কিছুদিন আগে সাইকেলে চড়া এক মহিলা পুলিশ সদস্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিলো। ছবিটা দেখে অনেকেরই ভালো লেগেছে, অন্তত আমরা যারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারী অংশগ্রহণ পূর্ণভাবে চাই। দীর্ঘকাল ধরে আমাদের পরিবারগুলোয় ধরা ঘুণ আর মৌলিক অবক্ষয়, সঠিক ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব ও ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারণার প্রকাশ আমরা মাঝেমাঝেই দেখি। যদিও বলা হচ্ছে আমরা সভ্যতায় অনেকটা এগিয়েছি এবং পরিবর্তিত কৌশল ও উন্নত প্রযুক্তির প্রভাবে অসংখ্য পরিবার হয়ে পড়েছে যান্ত্রিক। আর ছোট ছোট যন্ত্রের আঘাতে অহর্নিশি কষ্ট পাচ্ছে শিক্ষিত নারীরা; সভ্যতার এতটা অগ্রগতির দিনেও যারা পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে নিজেকে একজন ‘মানুষ’ ভাবার সুযোগ পায়নি। মেয়েদের কাজের জায়গাটিতে ঝামেলা তো থাকেই, তার উপর যুক্ত হয় পরিবার বিশেষ করে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাজ বা বাইরে যাওয়ার অতি-অনুমতি প্রথা! এ যেনো একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর!
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, রাবণ কর্তৃক সীতা অপহৃতা হওয়ার পর- রাম-লক্ষ্মণ সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলে, সুগ্রীবের সাথে এঁদের বন্ধুত্ব হয়। বালীকে হত্যার পরিবর্তে সুগ্রীব রাম-লক্ষ্মণের সহায়তা করবেন এমন প্রতিজ্ঞা করেন। পরে রামের পরামর্শে সুগ্রীব কিষ্কিন্ধায় গিয়ে বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। যুদ্ধ চলাকালে রাম আড়াল থেকে বাণ নিক্ষেপে বালীকে হত্যা করবেন এমন প্রতিজ্ঞা করলেও যুদ্ধ চলাকালে উভয়ের দৈহিক আকৃতি একই রকম মনে হওয়ায় রাম বাণ নিক্ষেপ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। সেদিন সুগ্রীব কোনমতে বালীর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচেন। পরদিন রাম সুগ্রীবের গলায় গজপুষ্পীলতা বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। বালী-সুগ্রীবের যুদ্ধচলাকালীন সময়ে রাম গজপুষ্পীলতা’র চিহ্ন দেখে সুগ্রীবকে চিহ্নিত করেন এবং বালীর প্রতি বাণ নিক্ষেপ করে তাঁকে হত্যা করেন। এরপর সুগ্রীব রাজ্য দখল করে নিজ স্ত্রী রূমা ও বালীর পত্নী তারাকে অধিকার করেন।
যুগ আধুনিক হচ্ছে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক হচ্ছে মানুষ। কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। অনেক গুরুত্বপূর্ন পদে নিযুক্ত হচ্ছে নারী। কিন্তু তারপরেও নারীদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। কর্মজীবনে এখনও প্রতিনিয়ত হেনস্তা হচ্ছে নারী। বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণা সূত্রে জানা যায়, আমাদের দেশের বেশির ভাগ শহরের বিভিন্ন কর্মস্থলগুলো নারীবান্ধব নয়। কোথাও আবার নারীদের জন্য আলাদা আসন ব্যবস্থা থাকলেও বাচ্চাদের জন্য ফিডিং কর্ণার ও আলাদা ওয়াশরুম খুব একটা থাকে না। বিশেষ করে সরকারি অফিস, সরকারি ও বেসরকারি স্কুল কলেজ ও হাসপাতালে নেই নারী বান্ধব পরিবেশ। বিভিন্ন শহরের কর্মজীবী নারীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আবাসনের অভাব। বেশিরভাগ শহরেই কর্মজীবী নারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা নেই। এ কারণে কোনো কর্মজীবী নারীকে দূর থেকে এসে চাকুরী করতে দিতে চান না পরিবারের অন্য সদস্যরা। কোনো ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা ছাড়া নারীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়োগ দিলে, পরিবার বা স্বামী ওই পরিবেশে নারীকে চাকরি করতে দিচ্ছেন না। শিক্ষিত, যোগ্য হওয়ার পরেও তারা কাজ করতে পারছেন না। বাল্যবিবাহের ফলেও মেয়েদের একটি অংশ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছে। এটা আমাদের উন্নতিতে কতোটা আঘাত করছে তা আজকে না বুঝলেও, পরে বোঝা যাবে। জনসংখ্যার অর্ধেককে পিছনে ঠেলে আমরা জাতিকে কীভাবে এগিয়ে নিতে পারবো?
আমি দেখেছি, অনেক স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিস মহিলা নিয়োগ দিতে চায় না। কারণ মহিলারা বিভিন্ন অজুহাতে ছুটি বেশি কাটায়; অথচ সত্য এমন যে, মহিলা চাকরিজীবী তাকে বাসা পুরো সামলে নিয়ে পরে চাকরি করতে হয়। আমাদের দেশে আগে গ্রামে যত বেশি নারী নির্যাতন হতো, তার চেয়ে এখন শহরে বেশি অত্যাচারিত হচ্ছে নারীরা। অথচ নারীর অধিকার, মর্যাদা নিয়ে টিভি পত্রিকা বা নারী সংগঠনগুলো অনুষ্ঠান বা সেমিনার করতে পিছিয়ে নেই। রাস্তায় বা মঞ্চে অধিকার তো প্রতিষ্ঠিত হয়েই গেল কিন্তু নিভৃতে পরিবারে স্ত্রী হিসেবে, ছেলের বউ হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে কোনো সিদ্ধান্তে মতামত প্রদান, নিজের পছন্দকে মূল্যায়ন বা স্বাভাবিক স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত দেশের শিক্ষিত নারীদের কতজন ঠিকমতো পাচ্ছে? তার মানে কি আমি নারীদের পরিবারের কর্তা পুরুষের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বলছি? না। বরং আফসোস শুধু এটুকু, পরিবারে বাবা, মা, ভাই, বোনের সঙ্গে একটি ছেলে যে মেয়েটিকে বিয়ের মাধ্যমে প্রবেশ করালো তাকে সদস্য হিসেবে সহজ ও স্বাভাবিক স্বাধীনতা ও সম্মান দেয়ার মানসিকতা বেশিরভাগ শিক্ষিত পুরুষদের নেই। অথচ পরিবারের অন্যদের মন রক্ষা করতে গিয়ে স্ত্রীকে অহেতুক উপহাস, অপমান ও অবহেলা করছেন অসংখ্য শিক্ষিত পুরুষ লোক।
কর্মজীবী নারীর আবাসন, যাতায়াতের সুব্যবস্থা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রশিক্ষণ, সন্তান লালনপালনের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং নজর না বাড়ালে কর্মক্ষেত্রে নারীদের ধরে রাখা সম্ভব হবে না। প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে টিকে থাকতে হলে নারীর দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। দেশের বিশাল জনসংখ্যা নারীকে উৎপাদনব্যবস্থার বাইরে রেখে উন্নতি করা কি সম্ভব?
(লেখক – গবেষক সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র)
ছবি:- সৌজন্যে The Virtual Paintout