বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রতিটি বাঙালি ছেলেমেয়ের ইতিহাস । যারা সে সময় জন্ম গ্রহণ করেনি, মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানি বা গ্রামের স্থানীয় লোক যারা কোনো না কোনো ভাবে ১৯৭১ সনে এর সঙ্গে জড়িত ছিল; যে সব মুক্তি যোদ্ধা গ্রামে গঞ্জে বেঁচে আছেন, তাদের কাছ থেকে ও জেনে নিতে পারেন।
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে, এ ভাবে সমগ্র জাতি এক সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় নি বা শুনি ও নি । যুদ্ধকালীন সময় পূর্ব বাংলার লোকসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি, এক কোটি প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল; বাকিরা দেশে থেকে মুক্তি যোদ্ধাদের নিজেদের বাড়ি ঘরে লুকিয়ে রেখে, নিজে না খেয়ে ওদের খাওয়া থাকা ও বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে। মুক্তি যোদ্ধাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেকে রাজাকার, আল বদর,পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে; অনেকের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে এবং মাবোনদের ইজ্জত হারিয়েছে; লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ নিরুপায় হয়ে ভারতের বর্ডার পার হতে গিয়ে রাজাকারদের বা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে।
আমার আজ ও মনে পড়ে, মোহদ্দীরবাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম ভূইয়াঁ করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার প্রাক্কালে ইসলামাবাদ গিয়েছিলো, আমাদের এলাকার লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।আমার মনে পড়ে, সে দেশে আসার সময় আমাদের বলেছিলো,” দেশের পরিস্থিতি ভালো না , চলেন দেশে চলে যাই”। তার মাস খানেকের মধ্যে সেপ্টেম্বরের ১৯৭১ প্রথম সপ্তাহে, সে স্থানীয় রঘুনাথপুর বাজার তার বাবা ও অন্যদের সঙ্গে নৌকা করে গিয়েছিল ; ওটা ছিল বুধবার (সাপ্তাহিক বাজার দিন ); সে জানতো না রাজাকার বাচ্চু ও তার লোকজন দলবল নিয়ে বাজার আক্রমণ করবে। ঐদিন রাজাপুরা, শাহরাস্তি উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন, আরোও কয়েকজন সঙ্গী বাজারে “বগিরমার” বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল । “রাজাকার বাচ্চু ও তার দল খবর পেয়ে এসে আক্রমণ চালায় এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনকে গুলি করে শহীদ করে।
নজরুল ইসলাম ভূইয়াঁ নৌকায় বসে ছিল, রাজাকার তাকে নৌকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে তার বাবা ও অগণিত লোকের সামনে গুলি করে শহীদ করে। তার বাবা আর্তনাদ করে বলেছিলো আমার ছেলে নিরীহ, “ওকে না মেরে আপনারা আমাকে মারেন,” কিন্তু রাজাকারদের কোনো দয়া হয় নি।
ঘটনার এখানেই শেষ ছিল না, রাজাকার বাচ্চু ও তার সঙ্গীরা শহীদ আব্দুল মতিনের লাশ হাজীগঞ্জ থানা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে পাকিস্তানী আর্মিদের দেখিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছিল। ওরা বাজারে পুলের উপর গলায় রশি দিয়ে আব্দুল মতিনের লাশ ঝুলিয়ে রেখে লোকজনদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে এবং পরে লাশ ডাকাতিয়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়; স্থানীয় লোকজনের প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধারা এই লাশ নদী থেকে উঠিয়ে নিয়ে নাসিরকোট শহীদ কবরস্থানে দাপন করেছে।
আব্দুল মতিন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করে কেবলই বের হয়েছিল। তার মা বাবা, ভাই আবদুল মান্না এবং আত্মীয়দের আর্তনাদে কেউ ভয়ে শান্তনা দিতে ও সে দিন সাহস পায় নি ; পুরা পরিবার বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মগোপন করে কোনোরকমে জীবন বাঁচিয়েছিলো। (সূত্র:শহীদ আব্দুল মতিনের পরিবার) “
১৯৭১ সনে, এক কথায় বলা যেতে পারে যে সমগ্র জাতি যুদ্ধ করে দেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করেছে। এই ৯ মাস যুদ্ধ কালীন সময় লক্ষ লক্ষ মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। যদি জনগণ মুক্তিযুদ্ধাদের পাশে সে সময় না দাঁড়াতো, এই যুদ্ধ এত দ্রুত শেষ হতো না ।
আমাদের সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জনগণের সহযোগিতা নিয়ে যে ভাবে যুদ্ধ করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছে, তা ইতিহাসে বিরল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে সার্বভৌম দেশ অর্জন করে সমগ্র জাতিকে উপহার দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আল বদর, আল-শামস ৯মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা করে যে অপরাধ করেছে তার কোনো ক্ষমা হয় না, যদিও বঙ্গবন্ধু মানবতার খাতিরে ক্ষমা করে দিয়ে ছিলেন।
১৯৭০ সনে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ জয় জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁন ও আর আর পাকিস্তানী শাসকদের ভাবিয়ে তুলেছিলো; এরা চিন্তা ও করতে পারে নি আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এতগুলি আসন পাবে। পুরা বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানী শাসক গুষ্ঠি এক দিকে গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন এবং ওপর দিকে জাতিকে ধোকা দিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা করেছিল ।
একটা দেশে নির্বাচন দিয়ে, নির্বাচিত লোকদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে এ ভাবে প্রতারণা করে, রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত নিরীহ জনসাধারণকে কামান ও গোলাবারুদ নিয়ে হত্যা করা জঘন্য অপরাধ। পাকিস্তানী হায়না রাতের অন্ধকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও ছাত্রীনিবাস, টিচার্স কোয়ার্টার্স, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, অতর্কিত হামলা করে হাজার হাজার লোক হত্যা করেছে। এরা পশুর মত নীলক্ষেতে বসতিতে নিরীহ লোকদের হত্যা করেছে। পাকিস্তানী শাসকদের হিংসত্বমূলক এবং বাঙালি,হিন্দু বিরোধী মনোভাব এর মূল কারণ । পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন কুমিল্লা , চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী,যশোর পরিকল্পনা করে এক সঙ্গে আক্রমণ করেছিল।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের মানুষ দরকার নেই শুধু মাটির দরকার। “এটা ছিল পাকিস্তানী শাসক গুষ্ঠির বাঙালি বিদ্বেষ নীতি;ওরা স্বাধীনতার যুদ্ধের ৯ মাস পূর্ব পাকিস্তানে শাসনের নামে ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়েছিল। এরা লক্ষ লক্ষ মাবোনকে জোর করে ধরে নিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে মাসের পর মাস ধর্ষণ ও নির্যাতন করে মেরেছে। একটা স্বাধীন দেশে এ জাতীয় গণ হত্যা কি কোনো দেশ বা জাতি আশা করে ?
