মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধের একটি বড় অস্ত্র ছিল পাকিস্থানী সেনা কর্তৃক বাঙ্গালী নারী ধর্ষণ। ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সরাসরি বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পাকিস্থানী সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের ঐ নির্দেশে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্থানের সেনাবাহিনী এত ব্যাপক হারে নারী নির্যাতন করেছিল। শুধু তাই নয়, পাকিস্থানী জেনারেল টিক্কা খান সমন দেওয়ার ফলে ঐ দেশের সরকার যুদ্ধ চলাকালে সৈনিকদের বাঙ্গালী নারী ধর্ষনের বৈধতা দিয়ে ছিল। পাকিস্থান সরকারের পরিকল্পনা ছিল, তাদের সেনাবাহিনী দ্বারা ব্যাপকহারে গণ ধর্ষন করে বাঙ্গালী নারীর গর্ভে পাক – বাঙ্গালী শঙ্কর শিশুর বীজ বপন করা। যার ফলে পশ্চিম পাকিস্থানের আদলে পূর্ব পাকিস্থানে একটি নতুন প্রজম্মে গড়ে উঠে এবং বাঙ্গালী জাতিস্বত্তা বিলীন হয়। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্থানী সেনারা কেবল সাধারণ মানুষের উপর নয়, প্রচন্ড আক্রমন চালায় বাঙ্গালী নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরও। সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী সদস্য, আইপিআর ও পুলিশকে হত্যা করা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বড় লক্ষ্য। তাই তারা এক যোগে আক্রমন করে পিলখানার আইপিআর ছাউনি এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর। রাত ১২ টায় এই দুই জায়গায় পাকিস্থানী সেনারা পৌছে। পিলখানায় বাঙ্গালী জওয়ানরা প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। কিন্তু বেশীক্ষন ঠেকিয়ে রাখতে পারেন নি। রাজারবাগের পুলিশেরা অতি তুচ্ছ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রবল যুদ্ধ করেন। ২৬ শে মার্চ সকালে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী পুলিশ লাইনের ব্যারাকের চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে বাঙ্গালী পুলিশদের নাকে, মুখে, সারা দেহে বেয়নেট ও বেটন চার্জ করতে করতে ও বুটের লাথি মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসে। সেই সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস এফ ক্যান্টিনে ছিলেন সুইপার রাবেয়া খাতুন। নিচে তার প্রত্যক্ষ বিবরন তুলে দেওয়া হলো ।

“ক্যান্টিনের কামড়া থেকে বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও বের করে আনা হয়। আমাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়, তারা আমার উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করছিল আর কুকুরের মত অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছিল। আমার উপর উপর্যূপরি পাশবিক অত্যাচার করতে করতে যখন আমাকে একেবারে মেরে ফেলে দেওয়ার উপক্রম হয়, তখন আমার বাঁচবার আর কোন উপায় না দেখে আমি আমার প্রান বাঁচাবার জন্য ওদের নিকট কাতর মিনতি জানাই। আমি হাউমাউ করে কাঁদ ছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরো না, আমি সুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করার মত আর কেউ থাকবে না ——তখনো আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর। কুকুরের মতই আমার কোমড়ের উপর চড়াও হয়ে আমাকে উপর্যূপরি ধর্ষন করছিল।