যার হৃদয় ছিল তার বয়সের চেয়ে বড় , দেশের জন্য , মায়ের জন্য , যার ছিল অফুরান্ত ভালোবাসা সেই অকুতোভয় যুবকের গ্ ল্পেই রচিত হয়েছে আমার দেশ । সে কোন বিখ্যাত পরিবার থেকে আসা কেউ নয় ছিল এক সচ্ছল কৃষক- এর সন্তান , যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করার সংকল্প নিয়ে ফিরে আসেন নি আর ।
আমি এতোক্ষন যার কথা বললাম সে আমার বাবার ভাই এর সন্তান আমার চাচাত ভাই মোঃ ইউনুস মোল্যা । ১৯৭০ এর শেষ দিকে দেশের অবস্থা তেমন সুবিধা জনক না , চারিদিকে উৎকণ্ঠা এমন এক সময়ে তার পাকিস্তান নেভিতে তার চাকুরী হয়ে যায় । সদ্য আই আস সি পাশ । তার মা কিছুতেই ছেলেকে চাকুরীতে যেতে দিবেন না , দুধ ভাতে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালো সে যাবে না । এতে কিন্তু সে খুব খুশী ই হলো , মায়ের কথাও রাখা হলো ।
একাত্তরে এপ্রিলের প্রথমদিকে ছোট্ট এক টি চিরকুটে শুধু কয়েকটি কথা লিখা ” মা বাবা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি ” তোমাকে বলে যেতে পারব না বলেই পালিয়ে যাওয়া , মাফ করে দিও মা ।
মার্চের শেষের দিকে যখন বাতাসে বারুদের গন্ধ আর চতুর্দিকে শুধু লাশের খবর সে নাকি প্রায় ই বলত এভাবে বাঁচব কেন ? বাইরে ঘরে যেখানেই থাকি মৃত্যু এড়াতে পারব না । তার চেয়ে যুদ্ধ করি , দেশ স্বাধীন হলে সবাই বলবে তুমি মুক্তি যোদ্ধার মা আর মরে গেলে শহীদের মা । ছেলের কথায় সবার আতংকে দিন কাটে সবার , কিন্তু চিন্তা করতে পারে নাই সে রাতের অন্ধকারে চলেই যাবে ছেলে তার ।
আমরা তখন ছোট মুক্তিযুদ্ধ অতো বুঝি না ,মনে আছে কারো কথায় হাসিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল , ইউনুস ভাই আর সাথে তার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে এসছে ( চরভদ্রাসনে ) । উনি ওই কলেজ থেকেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন । আমার মা সবার ছোট চাচী , জিজ্ঞেস করলো ভাত খাবি ? বলল আমার সাথে আরোও লোক আছে , আস্তে আস্তে বাড়ির অন্য সবাই চলে আসল, সবাই খুব আস্তে কথা বলছে , বাড়ির অন্যান্য ঘর থেকে ভাত এনে খাওয়ানো হলো ওনাদের , যাবার সময় শুধু বলে গেল আমি যুদ্ধে গিয়েছি , আমাদের কারো বাড়ীতে যেন ভুলেও পাকিস্তানের পতাকা না উড়ে , ওনাদের সবার হাতে স্টেনগান । আমার মেজো কাকা , ধলা কাকা খুব ভয় পেয়ে গেলেন, বললেন বাবারা তোমরা শান্ত হও । সেটাই ইউনুস ভাইকে আমার শেষ দেখা ।
তার পরে শুধু কারো কারো নাম শুনেছি নিখোঁজ হবার ,হালিম মৃধা , ফকরুজ্জামান, কালাম মাস্টার, ফজর মোল্যা , ওয়াসেল শিকদার , জালাল কমান্ডার আসলে এরা সবাই বাড়ী থেকে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল , আর দেখতাম সবার কানা ঘুষা এরা ফিরে আসবে কি ?
মনে আছে চাচী সেই মাধব দিয়া থেকে আসত তার ছেলের খোঁজে , প্রায় পাগলের মত করত, কোন এক জনের মাধ্যমে খবর পাঠানো হলও মা তাকে দেখতে চায় । অনেক অনুরোধে এসেছিল রাতের অন্ধকারে একবার মাধব দিয়ার সেই বাড়ীতে , বলে গিয়েছিল তার মাকে আর মাত্র কয়েকদিন দেশ স্বাধীন করেই ফিরে আসবে ।
না আর ফিরে আসেনি । দেশ স্বাধীন যেদিন হলো সেই ১৬ ই ডিসেম্বর ভোররাত্রে যখন বিহারীরা পালিয়ে যাচ্ছিল ওই সময়ে মুক্তিবাহিনীর ও বিহারীদের মধ্যে যুদ্ধ হয় । বিহারীরা পিছন থেকে গুলি করে দেয় ,সাথে সাথে উনি পড়ে যান নদীর পাড়ে , তার পর আরোও কয়েকটা গুলি ওনার বুক্ টা ঝাঝড়া করে দেয় । ঘটনা টা ঘটে সি এন্ড বি ঘাটের কাছে আর ওনার বাড়ী থেকে কিছুটা দূরে । লাশ পাওয়া গেল তার সেই চিরচেনা পদ্মানদীর পাড়ে । তারপর থেকে আমার কাকা ৭ বছর বেঁচে ছিলেন স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়ে আর চাচী কোনদিন রক্ত দেখতে পারতেন না , পাগলের মত দিন কাটাতেন । বাড়ীটা ছিল ফ রিদপুর শ হর থেকে ২/৩ মাইল দূরে চরমাধবদিয়া বাকীগঞ্জ মাদ্রাসার পাশে ।
স্বাধীনতার সূর্যটা তার দেখা হয় নাই । দেখা হয় নাই মায়ের সাথে ।
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই মহান মুক্তিযোদ্ধা সহ স্বাধীনতার সকল সূর্য সন্তানদের ।তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না ।