আমি ১৯৭০ সনে চাকুরী নিয়ে পাকিস্তানে গিয়েছি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে আটক ছিলাম; পরে রাতের অন্ধকারে তুরখাম বর্ডার ক্রস করে আফগানিস্তান -ইন্ডিয়া হয়ে দেশে চলে আসি।
পাকিস্তানিদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে গিয়ে আমরা বাঙালীরা তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমরা উর্দু জানতাম না; ওরা আমার মতো আরো অনেক বাঙালিকে উর্দু শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতো। কিন্তু বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বে ও ওরা এক শব্দ ও বাংলা শিখতে রাজি হতো না। আমাদের খাওয়া, আমাদের জাতীয় পোশাক বিশেষ করে আমাদের মহিলাদের শাড়ি এবং কপালে টিপ্ দেয়া নিয়ে ওরা প্রকাশ্যে সমালোচনা করতো। তাছাড়া আর একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি যে আমরা হাতে ভাত খাই ওরা রুটি খায় এবং ভাত খাইতে চামচ ব্যবহার করি না । ওরা প্রকাশ্যে সমালোচনা করতো যে আমরা কেন হাত দিয়ে ভাত খাই। আমরা মাছ খাই, মাছে গন্ধ হয় (মাস্সি সে বদবু হোতা হায়) এ নিয়ে কতরকম তামাশা করতো; ওদের সঙ্গে কাজের ফাঁকে একত্রে বসলে ওরা এ সব সমালোচনা করতো ।
একদিন হাস্য রসিকতা করতে গিয়ে একজন বলতেছিলো, সে খুলনা বা যেশোর কোথায় চাকরি করত। আমাদের দেশে অনবরত বৃষ্টি হলে পুকুর থেকে মাছ পানির স্রোতের বিপরীতে উপরে উঠে, কিভাবে আমাদের ছেলেরা সেই মাছ ধরে এর একটা বর্ণনা দিতে ছিল;অনেক পাকিস্তানী কর্মচারী এ নিয়ে হাঁসতে ছিল।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁন হোসাইন শহীদ সারওয়ার্দী সাহেবকে ভারতীয় নাগরিক এবং , দালাল বলে চাকুরিচ্যুত (প্রধান মন্ত্রী) করে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলো । এই সারওয়ার্দী সাহেব কে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বৈরুত এক হোটেলে রেখে দেয়; মৃত্যুর পর তার লাশ বৈরুত,লেবানন থেকে ঢাকা এনে রেস কোর্স ময়দানে দাপন করা হয়েছে ।
বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের একটি ছোট্ট গ্রাম এনায়েতপুর, উপজেলা কচুয়া,জেলা চাঁদপুর। ৭–৮ টি বাড়ি নিয়ে এই গ্রাম যার লোকসংখ্যা ১৯৭১ সনে চার শত থেকে পাঁচ সতের মধ্যে ছিল । এই গ্রাম থেকে আবু তাহের,আব্দুর রাজ্জাক, দেলোয়ার, আব্দুর রাশিদ এবং আরও দুই একজন (যাদের নাম আজ স্বরণে আসছে না ) বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে স্বক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করে ছিল। এরা সবাই আমাদের অতি আপন জন।
আবু তাহের ঢাকা কলেজে ছাত্র লীগের জেনারেল সেক্রেটারি,একজন সাংবাদিক এবং কচুয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন(আজ আর জীবিত নেই ); ওর অনুপ্রেরণায় বাকিরা আগরতলা গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ,রাজাকার ও আল বদর এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছিল।
এই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক ও আজ আর জীবিত নেই। আমার শিশু, কিশোর, যৌবন থেকে এদের সঙ্গে ছিল আত্মার আত্মীয়তার বন্ধন। ১৯৭১ সনে এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে এলাকাতে প্রচুর কাজ করেছিল।
আজকের দিনে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই সালাম যারা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে সমগ্র জাতিকে মুক্ত করে লাল সবুজ পতাকা উপহার দিয়েছিলো। আমাদের এই মুক্তিসেনারা চিরদিন প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে।
সমাপ্ত