( মোঃ জহির মিয়া (মুক্তিযোদ্ধা)-এর ডায়েরী থেকে )
“আমি গণহত্যা দেখেছি, একখানা
দেখেছি কাঁকর-খোয়া উড়তে ঝাঁকে-ঝাঁকে
দেখেছি নীহারকণা বোমার মতন ঝ’রে পড়তে
মুখের উপরে হায় আমার মনের দরজা বন্ধ করল ওরা
কার্ফিউ কায়েম করল, ব্যারিকেডে রাস্তা ভরল ওরা
আমার হৃদয় বদ্লে গেল সরু একটা গলিতে
বদ্লে গেল পাঁজর পাথরে”
(মাহমুদ দারবিশ, অনুবাদ: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
আমাদের এই পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে তীব্র ভালোবাসাটুকু আমরা অনুভব করি মাতৃভূমির জন্য । আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমাদের মাতৃভূমির জন্য যে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছিলো, সেই ত্যাগ আর অর্জনের ইতিহাসে গভীর মমতাভরা সাহস নিয়ে আমি শামিল হতে পেরেছিলাম । আমি চোখ বন্ধ করলে আজও টের পাই সেই বজ্র কন্ঠের আওয়াজ, আমাদের জাতির পিতা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের সেই উদাত্ত আহবান । আমি মাঝে মাঝেই স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই, অনুভব করি সেই তীব্র ভালোবাসাটুকু যা আজও বুকে লালন করে চলেছি ।
মুক্তিকামী মন:-
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল আমার বাবা মারা যান । আমার বাবা ছিলেন সচেতন ও স্বাধীনচেতা এক মানুষ । তিনি আমাকে ব্রিটিশ শাসনের কথা বলতেন, পাকিন্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে অন্যায়, শোষণ আর নির্যাতন হতো সেসব কথা বলতেন । বাবার কাছে শুনে আমি জানতে পারি, ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব বাংলা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান নামধারী বাঙালি অধ্যুষিত ভূখণ্ডের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের দ্বারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সর্বোপরী মানবিক জীবনযাপনের নানারকম বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়। আমি মন দিয়ে শুনতাম; আমার বাবার মুখে এক মহানায়কের কথা ! বাবার মুখে শুনতে শুনতে আমি তীব্রভাবে অনুভব করতাম আমার বাবার স্বপ্নে লালন করা স্বাধীনতার । আমি আমার গ্রাম লালপুরে বড় হয়েছি খুব কাছ থেকে আকাশ দেখতে দেখতে । দেশ তখন উত্তাল । বাবার মৃত্যুর কিছুদিন আগের ঘটনা । ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান । জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে গেছে, এ ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে তখন মুহূর্তের মাঝে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে আসে । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান ৭ মার্চ ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ । বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো ।
১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা । সে সময় সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে আব্দুল জানের বাড়িতে পাক সেনাদের ব্যাঙ্কার ছিলো। সেই ব্যাঙ্কার থেকে মর্টার সেল, এলএমজি ব্রাশ ফায়ারে এলাকা প্রকম্পিত হয়েছিলো। আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারে গোলা-বারুদের বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যেতো । আমরা নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য রাতের অন্ধকারে গজারিয়া নদী ও খালের পার্শ্বে আশ্রয় নিতাম।
একদিনের ঘটনা । পাকসেনারা সুনামগঞ্জ শহর থেকে গামবোট নিয়ে সুরমা নদি পার হয়ে গোলাবর্ষণ করতে করতে চাঁনপুর, গোবিন্দপুর, সাক্তারপাড় ও লালপুরের বেতকান্দায় আমাদেরর বাড়িসহ অনেকগুলো বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আমি বাড়ির পশ্চিম দিকের জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে নিরব দর্শক হিসেবে সেই দৃশ্য অবলোকন করি। আমার গা শিউরে উঠে, হাত-পা কাঁপতে থাকে । মনে হচ্ছিলো এই শেষ । এ যেন সেই কবিতারই প্রতিচ্ছবি –
“তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?”
( শামসুর রাহমান)
মুঠোয় মুক্তির স্বপ্ন:-
বাবার স্বপ্ন পূরণে বৃদ্ধা মা-কে ভাইদের সাথে গুলগাঁও-এ এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয়ে রেখে (খুশির বাপ) আমার সহপাঠী আব্দুর রওফ ভাইকে নিয়ে আমি ডলুরা আনসার কমান্ডার মধু ভাইয়ের সরণাপন্ন হই । মধু ভাই আব্দুর রওফ ভাইকে রাইফেল দেন, আমাকে ভারতে ট্রেনিং করার জন্য উৎসাহিত করেন। আমি কেঁদে কেটে বাড়িতে চলে আসি। ঐদিন সন্ধ্যায় আব্দুর রওফ ভাই অস্ত্র জমা রেখে বাড়িতে এসে আমকে বলেন, ‘চল, আমরা ভারতে একসাথে ট্রেনিং করে তারপর প্রিয় মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করবো’ ।
পরদিন সকালে আমি আব্দুর রওফ আর মুসলিম ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরি। পথের মধ্যে বাঘবেড়ের রুহুল আমিন ও মাঝেরটেকের রাজু ভাইকে সঙ্গে করে ৫ বন্ধু ভারতের লালপানি নামক সীমান্ত ফাড়িতে চলে যাই। সেখানে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক জনাব ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, আলফাত মোক্তার, ছাত্রনেতা ফেনারবাগের মুজিবুর ভাইয়ের সার্বিক সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর তালিকাভুক্ত করে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
“আমার হাতে নিলাম আমার
নির্ভরতার চাবি
তুমি আমার আকাশ থেকে
সরাও তোমায় ছায়া
তুমি বাঙলা ছাড়ো”
(বাংলা ছাড়ো- সিকান্দার আবু জাফর)
প্রশিক্ষণের দিনগুলো:-
আমাদেরসহ ১৫০ জন বাঙ্গালী যুবক ট্রেনিং এ যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। ১০/১২ দিন অবস্থানের পর আনুমানিক জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ট্রেনিং-এ নেয়ার জন্য একটি ট্রাক আসে। সেদিন ছাত্রনেতা মুজিবুল ভাই আমাকেসহ আব্দুর রওফ, রাজু, রুহুল আমিন ভাইকে ট্রাকে উঠিয়ে দেন। দুপুর ১২ ঘটিকায় ট্ট্রাকটি শিলং এর পথে যাত্রা করে। উচু-নিচু, ভঙ্গুর, ঢালু পাহাড়ী পথ। অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা একসময় শিলং পৌঁছাই । রাত পোহানোর পূর্বক্ষণে আমরা শিলং শহরে আর্মি ক্যাম্পে নাস্তা করি। সেখান থেকে সকাল ৬টায় আমাদের গাড়িটি ট্রেনিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দুপুর ১২টার সময় ভারতের মেঘালয়ের ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছি। সেখানে দোয়ারা বাজারের কাউছার আহমদ ও জালাল উদ্দিনসহ অনেক বাংলাদেশী যুবক ১০ নং ব্যাচ-এ ট্রেনিং করি। সুনামগঞ্জের গোলাম রব্বানী সাহেব ১০ নং ব্যাচের ডিউটি সার্জেন্ট নবীগঞ্জের বাচ্চু মিয়া ও ময়মনসিংহের আব্দুল খালেক উকিল ব্যাচ কমান্ডার। তাঁরা ইংরেজী থেকে বাংলায় ট্রেনিং এর বিষয়বস্তু আমাদের বুঝিয়ে দিতেন । ভারতের ট্রেইনারগন আমাদেরকে ২৮ দিনের ট্রেনিং এবং রাইফেল, এলএমজি, এমএলআর, স্টেনগান, ৩৬ গ্রেনেড, ডিনামাই ও এক্সপলিজি সম্পর্কে ট্রেনিং দেন।
যুদ্ধের প্রস্তুতি:-
জুন মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদেরকে বালাট সেক্টরে প্রেরণ করা হয় । বালাট সাব সেক্টর কমান্ডার জনাব মেজর এম এ মোতালিব সাহেবের অধীনে বি কোম্পানি কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক সাহেব প্লাটুন কমান্ডার আবুহেনা সাহেবের একটি সেকশনের কমান্ডার সাচনার জমির উদ্দিন সাহেবের সেকশনে প্রেরণ করেন। জমির ভাইয়ের সেকশনে আমি, সহযোদ্ধা আব্দুর রওফ, রাজু মিয়া, রুহুল আমিন, আলিম উদ্দিন ছিলাম । সাহসী মুক্তিযোদ্ধা জমির ভাইয়ের নেতৃত্বে সৈয়দপুর গ্রামের সর্ব দক্ষিণ পশ্চিম পার্শ্বে পাহাড়িয়া চলতি নদীর পাড়ে (পূর্ব)বামরা একটি বাড়িতে ব্যাঙ্কার খনন করি। এই ব্যাঙ্কার থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক হয়ে মুসলিমপুরের দিকে একটি রাস্তা বয়ে গেছে। এই রাস্তাটির ৩০০ গজ দক্ষিণে বয়ে যাওয়া চলতি নদী থেকে একটি শাখা নদী মুসলিমপুরের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে চলতি নদীর পূর্ব পাড় ঘেঁষে জব্বার হাজির বাড়িতে পাকসেনাদের ব্যাঙ্কার ছিল। সেই ব্যাঙ্কার থেকে পাকসেনারা ভারি গোলাবর্ষণ করত। আমরা আমাদের ব্যাঙ্কার থেকে মুসলিমপুরের দিকের রাস্তাটিতে পরিখা খনন করে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাকসেনাদের প্রতিহত করি। একদিন রাস্তাটির পার্শ্বে লাইন পজিশনে পাকসেনাদের উপর গুলিবর্ষণ করি। তাদের পাল্টা প্রচন্ড গোলাবর্ষণে একটি গুলি আমার মাথার হ্যালমেট ঘেঁষে পায়ের পাশে পরে। আল্লাহর অশেষ দয়ায় সেদিন প্রানে বেঁচে যাই । এই ব্যাঙ্কারে আমরা প্রায় ৩/৪ মাস অবস্থান করি ।
মুক্তির জন্য লড়াই:-
আমার ব্যাঙ্কার থেকে বামদিকে অর্ধ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৪ নং সাবসেক্টরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র বেরীগাও গ্রামে অবস্থিত ছিল। রাতদিন ২৪ ঘন্টা পাকসেনারা গোলাবর্ষণ করত। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সাথে তা প্রতিহত করত। সন্ধ্যার পর থেকে মারটার, এলএমজি, ব্রাসফায়ারের বিকট গোলাবর্ষণের শব্দে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হতো। হঠাৎ একদিন পাকসেনারা বেরীগাও হতে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করতে করতে সম্মুখদিকে অগ্রসর হয়। ঝরঝরিয়া মরা নদী ও পশ্চিম পাড় দিয়ে ডলুরা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এ সময় আমাদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোলাবারুদ না থাকায় আমাদেরকে পিছু হটতে হয় । ঐ দিনের ঘটনায় পাকসেনাদের প্রচন্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা তালেব আহমদ বেরীগাও এর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পরে। নির্মম ভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। আমরা বি কোম্পানীর সকল মুক্টিযোদ্ধারা জয় বাঙলা রাজার হেডকোয়ার্টারে অবস্থান করি। পরে সাবসেক্ট্রর কমান্ডার সাহেব প্লাটন ও সেকশন ভেঙ্গে নতুন করে কমান্ডার পরিবর্তন করেন । আমি আমার সহযোদ্ধা রাজু ভাই ও অন্যদের নিয়ে অচিন্তপুরের কমান্ডার নুরুল ইসলাম সাহেবের নেতৃত্বে নলুয়ার ডিফেন্সে অবস্থান নেই । সেখানে পাকসেনাদের প্রচন্ড আক্রমণের সম্মুক্ষীন হয়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি ।
বিজয়ের আনন্দ:-
ডিফেন্সে থাকাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী যৌথ হয়ে যুদ্ধ শুরু করে । যৌথ বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে পাকসেনারা ৬ ডিসেম্বর পিছু হটে এবং সুনামগঞ্জ শ্ত্রুমুক্ত হয় । ঐ দিন আমরা মঈনপুর বিদ্যালয়ে বি কোম্পানির সকল মুক্তিযোদ্ধাগণ ক্যাম্প স্থাপন করি । সেখানে ১৫/২০ দিন অবস্থানের পরে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে রাজ্জাক সাহেবের নেতৃত্বে ইব্রাহিম পুরের গোডাউনে আমাদের অস্ত্র জমা দেই । ঐ দিন মেজর মোতালিব সাহেব একটি সনদ পত্র প্রদান করেন । কর্নেল ওসমানী সাহেবের একটি সনদ আমরা পাই । তারপর দেশ স্বাধীন হলে বুক ভরে শ্বাস নিই । বুকের উপর থেকে অনেক দিনের জমে থাকা একটি পাথর সড়ে যায় যেনো ।
আজ এই স্বাধীন দেশে আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের নতুন প্রজন্ম মাতৃভূমিকে ভালোবাসার তীব্র আনন্দটুকু অনুভব করতে শিখবে । তারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা করে বলবে, আমাদের স্বাধীন দেশ উপহার দেওয়ার জন্য ভালোবাসা এবং সীমাহীন ভালোবাসা !