পাঞ্জাবী  সেনারা রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙ্গালী যুবতী মেয়ে, রূপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জীপে, মিলিটারী ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে জমায়েত করতে থাকে। আমি ক্যান্টিনের ড্রেন পরিস্কার করছিলাম। দেখলাম আমার সম্মুখ দিয়ে জীপ থেকে আর্মি ‍ট্রাক থেকে লাইন করে বহু বালিকা, যুবতী ও মহিলাকে এস. এফ ক্যান্টিনের মধ্য দিয়ে ব্যারাকে রাখা হল। বহু মেয়েকে হেড কোয়াটার বিল্ডিংয়ের উপরতলার রুমে নিয়ে যাওয়া হল। আর অবশিষ্ট মেয়ে যাদেরকে ব্যারাকের ভিতরে জায়গা দেয় গেল না তাদেরকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা হল। অধিকাংশ মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখলাম। অনেক রূপসী যুবতীর দেহে অলঙ্কার দেখলাম। তাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছিল। এরপরই আরম্ভ হয়ে গেল সেই বাঙ্গালী নারীদের উপর বিভৎস ধর্ষন, ——— ওদের উম্মও উল্লাসের সামনে কোন মেয়ে কোন শব্দ পর্যন্ত করে নায়, করতে পারে নায়।, যে সকল বাঙ্গালী যুবতী ওদের পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করল দেখলাম তৎক্ষনাৎ পাঞ্জাবী সেনারা ওদের চুল ধরে টেনে ছিড়ে ফেলে দিয়ে ওদের যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারাল ছুড়ি ঢুকিয়ে সেই বীরাঙ্গনাদের পবিত্র দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছিল। অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের অসার রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজনে দুপা দুদিকে টেনে ধরে চড়চড়িয়ে ছিড়ে ফেলে দিল। আমি দেখলাম সেখানে বসে বসে, আর ড্রেন পরিস্কার করছিলাম। পাঞ্জাবীরা শ্বশানের লাশ খেকো কুকুরের মত মদ খেয়ে সব সময় সেখানকার যার যে মেয়ে ইচ্ছা তাকেই ধরে ধর্ষন করছিল। শুধু সাধারন পাঞ্জাবী সেনারাই এই বীভৎস পাশবিক অত্যাচারে যোগ দেয় নায়। সকল উচ্চপদস্থ পাঞ্জাবী সামরিক অফিসারই মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মত হয়ে দুই হাত বাঘের মত নাচাতে নাচাতে সেই — উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙ্গালী মহিলাদের উপর সারাক্ষন পর্যায়ক্রমে ধর্ষন কাজে লিপ্ত থাকত। কোন মেয়ে, মহিলা, যুবতীকে এক মুর্হুতের জন্য অবসর দেওয়া হয় নাই। ওদের উপর্যূপরি ধর্ষন ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা সেখানেই রক্তাক্ত দেহে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। পরের দিন এ সকল মেয়ের লাশ অন্যান্য মেয়েদের সম্মুখে ছুড়ি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত। এরপর উলঙ্গ মেয়েদেরকে গরুর মত লাথি মারতে মারতে, পশুর মত পেটাতে পেটাতে উপরে হেড কোয়াটারের দোতালা, তেতালা ও চারতালায় উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হত। পাঞ্জাবী সেনারা চলে যাওয়ার সময় মেয়েদেরকে লাথি মেরে আবার কামড়ার ভিতর ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে চলে যেত। প্রতিটি মেয়ের হাত বাধা ছিল পিছনের দিকে, শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেক সময় পাঞ্জাবী সেনারা সেখানে এসে সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাথারি বেদম প্রহার করে যেত। প্রতিদিন এভাবে বিরামহীন প্রহারে মেয়েদের দেহের মাংস ফেটে রক্ত ঝরছিল। মেয়েদের কারো মুখের সম্মুখের দিকে দাঁত ছিল না। ঠোটের দুদিকের মাংস কামড়ে, টেনে  ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল, লাঠি ও লোহার রডের অবিরাম পিটুনিতে প্রতিটি মেয়ের আঙ্গুল, হাতের তালু ভেঙ্গে থেঁতলে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই সব অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত মহিলা ও মেয়েদের প্রসাব ও পায়খানা করার কাজে হাতের ও চুলের বাঁধন খুলে দেওয়া হত না এক মূহুর্তের জন্য, হেড কোয়াটারের উপর তলার বারান্দায় এই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েরা হাত বাধা অবস্থায় লোহার তারে ঝুলে থেকে সেখানে প্রসাব পায়খানা করতো – আমি প্রতিদিন সেখানে গিয়ে এই সব প্রসাব পায়খানা পরিষ্কার করতাম। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, অনেক মেয়ে অবিরাম ধর্ষনের ফলে নির্মম ভাবে ঝুলন্ত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিদিন সকালে গিয়ে সেই বাঁধন থেকে অনেক বাঙ্গালী নারীর বিভৎস মৃতদেহ পাঞ্জাবী সেনাদেরকে নামাতে দেখেছি। আমি দিনের বেলায়ও সেখানে সেই সকল বন্দী মহিলাদের পুতি গন্ধ, প্রসাব – পায়খানা পরিস্কার করার জন্য সারাদিন উপস্থিত থাকতাম। প্রতিদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ব্যারাক থেকে এবং হেড কোয়ার্টার অফিসের উপরতলা হতে বহু ধর্ষিতা মেয়ের ক্ষত বিক্ষত বিকৃত লাশ ওরা পায়ে রশি বেঁধে নিয়ে যায় এবং সেই জায়গায় রাজধানী থেকে ধরে আনা নতুন নতুন মেয়েদের চুলের সঙ্গে  ‍ঝুলিয়ে বেঁধে নির্মম ভাবে ধর্ষন আরম্ভ করে দেয়। এই সব উলঙ্গ নিরীহ বাঙ্গালী যুবতীদের সারাক্ষন সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনারা প্রহারা দিত। কোন বাঙ্গালীকেই সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। আর আমি ছাড়া অন্য কোন সুইপারকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না।”

১৯৭১ এ নারী নির্যাতনের এই চিত্র শুধু যে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিল তা নয়। দীর্ঘ নয় মাস এই চিত্র ছিল সমগ্র বাংলাদেশের। সারা দেশের ৪৮০ টি থানা ২৭০ দিন পাক সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট, পুলিশ ব্যারাক, স্থায়ী সেনা বাঙ্কার, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, সরকারীভবন ছিল ধর্ষন কেন্দ্র। নদী পথে লঞ্চে, ট্রলারে করে, ট্রাকে করে কখনো দিনে আবার কখনো রাতের অন্ধকারে শিকারীর মত হানা দিত পাকিস্থানী সেনারা। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এসে তারা বাড়ীর মেয়ে বৌদের নির্যাতন করত। রাস্তা ঘাটে জনসমক্ষে নির্যাতন করতেও তারা পিছপা হত না। শুধু একবার নয়। বার বার করে এসেছে পাকিস্তানী সেনারা, আবার যাবার সময় মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে ‍গিয়েছে তাদের সাথে। ৭ বছর থেকে শুরু করে ৭৫ বছর বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউই বাদ যায় নি তাদের হাত থেকে। আর পাকিস্থানী সেনাদের এই কাজে সহায়তা করত আল শামস আল বদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যগণ। পাক সেনাদের সহযোগীতা করার জন্য এরা তাদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেত। যে সব বাড়ীতে মা, বোন, মেয়ে আছে – পাকিস্থানী সেনাদের সেই সব বাড়ীতে নিয়ে যেত। আলবদর, রাজাকারেরা বাড়ীর মেয়েদের পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। পাকিস্থানী সৈন্যদের সাথে সাথে এরা টাকা পয়সা, বাসন পত্র, গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী, ফসল সবকিছু লুট করতো। লুট করা শেষে বাড়ী ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিত। শুধু তাই নয় পাক সেনাদের সাথে এরাও মহা উৎসাহে ধর্ষন কাজে লিপ্ত হত। নোয়াখালীর হাসিনা বেগমকে মিলিটারীরা তাদের গাড়িতে তুলে নেওয়ার সময় রাজাকারেরা তার ৭ বছরের মেয়ে রাবিয়াকেও তুলে নিয়ে যায়। ৩/৪ জন রাজাকার জ্বরে আক্রান্ত রাবিয়াকে ধর্ষন করে। ৩ দিন রক্ত ক্ষরনের পর মারা যায় রাবিয়া। 

ঠাঁকুরগায়ের কমলা বেগম যুদ্ধের সময় ৬/৭ মাসের অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক দেড় মাস পরই তিনি ধরা পড়েন পাকিস্থানী সেনাদের হাতে। সন্ধ্যার সময় মিলিটারি গ্রামে প্রবেশ করলে আতঙ্কিত হয়ে তিনি ও সবার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিছু দুর যাবার পর কমলার সাথে দেখা হয় তার দেবর ও আরো ২/৩ জনের। দেবর তাকে এই শরীর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে নিষেধ করে এবং আশ্বস্ত করে এই বলে যে, যতক্ষন সে বাড়ী থাকবে কমলা নিরাপদে থাকবে। দেবরের কথা শুনে দেবরের সাথে বাড়ী ফিরলেন কমলা। কিন্তু ঐ ফাঁকা বাড়িতে দেবরই প্রথম ধর্ষন করে তাকে। দেবর তাকে শাষিয়ে দেয় এই ঘটনা না জানানোর জন্য। কিন্তু কমলা তার স্বামী এবং শাশুড়ির কাছে ঘটনাটি জানালে দেবর ক্ষেপে যায়। এর কয়েকদিন পর তার দেবর একদল মিলিটারি নিয়ে আসে বাড়িতে। কমলাকে রান্না করতে বলে  সবার জন্য। ভয়ে সবাইকে রান্না করে খাওয়ালেন কমলা। শাশুড়ি, দেবরের কাছে প্রতিবাদ করলে দেবর বলে তাদের বাড়িতে মিলিটারিরা কোন দুশমনি করবে না। গভীর রাতে কমলার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় শাশুড়ির। কান্নাকাটি করেও রক্ষা করতে পারেন  নি কমলাকে। সেই রাতে মিলিটারিরা ধর্ষন করে কমলাকে। শুধু তাই নয়, শেষ রাতের দিকে তারা তুলে নিয়ে কমলাকে। প্রথমে কাছের একটি ক্যাম্পে পরে আরো তিন ক্যাম্পে পাঁচ মাস ছিলেন কমলা। একাত্তরের নির্যাতনের সেই দুঃসহ ভাষ্য এবার তার ভাষায়- 

“একটু পর পর আমি বেহুশ হই। আবার হুশ ফিরে আসে। দ্বিতীয় দিন আমার অবস্থা বেশী খারাপ হয়। তৃতীয় দিন আমার অবস্থা আরো খারাপ। প্রথম দিন থেকেই পেটে ব্যথা। তৃতীয় দিন যখন মিলিটারিরা আমাকে নির্যাতন করছে এই অবস্থায় আমার বাচ্চাটা জন্ম নেয়, বাচ্চাটা মনে হয়  একদিন আগেই মরে গিয়েছিল। পেটের ভিতরে ওর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একদিন আগেই। একদিন প্রসবের জ্বালা যন্ত্রনা, অন্যদিকে মিলিটারিদের নির্যাতন। আহারে আমি কত যে তাদের হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছি। বলেছি- হয় আমাকে মেরে ফেল, না হয় ছেড়ে দাও। আর সহ্য করতে পারছি না। আমি যত বেশী তাদের অনুরোধ করেছি তারা তত বেশী কষ্ট দিয়ে নির্যাতন করেছে, তত বেশী উল্লাশ করেছে তারা। তৃতীয় দিন শেষ রাতে আমার বাচ্চাটা হল।বাচ্চাটা যখন মাটিতে পড়েছে, তখনো আমার ফুলটা পড়েনি। এই অবস্থায়ও মাফ নেই, আবার ও চলল নির্যাতন। এক সময় বেহুশ হয়ে পড়লাম। যখন হুশ এল, দেখি চার দিক আলো। বুঝতে পারলাম সকাল হয়ে গিয়েছে। আমি পড়ে আছি, সারা শরীর রক্তে ভিজে চপচপে হয়ে আছে।অনেক চেষ্ঠা করলাম উঠে বসার জন্য, কিন্তু পারিনি।ও ভাবেই পড়ে ছিলাম নিঃসাড় হয়ে।

কিছুক্ষন পর দুই/তিন জন মিলিটারী এসে চুল ধরে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেল অন্য আরেক ঘরে, সে ঘরে প্রতিদিন রাখত, এটা সেই ঘর নয়। আমার শরীর থেকে তখন অনর্গল রক্ত বের হচ্ছে।গরু জবাই করলে যেমন গলগল করে রক্ত বের হয় তেমন। এর কিছুক্ষন পরে ঐ ঘরে এল একজন মহিলা। সে ছিল আমার মতই বন্দী। আমার অবস্থা দেখে সে নিজেই যেন ভয় পেয়ে গেল। টানতে টানতে আমাকে যখন নিয়ে আসা হল আরেকটি ঘরে সেই সঙ্গে আমার বাচ্চাটাও ছিল। ঐ মহিলা আমাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে একটি পাঞ্জাবী পরিয়ে দিল। পরিস্কার করা ছাড়া আর কোন সাহায্যই সে করতে পারেনি, রক্ত পরাও বন্ধ করতে পারেনি, শুধু আস্তে আস্তে সান্ত্বনা দিয়েছিল। কারন-বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মিলিটারী, এমন ভাবে ঘরের ভিতর পড়ে ছিলাম দুই / তিন দিন। এই ঘরে কেউ আসে না। এই সময় খাবার তো দুরের কথা। এক গ্লাস পানিও দেওয়া হয় নি আমাকে।তিন দিন পরে দেখলাম বারান্দা দিয়ে একজন মিলিটারি যাচ্ছে।আমার কষ্টের শব্দ শুনে ঘরে এল সে, আমাকে ঔষুধ দিল। ঐ ঔষুধ খেয়ে আমি সুস্থ্য হলাম বটে কিন্তু নিস্তার পেলাম না।

এর দুই / তিন দিন পর হঠাৎ একদিন বিকালে আমার দেবর এসে হাজির। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার কথা না শুনলে কি হয় দেখেছো ? আমার কথা যে শোনেনি তারই এমন অবস্থা হয়েছে। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে যাদের জানা নেই, তাদের অবস্থা এমনই হবে। এসব বলছে আর আমি চুপ করে আছি। আমি কেন চুপ সেটাও আমার অপরাধ। চুপ করে থাকার কারনে আমাকে এলোপাথারি মারতে শুরু করলো সে। মারতে মারতে যখন কাহিল হয়ে পড়ল, তখন চলে গেল অন্য ঘরে। সন্ধ্যার পর আবার আমাকে নেওয়া হল আরেকটি ঘরে।সেখানে দেখি বসে আছে আমার দেবরও।তারপর থেকে প্রায় রাতেই আসত সে, মিলিটারিদের সাথে মদ খেয়ে এবং তাদের সাথে তাল মিলিয়ে নির্যাতন করতো আমাকে। একাত্তরে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধুই আঘাতের ক্ষত ছিল। হাত পায়ে ছিল ধারালো ছুড়ির আঘাত, পেটে বুকে উরুতে ছিল কামড়ের দাগ। সেই সব আঘাতের ক্ষত কখনো শুকানো সুযোগ পেত না।শুকানোর আগেই আবার করা হত আঘাত নির্যাতন।এক সময় সারা শরীরে পচন ধরল, পূঁজ বের হল।সারা শরীর ফুলে একাকার। শরীরে কাপড় লাগালেই ব্যাথায় অস্থির হয়ে যেতাম। তারপরও এক রাত রেহাই পায়নি।এরপর আস্তে আস্তে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি। ভাবতে শুরু করি, এবার আমার মৃত্যু নিশ্চিত।তখন থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। এক সময় নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়ে ছিলাম, কিন্তু কোন উপায় ছিল না। যারা বন্দী থাকেন, তাদের তো সব পথই বন্ধ।” 

এমনই হৃদয় বিদারক, মর্মান্তিক দুঃখের কাহিনী আমরা জানতে পারি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লেখা সুরমা জাহিদের গবেষনা মূলক গ্রন্থ গুলিতে।

পাকিস্থানী সেনাদের হাতে নির্যাতীত এক বীরাঙ্গনা রাশিদা চাকমা। তাকে কখনো ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পে, দু/চার দিন রেখে দিন রাত ধর্ষন অত্যাচার করে আবার বাড়ী রেখে আসত। এমনও হত কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবার দল বেঁধে তার বাড়ী এসে দিনভর পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন করে চলে যেত। বাড়ীতে থাকাকালীন সময়ে যে, সে পালাবে তারও কোন উপায় ছিল না। রাতে তার ঘরের দরজা বাহির থেকে তালা বদ্ধ করে দিনের বেলা তাকে পাহাড়া দিয়ে রাখত। তবুও একদিন একটুখানি সুযোগ বুঝে রাশিদা কিছুটা পথ পালিয়েছিল। কিন্তু সে ধরা পড়ে যায় এবং এর জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়। শাস্তি স্বরূপ তার বাবা মায়ের সামনেই পালাক্রমে ১২/১৩ জন্য পরপর তাকে পাশবিক নির্যাতন চালায়। এক সময় তার বাবা তাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলে রাশিদা এবং তার বাবাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সারা শরীর রক্তাক্ত করে তারপর লবন লাগিয়ে দেয়। রাশিদার সামনেই তার বাবাকে কেটে তিন টুকরো করে হত্যা করা হয়। এরপর সেই ভয়ে রাশিদা আর পালাবার সাহস করেনি।