মন তার নিজের খেয়ালে চলে। ইচ্ছা অনিচ্ছা সেটা তার মতো করে সে করে নেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মনের খেয়ালে পদ্মায় নৌকা ভাসিয়েছেন। পদ্মা পাড়ের দৃশ্য দু’চোখে দেখেছেন অবিরাম, অবিরত। লিখেছেন ছোট গল্প ও চিঠি। তারই ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে “গল্পগুচ্ছ” ও “ছিন্নপত্র”। মনের খেয়াল নির্ণয় করে একটা উদ্দেশ্য ধরতে পারলেই যে কোনো একটা বিষয়ে দক্ষ হওয়া যায়। আমার মন বিজ্ঞানী বা কবির মতো না হয়ে উল্টা পথে চলে। প্রতিদিনই মন বলে এটা খাই, ঐটা খাই। রাজহাঁস কিনে এনেছি, গিন্নী বলেন এটা কেনো এনেছো? কৈশোরে শুনেছি অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা এরকম এটা, সেটা খেতে চান। আমি তো অন্তঃসত্ত্বা নই, তা’হলে মনে কেনো এরকম এটা, সেটা খেতে চায়। গ্রামে দেখেছি অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা মাটির পাতিলের ভাঙ্গা অংশ চিবিয়ে খেতেন। শুনেছি অনেকে মাটির চক খেতেন। ভারতীয় একটা ছবিতেও দেখলাম, অভিনেত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে মহল্লার টেইলারিং এর দোকান থেকে মার্কিং চক চুরি করেন। এই দৃশ্যের মাধ্যমে পরিচালক বুঝিয়েছেন যে, অভিনেত্রী অন্তঃসত্ত্বা।

একদিন হঠাৎ মন বললো, মুড়ির মোয়া খেতে চাই। মন কেনো এমনটা বললো, সেটা মনই ভালো জানে। কখনো কখনো মন বলে পিঠা খেতে চাই, বিরিয়ানি খেতে চাই। ভাবলাম, মোয়ার কথা স্ত্রীকে ভয়ে বলবো না নির্ভয়ে বলবো। কর্মজীবি সহধর্মিণীকে কথাটা বলি বলবো করেও বলা হয় নাই। শৈশবে মায়ের সাথে আমি মুড়ির মোয়া বানিয়েছি। মা চুলায় কড়াই বসিয়ে আখের গুড় জ্বালানোর পর গরম গুড় দুই আঙ্গুলে নিয়ে পরখ করে দেখতেন, গুড়ে মোয়া হবে কি-না? এরপর মুড়ি চালনিতে নিয়ে পরিস্কার করে গরম গুড়ে ঢেলে দিতেন। গুড়ে মুড়ি মাখামাখি হলে মা বলতেন, আয় মোয়া বানাই। দুই হাতের তালুতে সামান্য একটু পানি নিয়ে হাতের তালু ভিজিয়ে গুড় মাখানো গরম মুড়ি নিয়ে চাপ দিতাম। হাতের তালুর চাপে হয়ে গেলো গোল মুড়ির মোয়া। মায়ের সাথে এভাবে নারিকেলের নাড়ুও বানিয়েছি।

গ্রোসারি দোকানে দুধ কিনতে গিয়ে দেখি মুড়ির মোয়ার নব্য সংস্করণ। দেখতে আকারে চতুষ্কোণ গাট্টার মতো। শৈশবে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে গাট্টা খেয়েছি প্রচুর। বাদামের ও নারিকেলের গাট্টা। পুরাতন পত্রিকা দিয়ে গাট্টা নিয়েছি, কখনো দুই পয়সার গাট্টা কিনে খেয়েছি। আজকাল এসব চায়নিজ দোকানগুলিতেও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জিলায় গাট্টাকে “কটকটি” বলা হয়। ছাত্র জীবনে বন্ধুরা আঙ্গুল বাঁকা করে উল্টিয়ে নেড়ে মাথায় আঘাত করাকে আমরা “গাট্টা” মারা বলেছি। যে আঘাত করতো সে মজা পেতো। আঘাতপ্রাপ্ত ছেলেটির হতো মরণদশা! সে দু’হাতে মাথা ঢেকে আড়ালে চলে যেতো। কখনো কখনো বই, খাতা দিয়ে মাথা আবৃত করতো। হাতে কিছু না থাকলে সার্টের কলার টেনে মাথা ঢেকে নিতো। মোয়ার কথা স্মরণ হতেই হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটি নেই। সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই প্যাকট খুলে মোয়া খাওয়া শুরু করি। মেয়ে দেখলে বলতো, আঃ বাবা কি করো? তুমি কি বেবি? গাড়িতে বসে ড্রাইভ করার সময় বিদেশের ভয়ংকর শক্ত মুড়ির মোয়া আর গাট্টার স্মৃতিতে শৈশবে ফিরে যাই। “সেই আমার নানা রঙের দিনগুলি”। অন্ধকার তাড়িয়ে শপিং মলের কাছে এলে কাজ শেষে কর্মজীবি সহধর্মিণী সহযাত্রী হন। তিনি ডান পাশের সিটে বসতেই তাঁকে মুড়ির মোয়ার প্যাকেট দেই। স্ত্রী বললেন, এই শক্ত মোয়া খেয়ে দাঁত ভাঙ্গো আর-কি! পরদিন সকালে ম্যাডাম চা পরিবেশন করলে মুড়ির শক্ত মোয়া চায়ে ভিজিয়ে খাই। শীত ঋতু যাই যাবো করছে এমনি সময়ে পরদিন সকালের চায়ে ভেজা মোয়া নিয়ে আসে এক ভিন্ন রকমের স্বাদ। “ওলো সই আমার ইচ্ছা করে তোদের মতন মনের কথা কই”।

(ছবি-সৌজন্য Google)

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিছু ভাবনা-তৃতীয় পর্ব
পরবর্তী নিবন্ধডেট অব বার্থ
কামাল উদ্দিন
লেখক পরিচিতি: কামাল উদ্দিন (জন্ম: ১৯৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে "বাংলা সাহিত্যে" স্নাতকোত্তর (১৯৮২) সম্পন্ন করেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ফটোগ্রাফি চর্চা করেন। বেগার্ট ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি থেকে ডিপ্লোমা-ইন-ফটোগ্রাফি (১৯৯০) এবং বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি'র (বিপিএস) যোগ্যতা বোর্ড থেকে ১৯৯০ সালে "সিনিয়র গ্রেড ফটোগ্রাফার" "লাইসেনসিয়েটশীপ" (এলবিপিএস) অর্জন করেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রকাশিত বই "সহজ আলোকচিত্র" ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং "আলোকচিত্র সহজ ও উচ্চতর" (২০০২ সালে) ভারত হতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জ সুধীজন পাঠাগারে অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক হিসাবে নয় বৎসর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য। " কামাল হাসান" ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করেন। তিনি "কথন" আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা ও এক বৎসর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন