সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা ! যারা আমাকে ও আমার পরিবারকে বর্ষবরণের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।আগামী বছর সবার জন্য ভালো হোক এই কামনা করছি।
আজ বছরের প্রথম দিনে কম্পিউটার ওপেন করে মেইল চেক ও অন্যানো রুটিন কাজ করে প্রবাসী ব্লগ ওপেন করেই আমার ছোট ভাইয়ের একটি লেখা দেখলাম। সে নিয়মিত লেখে ও খুবই ভালো লেখে। তার আজকের লেখায় আমাদের বাবার ডায়রির কথা উল্লেখ করেছে। বাবার কথা মনে পড়তেই তাঁর চেহারা ,ব্যাক্তিত্ব ,কর্মজীবন ইত্যাদি সম্পর্কিত অনেক কথা মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। সব কিছু এক কোথায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়. কারণ এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যাপক একটি বিষয়। তাই বাবা কে নিয়ে আজ শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি ঘটনার উল্লেখ করবো।
তবে এ ঘটনাটি উল্লেখ করার আগে বাবার কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। আমার বাবার কর্মজীবন শুরু ১৯৫০ সালের কিছু আগে বা পরে। ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই পুলিশ বাহিনীর একজন নিয়মিত সদস্য হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। গ্রামীণ একজন কৃষক পরিবারের ছেলে সাধারণত এভাবেই কর্মজীবনে প্রবেশ করতেন ঐসময়ে। ব্যাক্তিগত বা কর্মজীবনে বাবা ছিলেন একজন সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। আমার বয়োবৃদ্ধির পর অর্থাৎ আমি বুঝতে শেখার পরে বাবার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে তার সততা ও কর্তব্য নিষ্ঠা আমার কাছে অতুলনীয় হয়।
তার কর্মজীবনের প্রায় ২৬ বছরই বৃহত্তর যশোর জেলার বিভিন্ন থানায় অতিবাহিত হয়।এর মধ্যে এক যুগের বেশি সময় তিনি যশোর সদরে চাকুরী করেছেন।আমার ছোট তিন বোনের জন্মও যশোর জেলায়।তাই আমাদের সব ভাইবোনের লেখা পড়া, কথাবার্তা বা চালচলন সবই যশোরের সাথে সংশ্লিষ্ট। চাকুরীজীবনের বাকি বছর গুলি তিনি কুষ্টিয়া জেলায় অতিবাহিত করেন এবং কুষ্টিয়া থেকেই ১৯৮৬ সালে অবসরে যান।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় বাবার পোস্টিং ছিল ঝিনাইদহ জেলার সদর থানার সেকেন্ড অফিসার। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে আমি, আমার ছোট বোন ও আমার মামাতো ভাই ( যে আমাদের বাসায় থেকে ঝিনাইদহ কেশবচন্দ্র কলেজে লেখাপড়া করতেন) দেশে বাড়িতে চলে আসি কয়েকদিন বেড়ানোর জন্য। যুদ্ধ শুরুর ২/৩ দিনের মধ্যে ( সঠিক সাল তারিখ মনে নাই) বাবা মা আমার ছোটভাই ও বোনকে নিয়ে ঝিনাইদহ থেকে পায়ে হেঁটে মাগুরা-নড়াইলের ভিতর দিয়ে বহু কষ্টে গোপালগঞ্জে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছান। ঝিনাইদহে আমাদের বাসায় সব কিছু ফেলে এক কাপড়ে চলে আসতে হয়েছিল বলে মা খুব মনকষ্টে ছিল।
যাইহোক ,গ্রামের বাড়িতে চলে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও এতদসংক্রান্ত খবরাখবর নিয়েই আমাদের সময় কাটতে লাগলো। বাবা ও তার কয়েক বন্ধু ভারতে চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণের জন্য। ভারত থেকে ফিরে এসে বাবা খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি তেরখাদা থানার ফাতলা বাজারে স্থাপিত ক্যাম্পের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন।ঐএলাকা খুলে সদর থেকে উত্তরে ও মোল্লাহাট থেকে উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। ফাতলা গ্রামটি একটি বড় ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম। প্রতি সপ্তাহে হাট বসতো ফাতলা হাই স্কুল মাঠে। তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল পায়ে হাঁটা অথবা নৌকা।
বাবার কাছ থেকে গেরিলা যুদ্ধের কিছু কিছু ঘটনা শুনেছিলাম। তবে সেসব বিষয় এখানে উল্লেখ করতে হলে লেখার কলেবর অনেক বেড়ে যাবে। তাই শুধু আমার লেখার শিরোনাম ‘একজন রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার গল্প ’ বিষয়েই আলোকপাত করতে চাই।
দুৰ্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে ঐ রাজাকার ছিল আমার এক চাচা। সে আমার বাবার আপন ফুপাতো ভাই। তার নাম কেরামত আলী। বয়সে সে আমার বাবার থেকে অনেক ছোট ছিল। তারা দুই ভাই ও এক বোন।আমার বাবার ফুফু বাড়ি ছিল তৎকালীন খুলনা জেলার মোল্লাহাট থানার মোল্লারকুল গ্রামে। আমার বাবার ঐ ফুফা ছিলেন একজন ধার্মিক প্রকৃতির লোক। ঐ গ্রামে আমার বাবার মেজো বোন অর্থাৎ আমার মেজো ফুফুর ও বিয়ে হয়েছিল। আমার ফুফাও একজন ধার্মিক লোক ছিলেন। আসলে আমার যতদূর মনে পড়ে সেটা হলো ঐ এলাকার সকল অধিবাসীই কমবেশী ধার্মিক প্রকৃতির লোক ছিলেন।
কেরামত কাকা ব্যাক্তিগত জীবনে খুব সহজ সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন। তখনও তিনি অবিবাহিত যুবক । আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে আমার চাচাদের সাথেই থাকতেন। তবে আমার বাবাকে খুব সম্মান করতেন এবং ভয়ও করতেন। আমাদেরকে তিনি খুবই আদর করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশের সব এলাকায় জনগণ দুই শিবিরে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ ও বিপক্ষ বিভক্ত হয়ে পড়ে। একথা আমরা সবাই জানি। তো স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মপরায়ণ পরিবারের সদস্য বিধায় আমার কেরামত কাকা ও তার এলাকার লোকজন অনেকেই রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে। পারিবারিক বা সামাজিক চাপে তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করলেও মনে প্রাণে রাজাকার ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি আল বদর ও রাজাকারদের গতিবিধি ও অভিযানের অনেক খবরা খবর দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করেন।
কেরামত কাকাদের মূল ক্যাম্প ছিল মোল্লাহাট। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মোল্লাহাট থানা সদরে আল বদর ও রাজাকার বাহিনীর বড় ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্প থেকেই আল বদর ও রাজাকাররা আসে পাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাতো। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে মোল্লাহাট থানা সদর এক মাইলের পথ। প্রতি সপ্তাহে মোল্লাহাটের বাজারে যেতাম আমার মেজো চাচা বা দাদার সাথে। আমার দাদা তখনও জীবিত ছিলেন এবং ভালোভাবেই চলাফেরা করতে সক্ষম ছিলেন। মোল্লাহাট গেলে আমাদের কেরামত কাকার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। তখন মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। আমাদের ঐ অঞ্চলের অনেক তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এসেছে।সবাই আগামী দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এক দিন ছদ্দবেশে কেরামত কাকা ফাতলা হাটে আমার বাবার সাথে দেখা করেন।
রাতে খাবার পরে আমার বাবাদের ক্যাম্পে তখন উৎসবের আমেজ চলছে। অনেক রাতে ক্যাম্পের প্রহরী বাদে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ,সেই সময় বাবা ও অন্যানদের সাথে ঘুমে মগ্ন। হটাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় তার ।বাবা জানালার কাছে আসার আগেই বাইরে প্রহরীর কণ্ঠস্বর শোনা গেলো ,হল্ট ! হল্ট !! অন্নান্য অনেকেও ঘুমে থেকে উঠে এসেছে। বাহিরে এসে বাবা দেখলেন, ভিজে কাপড়ে ঠান্ডায় প্রহরীদের রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেরামত কাকা ও তার আর এক বন্ধু আফজাল। বাবাকে দেখে সে কেঁদে ফেললো এবং বললো ,ভাইজান আমাদের ডিঙি নৌকা বিলের মধ্যে রেখে আমরা সাঁতার কেটে এখানে এসেছি। নৌকায় ১০/১২ টি রাইফেল ও কয়েক বাক্স গুলি আছে। আমাদের মারবেন না। বাবা ও ক্যাম্প কমান্ডার পরামর্শ করে কেরামত কাকা ও তার বন্ধুকে ক্যাম্পে থাকতে অনুমতি দিলেন। সেইসাথে অন্নান্য মুক্তিযোদ্ধাদের শান্ত করলেন এবং জানালেন সে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেছেন।
যুদ্ধের পরবর্তী কয়েকদিন কেরামত কাকার দেয়া তথ্য নিয়ে ঐ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অভিযান চালায় এবং প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। সেই সাথে অনেক রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সদস্যদের ধরতে সক্ষম হন।
তো এই হলো একজন সত্যিকার রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার গল্প। এ গল্পটি শুধু গল্পই নয়। গল্পের ৯৫% ঘটনাই সত্য। আজকাল দেশে বিদেশে যেভাবে রাজাকাররা কাগজ কলমে ও রাজনৈতিক লেবাস পরিবর্তন করে রাতারাতি রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে তা আমরা সবাই জানি। তবে আমার জানা এ ঘটনার মতো রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার ঘটনা আর কারো জানা আছে কি ? থাকলে আসুন , শেয়ার করে সবাইকে জানাই।
I like the real life story. Thanks for sharing!
তারেক,
আপনার কাহিনী শুনবো ?