এই ভাবেই দীর্ঘ নয় মাস কাটে রাশিদার। আরো আরেকজন বীরাঙ্গনা নারী নুরজাহান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। দু / চার দিন পর পর তার ক্যাম্প বদল করে, এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে ‍গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করতো। পাশবিক নির্যাতন করতে করতে তার স্তনের মাংস কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে ছিল। সেই ক্ষত চিহৃ আজও আছে।ক্ষত এতটাই গভীর ছিল যে স্তনে ঘা হয়ে পচন ধরে যায়। এক সময় দুর্গন্ধ ছাড়ায়, তারপরও তাকে রেহাই দেওয়া হয়নি। তাকে দু / এক দিন পর পরই অবর্ণনীয় অমানবিক বিকৃত রুচির পাশবিক নির্যাতন করা হত। কারন তার কাছে জানতে চাওয়া হত কোন কোন বাড়ীতে মেয়ে বউ আছে। অন্য কেউ এই অত্যাচার নির্যাতনের সম্মুখীন হোক নুরজাহান তা চাইতেন না। তাই তিনি এত অত্যাচার সহ্য করতেন। কিন্তু তথ্য না দেওয়ার কারণে একদিন তার যোনি পথে সিদ্ধ করা গরম ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।চারটা ঢুকানো পর আর সহ্য করতে না পেরে নুরজাহান তখন দুজন মহিলার সন্ধান দেন।তখনকার মত তার উপর নির্যাতন থামে। 

মুনষত্ব আর বিবেক বোধের এমনই চরম অবক্ষয় ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। কোন কোন নারীকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বার ধর্ষন করেছে।আর এক একটি বার গণ ধর্ষনে ৮ / ১০ জন থেকে ১০০ জন পর্যন্ত অংশ নিয়েছে। পাক সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে কত নারী মৃত্যুবরণ করেছে, আর যারা মৃত প্রায় হয়ে যেত পাক সেনারা তাদের ঐ অবস্থায় মাটির গর্তে কিংবা ঝোপে জঙ্গলে ফেলে রাখতো। অথবা গুলি করে কখনো ছুড়ি দিয়ে কেটে হত্যা করতো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্থানী সেনা আর রাজাকারদের দ্বারা ৪ লক্ষেরও বেশী নারী নির্মম পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। যুদ্ধ শেষে অত্যাচারিত নারীরা ক্ষত বিক্ষত যৌনাঙ্গ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনি পথ, কেটে ফেলা উরু, স্তন পচন ধরে দুর্গন্ধ বের হওয়া শরীর নিয়ে পূর্নবাসন কেন্দ্রে আসতেন। পাকিস্থানী সেনাদের দ্বারা নির্বিচারে এই গণ ধর্ষনের ফলে বহু সংখ্যক নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। ধর্ষিতা নারীদের গর্ভপাত ঘটাতে এবং চিকিৎসা সহায়তা দিতে ১৯৭২ সালে অষ্ট্রেলীয় চিকিৎসক ডাঃ জিওফ্রে ডেভিস এসেছিলেন বাংলাদেশে। সেই সময়ে তিনি ঢাকায় প্রতিদিন ১০০ নারীর গর্ভপাত ঘটিয়েছেন।এইভাবে গর্ভপাত ঘটানোর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজার। তবে এই সংখ্যার হিসাব ছিল শুধু শহর অঞ্চলের। গ্রাম অঞ্চলের নারীদের আত্মীয় স্বজন গ্রাম্য দাই ও স্থানীয় চিকিৎসক এর দ্বারা তাদের গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন। আবার অনেক অবস্থা সম্পন্ন অবস্থা নারীরা ভারতে গিয়ে গর্ভপাত ঘটিয়ে এসেছিলেন। তবে এসবের কোন কিছুরই সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। যারা গর্ভপাত ঘটাতে সক্ষম হন নি তারা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন বাংলাদেশে। এই যুদ্ধে শিশুর সংখ্যা ২০ থেকে ৬০ হাজার। আবার বেঁচে যাওয়া নারীদের অধিকাংশই নানা রকম অসুখের শিকার হয়েছেন অথবা তারা আর কখনই সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হন নি।


আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন