আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি । কিন্তু ছেলেবেলায় বাবা মায়ের কাছ থেকে যুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন ঘটনা, গল্প শুনে শুনে যেন নিজের অজান্তেই হারিয়ে গেছি সেই ভয়াবহ দিনগুলিতে । তারপর পাঠ্যপুস্তকে যতটুকু পেয়েছি চেষ্টা করেছি সেই সময়গুলোকে উপলব্ধি করতে । এরপর যখন শ্রদ্ধেয়া জাহানারা ইমামের “৭১ এর দিনগুলি” পড়েছিলাম তখন আবেগ কে সংবরণ করতে পারিনি । বীর মুক্তিযোদ্ধা তরুন রুমির সাথেই যেন আমি ছিলাম। একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধের কিছু শব্দ ছিল নিষিদ্ধ । যেমন – “জয় বাংলা “ জয় বঙ্গবন্ধু” । কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিষ বা বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকে দুর্নিবার । “ ৭১ এর যীশু “ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর দেখেছিলাম মানুষের বদ্ধ আবেগের মুক্তির উল্লাস । হুমায়ুন আহমেদের “ আগুনের পরশ মনি” আর তারেক মাসুদের “মুক্তির গান” ছবি দুটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত মাইল ফলক চলচিত্র । হলগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। মানুষ আসলে ভালবাসে সত্য ইতিহাস জানতে। স্কুলে পড়া কালীন সময়ে আমি গার্লস গাইডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম । আমরা ২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বরের কুজকাওয়াজে অংশ নিতাম আনন্দচিত্তে । প্রতিটি স্কুল থেকেই অংশ নিত ছাত্র ছাত্রীরা । আমাদের শিখানো হতো মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বা দেশাত্মবোধক কিছু উপস্থাপন করতে । মনে পড়ছে “ পতাকার বুকে লাল সূর্য, চির ভাস্বর হয়ে রবে , আর পৃথিবী জুড়ে বাংলা ভাষা , ইতিহাস হয়ে রবে “ এই গানটির সাথে সাথে আমাদের কাগজের কাটা ফুল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র বানানোর দৃশ্য । আমাদের সবার কি আপ্রান চেষ্টা সুন্দরভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করার । সবার এই যে আন্তরিক চেষ্টা এটা দেশকে ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। যখন পড়লাম জহির রায়হানের “ আরেক ফাল্গুন, “২১শে ফেব্রুয়ারী “ বই দুটি আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের অবস্থা এবং আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানসিকতা নিয়ে লেখা । এই বই দুটি আমাকে উপন্যাস পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলো । একারনেই হয়ত বা জহির রায়হানের লেখা বিখ্যাত উপন্যাসগুলো পড়ার সুযোগ করে নিয়েছিলাম । টিভিতে যখনই দেখেছি বা দেখি যুদ্ধের কোন প্রামাণ্য চিত্র খুব কষ্ট হয় , মাথা নত হয়ে আসে শ্রদ্ধায় । আমি স্মৃতিতে রাখি ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ ইতিহাস । ২০১১ সালে আমার মা মারা যাওয়ার পর কানাডায় যখন প্রথম আসি আমি বেশ কিছুদিন আমার মেজ আপার কাছে ছিলাম । আপার বাসার বইয়ের ভাণ্ডারে পেয়েছিলাম আনিসুল হকের লেখা “ মা” উপন্যাসটি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আর তার মাকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটি আমি কয়েকবার পড়েছি। আর যতবারই পড়েছি আমার আবেগকে সংবরণ করতে পারিনি । আজাদ ছিল এক শিক্ষিত টগবগে তরুন । ততকালীন ঢাকা শহরের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। সেখান থেকে আজাদের বাবার কোন অন্যায়কে সহ্য না করে মা সন্তানের হাত ধরে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছিলেন। জীবনে অন্যায়ের কাছে মাথা নিচু করতে শেখাননি ছেলেকে । আজাদ যখন মায়ের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমিত চান , মা বলেন “ আমি তো তোমাকে শুধু আমার জন্য মানুষ করিনি বাবা, তুমি দেশের জন্য অবশ্যই যুদ্ধে যাবে।“ যেই মা তার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে ভাত খাওয়াতে না পেরে আমৃত্যু একটি ভাতও মুখে দেননি, খাটে নরম বিছানায় শোননি । সেই মায়ের জন্য অশ্রু তো অনেক শ্রদ্ধার আর ভালবাসার। এই বইটিতে পেয়েছি সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রুমি, জুয়েল , বদির মত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা । বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই সব বীরদের যাদের রক্তে গড়া আমার দেশ , আমার পতাকা ।