই শব্দের সম্ভারে। পাশের বাড়ীর ঘোড়াটা ডাকছে চিঁহি করে । আমার মনে পড়ছে আমার কালো সুন্দর ঘোড়া ব্ল্যাক জ্যাককে ,যাকে ধরে রাখতে পারিনি । ও কোথায় কেমন আছে কে জানে? যেমন তুমি । কোথায় আছো তুমি? বাংলাদেশে? সাইবেরিয়ায়? সাউথ ডাকোটায়? আছো তো নিশ্চয়ই, আমি আছি তুমি থাকবেনা , তা কি করে হয়?

এই ঘোড়া বিষয়ক নষটালজীর কথা বলতে যেয়ে মনে পড়ে গেল ওলেগের কথা। ওলেগ নবম শতাব্দীর একজন ক্ষনজন্মা পুরুষ । তিনিই কিয়েভ রুশের পত্তন করেন যা বর্তমান রাশিয়ার জন্মস্থান। ওলেগের একটি অতি প্রিয় ঘোড়া ছিল যার সওয়ার হয়ে সে প্রতিটি যুদ্ধে জিতেছে। আলেক্সান্ডারের বুসিফালের মতই এই ঘোড়াকে সে মনে করতো তার সৌভাগ্যের চাবি কাঠি। কিন্তু ঝামেলা বাঁধালো এক হতচ্ছাড়া গনক , সে বলল যে ওলেগের মৃত্যু হবে তার প্রিয় ঘোড়ার কারনে।

ঘোড়াটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসতো, তাই ওকে হত্যা না করে সে তার সহিসকে দিয়ে বললো ঘোড়াটির যেন কোন অযত্ন না হয় এবং ঘোড়াটি যেন কাছে আর না আনা হয়। কোষাগার থেকে ঘোড়ার খরচপত্রের বন্দোবস্ত করে দিল তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো রাজ্যবিস্তার ও সংহত করার কাজে। গড়ে তুলে বিরাট সাম্রাজ্য যা হবে ভবিষ্যতে রাশিয়ার ভিত্তি ,বাগান বাড়ী ও শিকার ক্ষেত্র। অনেক বছর পরে কোন এক নষ্টালজিক মুহুর্তে মনে পড়ল তার ঘোড়াটির কথা। সহিসকে ডাকা হল , সহিস বলল ঘোড়াটি মারা গেছে বেশ ক বছর আগে। ওলেগ বলল আপন মনে “গনকরা সব সময় মিছে কথা বলে, ঘোড়া মরে গেছে কত আগে আর আমি আছি বেঁচে এখনও!”
তার ইচ্ছে হল স্মৃতি বিজড়িত ঘোড়ার শেষ স্থানটি দেখতে। আদেশ দিল তাকে নিয়ে যেতে । মানুষ কেন এই কাজ করে ? মানুষ কেন আকড়ে থাকে অতীতের মায়ার বন্ধন? মানুষ পিচাশের এই কি এক মস্তবড় তফাত নয়?

ওলেগ ঘোড়ায় চড়ে গেল এক অন্তহীন এক মাঠে , যেখানে উবু হয়ে আছে আকাশ, যেখানে হুহু করে কাঁদছে উৎস ও অন্ত হারানো বেদে বাতাস, যেখানে চিল উড়ছে ওড়ার একঘেয়েমীর পাখায়। আর লক্ষ কোটি অজানা ঘাসফুল যারা ঝরে পড়েছে রাতের তারাময় আকাশ থেকে। ওলেগ দেখতে পেল সেই বিশাল বিষন্ন মাঠের অসীমতার মাঝখানে পড়ে আছে ওর প্রিয় ঘোড়ার মাথার হাড়টি আরও কিছু হাড় গোরের মাঝে। ঘোড়া থেকে নেমে এল , পা দিয়ে মাথাটিকে নেড়ে হেসে বলে ” কি এই মাথা কি আমাকে হত্যা করবে , যতসব মিথ্যুক গনকের দল ! ”
কখনও কখনও কাকতালীয় (random) ঘটনা ঘটে , কখনও কখনও গনকের কথাও ঠিক হয়ে যায় এ জন্য নয় যে সে সত্যিই ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিল ( আবার কে জানে হয়তো বা) , কখনও কখনও আমরা বহু কিছুর ব্যাখা করতে পারিনা এবং তখন ভাগ্য নামে এক ঝুড়িতে তুলে রাখি আমাদের অজ্ঞানতা গুলোকে।
ওলেগের মৃত ঘোড়ার মাথার ভিতরে ছিল এক বিষধর সাপ । সে বেড়িয়ে এসে ছোবল মারল। তার থেকেই মৃত্যু হল ওলেগের ।
” ভাগ্যের হাত থেকে মুক্তি নেই ” এবং এই মুক্তি খুঁজে পাওয়ার মানুষের যে তৃষ্না তা নিয়ে পুশকিন লেখেন তার অমর কাব্য “The Lay of Oleg the Wise”.

আমার কেন ওলেগ কে মনে পড়ল এই সকালে আমার সুদর্শন বড় বড় চোখের স্বর্গীয় দ্যুতিময় ঘোড়া ব্ল্যাক জ্যাককে মনে করতে যেয়ে? কোন কারন যুক্তি দিয়ে খুঁজে পাইনে কিন্তু মনে পড়ল এটা বাস্তব। সব কিছু যুক্তি জ্ঞান বিজ্ঞান দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়না , সব কিছু যুক্তি দিয়ে চলেনা । মানুষের অনুভূতি ও ব্যক্তিকতাকে বাদ দিয়ে ইমোশনহীন নৈর্বেক্তিক যুক্তি দিয়ে সমাজ চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এত বাস্তব একটি তত্ত্ব মার্ক্সবাদ আটকে গেল অযুক্তির চোরাবালিতে।

অথচ কাম্পানেল্লার উপন্যাস ” রৌদ্রময় শহর” বা টমাস মুরের উপন্যাস “ইওটোপিয়া” য় মানবতা মুক্তির যে অবাস্তব স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, মার্কস সমাজ বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখা করে চমৎকার বাস্তব ,একটি ব্যবস্থার নির্দেশনা দিয়েছিলেন । কিন্তু প্রয়োগ করতে যেয়ে ধরা পড়লো অসামঞ্জস্য ও দুর্বলতা গুলো । মাথা ব্যথার ঔষধ খুঁজে বের করার আগেই তরোয়াল দিয়ে মাথাটি কেটে ফেলা হল। স্পার্টাকাসের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা কি দেখিনি যে মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নমৃত্যুর মধ্য দিয়েই আসে দাস মালিকের বিজয় নৃত্য?

সেই সাথে বিগত দুশ বছরে বুদ্ধিবৃত্তির মানুষের সামনে যে শোষনহীন সমাজের স্বপ্ন গঠনের একটি বাস্তব থিওরি দেখা দিয়েছিল তা বদলে গেল স্বপ্নহীনতার শূন্যতায়, মধ্যযুগ ফিরে এল তার ‘মেধ যজ্ঞ’ নিয়ে। কোন এক অদৃশ্য হ্যামিলিয়নের বাশীওয়ালা বাঁশীতে দিল টান , আমরা মানবতাকে বিসর্জন দিলাম “অতি ধর্ম” ও “অতি বিধর্মের” মরুভূমিতে, যেখানে কেবল বিষকাঁটা গজায়।

এপ্রিল ২০১৫-এপ্রিল ২০১৬

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন