আমরা অনেকেই বলি বাংলাদেশ  অনেক এগিয়েছে; শুনে খুবই খুশি হই যে, যাক যেখানেই থাকি না কেন, নিজের দেশ ভালো শুনলে কার না মন আনন্দে ভরে উঠে। শিল্প ও  যোগাযোগ ব্যবস্থার বেশ উন্নতি  যেমন গার্মেন্টসে বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করছে ; অনেক রাস্তা, সেতু  হয়েছে, লোকজন যেখানেই খুশি যেতে পারে  ।

সে যুগে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যেতে হলে নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে মাছুয়াখাল, পরে বর্ষায়  নৌকায় বা সুদিনে পায়ে হেঁটে অনেক সময় লাগতো।  আজকাল তার অর্ধেকেরও কম সময় লাগে।  

আমার আজও মনে আছে ১৯৯০ এর দিকে আমি পরিবার নিয়ে এই সুদূর কানাডা থেকে দেশে গিয়েছি।  ঢাকা থেকে আমার গ্রামের বাড়ি এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর  যাবো।  গাড়ি নিয়ে কচুয়া পর্যন্ত গেলাম ভালো, কচুয়া থেকে গুলবাহার কোনো রকমে  ভাঙ্গাচুরা রাস্তায় গিয়ে বাকি এক মাইল রিক্সা এবং বাড়ির কাছে গিয়ে খাল পার হতে পারছি না, বাঁশের সেতু , নিজে কোনো রকমে পার হলেও সঙ্গে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে   আছে।  

আমাদের রাহিম চাচা আজ আর জীবিত নেই, দেখে বলেন দাঁড়াও আমি নৌকার ব্যবস্থা করি। উনি নৌকা পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের খাল  পার হওয়ার সমস্যা থেকে রক্ষা করলেন; নতুবা নিজে খাল পার হলেও স্ত্রী ছেলেমেয়েদের অবস্থা কি হতো ?  সে যুগে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোই নাজুক ছিল যে বলার কথা নেই।  

আজকাল দেশে যে কোনো জায়গায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়; এটা অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার। 

শুধু কি তাই ? 

সে যুগে প্রতিটি গ্রামে ছনের ঘর, না হয় টিনের ঘর ছিল।  কোনো বিদ্যুৎ ছিল না , সন্ধ্যা হলে হারিকেন জ্বালিয়ে এ ঘর থেকে সে ঘরে যাওয়া হতো।  রাতে সিঁদ কেটে চোর ঢুকে ঘরের মেয়েমানুষের সোনাগহনা, টাকা পয়সা বা যা পেতো নিয়ে যেত। রাতের অন্ধকারে এ ঘর থেকে সে ঘর বা এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি হারিকেন অথবা  টর্চ ব্যবহার করে যাওয়া হতো। আনাচে কানাচে বা রাস্তায় সাপ শুয়ে থাকে, হাতে একটা লাঠি জাতীয় কিছু থাকলে ভালো।

 প্রতি নবাড়িতেই কাঁচা পায়খানা, একবার পায়খানা থেকে আসলে মনে হতো গোছল করা দরকার।  আজকাল পাকা পায়খানা তাও আবার স্যানিটারি।  পুকুরে গোছল  করতে হতো, পুকুর ঘাটের করুন অবস্থা।  আজকাল মানুষ গ্রামগঞ্জে ও প্রতিটি ঘরের পাশে পুরুষ, মেয়েদের জন্য  গোছলখানার ব্যবস্থা করেছে ।  

প্রতিটি গ্রামে বিল্ডিং  এবং  ঘরে ঘরে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে রান্না করে।আমি আমার মা ও চাচিদের সে যুগে দেখেছি পাটখড়ি, কাঠ বা গাছের শুকনা পাতা ব্যবহার করে রান্না করতো।  কিন্তু আজকাল মানুষ গ্রামে ও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে।

 গ্রামে কারো একটা রেডিও থাকলে মনে হতো সে কত কী ?  

আজকাল গরিব, ধনী সবার ঘরে টেলিভশন, ফ্রীজ, প্রতিটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন ।  সে দিন আমার বাড়ির  এক মহিলার সঙ্গে কথা বলতেছিলাম, সে বলে আমার ছেলেরা বিদেশ থেকে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলে, ভাই আপনার ছবি তো দেখি না। হায়রে যুগের পরিবর্তন!

১৯৮৬-৮৭ আমি আমেরিকা, মায়া দেশে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে, শহরে সবার বাসায় টেলিফোন নেই।  এক মিনিট কথা বললে ৫ ডলার খরচ করতে হয়, সে ভয়ে টেলিফোন কমিয়ে দিয়ে চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করি।” চিঠি দিও, প্রতিদিন চিঠি দিও”।  প্রতিদিন লেটার বাক্স দেখি, মন খারাপ করে বলি ” ধুর ছাই, চিঠি নেই। ”   

আজকালকার মতো গ্রামে সে যুগে মেয়েদের পড়াশুনার প্রচলন ছিল না।  আমি রঘুনাথপুর হাই স্কুলে আমাদের বারেক স্যারের দুই মেয়ে ফাতেমা ও সাকিনা আপাকে পড়াশুনা করতে দেখেছি। স্যার নিজেই  ওদের স্কুলে আনা নেয়া করতেন। সারা স্কুলে আমি আর কোনো মেয়ে দেখি নি।  

আমি ৮ম শ্রেণী শেষ করে দোল্লাই নবাবপুর স্কুলে গিয়েছি  ।  কিন্তু ওই স্কুলে কোনো ক্লাসে মেয়ে দেখি নি।  মেয়েরা সে যুগে অল্প পড়াশুনা করে, বাড়িতে ধর্মীয় শিক্ষা , কোরান পড়া , নামাজ পড়া,হাতের কাজ, কাঁথা সেলাই, হাতপাখায় বিভিন্ন রকমের ফুল বা লেখা যেমন ” পান খাও গান গাও, ভুলনা আল্লাহর নাম।” তাছাড়া নামাজের মসলাতে সুন্দর ফুল আকাঁ ও লেখা শিখতো।  এ ছাড়াও মা চাচী বা দাদির কাছ থেকে রান্না শিখতো এবং অল্প বয়সেই বিয়ের প্রস্তুতি নিতো।  

লোকজন দেখতে আসলে বাবা বা দাদা মেয়ের হাত পা , মাথার ঘোমটা সরিয়ে চুল দেখাতো এবং বর পক্ষের মুরুব্বি শ্রেণীর লোক  কোরান বা নামাজ পড়তে পারে কিনা জিজ্ঞেস করতো।  

এক বিয়েতে মেয়ে পরিবর্তন করা হয়েছিল; পরদিন পালকি করে ছেলেমেয়েকে বাড়ি নিয়ে এসে দেখে ” এ মেয়েতো সে মেয়ে নয়, “।   মেয়েকে ডিভোর্স দেয়া হলো, কিন্তু ঝামেলা শেষ হয় নি, বিয়ের রাতেই মেয়ে প্র্যাগনেন্ট ! সে যুগে এ সব দু নম্বরি কাজ ও  হতো।   

আজকাল গ্রামে সব ছেলেমেয়েরাই  পড়াশুনা করে; সকাল হলে দল বেঁধে এরা স্কুলে  বা কলেজে যায়। গ্রামে ও মেয়েরা ছেলেদের মতো  B.A, এবং M.A পাশ করে। সরকার এতো এতো লোককে কাজ দেবার মতো ক্ষমতা নেই। আজকাল সারা দুনিয়াতেই বেকার সমস্যা এবং লোকজন ব্যবসা করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে, বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই, গার্মেন্টস ও অন্যান্য সেক্টরে অনেক মেয়ে উদ্যোক্তা দেখা যায়  ।     

মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে অনেক সমস্যা; আইন করে যৌতুক প্রথা উঠিয়ে দিলেও সমাজ থেকে উঠে যায় নি। গ্রামের মেয়েরা পড়াশুনা করলেও ভালো পাত্র পাওয়া যায় না। মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে প্রশ্ন উঠে ছেলেকে কি দেবে ? 

কোনো রকমে জমিজমা বন্ধক রেখে বা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে  মেয়ে বিয়ে দেয়া হলো, ছেলের নিজের , মাবাবার চাহিদা পূরণ করতে গ্রামের গরিব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ নিয়ে কত সংসারে অশান্তি, কত মেয়ের মাবাবা দুঃখ করে; এ সুদূর কানাডা থেকে ও শুনি । 

আমি গ্রামে মানুষ হয়েছি, গত ৪০ বৎসর দেশের বাইরে থাকি, সব সময় দেশে না গেলে ও নাড়ির টানে যোগাযোগ রাখি; মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শুনি, যখন যা পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করি।  

সে দিন দুই মেয়ের মাবাবার সঙ্গে কথা হলো : 

ক) এক মা বললো তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারে নি,  সৌদি আরবে পাঠিয়েছিল কোনো দালাল প্রতারকের মাধ্যমে; সৌদি আরব পৌঁছার পর মেয়ে    জানতে পারলো যে তাকে কৃতদাস হিসাবে পাঠানো হয়েছে।  মেয়ের কান্নাকাটি দেখে শেষ পর্যন্ত তাকে দেশে ফেরত পাঠায়।  আমি শুনে হতবাক ,ক্রীতদাস প্রথা দুনিয়া থেকে উঠে গেছে ,সেও বহু যুগ আগে। এ কি সত্যি ?

খ) আর এক মেয়ের মাবাবাকে আমি  কিছু না কিছু সাহায্য  করে আসছি ।  মেয়েটা পড়াশুনায় ভালো।  আমি খোঁজ খবর রাখি, দেশে গিয়ে মেয়েকে বাজার থেকে সুন্দর ড্রেস কিনে দিয়েছি  এবং তার মাবাবাকে  বুঝিয়ে বলেছি, ওকে পড়াশুনা করতে । 

 সে এসএসসি পাশ করেছে সাইন্স গ্রুপ থেকে, আমাকে জিজ্ঞেস করে,”  আংকেল আমি ভালো কলেজে পড়তে চাই।”   আমি বললাম পড়ো , আমি যতটা পারি সাহায্য করবো। আমি মনে মনে খুশি , একটা মেয়ে পড়াশুনা করবে।

কিছুদিন পর শুনতে পারি, গ্রামের পরিবেশের জন্য মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে উপায় নেই।  আমি তার মাবাবাকে  বললাম ঠিক হচ্ছে না, যত সমস্যাই  হোক, ওর পড়াশুনা চালিয়ে নাও ।অন্তত মেয়েটাকে B.A পাশ করিয়ে চেষ্টা করে প্রাইমারি স্কুলে ঢুকিয়ে দাও।    ওরা বলে ভাইজান, গ্রামের পরিবেশ সম্পর্কে আপনি জানেন না। আমরা তাকে কলেজে পাঠাতে পারছি না; আমি হ্যাঁ, বা   না বলে  কোনো লাভ নেই।  তার বিয়ে হল।  কিন্তু মেয়েটা কি সুখে আছে ? 

আমি ২-৩ দিন  হয়,  তার অবস্থা শুনে হতবাক ! মেয়ের  জামাইর আর বেয়াই  বাড়ির দাবি পূরণ করতে পারছে না। জামাই পক্ষ মনে করেছে মেয়ের পিছনে বড়ো পয়সাওয়ালা  আছে।  সে বাবার বাড়ি ফেরত আসছে, তাও এক বাচ্চা কোলে নিয়ে ।  আমি দুঃখের সঙ্গে বললাম, তোমরা কিছু পয়সা চাও, উপদেশ নিতে চাও না, এটাই সমস্যা। এখন দেখো কি করবে ? টেলিফোন রেখে দিলাম।        

গ) আমাদের সমাজে মেয়ে নিয়ে সমস্যা চিরদিনই ছিল; মেয়ে এবং ছেলেকে সমান ভাবে বাড়তে দেয়া হয় না।  মেয়েকে পণ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়, অনেক মাবাবা মনে করে মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে। যত ঝামেলা হোক, একটু ধর্য্য ধরে শক্ত হয়ে মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সুযোগ দিতে হবে।  জীবনে বাধা আসবে , ভয়ে হার মানলে তো পরাজয় হলো, তাতে ব্যক্তি বা সমাজের উন্নতি কোথায় ? 

 

ছোটকালে গ্রামে হাডুডু, গোল্লাছুট, ফুটবল আমার ভালো লাগতো। সে যুগে এই গ্রাম সে গ্রামে  হাডুডু এবং বিভিন্ন স্কুলে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা হতো; অনেক দূরদূরান্ত থেকে ভালো খেলোয়াড় পয়সা দিয়ে ভাড়া করে আনা  হতো।  আমি এলেবেলে খেলোয়াড় ছিলাম, শুধু খেলা দেখতে পছন্দ করতাম। আমি নিজেও খেলাধুলা করতাম; তবে খেলাধুলায়  সিরিয়াস ছিলাম না।  অনেক সময় আমি না খেলে দর্শকের ভূমিকা পালন করতাম।  স্কুলে আমাদের শিক্ষক বারেক পন্ডিত সাহেব প্রায়ই বলতেন, কিরে তুই না খেলে কেন দর্শকের গ্যালারিতে ? আমি বলতাম স্যার, আমার আজ ভালো লাগছে না।  

যা যা একটু খেললে ভালো লগবে , হয়তো হুকুম মান্য করার জন্য মাঠে নামতাম।

বাড়ির   সম- বয়সী ছেলেরা চাল, পাট বিক্রি করে পয়সা জোগাড় করতো, 

ওদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতাম । আমার মাবাবা এগুলি পছন্দ  করতো না, বলতো তুই যাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করিস ওরা সব গোল্লায় যাওয়া ছেলে; বাস্তবেও তাই , ওদের অনেকেই আজ আর জীবিত নেই।      কচুয়া, রঘুনাথপুর, পালাখাল, হাজীগঞ্জ বাজারে নৌকা করে যাওয়ার কথা শুনলেই  খুশি হতাম; নৌকা করে যাবো, বাজারে গিয়ে আখ, মুরলি কিনে আপন মনে খাবো আর বাজারে ঘোরাঘুরি করে  বেশ আনন্দ করবো, এখনো ও  ভাবলে আমার ইচ্ছে করে সেদিনে ফিরে যাই।  পকেটে পয়সা ছিল না, ভালো কাপড় ছিল  না, তবে মনে আনন্দ ছিল। 

কচুয়া বাজারে মহর আলী বাতের বড়ি বিক্রি করতো।  সে যে ঔষুধ বিক্রি করতো ,  নাম ছিল,”মেমচোরা বাতের বড়ি”।  সে হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতো, লোক জড়ো করতো এবং কিভাবে আসাম, ইন্ডিয়া  গিয়ে অনেক বৎসর থেকে বাতের বড়ি তৈরী করা শিখে, কোন এক   ম্যাডামকে  চুরি করে ভাগিয়ে বিয়ে করে দেশে নিয়ে এসেছে এই মজার কাহিনী  শুনার জন্য লোকজন ভিড় হতো,  ওর গল্প শুনে অনেকেই বাতের বড়ি খরিদ করতো।

আমাদের মইজুদ্দিন কাগু হুইন্না কয় ” যত্তো  সব হাগলের কথা, আংগো দেশে মাইয়্যাপাইনের অভাব আছে নাকি , হেঁতে গেছে আসাম মেম চুরি করতে।”   ওর তিলিস্মাতি কথা শুনে মনে মনে ভাবতাম, সাবাস বেটা , এক অসাধারণ কাজ সে করেছে।     

মানুষ জীবনে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে।  ছোট বয়স থেকে আমার জীবনে ও বড়ো হওয়ার স্বপ্ন ছিল।  

১৯৫৮ সনে আমি রঘুনাথপুর হাই স্কুলের ছাত্র; রঘুনাথপুর বাজারে এক মার্ডার কেসের তদন্ত করার জন্য চাঁদপুরের সাব ডিভিশনাল অফিসার এসেছিলেন।  বহুলোক তাঁকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিল, আমি এই  ছোট্ট  মানুষটিও উপস্থিত ছিলাম।  কে কী  ভাবে তাঁকে দেখেছিলো জানা নেই , ওর পিছনে শত শত লোক দেখে,আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কী  করে এত নামিদামি  হওয়া যায় ? 

আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি,আমাদের প্রধান শিক্ষক  ক্লাসে এসে প্রশ্ন করতেন, এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কে ? উত্তর অত্যন্ত সহজ, জানিনা স্যার।  উনি বলতেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট/গভর্নর জেনারেল  এখন আই, আই, চন্দ্রিগার ।  কয়েকদিন পর আবার জিজ্ঞেস করতেন, এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কে ? সোজা উত্তর মনে নাই,স্যার।  উনি বলতেন ফিরোজ খাঁন নুন , খাতায় লিখে রাখো, আবার জিজ্ঞেস করবো ।  আবার কিছুদিন পর জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কে ? খাতার পাতা উল্টিয়ে নাম বের করতে চেষ্টা করছি ? চুপটি মেরে সবাই স্যারের মুখের দিকে চেয়ে আছে ।  উনি বলেন এখন ইস্কান্দার মির্জা।  কিছুদিন পর আবার একই প্রশ্ন, এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কে ? হাঁ করে তাকিয়ে আছি।  এখন জেনারেল আয়ুব খাঁন।   

আমাদের সোনামিয়া মাস্টার দীর্ঘ ৩০ বৎসর উনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।  জেনারেল আয়ুব খাঁন দেশে মার্শাল- ল দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন প্রেসিডেন্টদের পদবি বাতিল করে দিয়ে চেয়ারম্যান পদবি দেয়ায় উনি নাখোশ হয়ে আর ইলেকশন করেন নি।  তবে আয়ুব খাঁন অনেককেই তমগায়ে খেদমত উপাদি দিয়ে  বহাল তবিয়তে রেখেছিলেন ।  অনেকে এই উপাদি পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন; শুনেছি ওদের অনেকেই  রাতে এই উপাদি বুকে জড়িয়ে ঘুমাতেন  আর নিজেকে ধন্য মনে করতেন।

আয়ুব খাঁন ক্ষমতায় এসে প্রথমেই হুকুম দিলেন দেশে যত কচুরি পানা এবং জঙ্গল আছে পরিষ্কার করতে হবে। মানুষের জঙ্গল পরিষ্কারের কারণে শিয়াল বড়ো  বেকায়দায়, লুকানোর জায়গা নেই।   

ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, মেম্বার , চৌকিদার, গ্রামের মাতবর , থানার দারোগা থেকে   শুরু করে বড়োই বিপদে পড়ে গেলো।  বর্ষার সময় আমাদের পুকুর , খালে এত এত কচুরিপানা হয় পরিষ্কার করা সহজ কাজ না।  আমার মনে আছে আমাদের পাশের ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান )  কে ধরে নিয়ে কিছু সময় কচুয়া বটগাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলো। চেয়ারম্যান, নসরুদ্দিন মোল্লা (নাসা মোল্লা) অত্যন্ত সুচতুর মানুষ, থানার দারোগা, পুলিশ  ওকে সম্মান করতো, এই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলো ।  

আয়ুব খাঁন সাহেব  আদেশ দিলেন দেশ থেকে অশিক্ষা দূর করতে হবে। ছোট ছোট বাংলা বই (ছবি সহ) পাঠানো হল, বুড়োদের শিক্ষার জন্য ;আমাদের দাদা জেঠা , চাচারা বিপদে পড়ে গেলেন।  আম থেকে- আ, কলা থেকে- ক, আঙ্গুল দিয়ে ধরে ধরে শিক্ষা দিতে হবে।  আমি নিজে ও আঙ্গুল দিয়ে ধরে ধরে দুই/চার জন মুরুব্বি শ্রেণীর দাদা বা চাচাকে শিখাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুই/চার মাস যাওয়ার পর এ সব কি ভাবে বন্ধ হয়ে গেলো  তা বলতে পারি না;  হয়তো রাজনৈতিক ধাক্কা খেয়ে আয়ুব খাঁন সাহেব বেকায়দায় পরে বন্ধ করেছিলেন।    

সে যুগে গ্রামে সিঁদ কাটা চোরের উপদ্রব ছিল; আয়ুব খাঁন সাহেব গ্রামের লোকজনকে দিয়ে রাতে পুরা গ্রাম ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন ।  আমাদের খালেক , হাকিম,   রশিদ ভাইয়ের মতো আরো অনেকে  রাত জেগে গ্রাম   পাহারা দিতে দেখেছি ।  ওদেরকে গ্রাম রক্ষিবাহিনী বলা হতো এবং মাঝে মধ্যে চিৎকার দিয়ে বলতো ‘ বস্তি জাগোরে ‘।  থানা থেকে লোকজন  রাত গ্রামে গ্রামে গিয়ে খোঁজ খবর নিতো এবং দুই/একজনকে ধরে নিয়ে শাস্তি ও দিতো। মানুষ ভয়ে ভয়ে থাকতো যদি কেউ রিপোর্ট করে ধরে নিয়ে শাস্তি দেবে।    

১৯৮৪ সন আমি মিনিস্ট্রি অফ ফিনান্স, (ইন্টারনাল রেভিনিউ ডিপার্টমেন্ট),বাউচি স্টেট অফ নাইজেরিয়া  সরকারি কাজ করি। ওই দেশে সে সময় শনি-রবি দুইদিন সরকারি ছুটি ছিল।  দেশের প্রেসিডেন্ট আলহাজি শেহু শাগাড়ি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রধান ।  শুক্রবার অফিস করে বাসায় ফিরেছি; শনিবার ভোরে আর্মি জেনারেল বুহারি ও জেনারেল টুন্ডে ইদি  আগবন দেশের ক্ষমতা দখল করেন।

আর্মি ক্ষমতা নেয়ার পর বাজারে কিছুই পূর্বের দামে পাওয়া যেত না।  বাজার ভর্তি জিনিস পত্র কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারছে না।  আমার এক বৎসর বয়সের বাচ্চার জন্য দুধ পাওয়া যেত না।  এক নায়রার  জিনিস পাঁচ নায়রা দিলে দোকানদার  কোত্থেকে একটা ডানো দুধ চুপি চুপি এনে দিয়ে বলতো আর নেই।  

মার্শাল – ল এডমিনিস্ট্রেটর  অফিসের কাজের পর সবাইকে দিয়ে কিছু না কিছু  অফিসের আনাচে কানাচে জঙ্গল  পরিষ্কার  করাতো ।  তখন আমার মনে পড়ে এবং অনেকের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খাঁন দেশের লোকদের এ ভাবে কাজ করিয়েছিলেন।  আমাদের অফিসার  বাবাজি উমরু মিসাও, বলেছিলেন যে এটা আর্মি সরকারের একটা কৌশল, লোকদের ভয়ভীতির মধ্যে রাখা ।    

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁন সাহেব আদেশ দিলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলের সেশন জানুয়ারির পরিবর্তে জুলাই থেকে শুরু করতে হবে।  আমি নিজে ১৮ মাস এক ক্লাসে ছিলাম।  শুধু কি তাই , উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলে চাপিয়ে   দেয়া হলো।  একটা শব্দ ও পড়তে পারি না, আমাদের বাড়িতে মাদ্রাসার ছাত্র আছে, একটু যাই যদি কোনো সাহায্য পাই।  কিন্তু কিছুই বুঝি না ,শুধু তোতা পাখির মতো মুখস্ত করি।  আমাদের এরাবিকের হুজুর ও খুব একটা এর প্রতি ইন্টারেস্ট দেখায় না। বার্ষিক পরীক্ষায় কে কী করেছে জানিনা ; তবে আমি ৩৬ পেয়ে পাশ করেছি।  কিছুদিন পর ৭ম শ্রেণীতে প্রমোশন পেয়ে শুনি, এই উর্দু আর পড়তে হবে না।  আমার মতো অনেকেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

আমাদের জাতীয় নেতা বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানী  ও পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র জনতার হুঙ্কারে  জেনারেল আয়ুব খাঁন সাহেব বেকায়দায় পরে এ সব বাদ দেন।    

ক্রমশ :

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতির মোম ঘর
পরবর্তী নিবন্ধমনের_কথা
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন